এক শ্রেণীর পীর, দরবেশ, ফকীর বা সুফীদের দাবী যে, তাদের নিকট নাকি বহু বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে কাশ্য হয়; যেমন আল্লাহর নবীর প্রতি অহী হতো। আবার অনেকে স্বপ্নে বা জাগ্রতাবস্থায় আল্লাহ অথবা তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করে সরাসরি দ্বীনী ও নাজাতের জ্ঞান এবং পথ অর্জন করে থাকে। আর এর হাওয়ালায় নতুন-নতুন দ্বীনী আচার-অনুষ্ঠান আবিষ্কার করে থাকে। শুধু তাই নয় বরং তারা এই নিয়ে গর্বও করে, তাদের ঐ জ্ঞান (?)কে কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়, কিতাব ও সুন্নাহর আলেমের প্রতি কুটি হেনে বলে, তোমাদের সনদ (বর্ণনা সুত্র) তো এক মৃত ব্যক্তি হতে অপর এক মৃত ব্যক্তি। কিন্তু আমরা সরাসরি আল্লাহ। রব্বল আলামীনের নিকট হতে ইলম গ্রহণ করে থাকি। তাই তাদের সনদে তারা বলে, আমার প্রভু হতে আমার হৃদয় আমাকে বয়ান করেছে যে,
বলে, তোমাদের কিতাবী ইম, আর আমাদের কালবী ইম; কলবে কলবে বাতেনী ইলম! মৌলভীরা তো পানারি পাতার মত পানির (ইলমের) উপর ভেসে বেড়ায়, আমরা পানির (ইলমে) গভীরে প্রবেশ করি ---- ইত্যাদি বুলি আওড়ে কিতাব ও সুন্নাহ ছেড়ে দ্বীনী বিধানের তৃতীয় উৎসরূপে তাদের মনের মানস কল্পনা ও ভাবাবেগকে শ্রেষ্ঠ কারামত বলে জাহির করে এবং বহু অজ্ঞ তাদের সেই কাল্পনিক কথার অনুসরণ করে নিজেদেরকে কৃতার্থ মনে করে অথচ তারাই সর্বনাশগ্রস্ত বিদআতী।
অধিকাংশ বিদআতীরা দুর্বল হাদীসের উপর ভিত্তি করে বিদআত (আমল) করে থাকে। এই ধরনের হাদীস ব্যাপকভাবে প্রচার করে থাকে। এর দ্বারা তাদের লিখিত কিতাবের কলেবরও বৃদ্ধি করে থাকে অথচ ঠিক একই সময়ে বহু সংখ্যক সহীহ হাদীসকে রদ করে থাকে। তার উপর আমল করতে অজুহাত পেশ করে বলে, 'ঐ হাদীস অসূলের খেলাফ’, অথবা ওটা খবরে ওয়াহেদ ইত্যাদি। আর এই ধরনের খোঁড়া ওজরে কত সুন্নত বরং ওয়াজেব ত্যাগ করে বসে।।
আবার প্রতিবাদ করে যদি ওদেরকে বলা হয় যে, যে হাদীসের উপর ভিত্তি করে আমল করছেন তা তো যয়ীফ অথবা মওযু'। তখন ওরা তার প্রত্যুত্তরে এমন কথা বলে যা অর্থহীন। যেমন বলে যে, 'ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীসের উপর আমল চলবে’ ইত্যাদি। অথচ এ কথা শর্তহীন নয়। (দেখুনঃ তানবীহু উলিল আবসার)। “মুহাদ্দেসীন ও অসুলিইয়্যীনদেন নিকট যথাস্থানে নির্দিষ্ট শর্তাবলীর সহিত ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা যায়।” এই কথার উপর দুটি আপত্তিমূলক টিপ্পনী রয়েছে।
(১) এই উক্তি হতে অনেকেই সাধারণ’ বা ‘ব্যাপক অর্থ বুঝে থাকে। মনে করে যে, উক্ত আমলে উলামাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। অথচ এ রকমটা নয় বরং তাতে বিদিত মতভেদ বর্তমান যা বিভিন্ন হাদীসের পারিভাষিক (অসূলেহাদীসের) গ্রন্থ মূহে বিশদভাবে আলোচিত। যেমন আল্লামা শায়খ জামালুদ্দীন কাসেমী (রঃ) তার গ্রন্থ (কাওয়ায়েদুল হাদীসে) আলোচনা করেছেন। তিনি ১১৩ পৃষ্ঠায় ইমামগণের এক জামাআত থেকে নকল করেন যে, তাঁরা আদপে যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা ঠিক মনে করতেন না। যেমন, ইবনে মাঈন, বুখারী, মুসলিম, আবু বাকর ইবনুল আরাবী প্রভৃতিগণ। এঁদের মধ্যে ইবনে হাযম অন্যতম; তিনি তার গ্রন্থ আল-মিলাল অনিহাল’ এ বলেন, '(সেই হাদীস দ্বারা আমল সিদ্ধ হবে) যে হাদীসকে পূর্ব ও পশ্চিমের লোকেরা (অর্থাৎ, বহু সংখ্যক লোক) কিংবা সকলেই সকল হতে কিংবা বিশ্বস্ত বিশ্বস্ত হতে নবী প্ল থেকে বর্ণনা করেছে। কিন্তু যে হাদীসের বর্ণনা-সুত্রে কোন মিথ্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি, কিংবা কোন অমনোযোগী গাফেল ব্যক্তি কিংবা কোন পরিচয়হীন অজ্ঞাত ব্যক্তি থাকে, তাহলে সেই হাদীস (যয়ীফ হওয়া সত্ত্বেও তার) দ্বারা কতক মুসলিম বলে থাকে (আমল করে থাকে)। অবশ্য আমাদের নিকট এমন হাদীস দ্বারা কিছু বলা (বা আমল করা), তা সত্য জানা এবং তার কিছু অংশ গ্রহণ করাও অবৈধ।
হাফেয ইবনে রজব তিরমিযীর ব্যাখ্যা-গ্রন্থে (২/১১২)তে বলেন, 'ইমাম মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় যা উল্লেখ করেছেন তার প্রকাশ্য অর্থ এই বুঝায় যে, তরগীব ও তরহীবে (অনুপ্রেরণাদায়ক ও ভীতি সঞ্চারক)এর হাদীসও তার নিকট হতেই বর্ণনা করা হবে, যার নিকট হতে আহকাম (কর্মাকর্ম সম্পর্কিত)এর হাদীস বর্ণনা করা হয়। (অর্থাৎ যয়ীফ রাবী হতে যেমন আহকামের হাদীস বর্ণনা করা হয়। না, তেমনিই সেই রাবী হতে তরগীব ও তরহীবের হাদীসও বর্ণনা করা হবে না।)
এ যুগে অদ্বিতীয় মুহাদ্দেস আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন, 'এই অভিমত ও বিশ্বাস রেখেই আমি আল্লাহর আনুগত্য করি এবং এই অভিমতের প্রতিই মানুষকে আহবান করি যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা আদপে আমল করা যাবে না, না ফাযায়েল ও মুস্তাহাব আমলে আর না অন্য কিছুতে। কারণ, যয়ীফ হাদীস কোন বিষয়ে অনিশ্চিত ধারণা জন্মায় মাত্র (যা নিশ্চিতরূপে রসুল প্লঃ-এর বাণী নাও হতে পারে।)* এবং আমার জানা মতে, উলামাদের নিকট এটা অবিসংবাদিত। অতএব যদি তাই হয়, তবে কিরূপে ঐ হাদীস দ্বারা আমল করার কথা বৈধ বলা যায়? অথচ আল্লাহ অজাল্লা তাঁর কিতাবে একাধিক স্থানে ধারণার নিন্দাবাদ করেছেন; তিনি বলেন,
وَمَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ ۖ وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
অর্থাৎ, ওদের এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই, ওরা অনুমানের অনুসরণ করে অথচ সত্যের বিরুদ্ধে অনুমানের (ধারণার) কোন মূল্য নেই। (সূরা নাজ্ম ২৮ আয়াত)
আর আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, “তোমরা অনুমান (ধারণা) করা হতে বাঁচ। অবশ্যই অনুমান সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা।” (বুখারী ও মুসলিম)
জেনে রাখুন যে, আমি যে রায় এখতিয়ার করেছি তার প্রতিপক্ষের নিকট এই রায়ের বিপক্ষে) কিতাব ও সুন্নাহ থেকে কোন দলীল নেই। অবশ্য পরবর্তীযুগের কোন আলেম তার গ্রন্থ আল-আজবিবাতুল ফাযেলাহ’ তে এই মাসআলার উপর নির্দিষ্ট পরিচ্ছেদে (৩৬-৫৯পৃঃ) ওঁদের সমর্থনে (ও আমাদের এই অভিমতের বিরুদ্ধে) দলীল পেশ করার প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের সপক্ষে অন্ততঃপক্ষে একটিও এমন দলীল উল্লেখ করতে সক্ষম হননি, যা হুজতের। উপযুক্ত! হ্যাঁ, তবে কিছু এমন উক্তি তাঁদের কারো কারো নিকট হতে নকল করেছেন, যেগুলি উক্ত বিতর্ক ও সমীক্ষার বাজারে অচল।
এতদসত্ত্বেও ঐ সমস্ত উক্তির কিছু কিছুতে পরস্পর-বিরোধিতাও বিদ্যমান। যেমন, ৪১ পৃষ্ঠায় ইবনুল হুমাম হতে নকুল করেন, “গড়া নয় এমন যয়ীফ হাদীস দ্বারা ইস্তিহবাব প্রমাণিত হবে।” অতঃপর ৫৫-৫৬ পৃষ্ঠায় জালালুদ্দীন দাওয়ানী হতে নকল করেন, তিনি বলেছেন, এ কথা সর্বসম্মত যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা শরীয়তের আহকামে খামসাহ’ (অর্থাৎ ওয়াজেব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মকরূহ ও হারাম) প্রমাণিত হবে না এবং ওর মধ্যে ইস্তিহবাবও।
আমি (আলবানী) বলি, এ কথাটাই সঠিক। যেহেতু অনুমান দ্বারা আমল নিষিদ্ধ এবং যয়ীফ হাদীস অনিশ্চিত অনুমান বা ধারণা সৃষ্টি করে, যেমন পূর্বে আলোচিত
মোট কথা, ফাযায়েলে আমাল বলতে এমন আমল যার ফযীলত আছে, তা যয়ীফ হাদীসের উপর ভিত্তি করে করা যাবে না। করলে তা বিদআত বলে গণ্য। হবে। যেহেতু যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোন আহকাম বা আমল (অনুরূপ কোন আকীদাও) সাব্যস্ত হয় না। তবে এমন আমল যা সহীহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে তার ফযীলত বর্ণনায় আমল করা যায়, তবে তারও শর্ত আছে যা পরে বলা হবে।
উদাহরণস্বরূপ, চারে নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মুসলিম) কিন্তু তার ফযীলত প্রসঙ্গে এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি ঐ নামায পড়বে তার পাপ সমুদ্রের ফেনার সমান হলেও ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি নিয়মিত বারো রাকআত চাশ্বের নামায পড়ে, তার জন্য আল্লাহ পাক বেহেস্তে এক সোনার মহল তৈরী করেন।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
আর এ দুটি হাদীসই যয়ীফ। চাশ্বের নামাযের এই ফযীলত বিশ্বাসে (ওঁদের মতে) তা ব্যবহার করা যায়। অনুরূপভাবে কুরবানী করা ও তার মর্যাদা কুরআন ও সুন্নাহতে প্রমাণিত তার ফযীলত বর্ণনায় (ওঁদের মতে কিছু শর্তের সাথে) কুরবানীর পশুর প্রত্যেক লোমের পরিবর্তে এক একটা নেকী--” এই হাদীস ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।।
এ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন, “শরীয়তে যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করা বৈধ নয়, যা সহীহ বা হাসান নয়। কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল প্রভৃতি উলামাগণ ফাযায়েলে আমালে সাবেত (প্রমাণসিদ্ধ) বলে জানা না যায় এমন হাদীস বর্ণনা করাকে জায়েয বলেছেন, যদি তা (ঐ যয়ীফ হাদীস) মিথ্যা বলে জানা না যায় তবে।
অর্থাৎ, যখন জানা যাবে যে, আমল শরয়ী (সহীহ) দলীল দ্বারা বিধেয় এবং তার ফযীলতে এমন হাদীস বর্ণিত হয় যা মিথ্যা (মওযু’) বলে জানা যায় না, তাহলে (হাদীসে বর্ণিত) সওয়াব সত্য হতে পারে (এই বিশ্বাস করা যায়)। কিন্তু ইমামগণের কেউই এ কথা বলেননি যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোন কিছুকে ওয়াজেব অথবা মুস্তাহাব করা যাবে। আর যে এ কথা বলে সে ইজমা’ (সর্ববাদীসম্মতি)র বিরোধিতা
করে। তদনুরূপ, কোন শরয়ী (সহীহ) দলীল ছাড়া কোন কিছুকে হারাম করাও অবৈধ। কিন্তু যদি (কোন সহীহ হাদীস দ্বারা) তার হারাম হওয়ার কথা বিদিত হয়। এবং ঐ কাজের কর্তার জন্য শাস্তি বা তিরস্কারের কথা কোন এমন (দুর্বল) হাদীসে বর্ণিত হয় - যা মিথ্যা বলে জানা না যায় - তবে তা (ঐ শাস্তির বিশ্বসে) বর্ণনা করা বৈধ। অনুরূপভাবে তরগীব ও তরহীবে ঐরূপ হাদীস বর্ণনা করা বৈধ হবে; যদি তা মিথ্যা (গড়া) বলে পরিচিত না হয়। কিন্তু এ কথা জানা জরুরী হবে যে, আল্লাহ এ বিষয়ে এই অজ্ঞাতপরিচয় হাদীস ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় (সহীহ) দলীলে তরগীব বর্ণনা করেছেন।
অনুরূপভাবে ইসরাঈলিয়াতও তরগীব ও তরহীবে বর্ণনা করা যায়, যদি তা মিথ্যা বলে বিদিত না হয় এবং যখন জানা যায় যে, ঐ বিষয়ে আল্লাহ পাক আমাদের শরীয়তে আদেশ দান করেছেন অথবা নিষেধ করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র অপ্রমাণিত (অশুদ্ধ) ইসরাঈলিয়াত দ্বারা আমাদের শরীয়ত প্রমাণ করা হবে -এ কথা কোন। আলেম বলেন না। বরং ইমামগণ এই ধরণের কোন হাদীসকেই শরীয়তের বুনিয়াদ করেন না। আহমাদ বিন হাম্বল এবং তার মত কোন ইমামই শরীয়তে ঐ ধরনের হাদীসের উপর নির্ভর (ভিত্তি) করতেন না। যে ব্যক্তি নকল করে যে, আহমাদ। যয়ীফ হাদীসকে হুজ্জত (বা দলীল) করতেন; যে হাদীস সহীহ বা হাসান নয়, তবে নিশ্চয় সে তার সম্পর্কে ভুল বলে।” (আল কায়েন্নাতুল জালীয়াহ ৮২ পৃঃ, মজমুত্ম ফাতাওয়া ১/২৫ ১ নং)।
আল্লামা আহমাদ শাকের আল-বায়েষুল হাষীষ’ গ্রন্থে (১০১ পৃষ্ঠায়) বলেন, ‘আহমাদ বিন হাম্বল, আব্দুর রাহমান বিন মাহদী এবং আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রঃ) এর উক্তি, যখন আমরা হালাল ও হারামে (আহকামে) হাদীস বর্ণনা করি, তখন কড়াকড়ি করি এবং যখন ফাযায়েল ইত্যাদিতে বর্ণনা করি তখন শৈথিল্য করি-- আমার মতে -অল্লাহ আ’লাম- তাঁদের বলার উদ্দেশ্য এই যে, শৈথিল্য কেবল হাসান হাদীস গ্রহণে করতেন যা সহীহ’ এর দর্জায় পৌছে না। কারণ সহীহ ও হাসানের মাঝে পার্থক্যরূপ পরিভাষা তাঁদের যুগে স্পষ্ট স্থিত ছিল না। বরং অধিকাংশ পূর্ববর্তীগণ হাদীসকে কেবল সহীহ অথবা যয়ীফ (এই দুই প্রকার) বলেই মনে করতেন।
সুতরাং তাঁদের ঐ শৈথিল্য যয়ীফ হাদীস বর্ণনায় নয়, হাসান হাদীস বর্ণনায়।) আল্লামা আলবানী বলেন, 'আমার নিকট এর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা রয়েছে, তাদের ঐ উল্লেখিত শৈথিল্য ইসনাদ (বর্ণনা সূত্র)সহ যয়ীফ হাদীস রেওয়ায়াত করার উপর মানা যায় - যেমন তাদের বর্ণনার ধারা ও প্রকৃতি; যে ইসনাদ সমূহের মাধ্যমে হাদীসের দুর্বলতা জানা সম্ভব হয়। সুতরাং কেবলমাত্র সনদ উল্লেখ করাই যথেষ্ট হয় এবং যয়ীফ’ বলে বিবৃত করার প্রয়োজন আর থাকে না। কিন্তু ঐ ধরণের হাদীস বিনা সনদে বর্ণনা করা যেমন পরবর্তীকালে উলামাগণের ধারা ও প্রকতি এবং তার। দুর্বলতা বর্ণনা না করা যেমন ওঁদের অধিকাংশের রীতি - এমন পদ্ধতি অবলম্বন। করা থেকে তাঁরা (ইমাম আহমাদ প্রভৃতিগণ) বহু ঊর্ধে এবং এ বিষয়ে তাঁরা আল্লাহকে অধিক ভয় করতেন। আর আল্লাহই অধিক জানেন।
(২) যে ব্যক্তি এ ধরণের কোন গ্রন্থ লিখেন যাতে চোখ বুজে সহীহ-যয়ীফ সবই সংকলন করেন এবং মনে করেন যে, কিছু শর্তের সাথে যয়ীফ হাদীস দ্বারা ফাযায়েলে আ’মালে আমল করা যায় তাঁর উচিত, গ্রন্থের ভূমিকায় সে বিষয়ে (সাধারণকে) সতর্ক করা এবং ঐ শর্তাবলী উল্লেখ করে (সেই অনু্যায়ী) আমল করতে সাবধান করা। যাতে পাঠকও অজান্তে গ্রন্থে উল্লেখিত প্রত্যেক হাদীসের উপর আমল এবং মুবাল্লেগও ঐ গ্রন্থ শুনিয়ে সকলকে আমল করার তাকীদ না করে বসে। ফলে সকলের অজান্তেই সকলে রসুলের বিরোধিতায় লিপ্ত না হয়ে পড়ে। সুতরাং ঐ শর্তগুলিকে জানা একান্ত জরুরী; বিশেষ করে তাদের জন্য যারা ফাযায়েলে যয়ীফকে ব্যবহার করে থাকে। যাতে যে কেউ ধংস হবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট জানার পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট জানার পর জীবিত থাকে। হাফেয সাখাবী ‘আল-কওলুল বাদী’ (১৯৫ পৃঃ)তে তার ওস্তাদ হাফেয ইবনে হাজার থেকে ঐ শর্তগুলি নকল করেছেন এবং তা নিম্নরূপঃ
(ক) হাদীস যেন খুব বেশী যয়ীফ না হয়। অথবা তার বর্ণনা সুত্রে যেন কোন মিথ্যাবাদী, মিথ্যায় কলঙ্কিত বা অভিযুক্ত এবং মারাত্মক ত্রুটি করে এমন ব্যক্তি না থাকে।
(খ) তা যেন (শরীয়তের) সাধারণ ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ একেবারে ভিত্তিহীন গড়া বা জাল হাদীস না হয়। (গ) এ হাদীস দ্বারা আমল করার সময় যেন তা প্রমাণিত (বা শুদ্ধ) হাদীস বলে। বিশ্বাস না রাখা হয়। যাতে নবী ধ্রু-এর সহিত সেই সম্পর্ক না জোড়া হয়; যা তিনি বলেননি। অতঃপর তিনি বলেন শেষোক্ত শর্ত দুটি ইবনে আব্দুস সালাম ও ইবনে দাক্বীকুল ঈদ হতে বর্ণিত এবং প্রথমোক্তের জন্য আলাঙ্গ বলেন, ‘তা সর্বদিসম্মত।
ইবনে হাজার (রঃ) তাঁর পুস্তিকা তাবয়ীনুল আজব’ এ বলেন, 'আহলে ইলমগণ ফাযায়েলে যয়ীফ হাদীস ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন; যদি তা গড়া না হয় বা খুব বেশী যয়ীফ না হয় -এ কথাটি প্রসিদ্ধ। কিন্তু এর সহিত এই শর্তও আরোপ করা উচিত যে, আমলকারী যেন ঐ হাদীসটিকে যয়ীফ বলেই বিশ্বাস রাখে (শুদ্ধ মনে না করে) এবং তা যেন প্রচার না করে। যাতে কেউ যেন যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করে যা শরীয়ত নয় তাকে শরীয়ত করে না বসে অথবা কোন জাহেল তাকে আমল করতে দেখে তা সহীহ সুন্নাত মনে না করে বসে।
এ বিষয়ে আবু মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুস সালাম প্রভৃতি উলামাগণ বিবৃতি দিয়েছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর রসূল ধ্রু-এর সেই বাণীর পর্যায়ভুক্ত না হয়ে পড়ে যাতে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আমার তরফ থেকে কোন এমন হাদীস বর্ণনা করে যার বিষয়ে সে মনে করে যে তা মিথ্যা, তাহলে সে (বর্ণনাকারী) মিথ্যাবাদীদের একজন।” (মুসলিম, সহীহুল জামে’৬১৯৯নং)
সুতরাং যে আমল করবে তার অবস্থা কি? আহকাম অথবা ফাযায়েলে (যয়ীফ) হাদীস দ্বারা আমল করায় কোন পার্থক্য নেই। (অর্থাৎ যদি যয়ীফ হাদীস দ্বারা আহকাম বা হালাল ও হারামে আমল না চলে তবে ফাযায়েলেও চলবে না। কারণ, (উভয়ের) সবটাই শরীয়ত।
আল্লামা আলবানী (রঃ) বলেন, 'এই সমস্ত শর্তাবলী খুবই সুন্ন ও গুরুত্বপুর্ণ। যদি যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমলকারীরা এর অনুগামী হয়, তাহলে তার ফল এই হবে যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমলের সীমা সংকীর্ণ হবে অথবা মূলেই আমল প্রতিহত হবে। এর বিররণ তিনভাবে দেওয়া যায়ঃ| প্রথমতঃ প্রথম শর্তটি নির্দেশ করে যে, যে হাদীসকে ভিত্তি করে আমল করার ইচ্ছা হবে সেই হাদীসটির প্রকৃত অবস্থা জানা ওয়াজেব। যাতে বেশী যয়ীফ হলে। তার দ্বারা আমল করা থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রত্যেক হাদীসের উপর এই জ্ঞান লাভ জনসাধারণের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। যেহেতু হাদীসশাস্ত্রবিদ উলামার সংখ্যা নেহাতই কম, বিশেষ করে বর্তমান যুগে। অর্থাৎ, (সেই উলামার সংখ্যা নগণ্য যাঁরা তথ্যানুসন্ধানকারী (সমস্ত হাদীসের সত্যাসত্য যাচাইকারী) গবেষণা ও সমীক্ষাকারী হাদীস বিশারদ, যাঁরা রসুল প্ল হতে শুদ্ধ প্রতিপাদিত হাদীস ব্যতীত লোকদের জন্য অন্য কোন হাদীস পরিবেশন ও বর্ণনা করেন না এবং যয়ীফ (তথা তার নিম্নমানের) হাদীসের উপর সকলকে সতর্ক ও সাবধান করে থাকেন। বরং এই গ্রুপের উলামা অল্পের চেয়ে কম। সুতরাং আল্লাহই সাহায্যস্থল।
এরই কারণে দেখেবেন, যারা হাদীস দ্বারা আমলে আপদগ্রস্ত হয়েছে তারা এই শর্তের স্পষ্ট বিরোধিতা করে। তাদের কেউ যদিও বা সে অহাদীসের আলেম হয় - ফাযায়েলে আমালে কোন হাদীস জানা মাত্রই তা অধিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত কিনা। তা না জেনেই তার উপর আমল করায় ত্বরান্বিত হয়। এরপর যদি কেউ তাকে ঐ হাদীসের দুর্বলতার উপর সতর্ক করে, তবে শীঘ্র ঐ তথাকথিত কায়দার’ শরণাপন্ন হয়; “ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীস ব্যবহার করা যায়।” পুনশ্চ যখন এই শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, তখন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকে যায়। এ বিষয়ে আল্লামা দুটি উদাহরণ পেশ করেন? (১) “সর্বোৎকৃষ্ট দিন আরাফার দিন; যদি জুমআর দিনের মুতাবেক হয় তবে তা সত্তর হজ্জ অপেক্ষা উত্তম।” (রাযীন)
এ হাদীসটির প্রসঙ্গে আল্লামা শায়খ আলী আল-ক্বারী বলেন, কিছু মুহাদ্দেসীন বলেন যে, এই হাদীসের ইসনাদটি যয়ীফ, তা সঠিক মানা গেলেও উদ্দেশ্যে কোন ক্ষতি হয় না। যেহেতু যয়ীফ হাদীস ফাযায়েলে আমালে গ্রহণীয় এবং আল্লামা আবুল হাসানাত লখনবী এই কথা নকল করে বহাল করেছেন। (আল আজৰিবাতুল ফাযেলাহ ৩৭ পৃঃ) কিন্তু ভাবার বিষয় যে, কিরূপে এই শ্রদ্ধাভাজন আলেমদ্বয় উপযুক্ত শর্ত লংঘন করেছেন। অথবা নিশ্চয় তাঁরা এই হাদীসের সনদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। থাকলে অবশ্যই তা বিবৃত করেন এবং তার পরিবর্তে বিতর্ক ছলে ‘তা মানা গেলেও এই কথা বলতেন না। অথচ আল্লামা ইবনুল কাইয়েম ঐ হাদীস প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বলেন, 'বাতিল, রসূলুল্লাহ প্লঃ হতে ওর কোন ভিত্তি নেই, আর না কোন সাহাবী বা তাবেয়ী হতে।” (যাদুল মাআদ ১/১৭) (২) “যখন তোমরা হাদীস লিখবে, তখন তোমরা তার সনদ সহ লিখ। যদি তা সত্য হয়, তাহলে তোমরা সওয়াবের অংশীদার হবে। আর যদি তা বাতিল হয়, তাহলে তার পাপ তার (বর্ণনাকারীর) হবে।” (আল আজৰিবাতুল ফাযেলাহঃ ২৬পৃঃ)
এই হাদীসটি মওযু’ (গড়া হাদীস)। (দেখুন ও সিলসিলাতু আহাদীসিয যয়ীফাহ অল মওযুআহ ৮২২নং) এতদসত্ত্বেও শ্রদ্ধেয় লখনবী সাহেব এর উপর চুপ থেকেছেন। কারণ, এটাও ফাযায়েলে আমাল তাই! অথচ এটি এমন একটি হাদীস যা যয়ীফ ও জাল হাদীস প্রচার করতে ও তার উপর আমল করতে সকলকে অনুপ্রাণিত করে। যার মর্মার্থ হচ্ছে নকলকারীর কোন পাপ নেই। অথচ এমন ধারণা আহলে ইলমদের নীতির পরিপন্থী। যেহেতু তাঁদের নীতি এই যে, গড়ার কথা বিবৃত না করে কোন গড়া হাদীস বর্ণনা করাই জায়েয নয়। তদনুরূপ যথার্থতা যাচাইকারী সংস্কারক উলামা; যেমন ইবনে হিব্বান প্রভৃতিগণের নিকট যয়ীফ হাদীসও (তার দুর্বলতা উল্লেখ না করে বর্ণনা বৈধ নয়)।
আল্লামা আহমাদ শাকের উপযুক্ত তিনটি শর্তাবলী উল্লেখ করা সর্বাবস্থায় ওয়াজেব। কারণ, তা উল্লেখ না করলে পাঠক অথবা শ্রোতার ধারণা হয় যে, তা সহীহ বিশেষ করে, নকলকারী অথবা বর্ণনাকারী যদি উলামায়ে হাদীসের মধ্যে কেউ হন (অথবা দ্বীনের বুযুর্গ হন ও সমাজে মান্য হন); যাঁর প্রতি সকলে হাদীস বিষয়ে রুজু করে। যেহেতু যয়ীফ হাদীস গ্রহণ না করায় আহকামে ও ফাযায়েলে আমাল ইত্যাদির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং সহীহ বা হাসান - যা রসুল থেকে শুদ্ধরূপে প্রমাণিত হয়েছে - তা ব্যতীত কোন কিছুতে কারো হুজ্জত বা দলীল নেই।' (মুখতাসার আল-বায়েষুল হাষীষ ১০ ১পৃঃ)
আল্লামা আলবানী বলেন, 'সার কথা এই যে, এই শর্তের পালন কার্যতঃ যে হাদীস (শুদ্ধ বা সহীহ বলে) প্রতিপাদিত নয়, সেই হাদীস দ্বারা আমল ত্যাগ করতে বাধ্য করে। কারণ, সাধারণ মানুষের পক্ষে (যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসের) অধিক দুর্বলতা জানা (ও চিহ্নিত করা) কঠিন। ফলতঃ এই শর্তারোপ করার অর্থ ও উদ্দেশ্যের সহিত যা আমরা এখতিয়ার করেছি তার প্রায় মিল রয়েছে এবং সেটাই উদ্দিষ্ট। দ্বিতীয়তঃ দ্বিতীয় শর্ত থেকে একথাই বুঝা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে আমল যয়ীফ হাদীস দ্বারা নয়, বরং সাধারণ ভিত্তি না থাকলে (কুরআন বা সহীহ সুন্নাহ হতে ঐ আমলের মূল বুনিয়াদ না থাকলে) যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল হয় না। অতএব এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, এই শর্তের সহিত যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা আপাতদৃষ্ট, বস্তুতঃ নয়। আর সেটাই অভীষ্ট।
তৃতীয়তঃ তৃতীয় শর্তটি হাদীসের দুর্বলতা জানা জরুরী হওয়ার ব্যাপারে প্রথম শর্তেরই অনুরূপ। যাতে আমলকারী তা (সহীহ) প্রমাণিত বলে বিশ্বাস না করে বসে। অথচ বিদিত যে, যারা ফাযায়েলে যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে আমল করে তাদের অধিকাংশই হাদীসের দুর্বলতা চেনে না। আর এটা উদ্দেশ্যের বিপরীত।
পরিশেষে স্থূল কথা এই যে, আমরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মুসলিম জন সাধারণকে উপদেশ করি যে, তাঁরা যেন যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা আদপেই ত্যাগ করেন এবং নবী প্ল থেকে প্রমাণিত (সহীহ বা হাসান) হাদীস দ্বারা আমল করতে উদ্যোগী হন। যেহেতু তাতেই যা আছে যয়ীফ হাদীস থেকে অমুখাপেক্ষী করে। (আমলের জন্য তাই যথেষ্ট।) আর ওটাই রসুল প্ল-এর উপর মিথ্যা বলায় আপতিত হওয়া (ও নিজের ঠিকানা জাহান্নাম করে নেওয়া) থেকে বাঁচার পথ। কারণ, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় জানি যে, যারা এ বিষয়ে বিরুদ্ধাচরণ করে তারা উক্ত মিথ্যাবাদিতায়। সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। যেহেতু তারা প্রত্যেক সবল-দুর্বল (এবং জাল ও গড়া) হাদীস (এবং অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কেচ্ছা-কাহিনীকে হাদীস ধারণা করে তার দ্বারা) আমল করে থাকে। অথচ নবী প্লঃ (এর প্রতি ইঙ্গিত করে) বলেন, “মানুষের মিথ্যাবাদিতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (অনুরূপভাবে যা পড়ে) তার সবটাই বর্ণনা করে।” (মুসলিম)।
আর এর উপরেই বলি মানুষের ভ্রষ্টতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (বা পড়ে) তার সবটার উপরই (বিচার-বিবেক না করে) আমল করে। (যেহেতু চকচক করলেই সোনা হয় না।) (দ্রষ্টব্যঃ সহীহহুল জামেইস সাগীর, ভূমিকা ৪৯-৫৬পৃঃ, তামামুল মিন্নাহ ভূমিকা)
(১) বিদআত কুফরের ডাকঘর। বিদআতীদের বহু ফির্কা তাদের বিদআতের মাধ্যমে কুফরে পৌছে কাফের হয়ে গেছে; যদিও বা তারা নিজেদের পরিচয় মুসলিম বলেই দিয়ে থাকে। যেমন ‘কামেল পীর বা দরবেশদের উপর থেকে শরয়ী বন্ধন তুলে নেওয়া, তাদেরকে আল্লাহর কিছু বৈশিষ্ট্যে (যেমন, গায়েব জানা, মসীবত দুর করা, সন্তান দান করা প্রভৃতির ব্যাপারে) শরীক করা, তাদের কবর সিজদা করা, বা তওয়াফ করা। কাবীরাহ গোনাহকারী মুসলিমকে কাফের জ্ঞান করা ইত্যাদি। যারা কিছু আমল ও ইবাদত তো করে কিন্তু ঐরূপ বিদআতের পাশে কোনই মূল্য নেই। আল্লাহ পাক বলেন,
وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً حَتَّىٰ إِذَا جَاءَهُ لَمْ يَجِدْهُ شَيْئًا
অর্থাৎ, যারা কুফরী করে (সত্য প্রত্যাখ্যান করে) তাদের কর্ম মরুভূমির মরীচিকার ন্যায়, পিপাসার্থ যাকে পানি মনে করে; কিন্তু সে ওর নিকট উপস্থিত হলে দেখে তা কিছুই নয়। (সূরা নুর ৩৯ আয়াত)
(২) বিদআতীরা আল্লাহর উপর বিনা ইলমে অনুমান-প্রসূত কথা বলে। সাধারণতঃ বাতেনী দাবীদাররা এই রোগের রোগী। যারা কলবে জ্ঞানার্জন করে থাকে, কুরআন হাদীস ও তফসীরের ইলমে কোন প্রকারের অনুরাগ প্রকাশ করে না, সলফের পথ জানার কোন ইচ্ছা রাখে না। বরং মনগড়া বাতেনী ইলম দ্বারা স্বপ্ন ও পরিকল্পিত কাশফ দ্বারা এবং ত্রিশ এর অধিক পারা কুরআন (?) দ্বারা ভক্তদের মনোরঞ্জন করে থাকে। শরীয়তের উর্ধ্বে থেকে মারেফতীর দাবী করে সবকাজে ফুর্তি মারে। আর এ সবের মাধ্যমে প্রকৃত ইলম ছাড়াই আল্লাহ ও তদীয় রসূলের উপর হলাহল মিথ্যা বলে। যা বান্দার জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। (সূরা আ'রাফ ৩৩ আয়াত)। মহান আল্লাহ নিজ নবীর জন্য বলেন,
وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ (44) لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ (45) ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ (46) فَمَا مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ (47) وَإِنَّهُ لَتَذْكِرَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ (48) وَإِنَّا لَنَعْلَمُ أَنَّ مِنكُم مُّكَذِّبِينَ (49)
অর্থাৎ, সে যদি কিছু রচনা করে আমার নামে চালাতে চেষ্টা করত, তবে আমি তাকে কঠোর হস্তে দমন করতাম এবং তার কণ্ঠশিরা কেটে দিতাম, তখন। তোমাদের কেউই তাকে রক্ষা করতে পারত না। (সূরা হাক্কাহ ৪৪-৪৯ আয়াত)।
আল্লাহর রসুল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকত আমার উপর মিথ্যা বলে, সে যেন। নিজের ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।” (বুখারী ও মুসলিম)। অনুরূপভাবে শির্ক ও কুফরীর মূলও আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা। যেহেতু মুশরিক অজ্ঞভাবেই মনে করে যে, সে যার পুজা করে সেই মা'বুদ তাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে, তাঁর সামীপ্য দান করবে, তাঁর নিকট সুপারিশ করবে এবং অসীলা বা মাধ্যম হয়ে তাঁর নিকট থেকে তার প্রয়োজন মিটাবে। এ সব অমূলক ধারণা তার কল্পনাপ্রসূত। তাই প্রত্যেক মুশরিক আল্লাহর উপর মিথ্যা ধারণা ও রচনা করে থাকে। আর এইরূপ ধারণা ও অনুমানই বিদআতীকে বিদআতে উৎসাহিত করে। (মাদারেজুস সালেকীন)।
আর “যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে কিংবা তাঁর নিদর্শনসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে তার অপেক্ষা বড় অত্যাচারী আর কে?” (সূরা আ'রাফ ৩৭ আয়াত)।
(২) বিদআতীরা সুন্নাহ ও আহলে সুন্নাহর প্রতি নিতান্ত বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ করে। উল্টোভাবে নিজেদেরকে আহলে সুন্নাহ’ এবং প্রকৃত আহলে সুন্নাহকে ‘কাফের’, ‘ওয়াহাবী ইত্যাদি বলে। অন্ধকার বলে, আলো তুমি নহ ভালো!” বিদআতীরা আহলে সুন্নাহকে বিভিন্নভাবে অপবাদ দিয়ে মন্দ নামে অভিহিত করেছে। যেমন মক্কার মুশরেকীনরা প্রিয় নবী (সা.)-কে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে কেউ বলেছিল, 'যাদুকর’, কেউ বলেছিল, গণক, কেউ বলেছিল, ‘কবি’, কেউ বলেছিল ‘পাগল’, কেউ বলেছিল ‘বিকার গ্রস্ত’, আবার কেউ বলেছিল, 'মিথ্যারচনাকারী মিথ্যক’ ইত্যাদি। অথচ তিনি এ সব অপবাদ থেকে পবিত্র ছিলেন। আল্লাহ বলেছিলেন,
انظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوا فَلَا يَسْتَطِيعُونَ سَبِيلًا
অর্থাৎ, দেখ ওরা তোমার জন্য কি উপমা দেয় ফলে ওরা পথ ভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং ওব্রা পথ পাবে না। (সূরা ইসরা ৪৮ আয়াত)
তদনুরূপ আহলে সুন্নাহ বা সালাফীগণও যাবতীয় অপবাদ থেকে পবিত্র। যেহেতু তারা উজ্জ্বল সুন্নাহ, সন্তোষজন চরিত্র, সরল পথ এবং শক্ত, চুড়ান্ত ও অকাট্য দলীলের ধারক ও বাহক। আল্লাহ আয্যা অজাল্ল যাদেরকে তাঁর কিতাব ও অহীবাণীর অনুসরণ এবং তাঁর রসুলের চরিতাদর্শের অনুকরণ করার তওফীক ও প্রেরণা দান করেছেন। যারা তাঁর অনুকরণে মানুষকে সৎকথা ও কাজের নির্দেশ এবং অসৎ কথা ও কাজে বাধা দান করে থাকে এবং জীবনের প্রতি মুহূর্তে তাঁরই চরিত ও সুন্নাহর অনুসারী থাকে। যাদের বক্ষ তাঁর প্রেমে এবং তাঁর শরীয়তের ইমামগণ ও তাঁর উম্মতের উলামাগণের মহব্বতে সদা প্রশস্ত। আর যারা যে জাতিকে ভালোবাসে তারা কিয়ামতে তাদেরই সঙ্গী হবে। (ই’তিকাদু আহলিল হাদীস)।
(৪) পুর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, বিআতীদের আমল রহিত, যেহেতু দ্বীন পুর্ণাঙ্গ এবং যে কাজে কিতাব বা সুন্নাহর কোন নির্দেশ নেই তা করা ভ্রষ্টতা এবং এর পরিণাম জাহান্নাম। বিদআতীদের নিরর্থক মেহনত এবং বেকার কর্মকান্ডের কোন পারিশ্রমিক, প্রতিদান ও সুফল নেই। আল্লাহ জাল্লা শানুহ বলেন,
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا (103) الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا
অর্থাৎ, বল আমি কি তোমাদেরকে তাদের সংবাদ দেব, যারা কর্মে (আমলে)। বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত? ওরাই তারা, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পন্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে। (সূরা কাহফ ১০৩-১০৪ আয়াত)
(৫) বিদআতীদের সমঝ বিপরীত মুখী হয়ে যায়। জলাতঙ্ক রোগের মত কুপ্রবৃত্তি তাদের শিরা-উপশিরায় স্থানাধিকার করে বসে। ফলে ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো রূপে দেখে থাকে। বিদআতকে সুন্নাত এবং সুন্নাতকে বিদআত জ্ঞান করে থাকে। বিদআতীকে ওলী এবং সুন্নীকে কাফের’ ভেবে থাকে। বাউলিয়াকে আওলিয়া এবং মুত্তাকীন আওলিয়াকে (ইলমের) দেউলিয়া মনে করে। যাদের নিকট কোন হুজ্জত ও দলীল ফলপ্রসু হয় না। নবীর আদেশ মানতে এবং প্রকৃত আওলিয়াদের ও দলীল পথ অনুসরণ করতে বললে বলে, তোমাদের নবী ও আওলিয়াদের পথ অনুসরণ করতে বললে বলে, তোমাদের নবী ও আওলিয়াদের প্রতি কোন আদব ও মহব্বতর্ক নেই। হাদীস ও আয়াত দ্বারা কুরআনের তফসীর করতে গেলে বলে, তোমরা কুরআন বুঝ না, কুরআন মান না। প্রায় সব ব্যাপারেই উল্টা বুঝিল রাম।
(৬) যে বিদআত করলে মানুষ কাফের হয়ে যায় সেই বিদআতের বিদআতী এবং তার প্রতি আহবানকারী বিদআতীর রেওয়ায়াত (হাদীসের বর্ণনা) গ্রহণ যোগ্য নয়। যেমন, তার সাক্ষিও অগ্রহণযোগ্য।
(৭) অধিকাংশ ফিতনার পশ্চাতে কোন না কোন বিদআতীর হাত থাকে এবং বিদআতীরাই বেশীরভাগ ফিতনায় আপতিত হয়ে থাকে। তাদের কারণে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এমন ফিতনার সৃষ্টি হয় যাতে বহু মানুষ সন্ধ্যায় মুমিন থাকে, সকালে কাফের হয়ে যায় এবং সকালে মুমিন থাকলে, সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যায়। সামান্য পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে এরা দ্বীনকে বিক্রয় করে দেয়। বিদআতই দ্বীন ও সমাজের বড় ফিতনা। ইবনে মাসউদ ৩৯ বলেন, “তোমাদের তখন কি অবস্থা হবে, যখন ফিতনা তোমাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেবে? যাতে বড় বৃদ্ধ হবে এবং ছোট প্রতিপালিত (হয়ে বড়) হবে। মানুষ যাকে সুন্নাহ মনে করবে। যখন তা (ফিতনা বা বিদআত) অপসারিত করা হবে তখন লোকেরা বলবে, ‘সুন্নাত অপসারিত হল। একজন জিজ্ঞাসা করল, 'হে আবু আব্দুর রহমান! এরূপ কখন। হবে? তিনি বললেন, 'যখন তোমাদের কৃারীর সংখ্যা অধিক হবে এবং ফকীহ (অভিজ্ঞ আলেমদের) সংখ্যা কম হবে, তোমাদের নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং আমানতদারের সংখ্যা কমে যাবে ও আখেরাতের কর্ম দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ অন্বেষণ করা হবে।” (দারেমী ১/৬৪ নং)
ইমাম মালোকের নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ! কোত্থেকে ইহরাম বাঁধব? তিনি বললেন, ‘যুলহুলাইফা থেকে; যেখান থেকে রসুলুল্লাহ এ ইহরাম বেঁধে ছিলেন। লোকটি বলল, আমি মসজিদে নববী) থেকে ইহরাম বাঁধতে ইচ্ছা করছি। তিনি বললেন, 'এমনটি করো না। লোকটি বলল, 'আমি ইচ্ছা করছি যে, মসজিদে কবরের নিকট থেকে এহরাম বাঁধব।” তিনি বললেন, এমনটি করো না, কারণ আমি তোমার উপর ফিতনার ভয় করি। লোকটি বলল, ‘এটা আবার কোন ফিতনা? এতো কয়েকটা মাইল মাত্র বেশী করব!’ তিনি বললেন, ‘কোন ফিতনা এর চেয়ে অধিক বড় যে, তুমি মনে কর, তুমি এমন। ফযীলতের প্রতি অগ্রগামী হয়েছ, যা হতে রসূল ধ্ৰু পিছে থেকে গেছেন? আমি শুনেছি আল্লাহ বলেছেন যে,
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থাৎ, সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় (ফিতনা) অথবা কঠিন শাস্তি (আযাব) তাদেরকে গ্রাস করবে। (সূরা নুর ৬৩)।
বলাই বাহুল্য যে, বিদআতীদের এটাই হচ্ছে মূল বুনিয়াদ। ভাল জিনিস তো। বাড়তি করলে ক্ষতি কি? তাদের আকেলে অনুরূপ অতিরঞ্জনে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু ইমাম মালেক (রঃ) বলেন, ঐটাই ফিতনা। (৮) বিদআতীর নিকট হক ও বাতিলের মাঝে তালগোল খেয়ে যায়। কখনো বা মস্তবড় গর্হিত কর্ম দেখে চুপ থেকে মৌনসম্মতি জানায়। আবার কখনো ছোট বিষয়ে কোমর বেঁধে লড়ে। কখনো সামান্য বিষয়কে বড় এবং বড় বিষয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তাই কখনো মুসলিমদের জান ও মালকে হালাল মনে করে তাদেরকে হত্যা করে। এবং কখনো মশা মারাও হারাম ভাবে। বিভিন্ন কুসংস্কারদিকে দ্বীন ভাবে। যাদু ও শয়তানী কর্মকান্ডকে কারামত জ্ঞান করে। ফলে তাদের অবস্থা ঠিক বানী ইস্রাঈলদের মত হয়; যাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থাৎ, তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-শুনে সত্য গোপন করো না। (সূরা বাকারাহ ৪২ আয়াত)
(৯) বিদআতী অভিশাপ যোগ্য। তদনুরূপ যে ব্যক্তি কোন বিদআতীর সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে তার উপরেও আল্লাহ ফিরিশ্যামন্ডলী এবং সকল মানুষের অভিশাপ। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “মদীনায় ঈর থেকে সওর পর্যন্ত হারাম। যে ব্যক্তি তার মধ্যে কোন অপকর্ম করবে বা দুর্ঘটনা ঘটাবে বা নবরচিত কর্ম (বিদআত) করবে অথবা এমন অপকর্মকারী বা বিদআতীকে স্থান বা প্রশ্রয় দেবে বা সাহায্য করবে তার উপর আল্লাহ, ফিরিশ্যামন্ডলী এবং সমগ্র মানবমন্ডলীর অভিশাপ। আল্লাহ কিয়ামতের দিন। তার নিকট হতে ফরয ও নফল কোন কিছুই গ্রহণ করবেন না।” (বুখারী, মুসলিম ১৩৬৬নং)।
তিনি আরো বলেন, “আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করে, আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে নিজ পিতামাতাকে অভিসম্পাত করে, আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে কোন দুষ্কৃতকারী বা বিদআতীকে আশ্রয় দেয় এবং আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে ভূমির (জমি-জায়গার) সীমা-চিহ্ন পরিবর্তন করে।” (মুসলিম ১৯৭৮) (১০)
বিদআতী আল্লাহর যিকর হতে মুখ ফিরিয়ে থাকে। আবার যিকর করলেও মনগড়া রচিত যিকর মুখে আওড়ে থাকে। ইল-ইল, হু-হু, হাই-হাই’ প্রভৃতি অর্থহীন শব্দ দ্বারা উচ্চস্বরে আজব যিকর টেনে থাকে। বরং এখানেই শেষ নয়; যিকরের সময় তথাকথিত তন্ময়তা ও ভাবাবেগে তারা নিজেদের দেহ আন্দোলিত করে। কাওয়ালীর স্বরে ও ডুগডুগির তালে নাচতে থাকে। বরং নারী -পুরুষ একই কক্ষে এই যিক হেঁকে থাকে। কখনো বা হুযুরের তরফ থেকে এই প্রত্যাদেশ হয়, ‘মনের আলো বড় আলো বাইরের আলো নিভাও রে, মনের পর্দা বড় পর্দা বাইরের পর্দা উঠাও রে!’
অতঃপর ঐ কামেলের মজলিসে অন্ধকারে বেপর্দায় যা ঘটে, তা বলাই বাহুল্য! অবশ্য এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, ঐ কামেলদের উপর শরীয়তের কোন বাঁধনই অবশিষ্ট থাকে না! পক্ষান্তরে অনেক বিদআতীর নিকট তাদের মনগড়া যিকর আওড়ানো কুরআন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত যিকর তো জানেই না। বলতে গেলে ব্যঙ্গ হাসে অথবা মুখ টেরা করে নেয়। যেহেতু ওদের নিকট কিতাবী’ যিকর অপেক্ষা ‘কলবী’ যিকরে ফযীলত বেশী। তাই কুরআন পঠিত হলে কর্ণপাত করে না অথচ ঐ ধরণের যিকর অথবা কাওয়ালী যিকরের ক্ষেত্রে মন দিয়ে কান লাগিয়ে মাথা হিলিয়ে শোনে ও আওড়ায়। মহান আল্লাহ অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে বলেন,
وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ ۖ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
অর্থাৎ, যারা পরকালে বিশ্বাস রাখে না (তাদের সামনে) যখন একক আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কারো (তাদের উপাস্যদের) উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লাসিত হয়।” (সূরা যুমার ৪৫ আয়াত)
এরা তো সেই বিদআতী যারা কুরআন ও সুন্নাহর নাম শুনলে স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করে। কুরআন-হাদীস শুনতে এদের মন টক হয়ে যায়। কুরআন ও সুন্নাহর মজলিস ও জলসায় উপস্থিত হয় না। হলেও তাদের প্রবৃত্তির প্রতিকূল কথা শুনে মজলিস ছেড়ে পলায়ন করতে চায়। মহান আল্লাহ ঐ শ্রেণীর মানুষের জন্য বলেন,
فَمَا لَهُمْ عَنِ التَّذْكِرَةِ مُعْرِضِينَ * كَأَنَّهُمْ حُمُرٌ مُّسْتَنفِرَةٌ * فَرَّتْ مِن قَسْوَرَةٍ
অর্থাৎ, ওদের কি হয়েছে যে, ব্রা উপদেশ হতে দুরে সরে পড়ে? ওরা যেন ভীতএস্ত গর্দভদল, যা সিংহের সম্মুখ হতে পলায়ন-পর। (সূরা মুদ্দাসসির ৪৯-৫১ আয়াত)
পরন্তু এমন অনেক বিদআতী আছে, যারা উচ্চ ও সমস্বরে কখনো বা লাউড স্পিকারে যিকর হাঁকে। এরা একই সঙ্গে বিদআত করে, রিয়া করে, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় এবং আল্লাহর যিকরের প্রতি মানুষের মনকে বীতরাগ করে তোলে। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই ইসলামকে কেবল যিকর ও খানকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় এবং অন্যান্য ময়দান ও পরিবেশে তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না!
(১১) বিদআতীদের প্রধান চরিত্রসমূহের অন্যতম চরিত্র সত্য গোপন করা। আপন ভক্তদের নিকট কত ন্যায় ও সত্যের অপলাপ ঘটায়, যা প্রকাশ করলে তাদের ভেদ ফাঁস হয়ে যায়। কোন স্বার্থের খাতিরে জানা বিষয়কে না জানার ভান। করে অথবা শব্দার্থ গোপন করে অথবা কূটাই বা দূর ব্যাখ্যা করে অথবা মনগড়া অর্থ করে আসল সত্য গোপন করে। আর এই কাজে তারা এ কাফেরদের দলে শামিল। হয়ে যায়, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ ۖ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
অর্থাৎ, যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে (মুহাম্মাদ)কেও তেমনি চেনে, যেমন তারা তাদের পুত্রদেরকে চেনে। কিন্তু তাদের একদল জেনেশুনে সত্য গোপন করে থাকে।” (সূরা বাক্বারাহ ১৪৬ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,
أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِن بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
অর্থাৎ, তোমরা কি আশা কর যে, ওরা তোমাদের মত ঈমান আনবে? অথচ ওদের মধ্যে একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত এবং বুঝার পর জেনে শুনে তা বিকৃত করত।” (সূরা বাক্বারাহ ৭৫ আয়াত)
অন্যত্র তিনি বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ
অর্থাৎ, আমি যে সব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে আমি কিতাবে ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে, আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেন এবং অভিশাপকারীরাও তাদেরকে অভিশাপ দেয়।” (সূরা বাকারাহ ১৫৯ আয়াত) আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন জানা ইম প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হয় এবং তা গোপন করে, আল্লাহ কিয়ামতে তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন।” (ইবনে মাজাহ)। বলাই বাহুল্য যে, কোন ইলম গোপন করা মুসলিমের জন্য হারাম এবং তার শাস্তি ভয়ানক। অতএব কোন মুত্তাকী ওলী কি করে কি সাহসে কোন ইলম গুপ্ত রাখতে পারেন? যাতে এ কথাই প্রতয়মান হয় যে, কোনও ইলম -যার মাধ্যমে ইহপরকালে মঙ্গলের আশা করা যায়-তা গুপ্ত নেই। সব ইমই আল-আমীন নবী ঐক্ত, তাঁর পর তাঁর আমানতদার সাহাবায়ে কেরাম , তাঁদের পর তাবেয়ীনবৃন্দ (রঃ) এবং তাঁদেরই অনুগামী আউলিয়া ও ইমামগণ প্রকাশ ও প্রচার করে গেছেন। বাতেনী ইলম বলে কিছু নেই; যা আছে তা ভন্ডামি ও ভ্রষ্টতা। বাতেনীর নাম নিয়ে বোকা মানুষদেরকে ধােকায় ফেলে ওরা নিজেদের বুযুর্গী জাহির করে থাকে মাত্র।
(১২) বিদআতের অন্যতম প্রভাব এই যে, বিদআতী তার দ্বারা দ্বীনের সৌন্দর্য বিনষ্ট করে এবং তার অনাবিল রূপে আবিলতা আনে। বিদআতীদের বহুবিধ কুসংস্কার ও কু-আচরণ দেখে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের প্রতি কটাক্ষের সহিত বিদ্রুপ হানে। দরবেশীরূপ, বৈরাগী হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, নযর-নিয়ামের নামে অসদুপায়ে ভক্তদের অর্থহরণ, গাঁজা ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সেবন প্রভৃতি দেখে সকলের মনে। ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। ফলে দ্বীনের আসলরূপ চাপা পড়ে যায় এবং ইসলাম গ্রহণ করা হতে অনেক মানুষ দুরে সরে যায়। বরং বহু অজ্ঞ মুসলিমের মনেও ইসলামের প্রতি বিরাগ জন্মে। ফলে বিদআতীরা মানুষের হেদায়াতের পথে। বাধা হয়ে দাড়ায়।
(১৩) বিদআত মুসলিম জাতির সংহতি ও ঐক্য ধ্বংস করে। সুসংবদ্ধ সমাজের অভ্যন্তরে বিছিন্নতা সৃষ্টি করে, এক এক ধরনের অভিনব বিশ্বাস কর্ম বা কর্মপদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জামাআত বা দল গঠিত হয়। মতানৈক্যের কারণে এক দল অপর দলের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রাখে। এক দল অপর দলকে ভ্রষ্ট, কাফের বা বিদআতী ভাবে। প্রতি দলের অনুসারী নিজের দলীয় নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং বিপক্ষের নীতির প্রতিবাদ করে। ভাবে তার দলই শ্রেষ্ঠ উম্মত, যাদেরকে আল্লাহ মানুষের জন্য নির্বাচিত করেছেন। অন্ধ পক্ষপাতিত্বের পরিণাম শেষে এই দাঁড়ায় যে, একদল অপর দলের জান মাল হালাল মনে করে! এই অবকাশে কোন। ইসলাম দুশমন সুবর্ণ-সুযোগ পায়। অগম্য ইসলাম দুর্গের উদ্দেশ্যে এই ছিদ্রপথ ব্যবহার করে এবং ইসলামের অপরাজেয় শক্তিকে ভিতর থেকে মুসলিমদের সাহায্যেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে কৃতার্থ হয়ে যায়। যখন অনল্প অর্থ ও শক্তি থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরা পরাভূত হয়ে পড়ে।
আল্লাহর রসূল ঐ সত্যই বলেছেন, “অনতি দূরে বিজাতিসমূহ তোমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে, যেমন ভোজনকারীগণ (একই) ভোজপাত্রের উপর একত্রিত হয়।” একজন বলল, 'আমরা কি তখন সংখ্যায় কম থাকব? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন,“বরং তখন তোমরা সংখ্যায় অনেক থাকবে। কিন্তু তোমরা হবে তরঙ্গতারিত আবর্জনার ন্যায়। আল্লাহ তোমাদের শত্রুর বক্ষ হতে (তোমাদের প্রতি) ভীতি ছিনিয়ে নেবেন এবং তোমাদের হৃদয়ে দুর্বলতা প্রক্ষিপ্ত করবেন।” একজন বলল, 'হে আল্লাহর রসূল! সে দুর্বলতা কি? তিনি বললেন, “দুনিয়াকে ভালবাসা এবং মরতে না চাওয়া।” (আবু দাউদ)।
সংখ্যায় বেশী থাকলেও অনৈক্যের ফলে দুর্বল রয়ে যাবে। ঘনঘটা মেঘের কোথাও কোথাও বিজলী এবং গর্জন থাকলেও কোন বর্ষণ থাকবে না।
‘ভিতরে দিতে যত মরিয়াছি বাহিরের দিকেও তত,
গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু-ছাগলের মত।
অথচ বিধানকর্তা এ জাতিকে সতর্ক করে বলেছেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
অর্থাৎ, তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (কুরআন ও দ্বীন)কে শক্ত করে ধারণ কর এবং পরস্পর বিছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত) তিনি অন্যত্র বলেন,
أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
অর্থাৎ, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে (মতভেদ করে) বিছিন্ন হয়ো না।” (সূরা শুরা ১৩ আয়াত) তিনি আরো বলেন,
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
অর্থাৎ, “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা আলে ইমরান ১০৫ আয়াত) মহান আল্লাহ আরো বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ ۚ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
অর্থাৎ, অবশ্যই যারা দ্বীন সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (হে নবী) তুমি কোন কিছুতে তাদের অন্তর্ভুক্ত নও (এবং তারাও তোমার দলভুক্ত নয়)। তাদের বিষয় আল্লাহর উপর ন্যস্ত, আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদেরকে অবহিত করবেন।” (সূরা আনআম ১৫৯ আয়াত)।
আল্লাহর রসুল ও উম্মতকে সাবধান করে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “ইয়াহুদ একাত্তর দলে এবং নাসারা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে এবং আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। যার একটি মাত্র দল ছাড়া সবগুলিই জাহান্নামী হবে।”
সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, সেই একটি দল কোনটি, হে আল্লাহর রসুল?” তিনি। বললেন, “যে দল আজ আমি ও আমার সাহাবাগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত আছি, তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী) কিন্তু মুখতা ও যুলুম সকল মন্দের মূল। এই উভয় হতেই শুরু হয় ভুল বুঝাবুঝি। ফলে অনেকে নিজেকে ত্রুটিহীন মনে করে অথবা নিজের মান্যবরকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভুলমুক্ত জ্ঞানী মনে করে প্রকৃত হক ও সত্য চিনতে ভুল করে বসে এবং শুরু হয়। দ্বন্দ্ব ও বিছিন্নতা।
(১৪) সমাজকে সাবধান ও সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বিদআতীর গীবত করা বৈধ; যেমন ফাসেক ও প্রকাশ্যে পাপে লিপ্ত ব্যক্তির সমালোচনা ও চর্চা করা হারাম নয়। বরং প্রয়োজন ক্ষেত্রে তা ওয়াজেব হয়ে পড়ে। যেমন যদি কেউ বিদআতী বা দুষ্কৃতীর সহিত অজান্তে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়তে, তার প্রতিবেশ গ্রহণ, ব্যবসা বা অন্য কোন ব্যবহারিক জীবনে অংশী হতে কারো নিকট পরামর্শ বা খোঁজ-খবর নেয়, তবে জানা থাকলে নসীহতের নিয়তে তার নিকট ঐ ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা খুলে বর্ণনা করা ওয়াজেব হবে।
অনুরূপভাবে কোন তালেবে ইলমকে যদি কেউ কোন বিদআতীর নিকট বসতে বা ইলম শিক্ষা করতে দেখে তবে (হিংসা করে নয় বরং) নসীহতের নিয়তে ঐ তালেবকে সতর্ক করা তার জন্য ওয়াজেব। বিদআতীর প্রকাশ্য গীবত করা এবং জনসাধারণকে হুশিয়ার করা কেবল ইনসাফের সাথে তার বিদআতের উল্লেখ করতে হবে। অন্য কারণ না থাকলে তার অন্যান্য দোষ-ত্রুটি বয়ান করা বৈধ্য হবে না। যেমন ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটাবার উদ্দেশ্যে বা ঈর্ষায় কাতর হয়ে অথবা কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে অথবা ব্যক্তিগত কোন। প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ঐ সুযোগের অপব্যবহার করা আদৌ বৈধ হবে না।
(১৫) বিদআতীদের সাধারণ স্বভাব এই যে, তারা পথ ও মত পরিবর্তনের সময় বিদআত থেকে অধিক নিকষ্টতর বিদআতের প্রতি ধাবমান হয়। আল্লাহ তাআলা তাদের বক্রতার প্রতিদান দেন। যেহেতু কৃতকর্মের প্রকাররানুরূপ প্রতিফলই স্বাভাবিক। মহান আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ
অর্থাৎ, অতঃপর যখন ওরা বক্রপথ অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ ওদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। (সূরা সাফফ ৫ আয়াত)।
ইয়াহয়্যাবিন আবী উমার শাইবানী বলেন, 'বলা হত যে, বিদআতীদের তওবা আল্লাহ অগ্রাহ্য করেন এবং বিদআতী অধিকতর মন্দ বিদআতের দিকে স্থানান্তরিত হয়।
এ প্রসঙ্গেই আওয়াম বিন হাওশাব তাঁর পুত্রের উদ্দেশ্যে বলতেন, হে (বৎস) ঈসা! তুমি তোমার চিত্ত বিশুদ্ধ কর ও ধন অল্প কর। আল্লাহর কসম! ঈসাকে বিরুদ্ধাচারী (বিদআতী)দের দলে বসতে দেখার চাইতে তাকে গানবাদ্য ও মদের মজলিসে বসতে দেখা আমার নিকট (তুলনামূলকভাবে) অধিকতর পছন্দনীয়।”
কারণ বিদআতী তার বিদআতকে দ্বীন মনে করে এবং দ্বীনকে ধারণ ও মান্য করার মতই বিদআতকে ধারণ ও মান্য করে চলে। আবার কোন কারণবশতঃ ঐ বিদআত থেকে বহির্গত হলে অন্য কোন বড় বিদআতে প্রবেশ করে। কিন্তু মহাপাপী যারা; যেমন গান-বাদ্যকারী ও শ্রবণকারী মদ্যপায়ী ইত্যাদি তারা নিজ কামবশীভূত। তারা জানে যে, তারা যা করে তা মহাপাপ। কিন্তু তাদের কামপ্রবৃত্তি এবং মন্দকর্মপ্রবণ আত্মার বশবর্তী হয়ে তা বর্জন করতে সহজে সক্ষম হয় না। সম্ভবতঃ তাদের অবৈধতা-জ্ঞানের ফলে কখনো তা পরিহার করতেও পারে। যেহেতু গোনাহগার মানুষের ক্ষেত্রে তওবা, অনুশোচনা এবং সমূলে মন্দ কাজ বর্জন করার অধিক সম্ভাবনা ও আশা থাকে; যতটা বিদআতকে ধর্ম জ্ঞানকারী বিদআতীর ক্ষেত্রে থাকে না।
সেই বিদআতীর তওবার কোন আশা থাকে না, যার হৃদয়ে বিদআত বদ্ধমূল হয়ে অন্তস্তলে বড় জায়গা জুড়ে স্থান গ্রহণ করেছে। যার জন্য বিদআতকেই প্রকৃত দ্বীন মনে করে এবং তার প্রতিকূল সব কিছুকে পার্শ্বে বর্জন করে। বিদআতে বিজ্ঞ হয়ে অন্ধভাবে তাই পছন্দ করে। যে তা পছন্দ ও গ্রহণ করে তাকে ভালোবাসে এবং যে অপছন্দ ও অগ্রহণযোগ্য মনে করে তাকে মন্দ বাসে ও ঘূণা করে। বরং অনেক ক্ষেত্রে শত্রু মনে করে। তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং তার বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বেপরোয়া লড়াই লড়ে। যেমন প্রাচীন খাওয়ারেজ বিদআতীরা; যারা বিশ্বাস রাখে যে, যে ব্যক্তি কাবীরাহ গোনাহ করবে সে কাফের হয়ে চিরস্থায়ী জাহান্নামবাসী হবে। যারা কখনো এই বিশ্বাস ও ধারণা হতে বিচ্যুত হয়নি। (অবশ্য কিছু মানুষ সঠিক পথে ফিরে এসেছিল।) অথচ তাদের ঐ ধারণার প্রতিকূলে কুরআনী আয়াতে এবং সহীহ হাদীসে স্পষ্ট দলীল রয়েছে। কিন্তু তারা তা পৃষ্ঠপিছে বর্জন করে শরীয়তের বিরোধিতায় অটল থেকেছে। পরন্তু মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সহিত শির্কের অপরাধ ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। (সূরা নিসা ৪৮ আয়াত)
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; যদিও সে ব্যভিচার ও চুরি করে থাকে।” তিনি এইরূপ তিনবার পুনঃ পুনঃ বলেছেন।
অনুরূপ আরো বহু দলীলাদির উপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাহ বলে, মহাপাপী আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে, যদি তিনি চান তবে তাকে মার্জনা করবেন, নচেৎ তার পাপ অনুযায়ী পরিমাণ মত শাস্তি প্রদান করবেন এবং (তওহীদের গুণে) তার প্রত্যাবর্তন স্থান হবে জান্নাত। আল্লাহ পাক বলেন,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ
অর্থাৎ, বল, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য--। (সূরা কাহাফ ১১০ আয়াত) অন্যত্র তিনি বলেন,
قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ
অর্থাৎ, বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গায়ব (অদৃশ্য) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না। (সূরা নামল ৬৫ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,
قُل لَّا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ
অর্থাৎ, (হে মুহাম্মাদ!) বল, আমি তোমাদেরকে এ কথা বলি নি যে, আমার নিকট আল্লাহর ধনভান্ডার আছে। আর গায়ব (অদৃশ্য) সম্বন্ধেও আমি অবগত নই--। (সূরা আনআম ৫০ আয়াত)।
এই আয়াতসমূহ এবং আরো অন্যান্য আয়াত ও হাদীস শরীফের উপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাহ বলে যে, আল্লাহর নবী মানুষ ছিলেন এবং তিনি গায়ব জানতেন না, গায়বী খবর তিনি ওহীর মাধ্যমে জানতেন ও জানাতেন। কিন্তু বিদআতীরা ঐ সমস্ত দলীলকে পশ্চাতে ফেলে ভুক্তির আতিশয্যে প্রিয় নবী ধ্রু-কে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ (সৃষ্টির সেরা জীব) হতে বহিস্কৃত করে এবং তাঁর জন্য গায়বীর দাবী করে আল্লাহর আসনে তাঁকে বসাতে দ্বিধা করে না। কেউ বা তাঁর শরীয়তকে পদদলিত করে ফুর্তি মেরে মারেফতী’র দাবী করে অলী সেজে বসে। অথচ অলি হয়ে যে পরিমল আহরণ করে তার সবটাই গরল। হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করে ব্যবহার করে! এবং তারই মাধ্যমে অজ্ঞ সাদা মানুষদের মন ও হৃদয় লুটে ফায়দা উঠায়। মরণকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে নয়, যেখানে আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর নিজের জন্য দুআ ও দরূদ পড়তে বলেছেন, সেখানে মওতাদের জন্য দুআর উদ্দেশ্যে নয়, পরকালকে স্মরণ করে হৃদয়ে ভয় আনার উদ্দেশ্যে নয়, বরং মৃত্যের কাছে জীবন চাইতে নিঃস্বের কাছে সম্পদ চাইতে এবং পরকালের দুয়ারে ইহকাল চাইতে কবর যিয়ারত (পূজা) সিজদা, চুম্বন, তওয়াফ, তাবারুক, উরস। ইত্যাদি দ্বারা নতুন শরীয়ত রচিত করে।
ওরা মহব্বতে রসুলের নামে সেই কাজ করে যাতে ওদের খুশীর ভরপুর সমাগম ঘটে। ভিন্ন জাতির অনুকরণে দ্বীনকে কেবল নিজেদের স্বার্থ, আনন্দ ও সুস্বাদ আস্বাদনের উদ্দেশ্যে আংশিক ধারণ করে থাকে। আর নিরানন্দে একটু স্বার্থ ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারে ওরা আদৌ মহব্বতের পরিচয় দেয় না। আর ভাবে ঐ অনুষ্ঠানগত মহব্বতই জরুরী ও যথেষ্ট। বাকী তাঁর আদর্শে চরিত্র গড়া, তাঁর নির্দেশ পালন করা, তিনি যা পছন্দ করেছেন তা পছন্দ করা ইত্যাদিকে অজরুরী ও ফালতু ভাবে। পক্ষান্তরে, পার্থিব জীবনে প্রেমের কোন নির্দিষ্ট ধারা নেই, নিয়ন্ত্রিত গতি নেই। হাবীব তার মাহবুবকে যে কোন প্রকারে যে কোন উপায়ে এবং যে কোন মাধ্যমে তার মহব্বত জানাতে পারে। তাতে কোন বাধা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই এবং সুশৃঙ্খলতা নেই।
কিন্তু বান্দার জন্য আল্লাহ এবং উম্মতের জন্য রসুল এমন মাহবুব, যিনি কেবল নিয়ন্ত্রিত প্রেমই পছন্দ করেন। কপট, হীন উচ্ছঙ্খল বা স্বার্থের প্রেম আদৌ পছন্দ করেন না। নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাণের বাইরে কোন প্রেমের অতিরঞ্জন তাঁর নিকট প্রীত নয়। যেহেতু পার্থিব প্রেমে প্রায়শঃ ক্ষেত্রে হাবীব-মাহবুব উভয়ের মান-মর্যাদা অথবা কোন না কোন দিক সমপরিমাণ থাকে; যাতে উভয়ের মনের উচ্ছ্বাস গতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে একে অপরকে ইচ্ছামত বলে এবং ইচ্ছামত উপহার দেয়। কিন্তু সেই মাহবুব যিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, জীবনদাতা, প্রতিটি জীব যাঁর দয়ার মুক্ষাপেক্ষী; তিনি একমাত্র মাবুদ এবং সেই মাহবুব যিনি অনুসৃত, যাঁর আদেশ কেউ অমান্য করলে, যাঁর নির্দেশ কেউ লংঘন করলে জাহান্নামের মহাগ্নি তার উপযুক্ত শাস্তি হয়, যে মাহবুব তাকে ভালোবাসার উপায় শিক্ষা দিয়েছেন, প্রেমের ধরন বলে
দিয়েছেন, যাতে ভালোবাসতে গিয়ে কেউ বেআদবী করে না বসে। এমন মাহবুবের জন্য হাবীবের হৃদয়ে সদা ভয় থাকে; যাতে প্রেম নিয়ন্ত্রণ-হারা, নিয়ম-ছাড়া, বন্ধনহারা ও বেয়াড়া না হয়ে যায়। পার্থিব প্রেমে অতিরঞ্জন চলে, কখনো বা উপহাসছলে। বেআদবী চলে কিন্তু আল্লাহ ও রসুলের প্রেমে নিছক আদব, তা'যীম ও আনুগত্য থাকে। তাইতো ওযুর অঙ্গ তিন বারের পরিবর্তে চার অথবা তার অধিক বার ধৌত করা বৈধ নয়। যদিও অধিকবার ধৌত করায় অধিক অপবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা লাভ হয়। তাইতো আল্লাহর প্রেমে তন্ময় হয়ে ফজরে দুয়ের স্থানে চার রাকআত ফরয। পড়া প্রেমিক বান্দার জন্য বৈধ নয়। যেহেতু তাঁর প্রেমের পথ নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত। এই নির্দিষ্ট সীমা দ্বারাই তাঁর প্রকৃত প্রেমের অগ্নিপরীক্ষা হয়। তাই নির্দেশিত সরল পথ ব্যতীত অন্যান্য বঙ্কিম পথে তাঁর মহব্বত হাসিল হয় না।
পক্ষান্তরে প্রেমিকা কেবল শাড়ীর আবেদন জানালে তার সঙ্গে বাড়তি ব্লাউজ ও চুড়ি নিবেদন করলে সে নারাজ হয় না বরং আরো অধিক খুশী হয় এবং প্রেমের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ভূত্য সারা দিনের কর্তব্য পালন করেও যদি রাত্রে প্রভুর গা-পা দাবায় তবে প্রভু খুশী হয়ে তার বেতন বৃদ্ধি করে; নারাজ হয় না।।
হাঁ ব্লাউজ ও চুড়ি যদি প্রেমিকার দেহাঙ্গের মাপ ও তার পছন্দমত হয় এবং ভূতের ঐ বাড়তি খিদমত যদি প্রভুর সময় ও প্রয়োজন মত হয় তবেই তা সম্ভব। নচেৎ ভালোবাসার ঝুলিতে ভৎসনাই স্থান পাবে। আবার শাড়ী ব্যতীত অন্য কিছু বাড়তি আনলে এবং কাজ ছেড়ে প্রভুর পা দাবালে কি হবে তা বলাই বাহুল্য।
অনুরূপভাবে শরীয়তের পছন্দমত যে সব নফল (বাড়তি) কাজের নির্দেশ আছে। তা করলে তো আল্লাহ খুশীই হন। কিন্তু তাঁর নির্দেশ ও পছন্দের বাইরে নিজের মনগড়া কিছু করতে চাইলে অবশ্যই বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই লাভ হয় না। আবার তাঁর নির্দেশ অমান্য করে অতিরিক্ত অন্য কিছু করে মহব্বত প্রকাশ করতে চাইলে জাহেল হাবীব এটাই বুঝে যে, সে তার মাহবুব ও শরীয়ত অপেক্ষা অনেক বেশী বুঝে। আবার এতটা বলতে দুঃসাহস করে যে, শরীয়ত তো একটা পিয়াজের মত যার সবটাই খোসা (ছাল)! অর্থাৎ যার সার ও আসল কিছুই নেই !! শরীয়তের আলেম ও অনুগামীরা তো কেবল পানারী পাতার মত; যা পানির গভীরতার উপরেই ভেসে বেড়ায় ইত্যাদি!!! এ ধরনের ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা মহব্বতের দাবীদারদের অবস্থা যে কি হবে, তা জ্ঞানীদের নিকট সহজেই প্রতীয়মান। বিদআতীদের এমন অনেক মানুষ আছে যারা বিদআতকে অন্তর্মুলে স্থান দেয় না, তবে তা ভালো জেনে এবং তাতে আল্লাহ খুশী হবেন এই মনে করে লোকের দেখাদেখি সাধারণভাবে তা করে থাকে। কিন্তু তার বিপরীত কোন দলীল বা নীতিকথা শুনলে উদার মনে তা পরিত্যাগ করে প্রকৃত দ্বীনকে হীন সেবকরূপে ধরার চেষ্টা করে এবং বিদআত হতে তওবা করে। অবশ্যই তারা পথপ্রাপ্ত এবং তাদের জন্যই মুক্তি।
যে সমস্ত উপায়ে বিদআত চিহ্নিত হয়ে থাকে এবং যে সকল কর্মকে শরীয়তে বিদআত বলে গণ্য করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
(১) প্রতি সেই কথা, কাজ ও বিশ্বাস; যদিও বা তা ইজতেহাদী হয়; যা সুন্নাহর প্রতিকূল হয়, তা বিদআত।
(২) প্রতি সেই কর্ম যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের আশা করা যায় অথচ শরীয়ত তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তা করলে বিদআত করা হয়।
(৩) প্রতি সেই বিষয় যা কোন বর্ণনা বা নির্দেশ ব্যতীত বিধেয় হওয়া সভব নয়। অথচ সে বিষয়ে শরীয়তের কোন বর্ণনা বা নির্দেশ নেই, তা বিদআত। অবশ্য কোন সাহাবী কর্তৃক কোন ইঙ্গিত বা নির্দেশ থাকলে, তা বিদআত বলা যাবে না।
(৪) কাফেরদের সেই আচার-অনুষ্ঠান বা প্রথা; যা ইসলামে ধর্ম বা ইবাদতরূপে (বা করতে হয় ভেবে) পালন করা হয়, তা বিদআত।
(৫) যে বিষয়ের মুস্তাহাব হওয়ার উপর কোন ফকীহ বা আলেম -বিশেষ করে পরবর্তীকালের উলামাগণ বিবৃতি পেশ করেছেন অথচ তার সপক্ষে কোন শরয়ী দলীল নেই, সে বিষয়ও বিদআত।
(৬) প্রতি সেই ইবাদত বা আমল যার পদ্ধতি ও প্রণালী যয়ীফ অথবা মওযু’ (গড়া বা জাল) হাদীস ব্যতীত অন্য কোন সহীহ বা হাসান হাদীসে বর্ণিত হয়নি, তা করা বিদআত।
(৭) ইবাদতে প্রত্যেক অতিরিক্ত, অতিরঞ্জিত ও বাড়তি কাজই (অর্থাৎ ইবাদতে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সীমালংঘন করাই) বিদআত।
(৮) প্রত্যেক সেই ইবাদত যা শরীয়ত সাধারণভাবে পালন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, কিন্তু মানুষ তাকে কোন স্থান, কাল, গুণ, নিয়ম-পদ্ধতি, সংখ্যা বা কারণ প্রভৃতি বিশেষণ দ্বারা নির্দিষ্ট করে নিয়েছে তা বিদআত। (আহকামুল জানায়েয, আলবানী)
(৯) প্রত্যেক সেই আচার, কুপ্রথা বা কুসংস্কার; যা শরীয়তসম্মত নয় এবং বিবেক ও জ্ঞান-সম্মতও নয়, যা কিছু জাহেল দ্বীন ও করণীয় কর্তব্য মনে করে তা বিদআত। (মানাসেকুল হজ্জ, আলবানী ৪৫ পৃঃ) এই সকল বিদআতের দৃষ্টান্ত ও উদাহরণ পরবর্তী পর্যায়ে আলোচিত হবে।
কুরআন প্রসঙ্গে সে সমস্ত বিদআত প্রচলিত আছে, যেমন এমন ঢঙ্গে টেনে পড়া যাতে কুরআনের শব্দবিন্যাস বিনষ্ট হয়ে যায়। তেলাঅত শেষে ‘সাদাকাল্লাহুল আযীম’ পাঠ। মুর্দার উপর, কবরের উপর কুরআন পাঠ। সেহরীর আযানের পরিবর্তে কুরআন পড়ে জাগ্রতকরণ। জুমআর দিনে প্রয়োজনে খুতবার আযানের পূর্বে আর এক আযান দেওয়ার পরিবর্তে কুরআন (সূরা জুমআহ) পাঠ করে ডাকা হাঁকা।
শবীনা পাঠ, কুলখানী, ফাতেহাখানী, আয়াতের নক্সা বানিয়ে দেওয়ালে লিখা বা বাঁধিয়ে টাঙ্গানো। মুসহাফ নিয়ে কপালে, চোখে বা বুকে ঠেকানো, স্পর্শ করে গায়ে মাখা, চুম্বন করা। খতমের বাঁধা দুআ।
নবী (সা.)-কে কেন্দ্র করে যে সব বিদআত আকীদায় এসেছে, যেমন এই বিশ্বাস। করা যে, তিনি মানুষ ছিলেন না, তিনি গায়েব জানতেন, তাঁর দেহের ওজন ও ছায়া ছিল না। তাঁর মল-মূত্র পবিত্র ছিল। তিনি আল্লাহর নুর থেকে সৃষ্টি ছিলেন এবং তাঁর নুর থেকে জগৎ সৃষ্টি। তিনি হাযির ও নাযির; তিনি মীলাদ মাহফিলে হাযির হন। তিনি পার্থিব জীবনের ন্যায় জীবিত আছেন। কিছু চাইলে তিনি দিতে পারেন। তাঁর কবর যিয়ারত করলে পাপ ক্ষয় হয় ইত্যাদি।
ওলী-আওলিয়া নিয়ে প্রচলিত বিদআত যেমন, তাঁরা পার্থিব জীবনের ন্যায় জীবিত আছেন মনে করা। তাঁরা আহবানকারী ভক্তের আশা পূর্ণ করতে পারেন, রোগ ও বিপদ মুক্ত করতে পারেন, ধন ও সন্তান দান করতে পারেন, তাঁরা অদৃশ্যের (গায়বী) খবর জানেন ইত্যাদি বিশ্বাস করা; যাতে মানুষ মুশরিক হয়ে যায়। কোন ওলীর ত্যক্ত বস্তুর মাধ্যমে তাবারুক (বরকত) গ্রহণ। জীবিত, প্রকৃত অথবা কম্পিত ওলির এঁটো বা ব্যবহৃত কোন জিনিস ব্যবহার করে বর্কত ও কল্যাণের আশা করা ইত্যাদি।
মসজিদ বিষয়ক বিদআত যেমন; মসজিদ অধিক সৌন্দর্য-খচিত ও রঙচঙে করা। মসজিদে কারো কবর দেওয়া। মসজিদে সাংসারিক ও বৈষয়িক গল্পগুজব করা। কলরব, অট্টহাসি, অবৈধ সমালোচনা করা। মসজিদের দেওয়াল, মিম্বর বা ধূলা স্পর্শ করে গায়ে মেখে বর্কত বা আরোগ্যলাভের আশা করা ইত্যাদি।
আযানের বিদআত যেমন; জুমআর দ্বিতীয় আযান মিম্বরের গোড়ায় নিমস্বরে দেওয়া। আযানের পর উচ্চরবে দরূদ ও দুআ পাঠ করা। অসীলার দুআয়। ‘অদদারাজাতুর রাফীআহ’ বৃদ্ধি করা। আযানের পর পুনরায় নামাযের জন্য আহবান করা। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদ-- শুনে চোখে আঙ্গুল বুলিয়ে তা চুম্বন। করা। আসসালাতু খায়রুম মিনান নাওম’-এর উত্তরে সাদাকতা ওয়া বারারতা’ বলা। কাদক্বা-মাতিস সালাহ’ শুনে ‘আক্বামাহাল্লাহু আদামাহা’ বলা। আযানের শেষে হাত তুলে দুআ পড়া।