ইসলামের কিছু আলোচিত বিষয়ে অগ্রহণযোগ্য বিভ্রান্তি শাইখ সালেহ ইবন আবদুল্লাহ আল-হুমাইদ টি
ইসলামের কিছু আলোচিত বিষয়ে অগ্রহণযোগ্য বিভ্রান্তি শাইখ সালেহ ইবন আবদুল্লাহ আল-হুমাইদ টি

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله و الصلاة و السلام على رسول الله و على آله و صحبه.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আর সালাত ও সালাম শ্রেষ্ঠ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং শান্তি বর্ষিত হউক তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি ।

অতঃপর:

আমার নিকট পাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহের একটি ইসলামিক সেন্টার থেকে কতগুলো প্রশ্ন এসে পৌঁছলো, যেগুলোর পেছনে উস্কানি দিয়েছে “আল-আবা আল-বীদ” তথা ‘হোয়াইট ফাদার্স’ নামক কট্টরপন্থী খ্রিষ্টান মিশনারি সংগঠন; আর যখন আমি এগুলোর ব্যাপারে জানতে পারলাম, তখন আমি সেগুলোর জওয়াব না দিয়ে পারলাম না।

আর প্রশ্নসমূহের ধরন-প্রকৃতি এবং যুবক ও অন্যান্যদের মাঝে ইসলামী দিক-নির্দেশনা যেভাবে চলছে সে প্রেক্ষাপটে উক্ত প্রশ্নমালার ছত্রে ছত্রে যা পাঠিত হচ্ছে তা বিবেচনা করে সে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া ব্যতীত আমার গত্যন্তর ছিল না। তাছাড়া এ প্রশ্নগুলো ও অনুরূপ কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার পেছনে খৃষ্টান গির্জার যে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে তা অস্পষ্ট নয়। এগুলো মূলতঃ এমন কিছু ধারাবাহিক পর্ব যা নিরবচ্ছিন্নভাবে পূর্ব থেকেই চলে আসছে তা ইতিহাসের প্রতিটি পাঠকই সহজে বুঝতে পারে। বিশেষ করে যারা খৃষ্টানদের বিভিন্ন আন্দোলন, তাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা সমন্বিতকরণ, সার্বিক পর্যায়ে তাদের আক্রমনাত্মক যাবতীয় পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।

অতঃপর আমি এই ব্যাপারে মহান আরশের মালিক দয়াময় আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছি; আল্লাহর দীনের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য, ইসলামের অনুসারীদের আত্মসম্মানের জন্য এবং আল্লাহ চায় তো ভাষা ও কলমের মাধ্যমে সংগ্রাম করার জন্য।

প্রশ্নসমূহে উপস্থাপিত ইস্যুগুলো নিম্নোক্ত প্রধান শিরোনাম অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা যায়:

  •     সাম্য বা সমানাধিকার;
  •     স্বাধীনতা (ধর্মীয় স্বাধীনতা — দাসপ্রথা);
  •     নারী;
  •     শরী‘আত বাস্তবায়ন;
  •     জিহাদ।

১.

এই প্রশ্নগুলোর জন্ম বর্তমান সময়ে হয়নি; বরং এগুলো হল কতগুলো প্রশ্ন এবং সন্দেহ-সংশয়, যা ইসলামের উপর আঘাত হানার মতই পুরাতন।

আর যিনি এসব প্রশ্ন এবং অনুরূপ আরো যা কিছু এখানে বর্ণিত হয়েছে তার ব্যাপারে অবগত আছেন, তিনি জানেন যে, বিভিন্ন যুগে ও নানা উদ্দেশ্যে এসব প্রশ্ন প্রণয়নকারীগণ সেগুলোর জবাব পাওয়ার উদ্দেশ্যে তা করেনি এবং সত্যের অনুসন্ধান করাটাও তাদের লক্ষ্য ছিল না; বরং তারা সমাজের অভ্যন্তরে ও তার চিন্তা-গবেষণার ময়দানকে উত্তপ্ত করার উদ্দেশ্যে একটা বড় ধরনের শোরগোলের মধ্যে এসব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। অতঃপর সেখান থেকে দ্রুত কেটে পড়েছে এবং তাদের আঙুলসমূহ তাদের কর্ণকুহরে ঢুকিয়ে দিয়েছে এ আশঙ্কায় যে, তারা এসব প্রশ্নের সুষ্ঠু জবাব শ্রবণ করবে অথবা পেয়ে যাবে; সুতরাং মনে হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য হল প্রচণ্ড ভিড়ের ময়দানে কতগুলো টাইম বোমা নিক্ষেপ করা, অতঃপর তা বিস্ফোরিত হয়ে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই দ্রুত সেখান থেকে পলায়ন করা।

২.
উভয় পক্ষের আলোচকদের নিকট স্বীকৃত বিষয়ের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা কত সুন্দর হত, যাতে সেখান থেকেই আলোচনা শুরু করা যায় এবং সেখানেই ফিরে আসা যায়। কিন্তু এই গবেষকের অনুমান, এসব প্রশ্নের প্ররোচনার পেছনে উদ্দেশ্য হল সন্দেহ ও সংশয়ের বীজ বপন করা; বরং ‘নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা’, ‘বর্ণ বৈষম্যের বিরোধিতা’, ‘সমানাধিকার’ ও ‘মানবাধিকার’ নিয়ে উচ্চবাচ্য— ইত্যাদির মত প্রশস্ত দাবি-দাওয়ার নামে অন্যদের উপর আক্রমণ করাই এ সব প্রশ্নে অবতারণার উদ্দেশ্য। আর আপনি ভালভাবেই জানেন যে, এই ‘তত্ত্ব’ তো অবাস্তব দাবি মাত্র, যা দুর্বল ও হীনমন্য শ্রেণির ব্যক্তিদের নিকট চক্‌চকে, কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখলে তা কেবলই মরীচিকা, যাকে পিপাসার্ত ব্যক্তি পানি মনে করে সেখানে যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই পায় না; বরং পায় শুধু অহংকারী বড় কাউকে, যে নিগৃহীত ছোট কাউকে আগলে রেখে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে যাতে করে তাকে তক্ষুণি খেয়ে ফেলতে পারে, অথবা তাকে রেখে দিচ্ছে যাতে শেষপর্যন্ত মোটাতাজা হলে খেতে পারে। এ তো ‘আইন’ ও ‘সভ্যতার’ সুক্ষ্ম খোলস পরানো মগের মুল্লুক, যা আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম অবদান!

৩.

আলাপ-আলোচনার সময় কতগুলো গ্রহণযোগ্য আদর্শ ঠিক করা দরকার, যা উদাহরণের ক্ষেত্রে সূত্র হিসেবে অনুসরণ করা যায় এবং লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করা যায়।

আর যেহেতু এই প্রশ্নগুলো প্রকাশ পেয়েছে “হোয়াইট ফাদার্স” নামক খ্রিষ্টান মিশনারি সংগঠনের পক্ষ থেকে; তাহলে এই সংগঠনটি কি চাচ্ছে যে, খ্রিষ্টান নীতিমালাই হবে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ? আমি এ রকম ধারণা করি না; কেননা খ্রিষ্টান ও অ-খ্রিষ্টান সবাই খ্রিষ্টধর্মের ভিতরকার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ভাল করে জানে তাদের পবিত্র গ্রন্থের মাধ্যমে এবং  অতীত ও বর্তমানকালের তাদের পোপ ও যাজকদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আর আমার এই জবাবের মধ্যেই খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতির নমুনার দিকে দৃষ্টিপাত করা হতে পারে।

আর যদি ইয়াহুদী ধর্মই গ্রহণযোগ্য আদর্শ হয়, তবে খ্রিষ্টধর্ম ও এর পোপ, পণ্ডিত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিবর্গের বাস্তবতা হল যে তারা ইয়াহুদী ধর্মকে বিকৃত ও অযোগ্য মনে করে।

আর যদি আদর্শ হয় আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা, তবে খ্রিষ্টান পোপ-ফাদার ও তাদের অনুসারীদের সেখানে কী কাজ? তারা যদি তাতে মুগ্ধ থাকে এবং তারা জনসাধারণের নিকট তা পেশ করতে এবং জনগণকে তার দিকে আহ্বান করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তবে তা হবে এক লজ্জাজনক বশ্যতা। কেননা, এ কথা সর্বজনবিদিত যে, এই সভ্যতার সমৃদ্ধির সুপরিচিত কারণগুলোর অন্যতম হচ্ছে গির্জা ও গির্জার যাজকদের বর্জন। এই সভ্যতা গির্জা থেকে এমনভাবে পলায়ন করেছে যে, তা পরবর্তীতে আর ফিরে আসবে না; তাদের ভাষায় ‘মধ্যযুগীয় পশ্চাদমুখিতা’য় যদি-না ফিরে যেতে ইচ্ছা করে!

তবে এখানে এই লেখক উক্ত পাশ্চাত্য সভ্যতাকে অনুকরণীয় হওয়ার মত উত্তম দেখে না। কারণ, তাতে রয়েছে প্রকাশ্য বিচ্যুতি ও মানবতার জন্য দুঃখ-দুর্দশা, যার কারণে গোটা বিশ্ব ভয়-ভীতি, সন্ত্রাস, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা অবরুদ্ধ হয়ে আছে যা অচিরেই যেন সে-সভ্যতা ও তার রূপকারদেরকে পরিপূর্ণ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর তার মধ্যে এই বিচ্যুতি ব্যতীতও রয়েছে ‘মানবাধিকার’, ‘সমানাধিকারের’ মতো কিছু স্থুল তত্ত্ব, যেগুলোর কোনো বাস্তবতা নেই। আর এর বাস্তবতার কিছু যদি থেকেও থাকে, তবে তা শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের জন্যই। তাদের ছাড়া অন্যদের জন্য শুধু রয়েছে জঙ্গলের শাসন কিংবা “উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ভুলপন্থাও অনুমোদনযোগ্য” শীর্ষক বিকৃত তত্ত্ব ও আদর্শ।

দুঃখজনক হওয়া সত্ত্বেও এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সকলের নিকট সন্তোষজনক এমন কোনো জায়গা নেই, যেখান থেকে শুরু করে আমরা একটা সন্তোষজনক ফলাফলে পৌঁছুতে পারতাম।

৪.

উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর একটি জবাবও খ্রিষ্টধর্ম এবং খ্রিষ্টীয় আকিদা-বিশ্বাসে পাওয়া যাবে না। তবে একটি খ্রিষ্টান মিশনারি সংগঠন কী করে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করে?

দাসপ্রথা, নারী সম্পর্কিত বিষয়াদি, পবিত্র ধর্মযুদ্ধ এবং খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণকারী ও অন্যান্যদের মধ্যে বিভক্তি— সবকিছুই খ্রিষ্টধর্মে বিদ্যমান; খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা এসব সমস্যার কি জবাব দেয়, তা জানার অধিকারও পাঠকদের রয়েছে।

যেহেতু এর জবাব না-বোধক, সেহেতু তারা কেন খ্রিষ্টধর্মের দিকে দাওয়াত দেয়া বন্ধ করে না? অথচ এ ধর্মতেও এ সকল উত্থাপিত বিষয়াদি সমভাবে বিদ্যমান! মূলত তারা এই দিনগুলোতে এসব বিষয়কে উত্থাপন করেছে দোষণীয় ও ত্রুটিপূর্ণ বিষয়রূপে, যাতে এর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমদেরকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে।

৫.

আরও একটি বিষয় অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও তিক্ত। আর তা হল এই যে, এসব প্রশ্নের পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন, এ প্রশ্নগুলো নিরপেক্ষ নয়। এসব প্রশ্নের বাক্যে ও ছত্রে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও পূর্বপ্রসূত ধারনাই ছিল নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি ।

৬.

উপরোক্ত কথাগুলো এই বিষয়ের ও উত্তরের অবতারণায় ভূমিকা হিসেবে আসায় আমি ব্যথিত। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক অধ্যয়নকারীর জেনে রাখা প্রয়োজন এবং প্রত্যেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করতে পারেন যে, আমি সত্য অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা-সাধনা করেছি। আর এ কাজটি করেছি আমি আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে এবং তাঁর নিকট সওয়াব ও কল্যাণের আশায়; আমানত যথাযথভাবে আদায় করতে এবং গোটা মানবতার কল্যাণ কামনায়।

৭.

আর আমি সম্মানিত পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমার এই জবাবের উদ্দেশ্য হল ঐসব অমুসলিমদের সম্বোধন করা, যারা কুরআন ও সুন্নাহর মত শরী‘আতের বক্তব্য দ্বারা পেশকৃত দলিলের প্রতি অনুগত নয়। আর তাই এই প্রশ্নোত্তর ও আলোচনায় অন্য কোনো কিছুর চাইতে বিবেক-বুদ্ধিকে সম্বোধন এবং চিন্তাশক্তির সাথে আলোচনাই গুরুত্ব পেয়েছে।

তবে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানে শরী‘আতের নস ও বক্তব্যসমূহও একত্রিত করা হয়েছে; পাঠক তা লক্ষ্য করে থাকবেন দাসপ্রথা ও অন্য কিছু বিষয়ের আলোচনাতে।


আর আমি পরিপূর্ণ আস্থা ও দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই: নিশ্চয় আমার দীন হলো আল-ইসলাম; আর তার প্রতি আমার ঈমান ও বিশ্বাস নড়বড়ে হওয়ার মত নয়। আর আল-কুরআন প্রকৃতভাবেই আল্লাহর বাণী; আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং তিনি সকল মানুষের নিকট প্রেরিত আল্লাহর রাসূল। আর ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালাম হলেন আল্লাহর নবী ও বলিষ্ঠ রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ তা‘আলা সকল জাতির মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছেন; আর ইসলাম হল আল্লাহ তা‘আলার সর্বশেষ দীন, যা ব্যতীত অন্য কোন ধর্মকে তিনি গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ হলেন সাহায্য-সহযোগিতার আধার এবং তাঁর উপরই আমাদের ভরসা; মহান ও সর্বোচ্চ আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন উপায় নেই এবং কোন শক্তি-ক্ষমতাও নেই।

এই পুস্তকে আমি প্রশ্নের ধারাবাহিকতায় কিছু পরিবর্তন করেছি এবং তা বিষয়বস্তুর আলোকে বিন্যাস করেছি; তাতে তার আসল ধারাবাহিকতা রক্ষা করিনি। তবে প্রশ্নকারকদের মূল ধারাবাহিকতায় প্রশ্নগুলো জবাবসমূহের শেষে উপস্থাপন করব।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে