দেবতাদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা : তারা তাদের দেবতাদেরকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসতো। আল্লাহকে ভালবেসে যেমন আল্লাহর উপাসনা করতো, তেমনি দেবতাদের ভালবেসে তাদেরও উপাসনা করতো। তাদের এমন ভালোবাসার প্রতি ইঙ্গিত করেই মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ ﴾ [البقرة: ١٦٥]
‘‘মানুষের মাঝে এমনও কিছু লোক রয়েছে যারা আল্লাহর অনেক সমকক্ষ নির্ধারণ করে, তাদেরকে আল্লাহর ভালোবাসার মতই ভালবাসে।’’[1]
দেবতাদের অনিষ্টের গোপন ভয় করা :
তারা মনে করতো যে, তাদের দেবতাদের কেউ বেআদবী করলে বা তাদের সমালোচনা করলে দেবতারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যে কোন অনিষ্ট সাধন করতে সক্ষম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেবতা ও মূর্তিসমূহের সমালোচনা করার ফলে তাঁকেও তারা তাদের দেবতাদের অনিষ্টের গোপন ভয় দেখাতো। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَيُخَوِّفُونَكَ بِٱلَّذِينَ مِن دُونِهِۦۚ﴾ [الزمر: ٣٦]
‘‘আল্লাহ ব্যতীত তাদের যে সব দেবতা রয়েছে, তারা তোমাকে সে সবের অনিষ্টের ভয় প্রদর্শন করে।’’[2]
বিপদে দেবতাদের শরণাপন্ন হওয়া :
ইহকালীন প্রয়োজন বা বিপদাপদ দূরীকরণের জন্য তারা তাদের দেবতাদের শরণাপন্ন হতো। আল্লাহর কল্যাণ তাঁর নিকট সরাসরি না চেয়ে নিজেদের অক্ষমতা দেবতাদের কাছে পেশ করে, তাদের নিকট অনুনয় বিনয় করে তাদের মাধ্যমে আল্লাহর অনুকম্পা ও কল্যাণ লাভ করতে চাইতো। আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পা লাভের জন্য এ পদ্ধতি পরিহার করে সরাসরি আল্লাহর নিকটে তাঁর দয়া কামনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَأَنِيبُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَأَسۡلِمُواْ لَهُۥ﴾ [الزمر: ٥٤]
‘‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দিকে প্রত্যাবর্তিত হও এবং তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ কর।’’[3]
বিপদে দেবতাদেরকে আশ্রয়স্থল হিসাবে মনে করা :
কোন বিপদ হলে বা কোন অকল্যাণ পেয়ে বসলে তারা তাদের দেবতাদের শরণাপন্ন হতো, তাদেরকে তাদের আশ্রয় স্থল হিসেবে মনে করতো। আল্লাহর এ জগতে তিনি ব্যতীত মানুষের জন্য অপর কোন আশ্রয় স্থল নেই; সে জন্য তিনি তাঁর রাসূলকে দিয়ে এ ঘোষণা দিতে বলেন :
﴿ قُلۡ إِنِّي لَن يُجِيرَنِي مِنَ ٱللَّهِ أَحَدٞ وَلَنۡ أَجِدَ مِن دُونِهِۦ مُلۡتَحَدًا ٢٢ ﴾ [الجن: ٢٢]
‘‘আপনি তাদের বলুন: আল্লাহ তা‘আলার পাকড়াও থেকে আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না এবং তিনি ব্যতীত আমি অপর কোন আশ্রয়স্থলও পাব না।’’[4]
দেবতাদের উপর ভরসা করা :
তারা বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণে তাদের দেবতাদের উপর ভরসা করতো। তাই মহান আল্লাহ বলেন :
﴿ وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٢٣ ﴾ [المائدة: ٢٣]
‘‘যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো, তা হলে একমাত্র আল্লাহর উপরেই ভরসা করো।’’[5]
>[2]. আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৩৬।
[3]. আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৫৪।
[4]. আল-কুরআন, সূরা জিন : ২২, ২৩।
[5]. আল-কুরআন, সূরা মায়েদাহ্ : ২৩।
দেব-দেবীদের নামে শপথ করা :
কোন কোন দেব-দেবীদের নামকে তারা বরকতময় ও সম্মানিত মনে করতো। তাদের নামে মিথ্যা শপথ করলে শপথকারীর পরিবার ও সহায় সম্পদে ক্ষতি হবার সমূহ আশঙ্ক্ষা করতো। যার ফলে তাদের নামে কেউ মিথ্যা শপথ করতে রাজি হতো না। গায়রুল্লাহের নামে শপথ করলে এতে গায়রুল্লাহর সম্মান করা হয় বিধায়, তা শির্কের অন্তর্গত হওয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللهِ فَقَدْ أَشْرَكَ»
‘‘যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর নামে শপথ করলো, সে শির্ক করলো।’’[1]
দেব-দেবীদের নামে সন্তানাদির নাম রাখা :
তারা দেব-দেবীদের বরকত প্রাপ্তির জন্য সন্তানাদির নাম ‘আব্দুল উজ্জা, ‘আব্দে শামস ইত্যাদি রাখতো।
দেব-দেবীদের নিকট সন্তানের জন্য কল্যাণ কামনা করা :
নবজাত শিশুদের নিয়ে দেব-দেবীদের কাছে গমন করে শিশুর জন্য তাদের নিকট থেকে কল্যাণ কামনা করতো।
তাদের এ-কর্মের সমালোচনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :
﴿ ۞هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَجَعَلَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا لِيَسۡكُنَ إِلَيۡهَاۖ فَلَمَّا تَغَشَّىٰهَا حَمَلَتۡ حَمۡلًا خَفِيفٗا فَمَرَّتۡ بِهِۦۖ فَلَمَّآ أَثۡقَلَت دَّعَوَا ٱللَّهَ رَبَّهُمَا لَئِنۡ ءَاتَيۡتَنَا صَٰلِحٗا لَّنَكُونَنَّ مِنَ ٱلشَّٰكِرِينَ ١٨٩ فَلَمَّآ ءَاتَىٰهُمَا صَٰلِحٗا جَعَلَا لَهُۥ شُرَكَآءَ فِيمَآ ءَاتَىٰهُمَاۚ فَتَعَٰلَى ٱللَّهُ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ١٩٠ ﴾ [الاعراف: ١٨٩، ١٩٠]
‘‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটিমাত্র সত্তা থেকে; আর তাত্থেকেই তৈরী করেছেন তার জোড়া, যাতে তার কাছে স্বস্তি পেতে পারে। অতঃপর পুরুষ যখন নারীকে আবৃত করলো (নারী পুরুষ উভয়ে দৈহিকভাবে মিলিত হল) তখন সে গর্ভবতী হলো অতি হালকা গর্ভে। সে তা নিয়ে চলাফেরা করতে লাগলো। এরপর যখন বোঝা হয়ে গেল তখন তারা উভয়েই তাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ডাকলো এই বলে যে, তুমি যদি আমাদেরকে সুস্থ সন্তান দান করো, তবে আমরা তোমার শুকরিয়া জ্ঞাপন করবো। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে সুস্থ সন্তান দান করলেন, তখন দানকৃত সে সন্তানে তারা তাঁর অংশীদার তৈরী করতে লাগলো। বস্তুত আল্লাহ তাদের শরীক সাব্যস্ত করা থেকে বহু উর্ধ্বে।’’[2]
আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কোন বস্তু হালাল বা হারাম করা :
আল্লাহর হালালকৃত কোন কোন বস্তুকে তারা নিজ থেকে কারো জন্যে হালাল ও কারো জন্যে হারাম করে নিতো এবং বলতো যে, এ হালাল বা হারাম আল্লাহই করেছেন। যেমন তারা একটি উট একাধারে দশটি মাদী বাচ্চা জন্ম দিলে এ উটটিকে তারা দেবতাদের জন্য মুক্তভাবে ছেড়ে দিত, কেউ এর পিঠে আরোহণ করতো না, এর গায়ের পশমও নিত না, মেহমান ছাড়া অন্য কারো জন্যে এর দুগ্ধ পান করাকে বৈধ মনে করতো না। এ ধরনের উটকে তারা ‘সা-ইবাহ’ বলে নামকরণ করতো। এ ‘সা-ইবাহ’ উটটি পরবর্তীতে আরো একটি মাদী বাচ্চা জন্ম দিলে এ বাচ্চাটিকে ‘বহীরাহ’ নামকরণ করে এর কান ছিদ্র করে দিয়ে এটাকে তার মায়ের সাথে ছেড়ে দিত এবং এর সাথে তার মায়ের মতই আচরণ করতো।[3]
অনুরূপভাবে একটি বকরী পরপর পাঁচ বারে দশটি মাদী বাচ্চা প্রসব করলে এবং এদের সাথে কোন নর বাচ্চা না থাকলে মহিলাদের জন্য তারা সে বকরীর মাংস ভক্ষণ করা হারাম বলে গণ্য করতো। এ বকরীটি মরে গেলে তা আবার মহিলাদের পক্ষেও ভক্ষণ করা হালাল বলে মনে করতো। এ ধরনের বকরীকে ‘ওয়াসীলাহ’ বলে নামকরণ করতো।[4]
অনুরূপভাবে একটি পুরুষ উট অপর মাদী উটের সাথে রমন ক্রিয়া সম্পাদন করার ফলে কোন নর সন্তান ছাড়াই একাধারে দশটি মাদী সন্তান প্রসব করলে এ পুরুষ উটের উপর আরোহণ করা ও এর পশম আহরণ করাকে হারাম বলে গণ্য করতো। এ ধরনের উটকে তারা ‘হামী’ বলে নামকরণ করতো।[5]
আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ জাতীয় খারাপ কাজ ও কূপ্রথা বা অভ্যাস সম্পর্কে বলেন :
﴿ مَا جَعَلَ ٱللَّهُ مِنۢ بَحِيرَةٖ وَلَا سَآئِبَةٖ وَلَا وَصِيلَةٖ وَلَا حَامٖ وَلَٰكِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يَفۡتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَۖ وَأَكۡثَرُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ ١٠٣ ﴾ [المائدة: ١٠٣]
‘‘মহান আল্লাহ ‘বহীরাহ, সা-ইবাহ, ওয়াসীলাহ এবং হামীকে শরী‘আত সিদ্ধ করেননি। কিন্তু যারা কাফের তারা আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। তাদের অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই।’’[6]
তারা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে এ সব কর্মকে ধর্মীয় আইনের মর্যাদা দান করেছিল।[7]
শির্কযুক্ত কথার মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক দেয়া :
তারা শির্কযুক্ত কথা-বার্তা (মন্ত্রের ন্যায়) পাঠ করে রোগীদের ঝাড়ফুঁক করতো।
‘আউফ ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :
«كُنَّا نَرْقَى فِي الْجَاهِليَّةِ ، فَقُلْنَا لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَيْفَ تَرَى ذلِكَ؟ فَقالَ :أَعْرِضُوْا عَلَيَّ رُقَاكُمْ. لاَ بَأْسَ بِالرُّقَى مَالَمْ يَكُنْ فِيْهِ شِرْكٌ»
‘‘আমরা জাহেলী যুগে ঝাড়ফুঁক দান করতাম। আমরা রাসূলুল্লা্হ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম : আপনি এগুলো কী মনে করেন? তিনি বলেন : ‘‘তোমরা যা বলে ঝাড়ফুঁক দিয়ে থাকো তা আমাকে পড়ে শুনাও, ঝাড়ফুঁকে কোন দোষ নেই, যদি তা শির্ক মুক্ত হয়।’’[8] এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা শির্কযুক্ত কথা-বার্তা মন্ত্রের ন্যায় পাঠ করে বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে ঝাড়ফুঁক দান করতো।
শিশুদের তা‘বীজ পরানো:
চোখের অশুভ দৃষ্টি (নজর লাগা) থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য তারা বাচ্চাদের গায়ে তা‘বীজ ব্যবহার করতো। একই উদ্দেশ্যে তারা উটের গলায় ধাতু নির্মিত তারের মালা ঝুলিয়ে রাখতো। তা‘বীজ বা ধাতু নির্মিত তারের মালা আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল বিনষ্টকারী হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَنْ عَلَّقَ تَمِيْمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ»
“যে তা‘বীজ ঝুলালো সে শির্ক করলো।’’[9]
কোনো উটের গলায় তার বা হার ঝুলানো দেখলে তা কেটে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছিলেন:
«لاَيَبْقَيَنَّ فِيْ رَقَبَةِ بَعِيْرٍ قِلاَدَةً مِنْ وَتَرٍ ، وَ لاَ قِلاَدَةً إِلاَّ قُطِعَتْ»
‘‘কোনো উটের গলায় ধাতব দ্রব্য দ্বারা নির্মিত তারের হার অবশিষ্ট রাখবে না, গলায় ঝুলানো হার পেলেই তা কেটে দিবে।’’[10]
তিনি আরো বলেন :
«إِنَّ الرُّقَى وَ التَّمَائِمَ وَالتِّوْلَةَ شِرْكٌ»
“(শির্ক যুক্ত) ঝাড়ফুঁক, তা‘বীজ ও জাদু শির্ক।’’[11]
শিশুদের গলায় ঝিনুকের মুক্তা ঝুলিয়ে রাখা :
শিশুরা যাতে অশুভ দৃষ্টির হাত থেকে মুক্ত হয়ে শান্ত-শিষ্ট হয়, সে-জন্য তাদের গলায় ঝিনুক থেকে আহরিত মুক্তা ঝুলিয়ে রাখতো। যারা উক্ত উদ্দেশ্যে তা ঝুলায় তাদের জন্য বদ দু‘আ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«مَنْ عَلَّقَ وَدَعَةً فَلاَ وَدَعَ اللهُ لَهُ»
‘‘যে (কোন কিছুর অশুভ দৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য) ঝিনুক থেকে আহরিত মুক্তা শরীরে ঝুলায় আল্লাহ যেন তার সে অকল্যাণ দূর না করেন।’’ [12]
রোগ নিরাময়ের জন্য ধাতব দ্রব্য নির্মিত বালা ব্যবহার করা:
তারা বাত রোগ নিরাময়ের জন্য খণিজ (ধাতব) দ্রব্য দ্বারা নির্মিত বালা হাতে পরিধান করতো। ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে হাতে স্বর্ণের বালা পরিধান করা অবস্থায় দেখতে পেয়ে বললেন : ‘‘ওটা কী? লোকটি বললো : ‘ওয়াহিনা’ নামক রোগ থেকে (যা স্কন্ধ বা হাতের শিরায় হয়ে থাকে) আরোগ্য লাভের জন্য এটি পরেছি। রাসূহুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন :
«أَنْزِعْهَا فَإِنَّهَا لاَ تَزِيْدُكَ إِلاَّ وَهْناً، فَإِنَّكَ لَوْ مِتَّ وَهِيَ عَلَيْكَ مَا أَفْلَحْتَ أَبَداً»
‘‘তুমি এটি খুলে ফেল, কারণ এটি তোমার রোগ বৃদ্ধি ছাড়া কোন উপকার করবে না, তুমি যদি এটি হাতে পরিধান করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো, তা হলে কস্মিনকালেও তুমি সফল হতে পারবে না, অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে না।’’[13]
মূর্তি ও প্রতিমার স্থলে মেলা বসানো :[14]
তারা তাদের মূর্তি ও প্রতিমাসমূহের স্থলে বার্ষিক মেলা বসাতো। এ উপলক্ষে লোকেরা দূর-দূরান্ত থেকে নিজেদের নানাবিধ প্রয়োজন দেব-দেবীদের কাছে উপস্থাপন করার জন্য আগমন করতো। তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য নানা রকম নজর, নিয়াজ ও হাদিয়া তুহফা দান করতো। আমাদের রাসূল বা অপর কারো কবর, কিংবা কোন স্থান ও সময়কে কেন্দ্র করে মুসলিমদের মাঝে যাতে এমন কোনো মেলার প্রচলন না হয়, সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«لاَتَجْعَلُوْا قَبْرِيْ عِيْداً»
‘‘তোমরা আমার কবরকে ঈদ তথা মেলার স্থানে পরিণত করো না।’’[15]
নবী ও অলিদের কবরে মসজিদ নির্মাণ করা :
ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা তাদের নবী ও অলিদের মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছিল। তাঁদের কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করেছিল। সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপর অভিসম্পাত করে বলেন :
«لَعَنَ اللهُ الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِد»
“আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের উপর অভিসম্পাত করেছেন, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছে।”[16]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন :
«فَلَوْ لاَ ذلِكَ لأَبْرَزَ قَبْرَهُ غَيْرَ أَنَّه خَشِيَ أَنْ يَتَّخَذَ مَسْجِداً»
“লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরকে ভবিষ্যতে মসজিদ বানানোর ভয় না থাকলে তাঁর কবর ঘরের বাইরে প্রকাশ্য স্থানেই প্রদান করা হতো।”[17]
পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করা :
তারা পশু ও পাখিকে নিজ স্থান থেকে ধমক দিয়ে সরিয়ে বা উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতো। পশু বা পাখি ডান দিকে উড়ে গেলে এটাকে শুভ লক্ষণ হিসেবে গণ্য করতো। আর বাম দিকে গেলে এটাকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করতো।[18] এ জাতীয় কর্ম শির্কের অন্তর্গত হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ ثَلاَثاً»
‘‘পাখি উড়িয়ে দেয়া থেকে ভাগ্যের শুভ বা অশুভ নির্ধারণ করা শির্ক। (এ কর্মটি যে শির্ক তা গুরুত্বের সাথে বুঝাবার জন্য) এ কথাটি তিনি তিন বার বলেন।’’[19]
অশুভ ধারণা :
তারা কোনো কোনো দিবস, মাস, কোনো পশু-পাখি, গৃহ ও মহিলাদেরকে অশুভ ও মন্দ বলে ধারণা করতো।[20]
উপত্যকার জিনের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা :
সফরে গিয়ে কোনো উপত্যকায় অবতরণ করলে সে উপত্যকার জিন সরদারের নিকট তারা আশ্রয় প্রার্থনা করে বলতো :
«أَعُوْذُ بَسَيِّدِ هَذَا الْوَادِيْ مِنْ شَرِّ سُفَهَاءِ قَوْمِهِ»
‘‘এই উপত্যকার সরদারের নিকট তার জাতির দুষ্টদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’’[21] কুরআনুল কারীমে তাদের এ জাতীয় প্রার্থনা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :
﴿ وَأَنَّهُۥ كَانَ رِجَالٞ مِّنَ ٱلۡإِنسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٖ مِّنَ ٱلۡجِنِّ فَزَادُوهُمۡ رَهَقٗا ٦ ﴾ [الجن: ٦]
‘‘মানুষের মধ্যকার কিছু লোকেরা জিনদের মধ্যকার কিছু জিনের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতো, ফলে আশ্রিত জিনেরা তাদের নিকট আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের ভয় আরো বাড়িয়ে দিতো।’’[22]
বরই গাছ দ্বারা বরকত গ্রহণ করা :
তারা ‘যাতে আনওয়াত্ব’ নামের একটি বরই গাছ দ্বারা বরকত অর্জন করতো। এ গাছে তারা তাদের অস্ত্র ও মালপত্র ইত্যাদি বেধে ঝুলিয়ে রাখতো। এ গাছের সম্মান করতো, এর উদ্দেশ্যে মানত করতো ও এর নিচে অবস্থান গ্রহণ করতো। একটি গাছকে কেন্দ্র করে এ ধরনের কাজ করা শির্ক, এ বিষয়টি না জানার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ সে গাছটি দেখে তাঁকে বলেছিলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য অনুরূপ একটি গাছ নির্বাচন করে দিন। তখন তিনি তাদেরকে এই বলে ধমক দিয়েছিলেন :
«إِنَّكُمْ طَلَبْتُمْ مِثْل مَا طَلَبَ بَنُوْاإِسْرَائِيْلُ مِنْ مُوْسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهاً كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ»
‘‘তোমরা ঠিক সে রকমই আবেদন করেছো যেমন বনী ইস্রাঈলরা মূসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট তাদের শত্রুদের দেবতাদের অনুরূপ একটি দেবতা নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য আবেদন করেছিল।’’[23]
কুরায়শ ও আরবদের দাবী :
ক্বুরায়শ ও আরব জনগণের ধর্মীয় অজ্ঞতার সুযোগে শয়তান তাদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শির্ক প্রবেশ করিয়ে দিয়ে থাকলেও তারা নিজেদেরকে দ্বীনে ইব্রাহীমের যথার্থ অনুসারী বলে দাবী করতো। কার্যত তাদের মাঝে দ্বীনে ইব্রাহীমের কিছু উপাসনা ও আচার-অনুষ্ঠান যেমন : কা‘বা শরীফের সম্মান করা, এর ত্বওয়াফ করা, হজ্জ ও ‘উমরা করা, আরাফা, মিনা ও মুযদালিফায় অবস্থান করা এবং সেখানে উট উৎসর্গ করা ইত্যাদি ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এ সব অনুষ্ঠান সম্পাদনের ক্ষেত্রেও তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু বেদ‘আতী কর্মকাণ্ডও সংযোজন করেছিল। সে সকল বেদ‘আতের মধ্যকার একটি বেদ‘আত এমন ছিল যে, কুরায়শগণ মনে করতো অন্যান্য লোকদের চেয়ে তাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আরবের অপর কোনো গোত্রই তাদের সাথে সে বৈশিষ্ট্যে শরীক হতে পারে না। এ বৈশিষ্ট্যের কথা ভেবে তারা অন্যান্য মানুষের সাথে আরাফায় অবস্থান করা থেকে বিরত থাকতো। এর বদলে তারা মুযদালিফায় অবস্থান গ্রহণ করতো এবং সেখান থেকেই মক্কায় ফিরে আসতো। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কর্মকে অপছন্দ করেন এবং কাফির ও মুসলিম নির্বিশেষে সকলকে সাধারণ মানুষদের ন্যায় আরাফা থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করার নির্দেশ দান করে বলেন : [24]
﴿ثُمَّ أَفِيضُواْ مِنۡ حَيۡثُ أَفَاضَ ٱلنَّاسُ﴾ [البقرة: ١٩٩]
‘‘অতঃপর তোমরা (মক্কায়) ফিরে এসো যেখান থেকে (সাধারণ) লোকেরা ফিরে আসে।’’[25]
তাদের অপর একটি বেদ‘আত ছিল যে, তারা বলতো হরমের বাইরের লোকজন হজ্জ বা ‘উমরা পালনার্থে হরমে আগমন করলে তারা তাদের সাথে নিয়ে আসা খাবার হরমের মধ্যে খেতে পারবে না।[26]
তাদের অপর একটি বেদ‘আত এমন ছিল যে, তারা হারামের বাইরের জনগণের প্রতি এ নির্দেশ জারী করেছিল যে, তারা হরমে আসলে বিশেষ ধরনের বস্ত্র ছাড়া কা‘বা শরীফের প্রথম ত্বওয়াফ করতে পারবে না। সে কারণে উক্ত বস্ত্র কেউ সংগ্রহ করতে অপারগ হলে উলঙ্গ অবস্থায়ই তাকে ত্বওয়াফ করতে হতো। মহিলারা সে কাপড় সংগ্রহ করতে না পারলে বুক খোলা রেখে ত্বওয়াফ করতো এবং বলতো :
‘‘আজ শরীরের পূর্ণ বা অংশবিশেষ অনাবৃত থেকে যাচ্ছে, যা অনাবৃত থেকে যাচ্ছে তা অনাবৃত রাখাকে আমি হালাল মনে করি না।’’[27]
তাদেরকে এভাবে উলঙ্গ অবস্থায় কা‘বা শরীফের ত্বওয়াফ করা থেকে বারণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ ۞يَٰبَنِيٓ ءَادَمَ خُذُواْ زِينَتَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِدٖ﴾ [الاعراف: ٣١]
‘‘হে আদম সন্তানরা! মসজিদে আগমনের সময় তোমরা পোশাকাদি পরিধান করে সৌন্দর্য গ্রহণ করো।’’[28]
অনুরূপভাবে তারা ইহরাম পরিহিত অবস্থায় তাদের বাসগৃহের দরজা দিয়ে প্রবেশ করাকে জায়েয মনে করতো না। তাই গৃহে প্রবেশের জন্য তারা ঘরের পিছনের দেওয়ালে একটি ছিদ্র করে তা দিয়ে প্রবেশ করতো এবং এ কাজকে তারা একটি পুণ্যের কাজ হিসেবে মনে করতো। তাদের এ কর্মের সমালোচনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَيۡسَ ٱلۡبِرُّ بِأَن تَأۡتُواْ ٱلۡبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَٰكِنَّ ٱلۡبِرَّ مَنِ ٱتَّقَىٰۗ وَأۡتُواْ ٱلۡبُيُوتَ مِنۡ أَبۡوَٰبِهَاۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ١٨٩ ﴾ [البقرة: ١٨٩]
‘‘ঘরের পিছন দিয়ে গৃহে প্রবেশ করা কোনো কল্যাণের কাজ নয়, কল্যাণের কাজতো তা-ই যে তাকওয়া অর্জন করলো। কাজেই তোমরা দরজা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা নিজেদের বাসনায় কৃতকার্য হতে পার।’’[29]
মোদ্দাকথা : উপরে মূর্তি, প্রতিমা পূজা এবং শির্ক ও কুসংস্কারে পরিপূর্ণ যে ধর্মের কথা আলোচিত হলো তা ছিল প্রায় সকল আরবদেরই ধর্ম। এ আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, কুরায়শ ও আরবগণ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের ক্ষেত্রে যে বিকৃতি আনয়ন করেছিল, তা শির্কের সকল প্রকারকেই শামিল করেছিল। অনুরূপভাবে তারা আল্লাহর উপাসনার ক্ষেত্রেও বিকৃতি সাধন করেছিল, যা তাদের নিকট উত্তম বেদ‘আত হিসেবে গণ্য ছিল। তাদের যাবতীয় শির্কী ও বেদ‘আতী বিশ্বাস ও কর্মই তাদেরকে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীন থেকে সম্পূর্ণভাবে বের করে দিয়েছিল।
আল্লাহ তা‘আলাকে একক সৃষ্টিকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং দ্বীনে ইব্রাহীমের কিছু কর্ম করে এর অনুসারী বলে তাদের শত দাবী থাকা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাদেরকে কাফির ও মুশরিক বলে আখ্যায়িত করেন। আল্লাহর স্বীকৃতি, কা‘বা শরীফের ত্বওয়াফ ও সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি ভাল কর্ম করা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৃষ্টিতে তারা মুসলিম থাকতে পারে নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, যুগে যুগে দ্বীনে মুহাম্মদীর অনুসারীদের মধ্যে যারা ক্বুরায়শ ও আরব জনগণের অনুরূপ হবে, তারাও দ্বীনে মুহাম্মদীর অনুসারী হওয়ার শত দাবী করে থাকলেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে তারা মুসলিম থাকতে পারবে না।
[2]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৮৯-১৯০।
[3]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৬।
[4]. তদেব।
[5]. তদেব।
[6]. আল-কুরআন, সূরা মায়েদাহ্ : ১০৩।
[7]. মুফতী মুহাম্মদ শফী‘, মা‘আরেফুল ক্বুরআন; অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মহিউদ্দীন খান, (মদিনা : সৌদি আরব, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ.৪১৬।
[8].মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুস সালাম, বাব নং ২২ (শির্কমুক্ত ঝাড়ফুক বৈধ হওয়ার বর্ণনা) হাদীস নং ২২০০; ৪/১৭২৬; আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুত ত্বিব, বাব : মা জা-আ ফির রুক্বা; ৪/২১৪; আবু জা‘ফর ত্বহাবী, আহমদ ইবন মুহাম্মদ, শরহে মা‘আনী আল-আ-ছার; সম্পাদনা : মুহাম্মদ যুহরী আন-নাজ্জার, (বৈরুত : দ্বারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৩৯৯হি.), ৪/৩২৮।
[9]. ইমাম আহমদ. প্রাগুক্ত; ৪/১৫৬।
[10]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জিহাদ, বাব নং ১৩৯; ২/৪/১৪৩; আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; ৩/৫২।
[11].আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুত ত্বিব, বাব নং ১৭, (তা‘লীকিত তামাইম), হাদীস নং ৩৮৮৩; ৪/৯; বায়হাক্বী, প্রাগুক্ত; ৯/৩৫০।
[12]. ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ৪/১৫৪।
[13]. ইবন মাজাহ; কিতাবুত ত্বিব, বাব : যিয়ারতিল কবরি; ২/৫৩৪।
[14]. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব, প্রাগুক্ত; পৃ. ১২৩।
[15]. টীকা নং ১৬২ দ্রষ্টাব্য।
[16]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জানাইয, বাব : বয়ান কারাহাতি ইত্তেখাজিল মাসাজিদি ‘আলাল কাবরি; ১/৩/১৮৮; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মসজিদ, বাব নং ৩; ১/৩৭৭।
[17]. তদেব।
[18]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৮।
[19]. আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাব নং ২৩ (কিতাবুন রাআহু), বাব নং ২৪, হাদীস নং ৩৯১০, ৪/১৭।
[20]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৮; ইবনে হাজার, ফাতহুলবারী; ৬/৬১।
[21]. ইকনে কাছীর, তাফছীরুল ক্বুরআনিল ‘আযীম; ২/১২৮ ও ৪/৪৫৭।
[22]. আল-কুরআন, সূরা জিন : ৬।
[23]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ফিতন..., বাব নং ১৮, হাদীস নং ২১৮০; ৪/৪৭৫।
[24].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফসীর, বাব নং ৩৭, হাদীস নং ৪২৪৮, ৪/১৬৪৩; ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/১১৯।
[25]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ১৯৯।
[26]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৯।
[27]. তারা বলতো : اليوم يبدو بعضه أو كله ** و ما بدا منه فلا أحله" দেখুন : ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/২০২, ২০৩; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফসীর, বাব নং ১, হাদীস নং ৩০২৮, ৪/২৩২০।
[28]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ৩১।
[29] . আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ১৮৯।
মানব সমাজে শির্ক সংঘটিত হওয়ার সূচনা লগ্ন থেকে নিয়ে ইসলাম পূর্ব যুগ পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ের মানুষের শির্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য নিম্নেবর্ণিত কারণসমূহকে দায়ী করা যেতে পারে :
প্রথম কারণ : সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন :
জ্ঞানী, গুণী ও মর্যাদাবানদের প্রশংসা ও সম্মান প্রদর্শন করা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ কখনও এ প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হতে পারে না। যে ব্যক্তি মানুষের অবদান ও উপকারকে স্মরণ করে তাদের কৃতজ্ঞ হতে পারে না, সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞ হতে পারে না। মানুষ স্বীয় চরিত্র ও কর্মগুণে সাধারণ মানুষের প্রশংসা ও সম্মান পেতে পারে। কিন্তু তাই বলে কোনো মানুষ কখনও আল্লাহর সম প্রশংসা ও সম্মান পাবার যোগ্য হতে পারে না। সে জন্য কারো প্রশংসা ও সম্মান করে তাঁকে রব ও ইলাহের স্তরে পৌঁছে দেয়া যাবে না।
তাই কোন মানুষের তা‘যীম ও সম্মান করতে হলে অবশ্যই তা শরী‘আত কর্তৃক অনুমোদিত সীমারেখার মধ্যে থেকেই করতে হবে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, শয়তান মানব জাতিকে প্রথম থেকেই তাদের গুরুজনের সম্মান প্রদর্শনের বৈধ পন্থা থেকে বিচ্যুত করেছে। তাদের বুদ্ধি ও বিবেককে নিয়ে শুরু থেকেই সে তামাশায় লিপ্ত হয়েছে। পরিণতিতে তাদেরকে সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িতে নিমজ্জিত করেছে। শীছ আলাইহিস সালাম-এর সন্তানদেরকে আদম আলাইহিস সালাম-এর কবরের চার পার্শ্বে ত্বওয়াফে লিপ্ত করেছে[1]।
ওয়াদ্দ, সুয়া‘, য়াগুছ, য়া‘উক ও নছর এর অনুসারীদেরকে দিয়ে তাঁদের সম্মান, স্মরণ ও আল্লাহর উপাসনায় আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষের আকৃতিতে হাজির হয়ে তাঁদের মূর্তি নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়েছে এবং মূর্তি নির্মাণ করে দিয়েছে। অতঃপর তিন প্রজন্ম যেতে না যেতেই জনগণকে আল্লাহর নিকট সে পাঁচ জনের শাফা‘আত প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় আকাঙ্ক্ষিত করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় তাদেরকে সে পাঁচ জনের উপাসনায় লিপ্ত করেছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, নবী ও সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করেই মানুষেরা প্রারম্ভে শির্কের মধ্যে পতিত হয়েছে। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এ প্রসঙ্গে বলেন:
‘‘এটিই হচ্ছে সাধারণ মানুষদের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার শ্রেষ্ঠ কারণ। আর বিশেষ লোকদের শির্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ হলো: তারা সে সব তারকার কাল্পনিক মূর্তি নির্মাণ করেছিল যাদের এ পৃথিবী পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রভাব রয়েছে বলে তারা ধারণা করেছিল এবং এ সকল মূর্তির জন্য গৃহ নির্মাণ করেছিল, এর জন্য খাদেম ও রক্ষী নিয়োগ করেছিল, এর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য হজ্জ ও কুরবানীর প্রচলন করেছিল। প্রাচীন ও আধুনিক কালের মানুষের মাঝে এর প্রচলন যথারীতি বর্তমান রয়েছে।’’[2]
আদম সন্তানদের সাথে শয়তানের খেলা এ পর্যন্তই শেষ হয়ে যায় নি; বরং সে সকল দিক থেকেই তাদেরকে তার বেড়াজালে আবদ্ধ করেছে। অবশেষে সে তাদেরকে কা‘বা শরীফের আঙ্গিণায় ছড়িয়ে থাকা পাথরের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করতে শিখিয়েছে। তাই তারা মক্কার বাইরে বসবাসের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় তাদের সাথে কা‘বা শরীফের আঙ্গিণার একটি পাথর বহন করেছে এবং বসবাসের স্থানের এক পার্শ্বে সে পাথরটি যত্নের সাথে রেখে কা‘বা শরীফের ন্যায় এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করেছে।
সাথে পাথর নিয়ে না গেলে অবতরণ স্থলের একটি সুন্দর পাথর বেছে নিয়ে এক স্থানে তা যত্নের সাথে রেখে দিয়ে এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করেছে। এমনকি উপত্যকায় পাথর না পেলে মাটি বা বালু একত্রিত করে এর উপর ছাগলের দুগ্ধ দোহন করে তা শুকিয়ে জমাট বেঁধে শক্ত হওয়ার পরে এর চার পার্শ্বেও ত্বওয়াফ করেছে। শয়তান তাদেরকে এ ধারণা দিয়েছে যে, এভাবে পাথর বা বালুর পার্শ্ব দিয়ে প্রদক্ষিণ করলে তারা কা‘বা শরীফের পার্শ্বে ত্বাওয়াফ করার ন্যায় পুণ্য লাভে ধন্য হবে। এটিই ছিল দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী বলে দাবীদারদের ধর্মীয় অবস্থা।
একইভাবে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ইতিহাসও নবী ও সালেহীনদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িতে পরিপূর্ণ ছিল। শয়তান তাদেরকে নবী ও সালেহীনদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এতই বাড়াবাড়িতে নিমজ্জিত করেছিল যে, তারা নবীগণের সাথে সংশ্লিষ্ট নিদর্শনাদি অন্বেষণ করে সে-গুলোকে ছোট ও বড় গির্জায় রূপান্তরিত করেছিল। উম্মুল মু’মিনীন আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইথিওপিয়ায় দেখা একটি গির্জা এবং তাতে চিত্রাকারে যে সব ভাস্কর্য রয়েছে সেগুলোর কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললেন। তিনি তা শুনে বলেন :
«أُولٰئِكَ إِذَا مَاتَ فِيْهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ أَوْ الْعَبْدُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلٰى قَبْرِه مَسْجِداً وَصَوَّرُوْا فِيْهِ تِلْكَ الصُّوَرَ،أُولئِكَ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللهِ»
‘‘ঐ সকল খ্রিষ্টানরা তাদের মধ্যকার কোন সৎ মানুষ মারা গেলে সে লোকের কবরের উপর মসজিদ (গির্জা) নির্মাণ করতো এবং সে মসজিদের দেয়ালে তাঁদের ছবি অঙ্কন করতো, আল্লাহর দৃষ্টিতে এরা সব চেয়ে নিকৃষ্ট জাতি।’’[3]
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা মতে সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এ ধরনের অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন করাই হচ্ছে অতীতের বিভিন্ন জনপদের শির্কে নিমজ্জিত হয়ে ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ। উম্মতে মুহাম্মদী যাতে এ ধরনের কর্মে লিপ্ত না হয়, সে জন্য তিনি তাঁর উম্মতকে সতর্ক করে বলেছেন :
«إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ، فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ»
‘‘সকল ক্ষেত্রে শরী‘আত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করা থেকে তোমরা নিজেদেরকে বিরত রাখবে কারণ; এ সীমা অতিক্রম করাই তোমাদের পূর্বেকার জনপদের ধ্বংস করেছে।’’[4]
দ্বিতীয় কারণ : পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ :
নবী-রাসূল ও সৎ মানুষদের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত করে শির্ক করার পাশাপাশি মানুষের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার অপর কারণ হচ্ছে- বাপ-দাদা ও চৌদ্দপুরুষের অন্ধ অনুসরণ। এর ফলে তারা পূর্বপুরুষদেরকে যে সকল কর্মকাণ্ড করতে দেখেছে সেটাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছে। পূর্ব পুরুষদের কাজগুলো সুস্থ বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না, মুহূর্তের জন্যেও তারা তা ভেবে দেখতে রাজি হয় নি। উদাহরণস্বরূপ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর জাতির লোকদের কথাই বলা যায়, তিনি যখন তাদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে একটু ভাবতে বললেন, আরো বললেন : তোমরা যে সকল মূর্তির পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করে এবং প্রয়োজনের সময় আহ্বান করে যাদের উপাসনা করছো, তারা কি তোমাদের ডাক শুনতে পায়, অথবা তারা কি তোমাদের কোন কল্যাণ বা ক্ষতি করতে পারে? তখন তারা এ বিষয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই এক বাক্যে বলেছিল :
﴿بَلۡ وَجَدۡنَآ ءَابَآءَنَا كَذَٰلِكَ يَفۡعَلُونَ﴾ [الشعراء: ٧٤]
‘‘আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এমনটি করতে পেয়েছি।’’[5]
তাদের এ বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে : তারা যা করছে তা সঠিক কি না, এ নিয়ে তাদের ভাববার কোনো অবকাশ নেই। তাদের দেব-দেবীগুলো তাদের ডাক শ্রবণ করে কি না বা এরা বাস্তবে তাদের কোনো লাভ বা ক্ষতি করতে পারে কী না, তাও খতিয়ে দেখার তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা বংশ পরম্পরায় এদের উপাসনার বিষয়টি পেয়ে এসেছে। আর এ পাওয়াটুকুই তাদের নিকট এদের উপাসনা করা সঠিক বলে প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই তাদের অনুসরণ করা থেকে তারা বিন্দু পরিমাণও বিচ্যুত হতে প্রস্তুত নয়!
অনুরূপভাবে মূসা আলাইহিস সালাম-এর জাতির দিকে তাকালেও একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। তিনি তাঁর জাতির লোকদেরকে যখন তাদের দেবতাদের পূজা করা ছেড়ে দিতে বলেন, তখন তারাও বলেছিল:
﴿أَجِئۡتَنَا لِتَلۡفِتَنَا عَمَّا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَا﴾ [يونس: ٧٨]
‘‘তুমি কি আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে আমরা যা করতে পেয়েছি তাত্থেকে আমাদেরকে বিমুখ করার জন্য আগমন করেছ।’’[6]
বিবেকের বিচারে তাদের কর্মের সঠিকতা যাচাই করা ছাড়াই এরাও একইভাবে নিজেদের পিতৃপুরুষদের অন্ধ অনুকরণে সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছে।
একইভাবে আমরা যখন মক্কার মুশরিকদের দিকে লক্ষ্য করি, তখনও দেখতে পাই যে, এরাও কা‘বা শরীফ ও অন্যান্য স্থানে রাখা মূর্তিসমূহের উপাসনা করার ক্ষেত্রে তাদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করেছে। এরাও অতীত জাতির লোকদের ন্যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছে :
﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ٱتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ بَلۡ نَتَّبِعُ مَا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ ﴾ [لقمان: ٢١]
‘‘যখন তাদের বলা হয় : আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তা অনুসরণ করো, জবাবে তারা বলে : আমরা বরং তারই অনুসরণ করবো যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি।’’[7]
এদের ব্যাপারে আল্লাহ অন্যত্র বলেন :
﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ قَالُواْ حَسۡبُنَا مَا وَجَدۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ ﴾ [المائدة: ١٠٤]
‘‘যখন তাদের বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে দিকে ও রাসূলের দিকে তোমরা এসো, তখন তারা বলে: আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে আমরা যা করতে পেয়েছি, তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’’[8]
মূর্তি পূজার কারণ :
মূর্তি পূজার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, অতীতের সাধারণ এবং বিশেষ লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়েছিল। সাধারণ ধার্মিক লোকেরা মৃত সৎ লোকদের সম্মান করতে যেয়ে তাঁদের মূর্তি তৈরী করেছিল, আর বিশেষ অধার্মিক লোকেরা এ জগতের তারকারাজির প্রভাবে বিশ্বাসী হয়ে সে সব তারকার কাল্পনিক মূর্তি তৈরী করে এগুলোর সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম বলেন:
‘‘সাধারণ মানুষদেরকে যে কারণটি মূর্তি পূজা করতে উৎসাহিত করেছে তা হলো, মৃতদের সম্মান প্রদর্শন (تعظيم الموتى) করা। কারণ; মূলত এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা মৃত ব্যক্তিদের আকৃতিতে মূর্তি নির্মাণ করেছিল। আর যে বিষয়টি বিশেষ লোকদেরকে নক্ষত্রের মূর্তি তৈরী করে এর উপাসনা করতে উৎসাহিত করেছিল, তা হলো : নক্ষত্রসমূহের সম্মান প্রদর্শন (تعظيم الكواكب) করা। উদাহরণস্বরূপ সূর্য দেবতার পূজারীদের কথাই বলা যায়, তারা সূর্যের ব্যাপারে এ-ধারণা করে যে, এটি হচ্ছে আকাশের রাজা এবং এটি একটি ফেরেশতা। তার রয়েছে আত্মা, বুদ্ধি ও বিবেক। এটিই হচ্ছে সকল নক্ষত্রপুঞ্জ ও চাঁদের আলো প্রদানের মূল উৎস ...কাজেই এর সম্মান পাওয়ার মত যোগ্যতা রয়েছে। এ কারণেই সূর্য পূজারীরা সূর্যোদয়, দ্বিপ্রহর ও তা অস্ত যাওয়ার সময় তাকে সেজদা করে থাকে।’’[9]
আমার মতে প্রচীনকালের লোকদের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার জন্য মৃত সৎ মানুষ ও নক্ষত্র সমূহের মূর্তির সম্মান প্রদর্শন করাকে কারণ হিসেবে দায়ী করা গেলেও পরবর্তী লোকদের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার জন্য শুধু সে কারণই দায়ী নয়, বরং এর সাথে তাদের বিশ্বাসগত আরো নানাবিধ কারণ সংযুক্ত হয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে :
তৃতীয় কারণ : দেব-দেবীরা কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করা :
তারা তাদের দেব-দেবীদেরকে মানুষের কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের ব্যাপারে সামর্থ্যবান বলে মনে করতো। এ ধারণার ভিত্তিতেই তারা তাদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো। বৃষ্টি না হলে তারা এদের কাছে বৃষ্টি কামনা করতো এবং বৃষ্টি হলে তা এদেরই দান বলে মনে করতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেব-দেবীদের সমালোচনা করেন বলে তাঁকে যে কোনো সময় দেব-দেবীদের অনিষ্টের শিকার হওয়ার ব্যাপারেও তারা ভয় প্রদর্শন করতো। দেব-দেবীদের অকল্যাণের ভয়ে তাদের নামে মিথ্যা শপথ করা থেকে বিরত থাকতো... ইত্যাদি।
চতুর্থ কারণ : দেব-দেবীদের আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মাঝে মাধ্যম বলে মনে করা :
তারা অলি ও ফেরেশতাদের নামে নির্মিত মূর্তিসমূহকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করতো। তাদের মধ্যস্থতায় আল্লাহর নিকট থেকে পার্থিব কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণ কামনা করতো। এদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য এদের উপাসনা করতো।
পঞ্চম কারণ : দেব-দেবীদেরকে শাফা‘আতকারী বলে মনে করা
তারা তাদের দেব-দেবীদেরকে সাধারণ মানুষদের জন্য আল্লাহর নিকট শাফা‘আতকারী বলে মনে করতো। এদের শাফা‘অতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে পার্থিব কল্যাণ প্রাপ্তির জন্য এদের কাছে তাদের প্রয়োজনের কথা জানাতো। এছাড়াও আরো কতিপয় কারণ রয়েছে যা নিয়ে সুক্ষ্ণভাবে চিন্তা করলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর প্রেরিত ধর্মে বিশ্বাসীদের মাঝে শির্ক সংঘটিত হওয়ার জন্য উপর্যুক্ত কারণসমূহই বিশেষভাবে দায়ী। আর যারা আল্লাহর প্রেরিত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল না, তারা চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্রকে তাদের জীবনের বিবিধ ক্ষেত্রে উপকারী মনে করার কারণে এদের সম্মান করতে যেয়ে বিভিন্ন উপায়ে সেগুলোর উপাসনা করেছে।
>[2]. ইবন কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লাহফান; ২/১৭৪।
[3].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুস সালাত, বাব নং ১৪, হাদীস নং ৪১৭; ১/১৬৪; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মাসাজিদ, বাব নং ৩, হাদীস নং ৫২৮; ১/৪৫০; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/৪৭।
[4].নাসাই, প্রাগুক্ত; বিতাবুল মানাসিক, বাব : বয়ানু ইলতেকাতিল হাসা; ৩/২১৮; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/২১৫।
[5].আল-কুরআন, সূরা শু‘আরা : ৭২।
[6]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ৭৮।
[7]. আল-কুরআন, সূরা লুকমান : ২১।
[8]. আল-কুরআন, সূরা মায়েদাহ্ : ১০৪।
[9]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লাহফান; ২/১৭৪, ১৭৫।
শির্ক অপরাধটি সকল অপরাধের মধ্যে একটি নিকৃষ্ট অপরাধ। এর পরিণতি খুবই ভয়াবহ। কারণ, তা যদি শির্কে আকবার এর অন্তর্গত হয়, তাহলে এটি তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণভাবে বহিস্কার করে দিবে। আর তা যদি শির্কে আসগার এর অন্তর্গত হয়, তবে এটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বহিস্কার না করলেও এত্থেকে সতর্কতা অবলম্বন না করলে এটিও মানুষের পরকালীন মহা বিপদের কারণ হতে পারে।
পৃথিবীর আদি মানুষেরা প্রারম্ভে তাওহীদে বিশ্বাসী ছিল; কিন্তু তাদের চির শত্রু শয়তানই তাদেরকে এক্ষেত্রে মতবিরোধে লিপ্ত করেছে। ফলে তাদের কিছু সংখ্যক লোক তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকলেও অবশিষ্টরা বিবিধ কারণে মুশরিক এবং নাস্তিকে পরিণত হয়েছে।
মানুষের মাঝে তাওহীদী চিন্তাধারা পুনরায় চালু করার জন্য মহান আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু যখনই মানুষেরা তাঁদের শিক্ষা থেকে দূরে চলে গেছে তখনই তারা পুনরায় শির্কে নিমজ্জিত হয়েছে।
প্রারম্ভে যখন নবী ও অলিদের সম্মান প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে শির্ক সংঘটিত হয়, তখন তা ইবাদত তথা আল্লাহর উলূহিয়্যাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল;কিন্তু কালের পরিক্রমায় তা জ্ঞান (علم), পরিচালনা (تصرف) ও অভ্যাস (عادات) তথা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আরব জনপদে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন, তখন তাঁর জাতির শির্ক আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে সমভাবে বিরাজমান ছিল। তারা আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের সাথে সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যসমূহের কোনো কোনো বৈশিষ্ট্যে তাদের দেব-দেবীদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিল।
তাদের কোনো কোনো দেবতা ছিল অতীতের সৎ মানুষের মূর্তি বিশেষ। তারা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করতো। আল্লাহর সাথে ফেরেশ্তাদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে মনে করে লাত, ‘উয্যা ও মানাত নামে মনগড়া তিনজন ফেরেশ্তাকে উদ্দেশ্য করে তিনটি দেবী গ্রহণ করেছিল। সেগুলোকে তারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম হিসেবে মনে করতো। অনুরূপভাবে সেগুলোকে তাদের পার্থিব কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য আল্লাহর নিকট শাফা‘আতকারী বলেও মনে করতো। এ দু’টি ধারণাকে কেন্দ্র করে তারা বিভিন্নভাবে এদের উপাসনাও করতো; যদিও লাত নামের পাথর সর্বস্ব দেবীটি একজন সৎ ইয়াহূদী ব্যক্তির বসার স্থানের উপর নির্মিত হয়েছিল। আর ‘উয্যা’ নামের দেবীটি তিনটি ছোট-বড় আকারের বাবলা গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল; যার মধ্যে একটি জিন-পরী বাস করতো এবং এ-জিনই সাধারণ জনগণকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করতো। অনুরূপভাবে বিভিন্ন স্থানে তাদের আরো কতিপয় গৃহ ছিল, যেগুলোকে তারা কা‘বা শরীফের ন্যায় মর্যাদার অধিকারী ও পবিত্র বলে জ্ঞান করতো।
আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাদের ও সকল বিশ্ববাসীর জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন এবং তিনি তাদেরকে সকল দেব-দেবী ও প্রতিমা পূজা পরিত্যাগ করতে বলেন, তখন তারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল এ দলীলের ভিত্তিতে যে, তারা ইব্রাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের অনুসারী এবং আল্লাহর গৃহের রক্ষক এবং তারাই রয়েছে সঠিক দ্বীন ও সত্য ধর্মের উপর। কারণ, তারা কা‘বা শরীফের ত্বওয়াফ করে, হজ্জ ও ‘উমরা করে, হাজীদের পানি পান করায় ও তাদের সেবা করে। আর মূর্তি পূজা পরিত্যাগ করবে না এ কারণে যে, তারা তাদের পূর্ব পুরুষদেরকে এ সব দেব-দেবীদের পূজা করতে দেখেছে। তাই এদের পূজা করাও দ্বীনে ইব্রাহীমেরই অংশ।
মহান আল্লাহ তাদের এ জাতীয় বক্তব্যের জবাবে পরিষ্কার ভাষায় তাদেরকে জানিয়ে দিলেন- তারা তাদের দেব-দেবীদের আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম ও শাফা‘আতকারী হওয়ার ধারণার ভিত্তিতে এদেরকে কেন্দ্র করে যে সব কর্ম করে থাকে, সে সব কর্মের কারণে তারা তাঁর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে শির্কে লিপ্ত হয়েছে। এর ফলে তারা দ্বীনে ইব্রাহীম থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে গেছে। তারা কাফির ও মুশরিকে পরিণত হয়েছে। তারা তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যে সব উপাসনা ও সৎকর্ম করছে, তাঁর কাছে সেগুলোর আদৌ কোনো মূল্য নেই। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে মুশরিকদের মিথ্যা দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতকে তাওহীদ ও শির্ক পরিচয়ের জন্য প্রয়োজনীয় দলীল প্রমাণাদি পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে তাদেরকে সুস্পষ্ট দ্বীন এবং সরল ও সঠিক রাস্তার উপর রেখে গেছেন। কেবল ধ্বংস প্রাপ্ত লোকজন ব্যতীত আর কেউই এ পথ থেকে ভ্রষ্ট হতে পারে না।
প্রথম পরিচ্ছেদ
বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের প্রাক্কালে জনগণ কর্তৃক তা গ্রহণের ধরন ও প্রকৃতি
বাংলাদেশের মুসলিমদের মাঝে শির্কের বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কে অবগত হওয়ার বিষয়টি অনেকটা এ দেশে ইসলাম প্রবেশকালীন সময়ে এখানকার মানুষের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং জনগণ কর্তৃক তা গ্রহণ করার ধরণ ও প্রকৃতি অবগত হওয়ার উপরে নির্ভরশীল। সে জন্য নিম্নে উপর্যুক্ত বিষয়াদি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করা হলো।
বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের প্রাক্কালে এখানকার ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থাঃ
বর্তমান বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ও সার্বভৌম এ দেশটি অতীতে ভারত উপমহাদেশের একটি অংশ ছিল। ১৭৫৭ সালে এদেশে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। অতঃপর ১৯৪৭ সালে তা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান নামে ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর পর ১৯৭১ সালে তা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমানে জনসংখ্যার দিক থেকে এ দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
এদেশটি পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে হিন্দু প্রধান দেশ ভারতের দ্বারা বেষ্টিত। এর দক্ষিণে রয়েছে মায়ানমার ও বঙ্গোপসাগর। এর আয়তন হচ্ছে ৫৫৫৯৮ বর্গ মাইল। এর জনসংখ্যার প্রায় ৯০% মুসলিম। সুদূর অতীত কাল থেকেই এ দেশের মানুষ মানব রচিত বিভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত ছিল। এ সব ধর্মের মধ্যে বহুল প্রচলিত ধর্ম ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম। তারা এ দু’টি ধর্মের বিভিন্ন রাজা-বাদশা এবং উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু ব্রাহ্মণদের দ্বারা সর্বদাই নির্যাতিত ও শোষিত ছিল। এ ছাড়াও সাধারণ লোকেরা হিন্দু ধর্মের বর্ণ বৈষম্য ও সামাজিক বিভিন্ন নিয়ম কানুনের দ্বারা নিপীড়িত ও অত্যাচারিত ছিল।
ঠিক এমনই এক যুগ সন্ধিক্ষণ ও পরিবেশে এদেশে ইসলামের শুভাগমন ঘটে। হিজরী প্রথম শতকে যদিও কোনো কোনো আরব বণিকদের মাধ্যমে এদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়,[1] তবে খ্রিষ্টাব্দ অষ্টম ও নবম শতকেই এদেশে ইসলাম প্রবেশ করেছে বিপুল সমারোহে। বণিকগণ চট্রগ্রামের তৎকালীন সামুদ্রিক বন্দর দিয়ে সে এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন এবং সেখানে তারা নিজেদের জন্য একটি উপনিবেশ তৈরী করে সেখান থেকেই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন।
এমনকি ১৭২ হিজরী সনে খলীফা হারুনুর রশীদের শাসনামলে তারা নদী পথে বর্তমান রাজশাহী জেলার পাহাড়পুর অঞ্চলেও পৌঁছেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।[2] তাদের সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দাওয়াতে এদেশের সাধারণ জনগণ প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তবে সে সময়ে যারা এ সব এলাকায় এসে ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়েছিলেন, আজ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে তাদের কারোরই নাম জানা সম্ভবপর হয় নি।
এরপর খ্রিষ্টাব্দ একাদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর এ সুদীর্ঘ সময়ে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তৎকালীন ইসলামী দেশসমূহের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষত আরব, ইয়ামন, ইরান, খুরাসান ও এশিয়া মাইনরের মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর ভারত থেকে বহু আলিমে দ্বীন ও ওলিগণ এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন যুগে ধারাবাহিকভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেছিলেন।[3] এ দীর্ঘ সময়ে ইসলাম প্রচারের এ যুগটিকে মোট তিন যুগে বিভক্ত করা যায় :
১. প্রাথমিক যুগ বা শৈশবকাল : খ্রিষ্টাব্দ একাদশ শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এ যুগটি বিস্তৃত ছিল।
২. যৌবন কাল : খ্রিষ্টাব্দ ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এ যুগটি বিস্তৃত ছিল।
৩. পতনের যুগ : খ্রিষ্টাব্দ পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ যুগে বিভিন্ন কারণে ইসলামের প্রচার ও প্রসার দুর্বল হয়ে পড়ে।
তাঁদের ইসলাম প্রচারের পদ্ধতি :
এ তিন যুগের ইসলাম প্রচারকগণ তাঁদের কর্মের পদ্ধতিগত দিক থেকে দু’ভাগে বিভক্ত ছিলেন। তাঁদের একদল ‘আবেদ’ নামে পরিচিত ছিলেন। এঁরা যুদ্ধের পথ পরিহার করে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় জনগণকে ইসলামের পথে আহ্বান জানাতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যদের মাঝে রয়েছেন শাহ সুলতান বলখী, যিনি প্রারম্ভে ঢাকার হরিরামপুরে এবং পরে ৪৩৯ হিজরীতে বর্তমান বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ে এসে ইসলাম প্রচার করেন। এ নীতির উল্ল্যেখযোগ্যদের মধ্যে আরো রয়েছেন শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী, যিনি ৪৪৫হিঃ/১০৫০ সালে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার ‘মদনপুর’ এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। মুঘল সম্রাট শাহ জাহানের আমলে ১০৮২/১৬৭১ সালে তাঁর নির্দেশে সেখানে তাঁর কবর নির্মাণ করা হয়।
এঁদের মধ্যে আরো রয়েছেন শেখ জালাল উদ্দিন তবরেযী, যিনি বাংলাদেশে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর এ দেশে আগমন করেছিলেন এবং ৬২২হিঃ/১২২৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এঁদের মধ্যে আরো রয়েছেন শাহ নেয়ামত উল্লাহ (মৃত ১০৭৫হিঃ/১৬৬৪ খ্রি.) এবং শেখ ফরীদ উদ্দিন ও অন্যান্য বহু দরবেশগণ।[4]
ইসলাম প্রচারকদের দ্বিতীয় দল ‘গাযী’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে যুদ্ধের পথ অবলম্বন করেছিলেন। তাঁদের মাঝে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন :
‘বাবা আদম শাহী’ যিনি ১১৫৭-১১৭৯ সালের মধ্যে তৎকালীন হিন্দু রাজা ‘বলরাম সেন’-এর আমলে ঢাকার ‘বিক্রমপুর’ এলাকায় এসে ইসলাম প্রচার করেন।
তন্মধ্যে আরো রয়েছেন : ‘মাখদুম শাহ দৌলা শহীদ’ যিনি খ্রিষ্টাব্দ ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পাবনা জেলার ‘শাহজাদপুর’ এলাকায় আগমন করেছিলেন।
আরো রয়েছেন : ‘শাহ তুরকান শহীদ’ যিনি তৎকালীন বাংলাদেশে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গাযী হিসেবে বগুড়া জেলায় আগমন করেছিলেন।
আরো রয়েছেন : ‘সৈয়দ আহমদ কাল্লা শহীদ’, উলূগই আ‘জম জা‘ফর খাঁন গাযী (মৃত- ৭১৩হি), শাহ জালাল (মৃত ৯৭০হি:/১৫৬২ খ্রি.) এবং অন্যান্য গাজীগণ।[5]
এ দীর্ঘ সময়ের মাঝে আগত এ সকল ‘আবিদ, যাহিদ (দুনিয়া বিরাগী) আলেম ও গাযীদের সততা, নিষ্ঠা ও চরিত্র মাধুর্যতা এবং তাঁদের দ্বারা প্রকাশিত কারামতসমূহ (অলৌকিক কার্যকলাপ) পর্যবেক্ষণ করে এ দেশের সাধারণ লোকেরা প্রভাবিত হয়ে দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করেছিল।
জনগণের ইসলাম গ্রহণের ধরণ ও প্রকৃতি:
জনগণের ইসলাম গ্রহণের অবস্থাকে বিচার ও বিশ্লেষণ করলে তাদেরকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়। তাদের প্রথম ভাগে রয়েছেন এমন সব লোকেরা যারা ইসলামকে ভাল করে বুঝে-শুনে, অত্যন্ত চিন্তা-ভাবনা করে তা একটি সত্য ও সঠিক ধর্ম হিসেবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই তাতে প্রবেশ করেছিলেন এবং এর সাথে সাথে তারা তাদের অতীত ধর্মের যাবতীয় শির্কী বিশ্বাস ও ধর্মীয় কুসংস্কার সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে তাওহীদী চিন্তা ও চেতনায় বিশ্বাসী হয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় ভাগে রয়েছেন এমন সব লোক যারা তাদের অতীত ধর্মের বিবিধ বিশ্বাসের উপর বহাল থেকে শুধুমাত্র সে-সব বিশ্বাসের নাম পরিবর্তন করে ইসলামে প্রবেশ করেছিলেন। তাদের পরিবর্তিত বিশ্বাসের মধ্যে ছিল- ব্রহ্মা দেবতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আকৃতিতে অবতার হয়েছেন এবং বিষ্ণু দেবতা রাসূল রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।[6]
সে সময়ে ভারত উপ-মহাদেশের সাধারণ মানুষের ইসলাম গ্রহণের প্রকৃতি বর্ণনা প্রসংগে গোপাল হালদার বলেন : ‘‘আর ইহাও আমরা জানি যে, এই নতুন ইসলামকে জনসাধারণ স্বভাবতই তাহাদের পূর্ব পরিচিত জিনিষের আঁধারে ঢালিয়া সাজাইতেছিল। নিরঞ্জন হইতেছিলেন আল্লাহ, বৌদ্ধ দেবতারা হইতেছিলেন মুসলিমদের পীর, স্তুপ হইতেছিল দরগাহ, পুরাতন দেবলীলার কাহিনী নতুন পীরের কেচ্ছায় পরিণত হইতেছিল।... ইহাই ছিল ভারতীয় ইসলামের একটা জনগ্রাহ্য রূপ।’’[7]
এ ধরনের মুসলিমরা নতুন জীবনের, নতুন চেতনার, নতুন সংস্কৃতির, নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টিতে কুরআন ও সুন্নাহর আলোর পথে চলার পরিবর্তে শুধুমাত্র লেবাছ পরিবর্তন করেছিল। প্রার্থনার স্থান ও ভাষা পরিবর্তন করেছিল। হিন্দু নামের পরিবর্তে মুসলিম নাম রেখেছিল মাত্র। ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরেছিল, উত্তরীয় রেখে টুপি নিয়েছিল, জলের বদলে পানি বলেছিল, মন্দিরের পরিবর্তে মসজিদে এসেছিল, শশ্মানের পরিবর্তে গোরস্থানে এসেছিল। ব্যস এ পর্যন্তই। তাওহীদের মর্মকথা, আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও তাওহীদ, তার অস্তিত্ব, ক্ষমতা, সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে ব্যবধান কী, এ সব তারা জানতে পারে নি। ফলে তারা আল্লাহ ও ভগবানের মধ্যে কী তফাৎ রয়েছে তা জানতে পারে নি। পার্থক্য এটুকু ছিল যে, পূর্বে তারা রাম মূর্তির কাছে ধর্ণা দিতো, এখন তারা মুসলিমের মৃত ওলি আওলিয়ার কবরে হাঁটুগেড়ে মাথা লুটিয়ে প্রার্থনা জানাতে লাগলো।
সে কালের মুসলিমরা যে ইসলামকে হিন্দু সংস্কৃতির আঁধারে ঢেলে সাজিয়েছিল, তা সে সময়কার বিভিন্ন কবি ও সাহিত্যিকদের লেখনীর মাঝেও প্রতিভাত হয়ে উঠেছিল।[8] তারা মক্কা ও মদীনাকে ঠাকুর জগন্নাথ ও কাশীধ্যামের সাথে তুলনা করতেও দ্বিধাবোধ করে নি।[9] তারা কর্মের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা আর শ্রীবিষ্ণু বলাকে একই মনে করতেন। এমনকি আল্লাহ, রাম ও রহীম এ দু’অংশে বিভক্ত বলেও বিশ্বাস করতেন।[10]
সে সময়কার সাধারণ মুসলিমদের চিন্তা, চেতনা ও কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় তারা মুসলিম হয়েছিল ঠিকই, তবে কেনইবা তারা মুসলিম হলো, ইসলামী সংস্কৃতি আর হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃতির মাঝে তফাৎটা কোথায়, তা তারা বুঝে উঠতে পারেন নি। অতীতে তারা যেমন তাদের দেব-দেবীদেরকে তাদের এবং ভগবানের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী এবং বিভিন্ন রকমের কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক বলে ভাবতো, মুসলিম হয়েও তেমনি তারা মুসলিম ওলি ও দরবেশদেরকে সে সব কিছুর মালিক বলে ভাবলো। এ অবস্থা শুধু যে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং এ অবস্থা তৎকালীন সকল মুসলিমদের ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও বিস্তৃত ছিল। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আকরম খাঁ বলেন :
‘‘হিন্দু ধর্ম সংস্কৃতিকে এইভাবে আদর্শরূপে গ্রহণ করার এবং এই আদর্শের ছাঁচে নিজেকে গড়ে তোলার এই প্রবণতা শুধুমাত্র কবি, সাহিত্যিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নাই, মুসলিমদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের সর্বস্তরে ইহা সঞ্চারিত ও উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করিয়া চলিয়াছিল। ইহার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে জলদেবতা বরুণ পীর বদরে, গৌরচন্দ্র গোরচাঁদ পীরে, ওলাই চন্দ্রী-ওলাবিবিতে, সত্যনারায়ণ সত্যপীরে, লক্ষীদেবী মা বরকতে রূপান্তরিত হন। আর এই রূপান্তরিত দেবদেবীগণ মুসলিমদের নিকট তাহাদের প্রাপ্য পূজা ও শ্রদ্ধা অব্যাহতভাবেই পাইতে থাকেন। তদুপরি এই সমস্ত রূপান্তরিত দেবতা বা পীর ছাড়াও বহু পীরের কল্পিত কবর এবং কোনো কবরের সহিত সম্পর্ক রহিত কল্পিত পীরও মুসলিমদের নিকট হইতে পূজা, উৎসর্গ, সিন্নি, মোমবাতি ইত্যাদি লাভ করতে থাকেন। অনেক খানকাহ ও দরগাহ এখানে মুসলিমদের সুখ সমৃদ্ধি এবং বিপদ আপদ হইতে উদ্ধার লাভের উপলক্ষ্যরূপে দীর্ঘকাল তাহাদের আল্লাহর স্থান দখলকারীর ভূমিকায় এবং আংশিকভাবে অদ্যাবধি সেই স্থানই তারা দখল করিয়া আছে।”[11]
এ তো হলো সাধারণ মুসলিমদের অবস্থা। অপর পক্ষে যারা ইসলামকে একটু বুঝে শুনে সঠিকভাবে ঈমান এনেছিলেন, তাদের ব্যাপারে আমাদের হাতে এমন কোনো দলীল প্রমাণাদি নেই যা এ কথা প্রমাণ করে যে, তারা তাওহীদকে এর প্রকারাদিসহ এবং শির্ককে এর কারণসমূহসহ জেনেছিলেন। আমরা যদি ধরে নেই যে, তারা এ সব বিস্তারিতভাবে জেনেছিলেন, তথাপি এ কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, শয়তান তাদের কারো মাঝে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভাল অথচ প্রকৃত অর্থে মন্দ এমন সব ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিয়েছিল, যেমনটি সে মানব জাতির পথ ভ্রষ্টতার উষালগ্নে ওয়াদ্দ, সুয়া‘, ইয়াগুস, ইয়া‘উক ও নছর এর অনুসারীদের প্রতি এ সব ছড়িয়ে দিয়েছিল।
শয়তান অত্যন্ত সন্তর্পণে তাদের মাঝে তা ছড়িয়ে না দিয়ে পারে কেমন করে? যেখানে সে তা ভারতের মুসলিম জনপদের মধ্যে এখানে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার পূর্বেই অতি সন্তর্পণে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। আর সে কারণেই আমরা মুজাদ্দিদে আলফে ছানী আল্লামা শেখ আমহদ ছরহিন্দী (রহ.)-কে (১৫৬৮-১৬২৪ খ্রি.) সে সবের প্রতিবাদ করতে দেখতে পাই। তিনি তৎকালীন ভারতের মুসলিমদের মাঝে, বিশেষ করে তাদের মধ্যকার সূফীদের অনুসারী ও মোগল সরকারের দরবারী আলিমদের মাঝে যে সকল শির্ক, বেদ‘আত ও ধর্মাদ্রোহী কর্মকাণ্ড বিস্তার লাভ করেছিল, সেগুলোর বিরুদ্ধে সংস্কারমূলক আন্দোলন গড়ে তোলেছিলেন, যার জন্যে তাঁকে হিজরী দ্বিতীয় সহস্রের মহান সংস্কারক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।[12]
সম্রাট জাহাঙ্গীর এর দরবারে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তাকে সেজদা না করার কারণে তিনি কারাবন্দী পর্যন্ত হয়েছিলেন। কারাগারে বসে তিনি তাঁর সংস্কারমূলক কর্ম চালিয়ে যাওয়ার ফলে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব দেখে জেল কর্তৃপক্ষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট এ মর্মে রিপোর্ট পেশ করতে বাধ্য হয়েছিল যে, ‘‘এ ব্যক্তির সংস্কারমূলক আহ্বানের প্রভাবে জেলখানার পশুসুলভ আচরণের মানুষগুলো মানুষে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে এবং সেখানকার মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হতে শুরু করেছে।’’[13] তাঁর এবং তাঁর এ সংস্কারমূলক আন্দোলনের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে, ‘‘সে সময়ে যদি শেখ আহমদ ছরহিন্দীর শুভাগমন না হতো, তা হলে প্রায় তিন শতাব্দী পূর্বেই ভারতের মাটি থেকে ইসলামের নাম ও এর নিদর্শন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো।’’[14]
এ প্রসঙ্গে মাওলানা আকরম খাঁ বলেন : ‘‘শেখ আহমদ ছরহিন্দী যে সংস্কারমূলক আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন শেষ পর্যায়ে এসে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (১১১৪-১১৭৬হি:) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যে সংস্কারমূলক আন্দোলন দাঁড় করেছিলেন, সে আন্দোলনের সাথে তা একীভূত হয়ে যায়। কালের পরিক্রমায় এই দুই সংস্কারকের যাবতীয় প্রচেষ্টা ‘রায়ব্রেলভী’ এর প্রখ্যাত মুজাহিদ পরিবারের সাথে এসে মিলে যায়। সৈয়দ আহমদই হলেন মুজাহিদ পরিবারের প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারত উপমহাদেশে ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা।
উল্লেখ্য যে, সৈয়দ আহমদের ভারতের মুসলিমদের স্বাধীনতা ও সংস্কারমূলক আন্দোলনের পিছনে একক লক্ষ্য ছিল মুসলিম রাজশক্তির বিনাশ এবং অমুসলিম রাজশক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে সমগ্র মুসলিম ভারতের জাতীয় জীবন স্বাভাবিকভাবে যে সব মারাত্মক অভিশাপে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিল তাত্থেকে ভারতের মুসলিম জাতিকে উদ্ধার করা। নওয়াব সুলায়মান জাহকে লেখা এক পত্রের মাধ্যমেও তাঁর এ উদ্দেশ্য ফুটে উঠেছে। সে পত্রে তিনি বলেন: ভাগ্যক্রমে এই দেশের শাসন ও রাজত্বের অবস্থা কিছুদিন হতে এরূপ হয়ে দাড়িয়েছে যে, খ্রিষ্টান ও হিন্দুগণ হিন্দুস্থানের অধিকাংশ অঞ্চলের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে এবং ঐ অঞ্চলগুলোকে অত্যাচারে, অবিচারে পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
ঐসব অঞ্চলে শির্ক ও কুফরের রীতিনীতি প্রবল হয়ে উঠেছে এবং ইসলামের অনুষ্ঠানগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে আমার অন্তর দুঃখে ও বেদনায় অভিভুত হয়ে পড়েছে, হিজরতের আগ্রহে আমার হৃদয় পূর্ণ হয়ে উঠে, ঈমানের অভিমান আমার হৃদয়কে উদ্বেলিত করে তুলে এবং জেহাদ প্রবর্তনের আগ্রহে আমার মস্তক আলোড়িত হতে থাকে।’’[15]
[2]. আব্দুল মান্নাম তালিব, বাংলাদেশে ইসলাম; (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮০ খ্রি.), পৃ. ৫৬।
[3]. তদেব; ৬৩।
[4]. শেখ ফরীদ উদ্দিন বর্তমান ফরিদপুর জেলায় আগত প্রখ্যাত ‘আবিদগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁর আগমনের সঠিক তারিখ জানা যায় নি। বলা হয়ে থাকে যে, তাঁর নামের সাথে সম্পর্ক রেখে পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলার নামকরণ করা হয়। এ আবিদের নামে ফরিদপুর জেলার কালেক্টরেট ভবনের নিকটবর্তী এলাকায় যশোর বোর্ডের নিকটতম একটি গাছের নিচে একটি দরগাহ রয়েছে। গোলাম ছাকলায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৯৮।
[5]. তদেব; পৃ. ৩৫; পীর চেহেল গাজী; (স্থান বিহীন: ১ম সংস্করণ, ১৯৬৮ খ্রি.) পৃ.।
[6]. গোলাম ছাকালায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৬; মোহর আলী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪।
[7]. গোলাম ছাকালায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৩-১৪; এ. এইচ. এম শামসুর রহমান, আপন গৃহে অপরিচিত; (খুলনা : জাহান প্রিন্টিং প্রেস, ১ম সংস্করণ, ২০০০ খ্রি.), প্রবন্ধ : ‘‘সংস্কৃতির রূপান্তর না শির্ক-বিদ‘আতের নামান্তর’’, পৃ. ৭; গোপাল হালদার রচিত ‘‘সংস্কৃতির রূপান্তর’’ গ্রন্থের পৃ. ১৯৮।
[8]. দেখুন : প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলিমদের অবদান; পৃ. ৮২। তাতে একটি কবিতা রয়েছে, যাতে আল্লাহকে ইশ্বর, আদমকে অনাদি নর, মা হাওয়াকে কালী, রাসূলকে চৈতন্য, খোআজ খিজিরকে বাসুদেব, কুরআনকে পুরান আর পীরদেরকে হিন্দুদের গুরুজনদের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
[9]. দেখুন কবি মোহাম্মদ আকবর (জন্ম ১৬৫৭ খ্রি.), পুথিকাব্য; পৃ. ৮৫। মুহাম্মদ ইউনুছ রচিত ‘‘চৌধুরী লড়াই’’ গীতির বন্দনায় তা বর্ণিত হয়েছে।
[10]. ‘নূরন্নেহর ও কবির কথা’ গীতি কাব্যে রয়েছে : ‘‘বিসমিল্লাহ ও শ্রী বিষ্ণু একই কথা। আল্লাহ দু’অংশে বিভক্ত হইয়া রাম ও রহীম হইয়াছেন’’। দেখুন : আপন গৃহে অপরিচিত; প্রবন্ধ : সংস্কৃতির রূপান্তর না শির্ক-বিদ‘আতের নামান্তর; পৃ. ৬।
[11]. মাওলানা আকরম খাঁ, মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস; (ঢাকা : আজাদ অফিস, ১ম সংস্করণ, ১৯৬৫ খ্রি.), পৃ.৮৬।
[12]. তদেব; পৃ. ১৬৭।
[13]. তদেব; পৃ. ১৪৮।
[14]. তদেব; পৃ. ১৪৯।
[15]. তদেব; পৃ. ১৫২।
তৎকালীন ভারতীয় মুসলিমদের ধর্মীয় অবস্থার অধঃপতন এখানেই শেষ নয়। আমাদের নিকট যথেষ্ট পরিমাণ এমনও তথ্য প্রমাণ রয়েছে যা এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, সৈয়দ আহমদ শহীদ এর যুগে ভারত ও বাংলার মুসলিমগণ শুধুমাত্র নাম সর্বস্ব মুসলিম ছিলেন। তারা বিশ্বাস ও কর্মে হিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় সেখানে যদি সৈয়দ আহমদ শহীদ এবং শাহ ইসমাঈল শহীদ ও তাঁদের সহযোগীদের পক্ষ থেকে সংস্কারমূলক আন্দোলন না হতো, তা হলে হয়তো বা ভারত উপমহাদেশে ইসলামের নাম ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। এ সব তথ্য প্রমাণের মধ্য থেকে নিম্নে জার্মানীর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক Hans Kohn এর “A History of Nationalism in the East” গ্রন্থ হতে সাধারণ পাঠকদের সুবিধার্থে তাঁর কিছু কথার অনুবাদ তুলে ধরা হলো। তিনি ভারতীয় মুসলিমদের ধর্মীয় অবস্থা এবং ওয়াহাবী আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও এর প্রভাব সম্পর্কে বলেন :
‘‘আফ্রিকার মত ভারত এবং সুমাত্রায়ও ওয়াহাবী আন্দোলন মুসলিমদের মধ্যে একটা উদ্দীপনাময়ী ও প্রাণ সঞ্চারক শক্তি হয়ে পড়ল এবং অস্থায়ীভাবে হলেও মুসলিম ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো। এই রাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল ইসলামের প্রথম যুগের ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া। তা ইউরোপীয় প্রভাবের বিরোধী ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে ওয়াহাবীদের নেতা ছিলেন সৈয়দ আহমদ ও হাজী মৌলভী মুহাম্মদ ইসমাঈল। মক্কায় হজ করতে গিয়ে তাঁরা ওয়াহাবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভারতীয় মুসলিমদের ধর্মীয় কলুষপরায়ণতা এবং হিন্দু রীতিনীতি ও আচার ব্যবহারের সাথে মুসলিম রীতিনীতি ও আচার ব্যবহারের মিশ্রণ দেখে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন।
তাঁরা ওয়াহাবী আদর্শে ভারতে ইসলামের সংস্কার সাধনে নিজেদের উৎসর্গ করবেন বলে সঙ্কল্প করেছিলেন। তৎকালে অনেক লোক বিশেষ করে ভারতে শুধু নামে মাত্র মুসলিম ছিল। তারা হিন্দুদের রীতিনীতি মেনে চলতো। তাদের পর্ব-পার্বনের অনুষ্ঠান করতো। বিবাহ-শাদী ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপারে তারা তাদের আইন-কানুন মেনে চলতো এবং তাদের বহু দেব-দেবীর উপাসনা করতো। ওয়াহাবীদের প্রচেষ্টায় এ সবের পরিবর্তন হতে লাগলো। ইসলামকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা হলো। ইসলামের প্রথম যুগের পবিত্র-নৈতিক দৃঢ়তা ফিরিয়ে আনা হলো এবং শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হলো...’’।[1]
তৎকালীন ভারতীয় ও বাংলাদেশী মুসলিমদের ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে Lt. Col. U. N. Mukherji Zuvi “A Dying Race” গ্রন্থে যা লিখেছেন তাত্থেকেও কিছু কথা অনুবাদ করে নিম্নে বর্ণনা করা হলো। তিনি বলেন :
‘‘পঁচাত্তর বছর আগে একজন মুসলিম কৃষক ও একজন হিন্দু কৃষকের মধ্যে সামান্যই তফাৎ ছিল। শুধু নাম ছাড়া মুসলিম কৃষক ও হিন্দুদের মধ্যে অধঃপতিত জাতের লোকের পার্থক্য করার আর কিছু ছিল না। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদেরকে হিন্দুদের একটা নীচ জাতি বলে গণ্য করা হতো। তারা সমান অজ্ঞ ও সমান দরিদ্র ছিল। তাদের আচার ব্যবহার, জীবন যাপনের ধরণ ও ধর্মাচরণ একই রকম ছিল।”
তিনি আরো বলেন : ‘‘একজন স্থানীয় লেখক দক্ষিণ বাংলার ...উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহের মুসলিম কৃষক সম্প্রদায়ের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ের অভিজ্ঞতা হতে বলেছেন- প্রতি দশজনের মধ্যে একজনও সামান্য কলেমা পর্যন্ত জানে না, অথচ জ্ঞাতে হোক আর অজ্ঞাতে হোক সর্বদা এই কলেমা পড়া মুসলিমদের একটা অভ্যাসের ব্যাপার। তিনি তাদের এমন একটি সম্প্রদায় বলে বর্ণনা করেছেন যে, যারা নিজেদের ধর্মের কোনো নিয়ম মেনে চলে না, বিধর্মীদের মন্দিরে গিয়ে পূজা করে এবং ইসলাম প্রবর্তক যে-সব রীতিনীতি অতিশয় ঘৃণ্য বলে পরিত্যাগ করেছেন, তারা তা-ই আকড়ে রয়েছে।”
এর পর সবকিছুর যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। এ সম্পর্কে হিন্দুও নন মুসলিমও নন এমন একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করাই ভাল। ভারত সরকারের ডিরেক্টর জেনারেল অব ষ্ট্যাটিষ্টিকস্ স্যার ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টারের বিবরণকে যথেষ্ট প্রামাণ্য বলে ধরা যায়। উপর্যুক্ত বিষয়ে মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন:
‘‘পঞ্চাশ বছর আগে কথাগুলোর দ্বারা শুধু উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নয়, সমগ্র বাংলার মুসলিম কৃষকদের অবস্থা বুঝানো যেতো। শুধু শহরে অথবা মুসলিম আমির ও ওমরাদের প্রাসাদের শান্ত জীবনে এবং তাদের ধর্মস্থানে নিষ্ঠাবান এবং পাণ্ডিত্যসম্পন্ন কতিপয় মৌলভী নিয়মিত ধর্মানুষ্ঠান করতেন। কিন্তু পল্লী এলাকার মুসলিম জনসাধারণ যে অবস্থার মধ্যে ছিল, তা খতনা করা নীচ হিন্দু জাতির বর্ণ শঙ্করের চেয়ে সামান্যই উন্নত ছিল। এরপর ভারতে ধর্মীয় জাগরণের ওই প্রবাহ বাংলার মুসলিমদের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল। প্রধানত উত্তরাঞ্চলের পরিব্রাজক প্রচারকগণ জেলা হতে জেলান্তরে গমন করে মুসলিমদের আবার ঈমানের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানাতে লাগলেন এবং বেখেয়াল ও অন-অনুতপ্তদের উপর আল্লাহর গজব সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দিতে লাগলেন। ফলে বহু সংখ্যক বাঙ্গালী মুসলিম পুরাপুরিভাবে হিন্দুয়ানী ত্যাগ করে শুদ্ধ হলেন এবং প্রাচীন কাল হতে গ্রামে গ্রামে যে সব আচার অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল তা ত্যাগ করলেন...।’’[2]
উপরে ভারত ও বাংলার মুসলিমদের ধর্মীয় অবস্থার সংক্ষিপ্ত যে বর্ণনা তুলে ধরা হলো, এত্থেকে তাদের ধর্মীয় অবস্থার যে কী করুণ দশা হয়েছিল, তারা যে কী পরিমাণ শির্ক, বেদ‘আত ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়েছিল, সে সবের একটা অনুমান করা যায়।
উপর্যুক্ত এ সব তথ্য প্রমাণের সাক্ষ্যদাতাগণ বহির্দেশীয় ও অমুসলিম হয়ে থাকলেও আমাদের হাতে স্বদেশীয় মুসলিম মনীষীদের পক্ষ থেকেও এ ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে, যা অমুসলিম মনীষীদের উক্ত কথার সত্যতা প্রমাণ করে। উদাহরণস্বরূপ আমরা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (১১১৪-১১৭৬হি:) এর কথা বলতে পারি। কালের পরিক্রমায় যে মুসলিমদের মাঝে শির্কী ধ্যান-ধারণা বিস্তারলাভ করেছিল, এর বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
‘‘অতঃপর যখন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী এবং তাঁর দ্বীন বহনকারীগণ বিদায় হয়ে গেলেন, তখন তাঁদের পশ্চাতে এমন সব লোকদের আগমন ঘটলো যারা সালাতকে বিদায় করে দিলো, নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে আরম্ভ করলো। কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত মুতাশাবেহ (অস্পষ্ট অর্থবোধক) শব্দসমূহকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে লাগলো, যেমন আল্লাহর বন্ধু হওয়া ও তাঁর নিকট শাফা‘আত করা- যা আল্লাহ তা‘আলা সকল শরী‘আতেই কেবল বিশেষ মানুষদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন- সেটাকে তারা ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে লাগলো। অনুরূপভাবে কারো দ্বারা অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে বা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে দেখলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে তারা (আল্লাহর) জ্ঞান স্থানান্তরিত হয়েছে এবং প্রকৃতি সে লোকের বাধ্য হয়েছে বলে মনে করতে লাগলো ...এ-জাতীয় রোগে যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের রয়েছে বিভিন্ন প্রকার : কেউবা আল্লাহকে সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়ে তাদের উপাসনায় লিপ্ত হয়েছে যাদেরকে সে আল্লাহর সমতুল্য বলে জ্ঞান করেছে।
এ কারণে তারা তাদের যাবতীয় প্রয়োজন (আল্লাহর বদলে) তাদের কাছেই পেশ করতে রয়েছে। আল্লাহর দিকে তারা মোটেও ফিরে তাকায় না...এদের কেউবা মনে করে আল্লাহ হলেন মূল পরিচালক ও সরদার, তবে কখনও তিনি তাঁর কোনো বান্দাকে মর্যাদা ও উলূহিয়্যাতের পোষাক পরিয়ে দেন, তাকে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা তা ব্যবহারের ক্ষমতা দান করেন, তাঁর বান্দাদের অভাব ও অভিযোগ শ্রবণের ক্ষেত্রে তাঁর শাফা‘আত শ্রবণ করেন, তাদেরকে রাজা-বাদশাদের প্রতিনিধির মর্যাদা দান করেন, যাদেরকে বাদশাগণ তাঁদের দেশের প্রত্যেক অঞ্চলে প্রেরণ করেন এবং তাঁদেরকে সে এলাকার ছোট ছোট বিষয়াদি পরিচালনার দায়িত্ব দান করেন।...এ ব্যাধি হচ্ছে সকল ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান ও মুশরিকদের এবং আজ পর্যন্ত যারা দ্বীনে মুহাম্মদী এর অনুসারী অথচ অতিরঞ্জিতকারী ও মুনাফিক তাদেরও রয়েছে এ ব্যাধি।’’[3]
তিনি তাঁর সমসাময়িক মুসলিমদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে আরো বলেন :
‘‘মুশরিকদের অবস্থা, তাদের বিশ্বাস ও কর্ম অনুধাবন করতে তোমার অসুবিধা হলে আমার যুগের সাধারণ ও মুর্খদের অবস্থার প্রতি নজর কর, বিশেষ করে তাদের মধ্যকার যারা ইসলামী দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করে বেলায়েতের ব্যাপারে তারা কী ধারণা পোষণ করে? অলিগণের বেলায়েতকে স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও তারা ধারণা করে যে, এ যুগে কোনো ওলি পাওয়া যাওয়া দুস্কর, তারা ওলিদের কবর ও তাঁদের নিদর্শনের স্থানসমূহে যায় এবং নানাধরনের শির্কী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়।’’[4]
বস্তুতঃ শাহ ওয়ালী উল্লাহ (১১১৪-১১৭৬ হি:) তাঁর এ-দু’টি বক্তব্যের দ্বারা পূর্বকাল থেকে আরম্ভ করে তাঁর সময় পর্যন্ত মুসলিমরা যে আক্বীদাগত বিকৃতির কারণে শির্কের মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছিল, সে বিষয়ের দিকেই তিনি ইঙ্গিত করেছেন। আউলিয়া ও দরবেশদেরকে মুসলিমরা কিভাবে আল্লাহর রুবূবিয়্যাত ও উলুহিয়্যাতে শরীক করে নিয়েছিল, সে বিষয়টি তিনি তাঁর এ-দু’টি বক্তব্যের দ্বারা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন।
পূর্ব থেকে শুরু করে শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.)এর সময়কার এক শ্রেণীর মুসলিমদের অবস্থা যদি এই হয়ে থাকে, তবে তৎকালীন বাংলার মুসলিমদের ধর্মীয় আক্বীদা-বিশ্বাসের যে কি করুণ দশা হতে পারে- তা সহজেই অনুমেয়। বস্তুতঃ তাদের আক্বীদা ও আমলের অবস্থা ধীরে ধীরে বদলে গিয়েছিল এবং ভারত ও অন্যান্য দেশের মুসলিমদের মাঝে যে সকল শির্ক, বেদ‘আত ও কুসংস্কার ছেয়ে গিয়েছিল, তা তাদের মাঝেও সমানভাবে প্রসার লাভ করেছিল। যে সকল সূফী ও সাধকগণ এ দেশে এসেছিলেন তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, কালের পরিক্রমায় সাধারণ মুসলিমগণ তাঁদের কবর ও কবরসমূহকে তাওহীদ বিনাশের একেকটি কেন্দ্রে পরিণত করেছিল।
মুসলিমদের আক্বীদা-বিশ্বাস ও চারিত্রিক অধঃপতনের যুগে সমগ্র ভারত ও বাংলায় যখন বৃটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এ দেশের মুসলিমদের ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির অবস্থা নাজুক থেকে নাজুকতর হয়ে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে গোলাম সাকলায়েন বলেন :‘‘বাংলাদেশে বৃটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পঞ্চাশ থেকে ষাট বছরের মধ্যে এখানকার মুসলিমদের ইসলামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়, অবস্থা এতই খারাপ হয়ে দাড়ায় যে, মুসলিমদের (দৈনন্দিন) জীবনে নানাবিধ বেদ‘আতী কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কার অনুপ্রবেশ করে, মুসলিমরা হিন্দুদের দেবতাদের নামে মানত এবং কবর, পীর ও কবর পূজা করতে থাকে। গাজী ও ফাতেমার নামে হালুয়া প্রদানসহ অন্যান্য ধর্মাদ্রোহী কর্ম করতে আরম্ভ করে।’’[5]
>[2]. মাওলানা আকরম খাঁ, প্রাগুক্ত;১৯৪-১৯৫। তিনি এ কথা গুলো থেকে উদ্ধৃত করেছেন। lt. Col. U. n. Mukherji, A Dying Race; p.৮৯-৯১।
[3]. শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ; ১/৬১।
[4]. শাহ ওয়ালী উল্লাহ, আল-ফাওযুল কাবীর; (দেওবন্দ : কুতুবখানা হেজায, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ. ৫১।
[5]. গোলাম ছাকালায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ২০২।
এ দেশের মুসলিমদের এ হেন অবস্থা দৃশ্যে হাজী শরী‘আত উল্লাহই (মৃত ১২৬৭হি:/১৮৫০খ্রি.) হলেন প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি পীর ও কবর পূজার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। জনগণকে তিনি তাঁর আন্দোলনের দ্বারা দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয়বিষয়াদি (فرائض الدين) সম্পর্কে জ্ঞান দান করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর এ আন্দোলন ‘ফারায়েযী আন্দোলন’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।[1] তাঁর এ আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জেমস টেইলর বলেন :
‘‘হাজী শরী‘আত উল্লাহ পীর ও কবর পূজা এবং গাজী, ফাতেমা ও অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে হালুয়া দান- এ জাতীয় যে সকল কর্মের সাথে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কোনই সম্পর্ক নেই এ সবের বিরুদ্ধে তাঁর যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যয় করেন।’’[2]
ভারত, বাংলাদেশ ও অন্যান্য মুসলিম দেশসমূহে এভাবে শির্ক, অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতা প্রসারিত হতে থাকায় এক সময় গোটা মুসলিম বিশ্ব থেকে পরিচ্ছন্ন ইসলামই পর্দার অন্তরালে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এ অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী[3] বলেছেন :
"وكاد أن يحجب الإسلام النقي حُجُبٌ من الشرك و الجهل والضلالة، طرأت على النظام الديني بِدَعٌ شغلت مكانا واسعا من حياة المسلمين وشغلتهم عن الدين الصحيح وعن الدنيا".
‘‘শির্ক, অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার বিবিধ নেক্বাব পরিচ্ছন্ন ইসলামকে আবৃত করে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। ধর্মীয় বিধানের উপরে এমন সব বেদ‘আতী কর্মকাণ্ড উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল যা মুসলিমদের জীবনের বিস্তর স্থান দখল করে নিয়েছিল, তাদেরকে সঠিক দ্বীন পালন ও দুনিয়া অর্জন করতেও বিরত রেখেছিল।’’[4]
এ প্রসঙ্গে মিসরের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাহমুদ শালতুত বলেন : ‘‘অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মত মুসলিমদের মধ্যেও একটি ভ্রান্ত চিন্তা অনুপ্রবেশ করেছে যে, রাসূলগণ ছাড়াও আল্লাহর বান্দাদের মধ্যকার এমন একদল বান্দাও রয়েছেন যাদেরকে আল্লাহ ইহজগত পরিচালনার দায়িত্ব দান করেছেন। তাঁদেরকে মানুষের দো‘আয় সাড়া দেবার যোগ্যতা দান করেছেন। সকল সৃষ্টিকে তাঁদের প্রতি মুখাপেক্ষী করে এবং বিপদের সময় তাঁদের নিকট সাহায্য চাওয়ার অধিকার দিয়ে সকলের উপর তাঁদেরকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন।
সকল মানুষের সমাধি থেকে তাঁদের সমাধিকে- এর উপর গম্বুজ নির্মাণ করা, মোমবাতি জালানো, বরকত অর্জনের জন্য তাঁদের কবরের উপর হাত বুলানো ও পর্দা টানানো ...ইত্যাদির মাধ্যমে- বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এ ছাড়াও তাঁদের উদ্দেশ্যে মানত করা যায় এবং যাবতীয় ধরনের হাদিয়া তুহফা তাঁদের নিকট পেশ করা যায়। এ জাতীয় ধ্যান-ধারণা ও কর্ম সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে যেমন বিস্তৃতি লাভ করেছে, তেমনিভাবে তা অমুসলিম সাধারণ মানুষের মাঝেও বিস্তৃতি লাভ করে।’’[5]বিভিন্ন মনীষীদের এ সব বক্তব্যের দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের দেশসহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই অধিকাংশ মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসে মারাত্মক বিকৃতি সাধিত হয়েছিল। ধর্মের নামে তারা অধর্মের কর্মে লিপ্ত হয়েছিল।
ওলীদেরকে তাঁদের উপযুক্ত স্থানে না বসিয়ে তাঁদের মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে তারা অতিমাত্রায় সীমালঙ্ঘন করেছিল। তাঁদের কবরগুলোকে শির্ক ও বেদ‘আত চর্চার আখড়ায় পরিণত করেছিল। তবে আশার কথা হলো, বর্তমানে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার পূর্বের তুলনায় অধিক হওয়াতে অবস্থার অনেকটা উন্নতি সাধিত হয়েছে। অতীতে ওলীদের কবরে গেলে যেভাবে মুসলিমদেরকে ভক্তি ও সম্মানের তাড়নায় তাঁদের কবর ও কবরে সেজদায় পড়ে থাকতে দেখা যেতো, বর্তমানে আর সে পরিমাণে দেখা যায় না। কবরে সেজদা করার বিষয়টি এখন অনেকের কাছে গর্হিত কাজ বলে মনে হলেও ওলীদের ব্যাপারে তাদের মনে অতিরিক্ত যে সব ধ্যান-ধারণা পূর্ব থেকে লালিত ছিল তা শুধু দেশের সাধারণ মুসলিমদের মধ্যেই নয় অনেক বিজ্ঞ লোকদের মাঝেও তা যথারীতি বিদ্যমান রয়েছে।
>[2]. আব্দুল মান্নান তালিব, প্রাগুক্ত; পৃ. ২০২।
[3]. আল্লামা আবুল হাসান ‘আলী নদভী বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠতম বিদ্বান। তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদ এর অধঃস্তন বংশধর। বিভিন্ন বিষয়ের উপর তাঁর লিখিত একশতেরও অধিক গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :
الطريق إلى المدينة، النبوة والأنبياءفي القرآن، السيرة النبوية ،وغيرها
তিনি ماذا خسر العالم بإنحطاط المسلمين এই গ্রন্থ লিখে বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি জন্ম লাভ করেন এবং ১৯৯৯ সালে মারা যান। দৈনিক সংগ্রাম, ১৯৯৯ খ্রি., ৩১ শে ডিসেম্বর, পৃ. ৩।
[4]. আবুল হাসান ‘আলী নদভী, মা-যা খাসিরাল আ-লামু বি ইনহেত্বাত্বিল মুসলিমীন; ‘‘মুসলিমদের অধঃপতনের ফলে বিশ্ব কি ক্ষতির সম্মুখীন হলো’’, (আল-ইত্তেহাদুল ‘আলমিল ইসলামী লিল মুনাজ্জামাতিত ত্বুল্লাবিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ১৯৪-১৯৫।
[5]. মাহমূদ শালতূত, আল-ইসলামু ‘আক্বীদাতুন ওয়া শরী‘আতুন; (কায়রো : দারুশ শুরুক, ১৭তম সংস্করণ, ১৯৯৭ইং), পৃ. ৪০।
শির্কের কেন্দ্রসমূহ :
আমাদের দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় শির্ক চর্চা করার যে সব কেন্দ্র রয়েছে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে দেখা যায় যে, সংখ্যার দিক থেকে যেমনি তা অগণিত, প্রকারের দিক থেকেও তেমনি তা বিভিন্ন রকমের। চিন্তা করলে এগুলোকে মোট আট প্রকারে বিভক্ত করা যায়।
প্রথম প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যা ওলীদের কবরকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে
এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যুগে যুগে অসংখ্য আউলিয়া ও সৎ ব্যক্তিবর্গের শুভাগমন হয়েছিল। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এদেশের পথভ্রষ্ট মানুষদেরকে তাওহীদের সন্ধান দান করা এবং তাদেরকে সকল সৃষ্টির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর দাসে পরিণত করা। এ চেষ্টা ও সাধনা করতে করতে তাঁদের অনেকে এ- দেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন শাহ জালাল, [1] শাহ পরান, [2] শেখ বদর[3] ও আল্লামা কেরামত আলী জৌনপুরীসহ[4] আরো অগণিত মনীষীগণ।
বহুকাল অতিবাহিত হয়ে যায় তাঁদের কারো সমাধি বা বিশ্রাম স্থলের উপর কোনো প্রকার স্থাপনা ও গম্বুজ নির্মাণ করা হয় নি। কবরের উপর টানানো হয় নি কোনো পর্দা। ছিল না এর কোনো খাদেম; কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যায় তাঁদের ভক্তদের সাথে শয়তানের প্রাচীনতম খেলা। কাওমে নূহ এর মত তাদের অন্তরেও সে এ ধারণার জন্ম দিল যে, এ সব ওলিগণ হলেন আমাদের ও আল্লাহর মধ্যকার মাধ্যম, তাঁরা হলেন আল্লাহর নিকট আমাদের যাবতীয় অভাব ও অভিযোগ উপস্থাপনের ব্যাপারে শাফা‘আতকারী। আল্লাহর সন্তুষ্টি তাঁদের সন্তুষ্টির মাঝেই নিহিত, তাঁরা মরে গেলেও রূহানী শক্তি বলে তাঁরা আমাদের দুনিয়া-আখেরাতের অনেক কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূর করতে পারেন।
এভাবে যারা এখানে এসেছিলেন শির্ক নিপাত করে ইসলামের তাওহীদী পতাকা উড্ডীন করতে, কালের পরিক্রমায় শয়তানের প্ররোচনায় তাঁদের কবর ও বিশ্রামের স্থানসমূহই ইসলামকে ধ্বংস করার ও শির্ককে প্রসারিত করার অসংখ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁরা যেখানে জনগণকে শির্কের অপরাধে জাহান্নামে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলেন, সেখানে তাঁদেরকে কেন্দ্র করেই শয়তান এমন সব ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি করে দিলো, যার মাধ্যমে সে জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করে ফেললো। তাদেরকে কীট-পতঙ্গের ন্যায় জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিল।
উল্লেখ্য যে, ওলীদের কবর কেন্দ্রিক শির্কের কেন্দ্রসমূহ শির্কের অন্যান্য কেন্দ্রসমূহের তুলনায় সংখ্যায় কম হলেও এগুলোর অপকারিতা ও অনিষ্টতা অন্যান্যগুলোর চেয়ে অধিক; কারণ, এ সব কেন্দ্রের মধ্যে এমনও কেন্দ্র রয়েছে যা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে এবং তা তাদের দুনিয়া-আখেরাতের মুক্তি! অর্জনের সহজ ও সরল মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাহ জালাল (রহ.)-এর কবর :
এক্ষেত্রে শাহ জালাল (রহ.)-এর কবর প্রথম স্থান অধিকার করেছে। যার ফলে সেখানে দৈনন্দিন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে শত শত লোক তাদের মনোবাঞ্ছনা পূরণের উদ্দেশ্যে আগমন করে। আমার এ গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ উপলক্ষে আমি ১৯৯৯ সালে সেখানে গিয়েছিলাম। আগত ব্যাক্তিদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে তার পরিচয় জানতে চাইলে লোকটি বললো : সে কুমিল্লা জেলা থেকে তার একটি মানত পূরণের উদ্দেশ্যে সপরিবারে এখানে আগমন করেছে। অনেককে দেখলাম কবরের খাদিমের নিকট টাকা, মোমবাতি ও আগরবাতি দিচ্ছে। কেউবা কবরের গিলাফের উপর গোলাপজল ছিটাচ্ছে। আরেকজনকে দেখলাম কবরের উত্তর পূর্ব পার্শ্বে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আগরবাতি জ্বালাচ্ছে।
এ সবই অবলীলায় করা হচ্ছে সকলের মানত পূর্ণ করার নিমিত্তে। অনুরূপভাবে আরো দেখলাম কিছু লোক কবরের চার পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করে রয়েছে। আবার অনেকে কবরের পশ্চিম উত্তর পার্শ্বের নির্ধারিত স্থানে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে। আবার পুকুরে গিয়ে দেখলাম কেউ কেউ পুকুরের মাছগুলোকে ছোট ছোট মাছ খেতে দিচ্ছে। অনেকে কবরের বড় বড় ডেগ ও কূপে টাকা দান করছে। কূপ থেকে অপরিষ্কার ময়লা পানি নিয়ে পান করছে। এক ব্যক্তি এ ময়লা পানি বোতলে ভরে বিক্রি করছে। এ সবই করা হচ্ছে কবরবাসী শাহ জালাল (রহ.) এর নিকট এ আকুতি প্রকাশ করতে- তিনি যেন তাদের ইহকালীন কল্যাণ এনে দেন এবং অকল্যাণ দূর করে দেন।
অথবা তিনি যেন আল্লাহর নিকট সে জন্য শাফা‘আত করেন। আর সে জন্যই তারা কবরের পার্শ্বে অত্যন্ত ভগ্ন হৃদয়ে ও বিগলিত চিত্তে নেহায়েত অনুনয়-বিনয়ের সাথে দো‘আ করছে। তাদের ভাবটা যেন এমন যে, তারা যেন বিপদে পড়ে তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থী হয়ে হাত তুলেছে, তিনি ছাড়া যেন তাদের আর কোনো আশ্রয় স্থল নেই। তিনি ছাড়া তাদের উপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হওয়ারও কোনো উপায় নেই। পৃথিবীর চলমান ঘটনা প্রবাহে তাঁর প্রভাব সম্পর্কে জনমনে এ বিশ্বাসও রয়েছে যে, যে মাটিতে শাহ জালালের কবর রয়েছে সে মাটির নিকটে বা দূরে কোথাও কোনো মারাত্মক অঘটন ঘটতে পারে না। সে কারণেই একটি বিমান দুর্ঘটনায় কোনো হতাহত না হওয়ার ফলে পত্রিকান্তরে এ মর্মে মন্তব্য প্রকাশিত হয় যে, সিলেটের মাটিতে শাহ জালাল (রহ.) শায়িত রয়েছেন বলেই বিমানের আরোহীরা নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল।[5] উক্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে বা তাঁর রূহানী নেক নজর লাভের আশায় কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর কবর যিয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারাভিযান আরম্ভ করতেও দেখা যায়।
শরফুদ্দীন চিশ্তী (রহ.)-এর কবর :
এ জাতীয় কেন্দ্রসমূহের মধ্যে অপর উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হচ্ছে রাজধানী ঢাকার হাইকোর্টে অবস্থিত শাহ শরফুদ্দিন চিশতী বেহেশ্তী (রহ.)-এর কবর। এ কবরটি বর্তমানের ন্যায় অতীতে এতো প্রসিদ্ধ ছিল না। রাজধানী ঢাকাতে অবস্থিত কবর ও কবরসমূহের উপর উর্দূ ভাষায় লিখিত একটি গ্রন্থে এ কবর সম্পর্কে লেখক যা বলেছেন, পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে সংক্ষেপে এর কিছু কথা অনুবাদ করে নিম্নে তুলে ধরা হলো :
‘‘অতীতে এ কবরের কিছু অনুসারী ছিল, যারা এ কবর যিয়ারত করতে আসতো। এ কবরবাসী সম্পর্কে সঠিকভাবে আমার কিছুই জানা নেই। আমার ধারণামতে এ কবরবাসী ব্যক্তি নওয়াব আলাউদ্দিন ইসলাম খাঁন চিশ্তীর কোনো নিকটাত্মীয় বা তাঁর কোনো সাথী হয়ে থাকবেন। এ কবরটি সরকারী জমির মধ্যে অবস্থিত হওয়ার কারণে বৃটিশ সরকার এ কবরটি নিশ্চিহ্ন করার জন্যে বারংবার চেষ্টা করেছে এবং এ উদ্দেশ্যে এর আশে-পাশে গাছও লাগিয়েছে। এর ভক্তদের দ্বারা কবরের উপর নতুন করে কোনো স্থাপনা বা গম্বুজ ইত্যাদি নির্মাণ করতেও বারণ করেছে, যাতে কবরকে ঘিরে পুরাতন যে দেওয়াল বা গম্বুজ রয়েছে তা সূর্যের আলোর অভাবে শেওলা ধরার ফলে ধীরে ধীরে নিজ থেকেই ধসে পড়ে।’’[6]
বৃটিশ শাসনামলের শেষ সময়ে এ কবরের এ জীর্ণ অবস্থা ছিল। তবে স্বাধীনতা উত্তরকালে এ কবরটি তার ভক্তদের দ্বারা পুরো মাত্রায় লালিত হতে আরম্ভ করে এবং ধীরে ধীরে এর প্রসিদ্ধিও দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বর্তমানে প্রসিদ্ধির ক্ষেত্রে এটি প্রায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এক সময় এখানে ছিল না কোনো মসজিদ। কোনো কবরকে বা কবরকে কেন্দ্র করে মসজিদ নির্মাণ করা শরী‘আতে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীতে এ কবরের ভক্তদের দ্বারা এ কবরকে ঘিরেই মসজিদ নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে শবে বরাতের রাতে এ কবর দর্শন করতে গিয়ে দেখেছিলাম, হাজার হাজার বনী আদম এ কবরের চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করছে। এ অবস্থা দেখে আমার মনে হচ্ছিল- তারা যেন কা‘বা শরীফের চার পার্শ্ব দিয়ে প্রদক্ষিণ করছে। সে সময়ে এ কবরটির পরিবেশ বর্তমানের চেয়ে অত্যন্ত খারাপ ছিল।
তখন কবরে অনেককে সেজদায় পড়ে থাকতে দেখা যেতো। কবরসহ পুরা এলাকাটি তখন মাথায় জটধারী নেংটা ফকীর, আউল-বাউল, মদ ও গাঁজাখোরদের আস্তানা ছিল। বর্তমানে এ কবরের অবস্থা অনেকটা উন্নতি লাভ করেছে। ১৯৯৯ সালে এ কবরটি পুনরায় দেখতে গেলে আমি আগের সেই অবস্থা দেখতে পাই নি। তবে এ কবরের উদ্দেশ্যে মানত করার এবং এখানে তা পূর্ণ করার সাধারণ মানুষের চিরাচরিত যে রীতি ছিল, বর্তমানেও তা পুরোমাত্রায় বহাল রয়েছে বলে দেখতে পেলাম। আরো দেখতে পেলাম একদল মানুষ কবরকে ঘিরে রয়েছে। এদের কেউবা বসে কিছু ধ্যান করছে, কেউবা দাঁড়িয়ে কিছু পাঠ করছে, আরেক দল মানুষ উচ্চ স্বরে মিলাদ পাঠ করছে। কিছু লোককে দেখলাম কা‘বা শরীফের ন্যায় এ কবরের বেষ্টনী ও দরজার চৌকাঠের উপর হাত মুছে নিয়ে নিজ মুখ ও শরীরে হাত বুলিয়ে বরকত হাসিল করছে।
কবর থেকে বের হওয়ার সময় বেআদবী হলে অনিষ্টের ভয়ে পিট পিছনে রেখে বের হচ্ছে। আরো দেখলাম কবর থেকে দূরে মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে মোমবাতি জ্বালানো রয়েছে। একটি যুবককে দেখলাম কা‘বা শরীফের গিলাফ ধরে চুম্বন করে বরকত অর্জন করার ন্যায় মসজিদের উত্তর পার্শ্বের দেওয়ালে লাগানো হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ও ‘আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.)-এর কবরের গিলাফদ্বয়ে ঠোঁট দিয়ে চুম্বন করছে এবং গাল দিয়ে তা স্পর্শ করে তাত্থেকে বরকত গ্রহণ করছে।
উপর্যুক্ত এ জাতীয় শির্কী ও বেদ‘আতী কর্মে যে শুধুমাত্র আমাদের দেশের সাধারণ মুসলিমরাই জড়িত রয়েছে, তা নয়, বরং এ জাতীয় গর্হিত কর্মে সকল মুসলিম দেশের সাধারণ মুসলিমরাও জড়িত রয়েছে। এ জন্য মুসলিমদের এ জাতীয় কর্মের উপর আক্ষেপ করে আল্লামা আহমদ বাহজাত বলেন :
‘‘এ নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত না হওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে অনেক দলীল প্রমাণাদি দাঁড় করানো সত্ত্বেও মুসলিমরা ওলীদের কবরে মসজিদ বানিয়েছে, তাঁদের সমাধিকে দৃঢ় ও মজবুত করার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করেছে, এমনকি এমন সব নামের উপরেও সমাধি তৈরী করেছে যে নামে আসলে কোনো ব্যাক্তিরও অস্তিত্ব নেই। বরং তা তৈরী করা হয়েছে কাঠের তখতী ও জীব জন্তুর লাশের উপর। এ অবস্থা সত্ত্বেও এগুলো জনগণের দ্বারা আবাদকৃত এমন সব কবর, যা বিপদ দূরীকরণ, রোগমুক্তি ও কঠিনকে সহজতর করার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে (আগমনের জন্য) উদ্দেশ্য করা হয়ে থাকে।’’[7]
আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর কবর :
এ দিকে চট্রগ্রামের আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর[8] কবরও প্রসিদ্ধির দিক থেকে পিছিয়ে নেই। সেখানে বার্ষিক ওরসে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই আপন আপন প্রয়োজন পূরণার্থে একত্রিত হয়ে থাকে। ভক্তরা তাঁর প্রশংসায় কবিতার পুস্তক পর্যন্ত রচনা করেছে। এ কবরের ভক্ত এক হিন্দু কবি তার পুস্তকে নিজ গুরুকে স্বয়ং আল্লাহর অবতার বলে দাবী করেছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত কথা আমরা ইন-শাআল্লাহ শির্কের বাস্তব প্রমাণাদি বর্ণনা প্রসঙ্গে পরবর্তীতে আলোচনা করবো।
এভাবে জনগণ প্রত্যেক ছোট ও বড় ওলিদের কবরগুলোকে পবিত্র স্থানে পরিণত করে হিন্দুদের ‘বৃন্দাবন’ ও ‘কাসী’র ন্যায় তীর্থযাত্রার স্থানে পরিণত করেছে। সেগুলোকে বিপদের সময় আশ্রয় নেবার স্থান বানিয়ে নিয়েছে। যাবতীয় অসুখ-বিসুখ দূরীকরণ ও প্রয়োজন পূরণার্থে তারা সেখানে এমনভাবে অবস্থান গ্রহণ করে যেমন আরবের মুশরিকরা তাদের দেবতাদের পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করতো। অবস্থার পরিবর্তনের জন্য নিশীথ রাতে নিজ গৃহে বসে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও অনুনয় বিনয় করার পরিবর্তে তারা এ সব ওলিদের কবরে এসে কান্নাকাটি ও অনুনয় বিনয় করে। উদ্দেশ্য তাঁরা যেন তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন এবং তাদের আকুতি ও মিনতির কথা স্মরণ করে আখেরাতের ভয়াবহ দুর্দিনে যেন তাঁরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করেন।
কবরের খাদিম হওয়ার উদ্দেশ্য :
নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ‘হিরনাল’-এর কথিত শাহ আলম আল-হাদী এর কবরের খাদেমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- আপনি এ কবরের খাদেম হলেন কেন? লোকটি উত্তরে বললো :
‘‘এ কবরের খাদেম হয়েছি এ আশা নিয়ে যে, আমার এ খেদমত দেখে কবরস্থ ওলি আমার উপর দয়াবান হবেন এবং তাঁর কবরের খাদেমী করার কথা স্মরণ করে আখেরাতে আমাকে সাথে না নিয়ে জান্নাতে যেতে লজ্জাবোধ করবেন।’’
ওলিদের কবরের ভক্তদের সেখানে যেয়ে মিনতি করার পার্থিব উদ্দেশ্য হয়তো বিভিন্ন রকমের হতে পারে; কিন্তু তাদের সকলের পরকালীন উদ্দেশ্য একটাই যা উক্ত শাহ আলম আল-হাদীর কবরের খাদেমের বক্তব্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। অথচ তারা জানে না যে, ভাগ্য নির্ধারণের মালিক যেমন এককভাবে আল্লাহ, তেমনি তা পরিবর্তনের মালিকও এককভাবে তিনিই। শরী‘আত নির্দেশিত কর্ম করার মাধ্যমেই তা পরিবর্তনের জন্য তাঁর নিকট মিনতি করতে হবে। ভাল-মন্দ সকল মানুষের মিনতি শুনার জন্যে তো তাঁর দরজা সকলের জন্য সমানভাবেই উন্মুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর যে সকল সাহাবীদের জন্য জান্নাতে যাওয়ার সনদপত্র প্রদান করা হয়েছে কেবল তাঁরা ব্যতীত পরবর্তী সৎ মানুষদের ব্যাপারে জান্নাতে যাওয়ার সুধারণা পোষণ করা গেলেও তা কারো জন্যে নিশ্চিত করে বলার অধিকার আমাদের নেই।
আর সে ধারণার ভিত্তিতে কোনো ওলি ও দরবেশের শাফা‘আত লাভের আশায় থাকারও কোনো যৌক্তিকতা নেই। কেননা; তাঁরা প্রকৃতপক্ষে জান্নাতী কি না, তা আমরা জানি না। জান্নাতী হয়ে থাকলেও শাফা‘আত করার বিষয়টি তাঁদের মালিকানাধীন বিষয় নয় যে, তাঁরা যাকে যখন খুশী শাফা‘আত করবেন। বরং তা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। কাকে কখন এর অনুমতি দেয়া হবে এবং কার জন্য হবে, তা কেবল তিনিই জানেন। তবে যারা আল্লাহর উলূহিয়্যাত বা রুবূবিয়্যাতে কোনো শির্ক করে মৃত্যুবরণ করবে, কুরআন ও হাদীসের বর্ণনামতে তাদের কারো শাফা‘আত প্রাপ্তির কোনই সুযোগ নেই।
দ্বিতীয় প্রকার : এমন সব কেন্দ্রসমূহ যা কোনো ওলির নিদর্শনের উপর নির্মিত হয়েছে :
এটি হচ্ছে এ দেশের সাধারণ মুসলিমদের সাথে শয়তানের তামাশা করার অপর একটি চিত্র। সে তাদেরকে ওলীদের কোনো কোনো নিদর্শনাদির উপর বা তাঁদের স্মৃতির সাথে জড়িত স্থানের উপর কোনো কবর ছাড়াই মাযার তৈরী করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, শাহ জালাল (রহ.)-এর কবর সিলেট শহরে থাকা সত্ত্বেও তাঁর নামে কুমিল্লা জেলার কোতয়ালী উপজেলার গাজীপুর গ্রামে একটি এবং একই জেলার সদর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে অপর একটি কবর রয়েছে।
এ দু’টি কবর সম্পর্কে উক্ত এলাকায় এমন জনশ্রুতি রয়েছে যে, শাহ জালাল (রহ.) তাঁর কোনো এক সফরে এ দু’টি স্থানে যাত্রা বিরতি করেছিলেন এবং সে দু’টি স্থানে তাঁর হাত ও পায়ের নখ, গোঁফ ও দাড়ি ছেঁটে এখানে দাফন করেছিলেন। পরবর্তীতে এ স্থান দু’টি জনগণের কাছে সম্মানিত স্থানে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে তা তাঁর কবরের সমান মর্যাদা পেতে থাকে। তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে সাধারণ লোকেরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে যা করে, এ দু’টি স্থানকে কেন্দ্র করেও এলাকার লোকেরাও তা-ই করে।[9]
তৃতীয় প্রকার : পাগলদেরকে কেন্দ্র করে নির্মিত কেন্দ্রসমূহ :
যে সকল পাগল উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ থাকে, সাধরণত মানুষের সাথে কথা-বার্তা বলে না; বিভিন্ন কবর, গোরস্থান, জংগল ও বড় বড় বট গাছের তলায় রাত যাপন করে, রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ করে কারো নিকট কিছু চায় বা কাউকে কোনো বস্তু দান করে; এ জাতীয় পাগলদের প্রতি সাধারণ লোকেরা ভিন্নরকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন। এদেরকে অনেকেই আল্লাহর ওলি হিসেবে মনে করে থাকেন। এ জাতীয় পাগলদের মধ্যে কেউবা সত্যিকার অর্থেই পাগল হয়ে থাকে, আবার কেউবা ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটি করে পাগলের ভাব প্রকাশ করে থাকে। উদ্দেশ্য এ অবস্থাকে পুঁজি করে পরবর্তীতে জীবিকার্জনের একটি সহজ উপায় বের করা। তাই কিছু দিন এভাবে থাকার পর এরা উপযুক্ত স্থান দেখে নিজের জন্য একটি আস্তানা গড়ে তুলে এবং সেখানে বসেই সে সাধারণ মানুষের কল্যাণার্জনে ও অকল্যাণ দূরীকরণে নানারকম কবিরাজী, তেলপড়া, পানিপড়া ও তাবীজ-কবজ দিতে আরম্ভ করে। আমার জীবনে এ জাতীয় কিছু পাগলের সাথে দেখা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯৮২/১৯৮৩ সালে ঢাকার গুলিস্তানে বর্তমান গাবতলী ও মিরপুরগামী বি. আর. টি. সি. বাস ষ্টেন্ডের স্থানে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় ধ্যানে মগ্ন গলা ও গায়ে লোহার জিঞ্জিরের সাথে বড় বড় তালা ঝুলানো এক পাগল দেখেছিলাম। ১৯৮৫/১৯৮৬ সালে পুনরায় সে পাগলকেই ঠিক সেভাবেই সে স্থানে বসে তা‘বীজ বিক্রি করতে দেখলাম। সাধারণ লোকেরা তাকে ঘেরাও করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেউ তাবীজ নিতে চাইলে সে চোখ বন্ধ করে তার নিকটে রাখা একটি কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটি তা‘বীজ বের করে দিচ্ছে এবং বিনিময়ে দু’টি করে টাকা নিচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম অনেকেই তার নিকট থেকে তা‘বীজ নিচ্ছে।
সাধারণ লোকদের মনে এ ধরনের পাগলদের ব্যাপারে ওলি হওয়ার ধারণা রয়েছে বলেই তারা এ পাগলের নিকট থেকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তাবীজ নিচ্ছে। তারা এদের সাথে সুন্দর আচরণ করে, এদের সাথে বেআদবী করলে বিপদ হতে পারে বলে মনে করে, এরা কারো নিকট টাকা চাইলে তা সে ব্যক্তির জন্য সৌভাগ্যের কারণ বলে মনে করে দ্রুত তা দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, না দিলে সমূহ ক্ষতিরও আশঙ্কা করে। কোনো ব্যবসায়ীর নিকট টাকা চাইলে ব্যবসায়ে অধিক লাভের আশায় সে তাকে তা দ্রুত দান করে। এদের দিলে ব্যবসায়ে লাভ হয় ও অধিক বিক্রি হয়, আর না দিলে অন্যান্য দিনের তুলনায় এ দিনে বিক্রি কম হয়, এ মর্মে কিছু বাস্তব ঘটনার কথাও লোক মুখে শুনা যায়।
এ জাতীয় ঘটনা যদি সত্যিও হয় তবে এর অর্থ এ নয় যে, তা এ পাগলকে টাকা দেয়া বা না দেয়ার কারণে হয়েছে, বরং তা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছার কারণেই। তিনি এ জাতীয় পাগলের দ্বারা জনগণের ঈমানের দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে চান। তিনি দেখতে চান কার ঈমান মজবুত আর কার ঈমান দুর্বল। এদের কোনো কোনো কথার সত্যতা বাস্তবে প্রমাণিত হয়ে থাকে, তা দেখে সাধারণ লোকেরা তাদেরকে ওলি বলে মনে করে এবং তাদের সত্য কথাকে তাদের কারামত হিসেবে গণ্য করে; অথচ তারা জানে না যে, এ জাতীয় পাগলেরা জঙ্গল ও গোরস্থানে থাকার কারণে এদের সাথে তাদের অজান্তেই শয়তান জিনের সখ্যতা গড়ে উঠে।
আর এ জিনরাই সাধারণ লোকদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এদের মুখে কিছু সত্য কথা বা কোনো তথ্য বলে দেয়। শয়তান এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বনী আদমকে যুগের পর যুগ বিভ্রান্ত করে আসছে। সাধারণ লোকেরা এভাবে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হয়েই যুগে যুগে শির্কে লিপ্ত হয়েছে। যারা মিছেমিছি ওলি হওয়ার ভান করে সাধারণ মানুষদেরকে প্রতারণা করে তাদের সম্পদ ও ঈমান হনন করতে চায়, এদের সাথে যে শয়তানের সখ্যতা গড়ে উঠে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ هَلۡ أُنَبِّئُكُمۡ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ ٱلشَّيَٰطِينُ ٢٢١ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٖ ٢٢٢ يُلۡقُونَ ٱلسَّمۡعَ وَأَكۡثَرُهُمۡ كَٰذِبُونَ ٢٢٣ ﴾ [الشعراء: ٢٢١، ٢٢٣]
“বল, আমি তোমাদেরকে বলবো কি কাদের উপর শয়তান অবতরণ করে? শয়তান অবতরণ করে প্রত্যেক মিথ্যাবাদী গোনাহগারের উপর। তারা (ফেরেশ্তাদের নিকট থেকে) শ্রুত কথা তাদের নিকট এনে দেয়। এদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী।”[10]
[2]. শাহ পরান ছিলেন শাহ জালাল (রহ.)-এর ভাগ্নে এবং তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তাঁকে তিনি সিলেট শহরের উত্তর পূর্ব এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। সিলেট শহর থেকে ৫/৬ মাইল দূরে একটি পাহাড়ের উপর তাঁর সমাধি রয়েছে। দেখুন : চৌধুরী দেওয়ান আনোয়ার, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৮০-২৮১।
[3]. শেখ বদর ছিলেন চট্রগ্রাম জেলায় আগত আউলিয়াদের মধ্যে অন্যতম। সাধারণ মানুষের মাঝে তিনি শেখ বদর ও বদর শাহ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম জানা যায় নি। সম্ভবত তাঁর নাম ছিল ‘শাহ বদর উদ্দিন বদরে আলম’। কথিত আছে যে, তিনি প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শত বছর পূর্বে একটি বড় পাথরের উপর সওয়ার হয়ে সমুদ্র পথে চট্রগ্রামে আগমন করেন। সে সময় উক্ত এলাকায় জিনের মারাত্মক ধরনের প্রভাব ছিল। তারা মানুষদেরকে নানাভাবে কষ্ট দিত। শেখ বদর সে এলাকায় আগমন করে মাটিতে একটি বাতি রাখার জন্য জিনদের নিকট অনুমতি চান। জিনরা এতে সম্মত হলে তিনি পাহাড়ের উপর বাতি জ্বালান। সে বাতির আলো পাহাড়ের চারদিকে বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে জিনরা সে এলাকা থেকে পালাতে থাকে। সে পাহাড়টি এখন ‘চেরাগীর পাহাড়’ নামে খ্যাত, ... সম্ভবত এই সূফী সাধকই সর্বপ্রথম চট্রগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি। দেখুন : গোলাম ছাকলায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ১১৫-১১৭।
[4]. তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর শিষ্য ছিলেন। ১৮২১ সালে তিনি সর্ব প্রথম এদেশে আগমন করেন এবং পশ্চিম বঙ্গ, বাংলাদেশ ও আসাম অঞ্চলে একাধারে আঠার বছর পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেন। দাওয়াত ও হেদায়াতের কাজে এ-সব এলাকায় তিনি তাঁর জীবনের একান্নটি বছর ব্যয় করেন। ১৮৭৩ সালে রংপুর জেলায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেখুন: মুহাম্মদ আফাজ উদ্দিন, “ইসলামী দাওয়াত বিস্তারে ও ধর্মীয় - সামাজিক সংস্কারে আব্দুল আউয়াল জৌনপুরী এর অবদান”, পি.এইচ.ডি থিসিস, (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, অপ্রকাশিত, ১৯৯৮ খ্রি.), পৃ. ৭৪ ও ৭৫।
[5]. যদিও মানুষের এ ধারণার অবাস্তবতা প্রকাশিত হয়ে গেছে ২০০৪ সালে শাহ জালালের কবরে বোমা হামলা ও এর ফলে লোক মরার মধ্য দিয়ে কেননা, জনগণের ধারণানুযায়ী যদি শাহ জালালের কোনো কেরামতী থাকতো, তা হলে তাঁর কবরে কোনো বোমা বিস্ফুরিত হতো না। বোমা বিস্ফুরণের পূর্বেই তিনি অদৃশ্য থেকে সন্ত্রাসীদের কোনো অনিষ্ট করে দিতেন।- লেখক
[6].হাবীবুর রহমান, আছুদগানে ঢাকা, উর্দ্দূ ভাষায় রচিত, (ঢাকা: মনজর প্রেস, ১ম সংস্করণ, ১৯৪৬ খ্রি.), পৃ. ৪৮।
[7] আহমদ বাহজাত, আল্লাহু ফীল আক্বীদাতিল ইসলামিয়্যাহ; (কায়রো: মুআছ ছাসাতুল আহরাম, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৯৬ খ্রি/), পৃ. ১৯০-১৯১।
[8]. আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারী নামের এ সূফী সাধক ১৮২৬ সালে চট্রগ্রাম জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কুরআন, হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। কর্ম জীবনে তিনি কিছু দিন যশোর জেলায় বিচারকের পদে সমাসীন ছিলেন। অতঃপর তিনি এ পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং কলিকাতার ‘বুআলী’ নামক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এ সময়ে তিনি কাদেরিয়্যাহ তরীকার পীর আবূ শিহামাহ এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ীতে চলে আসেন। এবং চট্রগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ ও নসীহতের মাধ্যমে দাওয়াতী কাজে ব্রতী হন। এক পর্যায়ে তিনি জনগণের মধ্যে ‘ফকীর মৌলভী’ উপাধিতে ভূষিত হন। এলাকায় তাঁর বিভিন্ন কারামত, তাকওয়া ও পরহেগারী প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। তিনি ১৯০৬ সালে পরলোক গমন করেন। গোলাম সাকলায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ১২৫-১২৬। সংক্ষিপ্তাকারে
[9]. এ মাজার দু’টি সম্পর্কে উপর্যুক্ত তথ্য প্রদান করেছে অত্র এলাকারই ছাত্র মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম। সে আল-হাদীস বিভাগের ১৯৯৩-৯৪ সালের ১ম বর্ষের ছাত্র ছিল। তার স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : তুলতুলী, মৌলভী বাজার, উপজেলা ও পোষ্ট : চান্দিনা, জেলা : কুমিল্লা।
[10]. আল-কুরআন, সূরা আশ-শু‘আরা : ২২৩, ২২৪।
আমাদের দেশে এমনও কিছু ভুয়া কবর রয়েছে যেখানে প্রকৃত পক্ষে কোনো ওলি বা দরবেশের কোনো কবর বা নিদর্শন নেই। এ জাতীয় ভুয়া কবর মূলত এক শ্রেণীর লোকেরা জনগণের অর্থ কড়ি লুন্টন করার জন্য মিছেমিছি গড়ে তুলেছে। এ জাতীয় মিথ্যা কবরের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে চট্রগ্রাম জেলায় অবস্থিত সূফী সম্রাট বায়েজীদ বুস্তামী -এর কবর। এ সূফী সাধক সে অঞ্চলে কেন স্বয়ং বাংলাদেশের মাটিতেই আগমন করেছিলেন কি না, এ নিয়ে বিজ্ঞজনদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সঠিক মতানুসারে তিনি এদেশে কখনও আগমন করেননি।[11] ইরান দেশের ‘বুস্তাম’ নামক স্থানে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেছেন। সেখানেই রয়েছে তাঁর কবর। তা সত্ত্বেও চট্রগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় তাঁর একটি স্মারক কবর রয়েছে। যার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষেরা দূর-দূরান্ত থেকে তাদের মানতের টাকা কড়ি ও জীব-জন্তু নিয়ে আগমন করে।
এ জাতীয় কেন্দ্রের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে কুমিল্লা জেলার ‘বরুড়া’ উপজেলার ‘মুগুতী’ নামক গ্রামের ফকীর রহীম আলী’র কবর। এ কবরটি মূলত সে ফকীরের বসার স্থানের উপর নির্মাণ করা হয়েছে। এ স্থানে সে বসতো। হঠাৎ একদিন সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। প্রতারক ও সুযোগ সন্ধানীরা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে তার বসার স্থলে কবর নির্মাণ করে এবং এখানে মানত ও শিরনী প্রেরণ করতে আরম্ভ করে। এভাবে তা মানত পূর্ণ ও প্রয়োজন পূরণের স্থানে পরিণত হয়ে যায়।
একইভাবে মাদারীপুর জেলার ‘দরগা খুলা’ নামক স্থানে ‘শাহ মাদার দরগা’ নামে আরেকটি ভুয়া কবর রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, শাহ মাদার নামে একজন সৎ মানুষ ছিলেন। তিনি মূলত ভারতের অধিবাসী ছিলেন। বিভিন্ন স্থান সফরের এক পর্যায়ে তিনি এখানে এসেছিলেন। অতঃপর নিজ দেশে চলে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তুস্বার্থান্বেষী মহল পরবর্তীতে তাঁর বসার স্থানে একটি মাযার তৈরী করে নেয়।
পঞ্চম প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যা বড় বড় গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে
এ জাতীয় কবর দেশের সর্বত্রই কম-বেশী রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঝিনাইদহ জেলার কোট চাঁদপুর উপজেলার ‘ফুলবাড়ী’ নামক গ্রামে এ ধরনের একটি কবর রয়েছে। যার নাম ‘ফুলবাড়ীর দরগা’। এ কবর বা দরগাটি মূলত একটি বড় পুকুর এবং এ পুকুরের পার্শ্বে অবস্থিত একটি বড় গাছ ও এর নিচে নির্মিত একটি টিনের ঘর, এ-সবের সমন্বয়ে গঠিত। এলাকার সাধারণ লোকেরা এ গাছটিকে পবিত্র মনে করে এর সম্মান করে। নিকট ও দূর থেকে এখানে মানত নিয়ে আসে এবং এ গাছের নিকট বিভিন্ন রকমের রোগ মুক্তি কামনা করে। অনেক সময় রোগীরা এ গাছের নিচে শুয়ে থাকে।
অনুরূপভাবে যশোর জেলার ‘মনিরামপুর’ উপজেলার ‘মাজিয়ালী’ নামক গ্রামেও একটি পুরাতন বড় গাছ রয়েছে, যার নিকটে রয়েছে জনৈক হিন্দু লোকের একটি ঘর। হিন্দুরা এ গাছের পূজা করে। অনেক মুসলিমও বিভিন্ন সময়ে তাদের কামনা বাসনা ও প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে এখানে মানত নিয়ে আগমন করে। মনস্কামনা পূরণের জন্য এ গাছের ডালে কোনো কোনো বস্তু ঝুলিয়ে রাখে।
অনুরূপভাবে যশোর জেলার ‘মনিরামপুর’ উপজেলার ‘মান্দারডাঙ্গা’ পীরের কবরেও একটি পুরাতন গাছ রয়েছে। সে কবরের পার্শ্বে রয়েছে একটি কুঁড়েঘর ও কয়েকটি ভুয়া কবর। এর পার্শ্বে প্রায় একশটি চুলা তৈরী করে রাখা আছে জনগণের মানতের পশু যবাই করে পাকানোর জন্যে। সাধারণ মুসলিমরা সেখানে তাদের মানতের ষাঁড় ও ছাগল নিয়ে যায় এবং তা যবাই করে সে সব চুলাতে পাক করে সবাই মিলে খায়। কোনো মহিলার সন্তান না হলে সন্তান প্রাপ্তির আশায় মাথায় কাপড় বেঁধে সে গাছের নিচে বসে থেকে গাছের একটি পাতা বা ফল নিচে পতিত হওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। পাতা বা ফল পতিত হলে সন্তান লাভের এক রাশ আশা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আর কিছুই পতিত না হলে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়।
এমনিভাবে ফরিদপুর জেলার কালেক্টরেট এলাকার সাথে সংলগ্ন একটি স্থানে যশোর রোডের নিকটে একটি বড় গাছ রয়েছে। কথিত আছে যে, শেখ ফরীদ নামের একজন ভারতীয় সাধক অত্র এলাকায় আগমন করে তাঁর সাথীদের সাথে এ গাছের নিচে বসেছিলেন। মানুষেরা পরে এ গাছের নিচে একটি মাযার তৈরী করে নেয় এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাদের প্রয়োজন শেখ ফরীদের নিকট পেশ করার জন্য এখানে আগমন করে।[12]
ষষ্ঠ প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যা কোনো কবর ও তৎ সংলগ্ন গাছকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে :
এ জাতীয় কেন্দ্রের উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাতক্ষিরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার ‘কামারঘাতি’ নামক গ্রামে একটি কবর রয়েছে, যার নাম ‘কামারঘাতি ছোট মিয়ার দরগা’। লোকেরা এ ব্যক্তির কবরকে কেন্দ্র করে এ মাযারটি তৈরী করে থাকলেও তারা এ ব্যক্তির সঠিক নাম ও তার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। এ কবরের পার্শ্বে রয়েছে একটি বড় গাছ। লোকেরা এ কবরে যেয়ে সেখানে তাদের বিনয়ভাব প্রকাশ করে, অত্যন্ত অনুনয় বিনয় করে দো‘আ করে ছোট মিয়ার নিকট সন্তান কামনা করে। রোগ থেকে মুক্তি চায়। কবরের পার্শ্বের বড় গাছের ডালে পাথর ও ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে।
এ প্রকারের উদাহরণস্বরূপ আরো বলা যায় যে, চট্রগ্রামের বায়েজীদ বুস্তামীর ভুয়া কবরের ডান পার্শ্বে একটি গাছ রয়েছে, এ গাছের কাছে লোকের বিভিন্ন উদ্দেশ্যে আগমন করে সেখানে সুতায় একাধিক গিঁঠ দেয়। একটি উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে এসে একটি গিঁট খুলে দেয়। এক ব্যক্তিকে গাছের গোড়ায় সুতা ঝুলিয়ে গিঁট দেয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সে ব্যক্তি বললো: এখানে লোকেরা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সুতায় গিঁট দেয়। কেউ দেয় সন্তান লাভের আশায়, কেউবা দেয় ভালো চাকরী প্রাপ্তির আশায়, আবার কেউবা দেয় মানসিক প্রশান্তি লাভের আকাঙ্ক্ষায়।
এক ব্যক্তি বায়েজীদ বুস্তামীর ওসীলায় আল্লাহর নিকট দো‘আ করা প্রসঙ্গে একটি কাগজে কিছু কথা লিখে গাছের সাথে তা ঝুলিয়ে রাখে। সে তার দো‘আয় লিখেছে: ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, ওহে সূফী সম্রাট বা-এজীদ বুস্তামী! আল্লাহর নিকট আমার দো‘আ মাকবুল হওয়ার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে ওসীলা করছি। তোমার নিকট কামনা করছি তুমি আমাকে নিরাপদে গাড়ী চালাবার তৌফিক দাও, আমাকে যাবতীয় বিপদ থেকে মুক্তি দাও এবং ভাল একটি কর্ম পাইয়ে দাও, আর এ এতীমের দো‘আ কবুল কর।’’
আমাদের দেশের ছোট বড় সাধারণ গোরস্থানগুলোতে এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে যে সব গাছ-পালার জন্ম হয়, সাধারণত জনগণের নিকট এগুলোর কোনো গুরুত্ব থাকে না; পক্ষান্তরে কোনো সত্যিকারের ওলি বা কথিত কোনো ওলির কবরের উপর বা নিকটে যদি কোনো বড় ধরনের গাছ বিশেষ করে কোনো বড় বট গাছ থাকে, তা হলে জনগণের কাছে এ গাছের গুরুত্ব বেড়ে যায়। তারা ওলির কবরের সম্মানের পাশাপাশি এ গাছেরও সম্মান করতে আরম্ভ করে। এ গাছের শিকড়ে সুতা বাঁধলে, এর মূল কাণ্ডে তারকাঁটা মারলে বিভিন্ন রকমের মনস্কামনা পূরণ হয় বলে তারা ধারণা করে। সিলেটের শাহ পরানের কবরে গেলে এর জ্বলন্ত প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়।
জনগণ মনে করে ওলিদের মৃত্যুর পর তাঁদের কবরের উপর বা এর সংলগ্ন গাছের মাধ্যমে তাঁদের বিভিন্ন রকমের কারামত প্রকাশিত হয়। এ জাতীয় গাছের একটি সুন্দর উদাহরণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ‘হিরনাল’ গ্রামের শাহ আলম আল-হাদী এর কবর সংলগ্ন গাছটি। এ গাছের ব্যাপারে অত্র এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে যে, কেউ এ গাছের ডাল কাটলে অথবা এর পাতা ছিড়লে সে ব্যক্তির পেটে বেদনা হয়, এর পার্শ্ব দিয়ে চলার সময় কারো পা পিঁছলে গেলে সে ব্যক্তির জ্বর হয়। আমি এ কবরের খাদেমকে এ গাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তখন সে বললো :
‘‘বৃটিশ শাসনামলের কোনো এক সময় ঝড়ের কারণে এ গাছের একটি ডাল ভেঙ্গে পড়ে, লোকেরা এ ডালটি সরিয়ে নিতে চাইলে তাদের পক্ষে তা সম্ভব হয় নি, বরং এর ফলে তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এ এলাকার সে সময়কার প্রতাপশালী হিন্দুরা হাতীর সহযোগিতায় এ ডালটি সে স্থান থেকে সরিয়ে নিতে চাইলে হাতীর দ্বারাও তা সরানো সম্ভব হয় নি। হাতীর গলায় বেধে দেয়ার পর যখন হাতী তা জোরে টান মেরেছিল তখন হাতী অস্বাভাবিক রকমের চিৎকার করেছিল। খাদেম আরো বললো : ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কিছু লোক সে ডালটি তার পূর্ব স্থান থেকে সরিয়ে সে গাছের কাছে নিতে পেরেছিল। এরপর তারা এ ডালটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাইলে তারা তা পোড়াতে পারে নি।
পরে আমরা এ ডালটিকে রাতের বেলা ওলির কবর ও সে গাছের মধ্যখানে একটি কুঁড়ে ঘরে রেখেছিলাম, সকালে উঠে আমরা সে ডালটি আর সে ঘরে দেখতে পাই নি’’। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের অন্তরে এ গাছের মর্যাদা ও গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এ কবরের খাদেম ও এর ভক্তরা মনে করে এ গাছ এবং এর ডালকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত যে সব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, সবই হয়েছে কবরস্থ এ ওলির কারণে, এ সব তাঁর কারামত বৈ আর কিছুই নয়!!
উক্ত কবরের খাদেম এ গাছের ডাল সম্পর্কিত যা কিছু বলেছে তা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তা হলে শর‘য়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হবে যে, এ গাছের ডালটি কারো পক্ষে সরাতে না পারার অর্থ এ নয় যে, কবরস্থ অলিই তাঁর কারামত প্রকাশের জন্য প্রথমে তা সরাতে বারণ করেছেন; বরং ডালটি এর স্থান থেকে সরাতে না পারার পিছনে রয়েছে শয়তানের কারসাজি। শয়তান জিনরাই দীর্ঘকাল এ ডালটিকে সরাতে দেয় নি, আবার এ জিন শয়তানরাই এ ঘর থেকে অবশেষে তা রাতের আঁধারে সরিয়ে নিয়েছে।
উদ্দেশ্য এর দ্বারা সাধারণ মানুষদের নতুন করে বিভ্রান্ত করা। যাতে তারা এ গাছকে আরো বেশী করে গোপনে ভয় করে এবং আরো বেশী করে এর তা‘যীম করে, এর দ্বারা আরো বেশী করে কল্যাণের আশা করে। এভাবে তারা যেন এ গাছকে কেন্দ্র করে শির্কী চিন্তা ও কর্মের মধ্যে সর্বদা লিপ্ত থাকে। উল্লেখ্য যে, এ গাছে যে জিনের বসতি রয়েছে তাও বাস্তব একটি ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত। একদা এক ব্যক্তির এক মেয়েকে রাতের আঁধারে জিনরা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে গাছে। অতঃপর ফজরের সময় তারা দূরবর্তী এক বাড়ীর আঙ্গিনায় তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে যায়।
মেয়েটি জ্ঞান ফিরে পেলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বললো : আমাকে কিছু অপরিচিত ব্যক্তিরা ‘হিরনাল’ এর কবরের নিকটতম গাছের ডালে নিয়ে বসিয়ে রেখেছিল।[13] এ বাস্তব ঘটনাটি আমাদের জন্য উত্তম সাক্ষ্য বহন করছে যে, এ কবরের ডাল কাটলে বা এর নিকটে কেউ হোছট খেয়ে পড়ে গেলে অসুখ হলে তা এ সব শয়তান জিনের অশুভ দৃষ্টির কারণেই আল্লাহর হুকুমে হয়েছে। এ জাতীয় সকল গাছে বসবাসকারী দুষ্ট জিনেরা সাধারণ মানুষের ঈমান নষ্ট করার জন্যে কখনও কারো কল্যাণ করে, কখনও কারো অকল্যাণ করে। আর সাধারণ মানুষদের এ কুমন্ত্রণা দেয় যে, এ সবই হচ্ছে কবরস্থ এ ওলির কারণে।
সপ্তম প্রকার : এমন সব কেন্দ্রসমূহ যা বেলায়েতের দাবীদারদের কবরে তৈরী করা হয়েছে
বেলায়েত লাভ করা বা আল্লাহর তা‘আলার ওলি হওয়া একটি উচ্চ মর্যাদা প্রাপ্তির ব্যাপার। যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভালবেসে একান্ত এখলাস ও একাগ্রতার সাথে তাঁর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে শরী‘আতের যাবতীয় বিধি-বিধান যথাসাধ্য পালন করেন, কেবল তাঁরাই সে মর্যাদায় আরোহণ করতে পারেন। যে কেউ এ পথের পথিক হওয়ার জন্য চেষ্টা ও সাধনা করতে পারেন। তবে যেহেতু এ সাধনার উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি; সে জন্য শর‘য়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ এ পথে অনেক দূর অগ্রসর হলে তিনি জনগণের কাছে তা প্রকাশ করতে পারেন না। বা এ দাবীও করতে পারেন না যে, আমি আল্লাহর ওলি হয়ে গেছি। যদি কেউ নিজের জন্য এ ধরনের দাবী করেন, তবে তিনি কোনভাবেই প্রকৃত ওলি হতে পারেন না।
কিন্তু আফসোসের বিষয় এ ধরনের বেলায়েতের দাবীদারদের সংখ্যাই আমাদের দেশে অধিক। তারা মনে করেন, কোনো পীরের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করলে এবং নিজ বাড়ীতে একটি খানকা বানিয়ে নিজ পীরের তরীকানুযায়ী মাথায় লম্বা চুল, গলায় লম্বা তসবীহ, আর গায়ে লাল সালু পরিধান করলে, জনগণের সাথে উঠা-বসা থেকে বিরত থাকলে, সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন ভক্তদের সাথে একত্রিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে যিকির করলে, নিজ পীর, বড়পীর আব্দুল কাদির জীলানী ও খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী এর বার্ষিক ওরস পালন করে সেখানে কিছু গান-বাজনা, মদ ও গাঁজা খেলে ওলি হওয়া যায়। এ জাতীয় স্বঘোষিত ওলি বা পীরদের সংখ্যাই সমাজে অধিক।
প্রকৃতপক্ষে তারা পার্থিব উপার্জনের একটি সহজ পথ মনে করে এটাকে একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে থাকে। সে জন্যেই আদম শুমারিতে তারা নিজেদের পেশাগত পরিচয় পীর বলে দিয়ে থাকেন।[14] এরা নিজেদের জীবদ্দশায় যেমন সুকৌশলে সাধারণ মানুষের ঈমান হনন করে সম্পদ অর্জন করে থাকেন, তেমনি তাদের মৃত্যুর পরেও তাদের বংশধরদের জন্য তার কবরকে পার্থিব উপার্জনের একটি সহজ উপায় হিসেবে রেখে যান। সাধারণ লোকেরা তাদের জীবদ্দশায় যেমন তাদের নানাবিধ প্রয়োজন ও মনস্কামনা পূরণের জন্য হাদিয়া, তুহফা ও মানত নিয়ে তাদের দরবারে আগমন করতো, তাদের মৃত্যুর পরেও ঠিক সেভাবেই বরং পূর্বের চেয়েও অধিক হারে আগমন করে থাকে।
অষ্টম প্রকার : এমন সব কেন্দ্র যা জীবিত বেলায়েতের দাবীদাররা নির্মাণ করেছে
অতীতে যারা বেলায়েত লাভের জন্য সাধনা করতেন, তারা সাধারণত নিজেদের প্রচার করা থেকে বিরত থাকতেন। তাঁদের কবরকে কবরে পরিণত করা থেকে আরম্ভ করে এর উপর গম্বুজ নির্মাণ করা, তাঁদের কবরকে কাপড় দ্বারা ঢাকা, উপরে সামিয়ানা টাঙ্গানো, তাঁদের উদ্দেশ্যে ইসালে সাওয়াবের নামে বার্ষিক ওরস পালন ইত্যাদি যা কিছুই বর্তমানে করা হয়ে থাকে, সে সবের জন্য তাঁরা মোটেও দায়ী নন। এ-জন্য যে, তাঁরা তো কাউকে এ সব করতে বলেন নি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমাদের দেশে এখন বেলায়েতের দাবীদার এমন অনেক পীর রয়েছে যারা নিজেদের জন্য খানকা তৈরী করে ‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিল’ ও ‘বাবে রহমত’ ইত্যাদি চমকপ্রদ নাম দিয়ে সেখানে ‘বিশ্ব আশেকে রাসূল সম্মেলন’র নামে ওরস পালন করে। তারা নিজেদের বাহ্যিক পোশাকাদি, মিলাদ মাহফিল ও যিকির-আযকারের অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সাধারণ লোকদের বুঝাতে চায় যে, তারা আসলেই আল্লাহর ওলি ও তাঁর কামেল বান্দা; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা পাকা প্রতারক, ধোঁকাবাজ ও অর্থ-সম্পদের দাস।
কেননা, তাদের মধ্যে বাহ্যিক বেশভূষা ছাড়া দ্বীনের আর কিছুই নেই। তারা মূলত দুনিয়ার গোলাম ও কবর পূজারী। সে জন্যেই তারা মাঝে মধ্যে আজমীর ও বাগদাদে গমন করে। তারা বাহ্যিক কিছু কর্মকাণ্ড দ্বারা সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। বাহ্যত তা তাদের কারামত মনে হলেও আসলে তা শয়তানী চক্রান্ত বৈ আর কিছুই নয়। সাধারণ লোকদেরকে প্রতারণা করার জন্য তারা শয়তানের সহযোগিতায় তা প্রকাশ করে থাকে। এ সব ধোঁকাবাজদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে দেওয়ানবাগের স্বঘোষিত পীর মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী। সে এ মর্মে দাবী করেছে যে, সে আল্লাহ তা‘আলাকে একটি যুবকের আকৃতিতে দেখেছে। আরো দাবী করেছে যে, সে স্বপ্নের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেহকে উলঙ্গ অবস্থায় ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার মধ্যবর্তী একটি আবর্জনার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছে।[15]
অপর এক স্বপ্নে দেখেছে: ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তাঁর সাথে কা‘বা শরীফসহ তার আরামবাগস্থ ‘বাবে রহমত’ নামক খানকাতে আগমন করে তাকে লক্ষ্য করে বলেছেন: দেওয়ানবাগী হজ্জ করে নি বলে লোকেরা যা বলে, তা সঠিক নয় কারণ, আমি (রাসূল) সর্বক্ষণ তার সাথে রয়েছি, আর কা‘বা শরীফ সর্বদা তার সামনে রয়েছে, সে মানুষের মাঝে আমার ধর্ম প্রচার করছে, এমতাবস্থায় তার হজ্জ করার কোনো প্রয়োজন নেই।’’[16] ‘বিশ্ব আশেকে রাসূল সম্মেলন’ নামে প্রতি বছর সে তার দেওয়ানবাগের খানকাতে একটি ওরস পালন করে। রাষ্ট্রের কোনো কোনো পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে তার গোপন আঁতাত রয়েছে। সে জন্য দেওয়ানবাগ এলাকায় সে জনগণের জমি অবৈধ দখলসহ যে সব অপরাধমূলক কর্ম করেছে, জনগণের পক্ষে এর কোনো প্রতিকার করা সম্ভব হয় নি। কা‘বা শরীফের ‘বাবে রহমত’ নামের দরজার নামে আরামবাগের খানকার নাম রাখার পিছনে ভাবটা যেন এমন যে, যারা তার এ খানকায় আগমন করবে তাদের মক্কা শরীফ যাওয়া হয়ে যাবে।
আল্লাহর রহমতে অবশেষে কিছুটা হলেও তার গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে সে তার আস্তানা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তার আস্তানা থেকে পুলিশ অনেক অস্ত্রশস্ত্রসহ কতিপয় ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীকেও পাকড়াও করেছিল।[17] তার পালিয়ে যাওয়ার পর আমি সেখানে গিয়ে এলাকার লোকজনকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বললো: সে জমির দলীল জাল করে অনেক সাধারণ মানুষের জমি বলপূর্বক দখল করে নিয়ে এ বিশাল দরবার তৈরী করেছে। এলাকার লোকেরা তাকে পছন্দ করে না। তারা আরো বললো: প্রত্যেক জুমু‘আর দিনে এ খানকাতে তার ভক্তরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে সমবেত হয়। তারা তাকে সেজদা করে, নগদ টাকা দান করে এবং সে সেজদাকারীদের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
এরকম পীরদের মধ্যে আরেক পীর হচ্ছে দেওয়ান মুহাম্মদ সাঈদ উদ্দিন সাঈদাবাদী।[18] যার খানকা ও আস্তানা ঢাকার সাঈদাবাদ বাস ষ্টেশনের পূর্বে অবস্থিত। কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকলেও অনেকের দৃষ্টিতে সে প্রথম সারির একজন ওলি ও সাধক। সে জন্যে তার দরবারে দেশের বহু লোক তাদের সমস্যাদি সমাধান ও মনস্কামনা পূরণের জন্য ভিড় জমায়। কখনও আজমীর ও বাগদাদে গেলে জনগণের যোগাযোগের সুবিধার্থে তা পত্রিকান্তরে প্রকাশ করে যায়। আবার আগমন করলে তাও পত্রিকার মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দেয়া হয়।
জনগণ তার নিকট থেকে ঝাড়ফুঁক থেকে আরম্ভ করে তার দো‘আ কামনা, সন্তান প্রাপ্তি ও সমস্যা সমাধানের জন্য যেয়ে থাকে। তার কাছে যেয়ে সন্তান লাভকারীরা মাঝে মধ্যে পত্রিকান্তরে তাদের সন্তান লাভের সংবাদটি প্রচার করে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি তারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং যারা এখনও তার কাছে যায় নি তাদেরকে তার নিকট যাবার উৎসাহ যোগায়। তার এ জাতীয় প্রচারাভিযান দ্বারা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, সে সূফী হওয়াকে নিজের জন্য জনগণের সম্পদ আত্মসাতের একটি সহজ উপায় হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।
[12]. গোলাম সাকলায়েন, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৯৮।
[13]. হিরনালের কবরের নিকটতম ‘কাকিনীবাগ’ গ্রামের মুহাম্মদ ফরহাদ উদ্দিন দেওয়ান এর নিকট থেকে এ তথ্যটি সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনাটি তার নিজের সামনে ঘটিত হয়েছে বলে সে জানায়।
[14] ১৯৮১ সালে পরিচালিত বাংলাদেশের আদম শুমারির পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২৯৮০০০ ব্যক্তি তাদের পেশাগত পরিচয় দিতে যেয়ে বলেছেন তাদের পেশা হচ্ছে পীর। দৈনিক ‘করতোয়া’ নামক একটি পত্রিকা এ সংবাদটি প্রকাশ করে এ মন্তব্য করেছে যে, এ সংখ্যাকে বাংলাদেশের মোট গ্রামের মধ্যে ভাগ করলে প্রতি গ্রামের ভাগে মোট চারজন করে ‘পীর’ পড়বে। এতে প্রমাণিত হয় যে, ‘পীর’ পেশাই এখন অন্যান্য সকল পেশার চেয়ে লাভজনক। দেখুন : দৈনিক ‘করতোয়া’, (বগুড়া : ১৮/১২/১৯৮৭ খ্রি.), পৃ.৩।
[15]. মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী, রাসূল সত্যই কি গরীব ছিলেন; (ঢাকা : সূফী ফাউন্ডেশন, আরামবাগ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ. ১২।
[16]. মাহবুবে খোদা দেওয়ানবাগী, আল্লাহ কোন্ পথে; (ঢাকা : সূফী ফাউন্ডেশন, আরামবাগ, ৩য় সংস্করণ, সন বিহীন), পৃ. ১৯৮।
[17]. দেখুন : দৈনিক ইনকিলাব, ১ম পৃষ্ঠা, তারিখ : ২৬/১২/১৯৯৯ খ্রি.।
[18]. অনেকের সাথে আলাপ করে এ ব্যক্তি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো : এ লোকটি একজন সাধারণ মানুষ, কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান নেই। আজমীর ও বাগদাদ গমনের মাধ্যমে সে মা‘রিফাত ও সুলুকের পথ ধরে। ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। তার নিকট দেশের সাধারণ জনগণের মত অনেক রাজনীতিবিদরাও গমন করে থাকেন। প্রতি সপ্তাহে জুমু‘আর নামাজের পর মিলাদ মাহফিল করা হলো তার একটি সাধারণ রীতি।
আমরা প্রথম অধ্যায়ে জাহেলী যুগের শির্কের কেন্দ্রসমূহের ধরণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে আমরা এ বিষয়টি খতিয়ে দেখবো যে, বাংলাদেশে অবস্থিত শির্কের কেন্দ্রসমূহের সাথে সে যুগের কেন্দ্রসমূহের কতটুকু সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ইসলাম পরবর্তী যুগে বিভিন্ন মুসলিম বা অমুসলিম দেশে বিশেষ করে আমাদের দেশে ওলীদের কবর বা তাঁদের নিদর্শনের উপর যে সব কেন্দ্র তৈরী করা হয়েছে, সেগুলোর বিশেষ ধরনের মিল রয়েছে নূহ ‘আলাইহিস সালাম-এর জাতির মধ্যকার ওয়াদ্দ, সুয়া‘, ইয়াগুস, ইয়া‘উক ও নসর নামের ওলিদের কবরে নির্মিত কেন্দ্রসমূহের সাথে; কেননা, তাঁদের নামে পৃথক পৃথক মূর্তি তৈরী করার পূর্বে তাঁদের ভক্তরা তাঁদের কবরগুলোর সাথে ঠিক সেরকমই আচরণ করেছিল যেরূপ আচরণ অধিকাংশ সাধারণ মুসলিমরা আজ তাদের ওলীদের কবরসমূহের সাথে করে থাকে।
সে সময় থেকে আরম্ভ করে সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত লোকেরা তাদের আউলিয়া ও নবীদের সম্মান ও তা‘জিম করতে গিয়ে এবং তাঁদেরকে সাধারণ মানুষের জীবনের কল্যাণার্জন এবং অকল্যাণ দূরীকরণের ক্ষেত্রে শাফা‘আতকারী মনে করার কারণেই তাঁদের কবরগুলোকে শির্কের কেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে মুসলিমরাও তাদের ওলীদের সম্মান ও তা‘জিম করতে গিয়ে এবং দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে আল্লাহ ও তাদের মাঝে মধ্যস্থতাকারী ও শাফা‘আতকারী হওয়ার ধারণা করার ফলে তাঁদের কবর ও কবরগুলোকে ঠিক একই কায়দায় শির্কের কেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছে।
পাগলদের কবরসমূহে নির্মিত কেন্দ্রসমূহ বা তথাকথিত বেলায়েতের দাবীদাররা নিজেদের জন্য যে সব কেন্দ্র নির্মাণ করেছে, সেগুলোরও ওলীদের কবরে নির্মিত কেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। এরা যদিও ওলীদের অন্তর্ভুক্ত নয়, তথাপি লোকেরা তাদেরকে অজ্ঞতাবশত ওলীদের মাঝে গণ্য করে নিয়েছে। এ ছাড়াও সে কালের গণকদের সাথে এদের বিশেষ রকমের মিল রয়েছে; কেননা, সে কালের গণকদের সাথে শয়তান জিনের সম্পর্ক ছিল, বর্তমান কালের বেলায়াতের দাবীদারদের সাথেও শয়তান জিনের গোপন সম্পর্ক রয়েছে।
এ জিনদের সহযোগিতাতেই যেমন গণকরা জনগণের উপকার করতো, তেমনি এরাও জিনদের সহযোগিতায় জনগণের উপকার করে থাকে। তাই সাধারণ লোকদের দৃষ্টিতে এরা আল্লাহর ওলি হয়ে থাকলেও মূলত তারা শয়তানের ওলি ও বন্ধু। সে জন্যেই তারা নিজেদের বেলায়াত লাভের বিষয় গোপন না রেখে পত্রিকান্তরে প্রকাশ করে। সাধারণত কা‘বা শরীফ ও মসজিদে নববী যিয়ারতের বদলে তারা আজমীর ও বাগদাদে যায়। নিজ নিজ খানকাতে ওরস পালনের নামে জাহেলী যুগের মুশরিকদের ন্যায় ঈদ পালন করে।
অবশিষ্ট বিভিন্ন গাছপালা, পুকুর, কূপ ও জীব জন্তুকে কেন্দ্র করে যে সকল শির্কের কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর মিল রয়েছে আরবের মুশরিকদের ‘লাত’ ‘উয্যা’ ‘মানাত’ ও ‘যাতে আনওয়াত’ নামের পাথর ও গাছকে কেন্দ্র করে নির্মিত শির্কের কেন্দ্রসমূহের সাথে; কেননা সেগুলোও গাছ ও পাথরকে কেন্দ্র করেই নির্মাণ করা হয়েছিল।