(৪) রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবায়ে কেরামের থেকে যাকাত আদায়ের প্রতিশ্রুতির বায়‘আত গ্রহণ করেছেন :
হাদীছে এসেছে,
عَنْ جَرِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ بَايَعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى إِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ-
জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে ছালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত আদায় করা এবং প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনা করার জন্য বায়‘আত গ্রহণ করেছি।[1]
(৫) যাকাত সম্পদের পবিত্রকারী : যাকাত আদায় করলে সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূরিভূত হয়ে তা পবিত্র হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا
‘উহাদের সম্পদ হতে ছাদাক্বাহ্ গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে’ (তওবা ৯/১০৩)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ : يَا رَسُوْلَ اللهِ أَرَأَيْتَ إِذَا أَدَّى رَجُلٌ زَكَاةَ مَالِهِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ أَدَّى زَكَاةَ مَالِهِ فَقَدْ ذَهَبَ عَنْهُ شَرُّهُ-
জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যদি কেউ তার সম্পদের যাকাত আদায় করে তাহলে কি হবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যদি কেউ তার সম্পদের যাকাত আদায় করে, তাহলে তার সম্পদের অকল্যাণ ও অমঙ্গল দূর হয়ে যাবে।[1]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ خَالِدِ بْنِ أَسْلَمَ قَالَ خَرَجْنَا مَعَ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما فَقَالَ أَعْرَابِىٌّ أَخْبِرْنِيْ قَوْلَ اللهِ (وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَ يُنْفِقُوْنَهَا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ) قَالَ ابْنُ عُمَرَ رضى الله عنهما مَنْ كَنَزَهَا فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهَا فَوَيْلٌ لَهُ، إِنَّمَا كَانَ هَذَا قَبْلَ أَنْ تُنْزَلَ الزَّكَاةُ فَلَمَّا أُنْزِلَتْ جَعَلَهَا اللهُ طُهْرًا لِلأَمْوَالِ-
খালিদ ইবনু আসলাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ)-এর সাথে বের হলাম। তখন এক বেদুঈন বলল, আমাকে আল্লাহর বাণী- ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও’ (তওবা ৯/৩৪) এ সম্পর্কে বলুন। তখন ইবনু ওমর (রাঃ) বললেন, যে ব্যক্তি সম্পদ জমা করেছে এবং যাকাত আদায় করেনি তার জন্য ধ্বংস অনিবার্য। এই বিধান ছিল যাকাতের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে। যখন যাকাতের বিধান অবতীর্ণ হল, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে সম্পদের জন্য পবিত্রতার কারণ নির্ধারণ করলেন।[2]
[2]. বুখারী হা/১৪০৪, ‘যাকাত’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ২/৯১ পৃঃ।
(৬) যাকাত আদায় করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায় : বাহ্যিক দৃষ্টিতে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ কমে যায় বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কমে যায় না; বরং তা বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَمْحَقُ اللهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ-
‘আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)।
তিনি অন্যত্র বলেন,
وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ رِبًا لِيَرْبُوَ فِيْ أَمْوَالِ النَّاسِ فَلاَ يَرْبُوْ عِنْدَ اللهِ وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ زَكَاةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ-
‘আর মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা সূদে যা দিয়ে থাক, আল্লাহর নিকট তা বৃদ্ধি পায় না; কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য যে যাকাত তোমরা দিয়ে থাক তা-ই বৃদ্ধি পায়, তারাই সমৃদ্ধিশালী’ (রুম ৩০/৩৯)।
অতএব যাকাত আদায় করলে এবং দান করলে সম্পদ কমে যায় না। বরং তা বৃদ্ধি পায়। যে কোন মাধ্যমে আল্লাহ তার রিযিক বৃদ্ধি করে দেন।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ-
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘দান সম্পদ কমায় না; ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ কোন বান্দার সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া হরাস করেন না এবং যে কেহ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে উন্নত করেন’।[1]
আভিধানিক অর্থ : الطهارة والنماء والبركة والمدح অর্থাৎ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশংসা। উল্লিখিত সব কয়টি অর্থই কুরআন ও হাদীছে উদ্ধৃত হয়েছে।
পারিভাষিক অর্থ : ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত নিছাব পরিমাণ মালের নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার নাম যাকাত।[1]
কুরআন ও হাদীছের অনেক স্থানে ‘যাকাত’-কে ‘ছাদাক্বাহ্’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের ৮ টি মাক্কী ও ২২টি মাদানী সূরার ৩০টি আয়াতে ‘যাকাত’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি আয়াতে ‘ছালাত’-এর সাথেই ‘যাকাত’ শব্দ এসেছে।
(৩) যাকাত ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যার মধ্যে নিহিত আছে মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। আর অর্থনৈতিক সমস্যা মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দু’টি প্রধান অর্থনৈতিক মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রি অর্থব্যবস্থা। এ্যাডম স্মীথের হাত ধরে যে পুঁজিবাদের যাত্রা তাতে শুধুই ব্যক্তিস্বার্থ ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার গন্ধ। ব্যক্তির ভোগ ও তৃপ্তি চূড়ান্ত হতে হবে, সর্বোচ্চ পরিমাণ তৃপ্তি বা উপযোগ লাভের সর্বাত্নক চেষ্টা পুঁজিবাদের মূল দর্শন। সমাজের হতদরিদ্র বা বঞ্চিতদের জন্য ছাড় দেওয়ার কোন সুযোগ সেখানে নেই। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাও এর কোন সমাধান বের করতে পারেনি। আদর্শিকভাবে এই দুই বিপরীত মেরুর বিরুদ্ধেই ইসলামের অবস্থান। সুতরাং ইসলামী অর্থনীতি উল্লিখিত দুই অর্থনীতির আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মকৌশলের দিক থেকে ভিন্ন। যেমন-
(ক) ইসলামী অর্থনীতির মূল উৎস হল কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। অপরদিকে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা মানব রচিত। এ্যাডম স্মিথ, রিকার্ডো, মার্শাল, কার্লমার্কস, লেলিন প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক এসব অর্থব্যবস্থার প্রবক্তা।
(খ) পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সম্পদের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্বীকৃত। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে পৃথিবীর সকল সম্পদের মালিক হলেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নির্দেশিত পথে এ সকল সম্পদ মানুষ ভোগ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।
(গ) পুঁজিবাদে উৎপাদনকারীর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। পক্ষান্তরে ইসলামী অর্থনীতি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি চলে মুনাফা অনুযায়ী, তাতে জনগণের ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। আবার সমাজতন্ত্রে উৎপাদন চলে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী; এতে জনগণের ভোগের স্বাধীনতা থাকে না। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদন পদ্ধতিতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণের দিকে নযর রাখা হয়।
(ঘ) পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিতে অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে হারাম ও হালাল যাচাই করা হয় না। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা হালাল ও হারাম বিবেচনা করা হয়।
(ঙ) পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সম্পদের মূল ভিত্তি হল সূদ। অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে সূদ সম্পূর্ণরূপে হারাম।
অতএব ইসলামী অর্থনীতির মধ্যেই মানব জাতির অর্থনৈতিক সকল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। আর ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস হল, যাকাত ব্যবস্থা। সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসাবেই যাকাত বিবেচিত হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হরাসের জন্য যাকাত অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। যাকাত কোন স্বেচ্ছামূলক দান নয়; বরং দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর লোকদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বাধ্যতামূলকভাবে প্রদেয় অর্থ। সামাজিক নিরাপত্তা অর্জন বিশেষতঃ দুস্থ ও অভাবগ্রস্তদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই যাকাতের ক্ষেত্রে এত কঠোর তাকীদ রয়েছে।
যাকাত মক্কায় ফরয হয়। কিন্তু নিছাব নির্ধারণ, কোন্ কোন্ সম্পদে যাকাত ফরয এবং তা ব্যয়ের খাত সমূহের বর্ণনা মদ্বীনায় দ্বিতীয় হিজরীতে অবতীর্ণ হয়েছে।[1]
(১) যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি : আল্লাহ কর্তৃক মানব জাতির জন্য একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর দন্ডায়মান। আর যাকাত হল তার তৃতীয় স্তম্ভ। হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ-
ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর দন্ডায়মান। ১- আল্লাহ্ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা। ২- ছালাত ক্বায়েম করা। ৩- যাকাত আদায় করা। ৪- হজ্জ সম্পাদন করা এবং ৫- রামাযানের ছিয়াম পালন করা।[1]
(২) যাকাত অস্বীকারকারী কাফির : যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি। আর ইসলামের কোন বিধানকে অস্বীকার করলে সে ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে কাফিরে পরিণত হবে। অতএব যদি কোন ব্যক্তি যাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তাহলে সে কাফির বা মুরতাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَإِنْ تَابُوْا وَأَقَامُوْا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوْا سَبِيْلَهُمْ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ-
‘কিন্তু যদি তারা তওবা করে, ছালাত ক্বায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তবে তাদের পথ ছেড়ে দিবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (তওবা ৯/৫)।
হাদীছে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوْا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ، وَيُقِيْمُوْا الصَّلاَةَ، وَيُؤْتُوْا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوْا ذَلِكَ عَصَمُوْا مِنِّيْ دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلاَّ بِحَقِّ الإِسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ-
ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল, আর ছালাত ক্বায়েম করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা লাভ করল; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর ন্যাস্ত’।[1]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে কুরাইশরা তাদের সম্পদের যাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে আবু বকর (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ أَبُوْ بَكْرٍ رضى الله عنه وَاللهِ لَوْ مَنَعُوْنِيْ عَنَاقًا كَانُوْا يُؤَدُّوْنَهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهَا-
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বকর (রাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম! যদি তারা একটি মেষ শাবক যাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায় যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে তারা দিত, তাহলে যাকাত না দেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব’।[2]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ لَمَّا تُوُفِّىَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَاسْتُخْلِفَ أَبُوْ بَكْرٍ بَعْدَهُ وَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ الْعَرَبِ قَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ لأَبِيْ بَكْرٍ كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ وَقَدْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُوْلُوْا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ فَمَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ فَقَدْ عَصَمَ مِنِّيْ مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلاَّ بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللهِ فَقَالَ أَبُوْ بَكْرٍ وَاللهِ لأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللهِ لَوْ مَنَعُوْنِيْ عِقَالاً كَانُوْا يُؤَدُّوْنَهُ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ فَقَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ فَوَاللهِ مَا هُوَ إِلاَّ أَنْ رَأَيْتُ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِيْ بَكْرٍ لِلْقِتَالِ فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الْحَقُّ-
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে যখন আবু বকর (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হলেন, তখন আরবদের কিছু লোক (যাকাত আদায়ে) অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। (আবু বকর (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেন)। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, আপনি কিভাবে লোকদের সাথে যুদ্ধ করবেন? কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমাকে লোকদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-কে স্বীকার করে। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করবে সে তার সম্পদ ও প্রাণ আমার হাত থেকে সংরক্ষিত করে নিবে। তবে ইসলামের অধিকার ব্যতীত। আর অন্য সবকিছুর হিসাব আল্লাহর কাছে রয়েছে। অতঃপর আবু বকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! যে ব্যক্তি ছালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করবে আমি তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হব। কারণ যাকাত হচ্ছে আল্লাহর সম্পদের হক। আল্লাহর শপথ! তারা যদি উটের গলার একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে, যা তারা রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় দিত, তাহলে এ অস্বীকৃতির কারণে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি দেখলাম আল্লাহ আবু বকর (রাঃ)-এর হৃদয়কে যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। কাজেই আমি বুঝতে পারলাম, আবু বকর (রাঃ)-এর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।[3]
[2]. বুখারী হা/১৪০০, ‘যাকাত’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ২/৭৮ পৃঃ; মিশকাত হা/১৭৯০।
[3]. বুখারী হা/১৪০০, ‘যাকাত’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ বুখারী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ২/৭৮ পৃঃ; মিশকাত হা/১৭৯০।
(৭) যাকাত ঈমানের সত্যায়নকারী : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ- أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيْمٌ-
‘যারা ছালাত ক্বায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে (যাকাত আদায় করে); তারাই প্রকৃত মুমিন। তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদেরই জন্য রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা’ (আনফাল ৮/৩-৪)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِيْنَ-
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এবং সকল মানুষের চেয়ে আধিক প্রিয় না হব।[1]
আর পৃথিবীতে মানুষের নিকটে সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্ত হল তার ধন-সম্পদ। আর সে কখনই তা দান করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাঁর নিকটে অধিক প্রিয় না হয়। আর যখনই সে তার সম্পদের যাকাত আদায় করে তখনই সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مُعَاوِيَةَ قَالَ قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم ثَلاَثٌ مَنْ فَعَلَهُنَّ فَقَدْ طَعِمَ طَعْمَ الإِيْمَانِ مَنْ عَبَدَ اللهَ وَحْدَهُ وَأَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَعْطَى زَكَاةَ مَالِهِ طَيِّبَةً بِهَا نَفْسُهُ رَافِدَةً عَلَيْهِ كُلَّ عَامٍ وَلاَ يُعْطِى الْهَرِمَةَ وَلاَ الدَّرِنَةَ وَلاَ الْمَرِيْضَةَ وَلاَ الشَّرَطَ اللَّئِيْمَةَ وَلَكِنْ مِنْ وَسَطِ أَمْوَالِكُمْ فَإِنَّ اللهَ لَمْ يَسْأَلْكُمْ خَيْرَهُ وَلَمْ يَأْمُرْكُمْ بِشَرِّهِ-
আব্দুল্লাহ ইবনু মা‘আবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি কাজ করবে সে পরিপূর্ণ ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে। যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে এবং স্বীকার করে যে আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই; যে ব্যক্তি প্রত্যেক বছর তার সম্পদের যাকাত হিসাবে উত্তম মাল দান করে এবং বৃদ্ধ বয়সের, রোগগ্রস্থ, ত্রুটিপূর্ণ, নিকৃষ্ট মাল প্রদান করে না; বরং মধ্যম মানের মাল প্রদান করে। আল্লাহ তোমাদের নিকট তোমাদের উত্তম মাল চান না এবং নিকৃষ্ট মাল প্রদান করতেও নির্দেশ দেননি।[2]
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ مَالِكٍ الأَشْعَرِىَّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوْءِ شَطْرُ الإِيْمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلأُ الْمِيْزَانَ وَالتَّسْبِيْحُ وَالتَّكْبِيْرُ يَمْلأُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ وَالصَّلاَةُ نُوْرٌ وَالزَّكَاةُ بُرْهَانٌ وَالصَّبْرُ ضِيَاءٌ وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ-
আবু মালেক আশ‘আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, পরিপূর্ণভাবে ওযূ করা ঈমানের অংশ বিশেষ। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাল্লাকে পূর্ণ করে। ‘সুবহানাল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ আসমান ও যমিনকে পূর্ণ করে। ছালাত হল নূর বা আলো। আর যাকাত হল প্রমাণ। ধৈর্য আলো। আর কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে প্রমাণ।[3]
[2]. আবুদাউদ হা/১৫৮২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৪৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৪১।
[3]. নাসাঈ হা/২৪৩৭; ইবনু মাজাহ হা/২৮০; আলবানী, সনদ ছহীহ।
(৮) যাকাত পূর্ণাঙ্গ ইসলাম মানার অন্যতম মাধ্যম : যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। একে বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম মানা সম্ভব নয়। বরং পূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য ইসলামের যাবতীয় বিধান মানা অবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِيْ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّوْنَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ-
‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ব্যতীত তাদের কি প্রতিদান হতে পারে? ক্বিয়ামত দিবসে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন’ (বাক্বারাহ ২/৮৫)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ثَلاَثٌ أَحْلِفُ عَلَيْهِنَّ لاَ يَجْعَلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مَنْ لَهُ سَهْمٌ فِيْ الإِسْلاَمِ كَمَنْ لاَ سَهْمَ لَهُ فَأَسْهُمُ الإِسْلاَمِ ثَلاَثَةٌ الصَّلاَةُ وَالصَّوْمُ وَالزَّكَاةُ-
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তিনটি বিষয় আমি শপথ করে বলছি; যে ব্যক্তির ইসলামে অংশ আছে এবং যার ইসলামে কোন অংশ নেই দু’জনকে আল্লাহ কখনোই সমান করবেন না। ইসলামের তিনটি অংশ হল, ছালাত, ছিয়াম ও যাকাত।[1]