কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা ইসলামহাউজ.কম ৪১ টি
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা ইসলামহাউজ.কম ৪১ টি

إنَّ الحمدَ للهِ نحمدُه ونستعينُه ونستغفرُه ، ونعوذُ بالله من شُرور أنفسنا وسيئاتِ أعمالنا ، مَن يهدهِ الله فلا مُضِلَّ له ، ومَن يُضلل فلا هاديَ له ، وأشهدُ ألاَّ إله إلاَّ الله وحده لا شريك له ، وأشهد أنَّ محمَّداً عبدُه ورسولُه .

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি; আর আমাদের নফসের জন্য ক্ষতিকর এমন সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না; আর তিনি যাকে পথহারা করেন, কেউ তাকে পথ দেখাতে পারবে না। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল)।

অতঃপর:

মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব; আল্লাহ মানুষকে সুন্দর গঠনে এবং সম্মান ও মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

لَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ فِيٓ أَحۡسَنِ تَقۡوِيمٖ

“অবশ্যই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।”[1] তিনি আরও বলেন:

﴿ ۞وَلَقَدۡ كَرَّمۡنَا بَنِيٓ ءَادَمَ وَحَمَلۡنَٰهُمۡ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ وَرَزَقۡنَٰهُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَفَضَّلۡنَٰهُمۡ عَلَىٰ كَثِيرٖ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِيلٗا ٧٠ ﴾ [الاسراء: ٧٠]

“আমি অবশ্যই আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি, স্থলে ও সমুদ্রে আমি তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদেরকে আমি পবিত্র বস্তু থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করেছি এবং আমি অন্য যত কিছুই সৃষ্টি করেছি, তার অধিকাংশের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।”[2]

এ সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার নিমিত্তে আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ পরিচালনার জন্য কিছু নিয়ম-কানুন দিয়েছেন, যা যুগে যুগে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মনোনীত নবী ও রাসূল ‘আলাইহিমুস সালামের মাধ্যমে মানুষ জানতে পেরেছে; তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের মাঝে এসেছে সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব ‘আল-কুরআনুল কারীম’ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ, যাতে মানব জীবনের সকল বিষয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, বর্ণিত হয়েছে গোটা মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা।

সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তি ব্যবহারিক জীবনে কুরআন ও সুন্নায় বর্ণিত আদবসমূহ মেনে চলতে পারলে ব্যক্তিগতভাবে সে দুনিয়ার জীবনে একজন ভদ্র, শালীন ও সভ্য মানুষ হিসেবে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারবে এবং পরকালীন জীবনে আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণের মিছিলে শামিল হতে পারবে; আর সামগ্রিকভাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা দুনিয়া হয়ে উঠবে শিষ্টাচারপূর্ণ, সুসভ্য, সুশৃঙ্খল, সুন্দর ও কল্যাণময়। আদব-কায়দার এসব গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করেই আমরা “কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে মুসলিম জীবনে আদব-কায়দা” শীর্ষক শিরোনামে এ গ্রন্থটি সংকলন শুরু করি, যাতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:

  • ভূমিকা
  • প্রথম অধ্যায়: আদব-কায়দা’র পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য
  • দ্বিতীয় অধ্যায়: নিয়তের আদবসমূহ
  • তৃতীয় অধ্যায়: আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুসলিম বান্দার আদব
  • চতুর্থ অধ্যায়: আল্লাহর বাণী ‘আল-কুরআনুল কারীম’-এর সাথে বান্দার আদব
  • পঞ্চম অধ্যায়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুমিন বান্দার আদব
  • ষষ্ঠ অধ্যায়: স্বীয় নাফসের সাথে মুসলিম বান্দার আদবসমূহ
  • সপ্তম অধ্যায়: মানুষ তথা সৃষ্টির সাথে আদব
  • অষ্টম অধ্যায়: দীনী ভাইদের সাথে আদব এবং আল্লাহর জন্য তাদেরকে ভালোবাসা ও ঘৃণা করা
  • নবম অধ্যায়: বসার ও মাজলিসের আদবসমূহ
  • দশম অধ্যায়: পানাহারের আদবসমূহ
  • একাদশ অধ্যায়: যিয়াফত তথা আপ্যায়নের আদবসমূহ
  • দ্বাদশ অধ্যায়: সফরের আদব
  • ত্রয়োদশ অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছদের আদব
  • চতুর্দশ অধ্যায়: স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে আদবসমূহ
  • পঞ্চদশ অধ্যায়: ঘুমানোর আদব
  • পরিশিষ্ট
  • গ্রন্থপঞ্জি
  • সূচীপত্র

অবশেষে বলতে হয়, চেষ্টা করা হয়েছে পবিত্র কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে মুসলিম জবীনের প্রয়োজনীয় আদব-কায়দার বিভিন্ন দিক তুলে ধরার, কিন্তু সকল বিষয় যে তুলে ধরতে পারিনি এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়; তবে বাংলা ভাষাভাষী প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ আলেম সমাজ এ বিষয়ে আরও বেশি লেখালেখি করলে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একদিন পূর্ণতা লাভ করবে এমন আশা করতেই পারি। পরিশেষে আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু আমাদের ও পাঠক সমাজের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্য মহান রাব্বুল ‘আলামীনের দরবারে নিবেদন করছি; আশা করছি তিনি আমাদের এ আবেদন কবুল করবেন এবং আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাগণের কাতারে শামিল করবেন। আমীন!

ড. মো: আমিনুল ইসলাম,

ডিসেম্বর, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ,

দৌলতগঞ্জ গাজীমুড়া কামিল মাদরাসা,লাকসাম, কুমিল্লা।

>
[1] সূরা আত-তীন, আয়াত: ৪

[2] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৭০

আদব শব্দটি আরবি "أدب "শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো: বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার।[1] আবার " أدب " শব্দের অর্থ: নিয়মনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি। আর আদব-কায়দা মানে— ভদ্র সমাজের রীতি-পদ্ধতি; ভদ্র ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যায়: আদব-কায়দা মানে কাঙ্খিত শিক্ষা, সভ্যতা ও মার্জিত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মগঠনের অনুশীলন করা।[2] ইবনু হাজার ‘আসকালানী রহ. বলেন:

« الأدب: استعمال ما يحمد قولاً وفعلاً »

“কথায় ও কাজে প্রশংসনীয় ব্যবহারকে আদব বলে।”[3] আবার কেউ বলেন:

« الأخذ بمكارم الأخلاق »

“উত্তম চরিত্র লালন করাকে আদব বলে।”[4] আবার কেউ কেউ বলেন:

« هو تعظيم من فوقك والرفق بمن دونك »

“আদব হলো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে সম্মান করা এবং অধস্তনকে স্নেহ করা।”[5] কেউ কেউ বলেন:

« الأدب هو حسن الأخلاق وفعل المكارم »

“আদব মানে উত্তম চরিত্র এবং ভালো কাজ।”[6] আর ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন:

« الأدب اجتماع خصال الخير في العبد »

“বান্দার মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটানোকে আদব বলে।”[7] আবার কেউ কেউ বলেন:

« والأدب هو الخصال الحميدة » .

“প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহকেই আদব বলে।”[8]আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুয়াদ্দাব’ (শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত) বলে। আর এসব গুণাবলী যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’ (অশালীন, অভদ্র, অসভ্য) বলে।

>
[1] ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, আল মুনীর আরবী-বাংলা অভিধান, দারুল হিকমা বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: জুলাই ২০১০ খ্রি., পৃ. ১৫; বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত সংষ্করণ: ডিসেম্বর ২০০০, পৃ. ১০৩

[2] আল-মু‘জাম আল-অসীত, দ্র: " أدب "

[3] ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। "

[4] প্রাগুক্ত।

[5] প্রাগুক্ত।

[6] প্রাগুক্ত।

[7] প্রাগুক্ত।

[8] প্রাগুক্ত।

মানবজীবন তথা মুসলিম ব্যক্তির জীবনে আদব-কায়দার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহুল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِنَّ الْهَدْىَ الصَّالِحَ ، وَالسَّمْتَ الصَّالِحَ ، وَالاِقْتِصَادَ جُزْءٌ مِنْ خَمْسَةٍ وَعِشْرِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ » . (رواه أبو داود).

“নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়্যাতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ সমতুল্য।”[1] আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:

« اُطْلُبْ الْأَدَبَ فَإِنَّهُ زِيَادَةٌ فِي الْعَقْلِ ، وَدَلِيلٌ عَلَى الْمُرُوءَةِ ، مُؤْنِسٌ فِي الْوَحْدَةِ ، وَصَاحِبٌ فِي الْغُرْبَةِ ، وَمَالٌ عِنْدَ الْقِلَّةِ » . (ذَكَرَهُ الْحَاكِمُ فِي تَارِيخِهِ).

“তুমি আদব অন্বেষণ কর; কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপুরক, ব্যক্তিত্বের দলীল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।”[2]

আর আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা ব্যক্তির জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি হয়; আর এ আদব হলো দীন ইসলামের সারবস্তু; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির জন্য জরুরি হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এবং সাধরণ মানুষসহ সকল সৃষ্টির সাথে আদব রক্ষা করে চলা; আর এ আদবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম জানতে পারবে তার খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় তার অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ; কিভাবে তার সালাম প্রদান, অনুমতি গ্রহণ, বসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ করা, হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার মত বিবিধ কাজ সম্পন্ন হবে; আর কেমন ব্যবহার হবে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এক কথায় এ আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কাঙ্খিত মানের ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে; ফলে দীন ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও দুনিয়ার দিক দিগন্তে। তাইতো কেউ কেউ শিক্ষার চেয়ে আদব বা শিষ্টাচারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« تَأَدَّبُوا ثُمَّ تَعَلَّمُوا » .

“তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর।”[3] আল-কারাফী তাঁর ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে বলেন:

«وَاعْلَمْ أَنَّ قَلِيلَ الْأَدَبِ خَيْرٌ مِنْ كَثِيرٍ مِنْ الْعَمَلِ »

“আর জেনে রাখবে, অনেক বেশি কাজের চেয়ে অল্প আদব অনেক বেশি উত্তম।”[4] আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন:

« لَا يَنْبُلُ الرَّجُلُ بِنَوْعٍ مِنْ الْعِلْمِ مَا لَمْ يُزَيِّنْ عِلْمَهُ بِالْأَدَبِ »

“ব্যক্তি কোনো প্রকার জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।”[5] তিনি আরও বলেন:

« نَحْنُ إلَى قَلِيلٍ مِنْ الْأَدَبِ أَحْوَجُ مِنَّا إلَى كَثِيرٍ مِنْ الْعِلْمِ »

“আমরা অনেক বেশি জ্ঞানের চেয়ে কম আদবকে অনেক বেশি জরুরি বা প্রয়োজন মনে করতাম।”[6] কোনো কোনো দার্শনিক বলেন:

« لَا أَدَبَ إلَّا بِعَقْلٍ ، وَلَا عَقْلَ إلَّا بِأَدَبٍ »

“আকল (বুদ্ধি) ছাড়া আদব হয় না; আবার আদব ছাড়া আকলও হয় না।”[7] অর্থাৎ একটি আরেকটির পূরিপূরক। আর জনৈক সৎব্যক্তি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন:

« اجْعَلْ عَمَلَك مِلْحًا وَأَدَبَك دَقِيقًا » “তুমি তোমার আমলকে মনে করবে লবণ, আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা।”[8] অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদবকে এত বেশি গুরুত্ব দিবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কম বেশি হয়।

[1] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৪৭৭৮; আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

[2] হাকেম রহ. তাঁর ‘আত-তারীখ’ গ্রন্থে বর্ণনটি উল্লেখ করেছেন।

[3] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। "

[4] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। "

[5] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। "

[6] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। "

[7] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। "

[8] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)।

মুসলিম ব্যক্তি নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাবের প্রতি বিশ্বাস করে এবং আরও বিশ্বাস করে তার ধর্মীয় ও জাগতিক জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়তের গুরুত্বকে। কারণ, নিয়তের দ্বারাই সকল কাজের অস্তিত্ব লাভ করে এবং নিয়ত অনুযায়ীই তার রূপ-প্রকৃতি তৈরি হয়; ফলে সে অনুসারে তা শক্তিশালী হয়, দুর্বল হয়, শুদ্ধ হয় এবং নষ্ট হয়; আর মুসলিম ব্যক্তি প্রত্যেক কাজে নিয়তের প্রয়োজনীয়তা ও তা বিশুদ্ধকরণের আবশ্যকতার বিষয়টিকেও বিশ্বাস করে। এ ব্যাপারে সে প্রথমত আল্লাহর বাণী থেকে দলীল গ্রহণ করে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ

“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।”[1] আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:

قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ

“বলুন, ‘আমি তো আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি, আল্লাহ‌র আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ‘ইবাদাত করতে।”[2] আর দ্বিতীয়ত দলীল গ্রহণ করে মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে, তিনি বলেন:

« إنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى » . (متفق عليه).

“প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত; আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।”[3] তিনি আরও বলেন:

« إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ » . (رواه مسلم).

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে লক্ষ্য করেন।”[4] আর অন্তরের দিকে লক্ষ্য করা মানে নিয়তের দিকে লক্ষ্য করা; কেননা, নিয়ত হলো কাজের উদ্দেশ্য ও প্রতিরক্ষক। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَةٌ » . (رواه مسلم).

“যে ব্যক্তি ভালোকাজের পরিকল্পনা করল, কিন্তু বাস্তবে সে কাজ করতে পারল না, সে ব্যক্তির জন্য সাওয়াব লেখা হবে।”[5] সুতরাং শুধু ভালোকাজের পরিকল্পনা করার দ্বারাই কাজটি ভালোকাজ হিসেবে গণ্য হয়ে যায়, প্রতিদান সাব্যস্ত হয়, সাওয়াব অর্জন হয়; আর এটা শুধু ভালো নিয়তের ফযীলতের করণেই সম্ভব হয়। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَثَلُ هَذِهِ الْأُمَّةِ كَمَثَلِ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ : رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا ، فَهُوَ يَعْمَلُ بِعِلْمِهِ فِي مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِي حَقِّهِ ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يُؤْتِهِ مَالًا ، فَهُوَ يَقُولُ : لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذِي يَعْمَلُ ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : فَهُمَا فِي الْأَجْرِ سَوَاءٌ . وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمْ يُؤْتِهِ عِلْمًا ، فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِي غَيْرِ حَقِّهِ ، وَرَجُلٌ لَمْ يُؤْتِهِ اللَّهُ عِلْمًا وَلَا مَالًا ، فَهُوَ يَقُولُ : لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذِي يَعْمَلُ ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : فَهُمَا فِي الْوِزْرِ سَوَاءٌ » . (رواه ابن ماجه).

“এ উম্মতের দৃষ্টান্ত চার ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত: ১. এক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ ও ‘ইলম (জ্ঞান) দান করেছেন, অতঃপর সে তার জ্ঞান দ্বারা আমল করে তার সম্পদকে হক পথে খরচ করে; ২. আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে ‘ইলম দান করেছেন, কিন্তু তাকে সম্পদ দেননি, অতঃপর সে বলে: আমার যদি এ ব্যক্তির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমি সে ক্ষেত্রে সে ব্যক্তির মতই কাজ করতাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সাওয়াবের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান। ৩. অপর আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু তাকে ‘ইলম দেননি, অতঃপর সে তার সম্পদের ক্ষেত্রে এলোমেলোভাবে কাজ করে তা অন্যায় পথে খরচ করে; ৪. অপর আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ ও ‘ইলম কোনটিই দান করেননি, অতঃপর সে বলে: আমার যদি এ ব্যক্তির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমি সে ক্ষেত্রে সে ব্যক্তির মতই কাজ করতাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: গুনাহের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান।”[6] সুতরাং ভালো নিয়তকারী ব্যক্তিকে ভালোকাজের সাওয়াব দেওয়া হয়; আর মন্দ নিয়তকারী ব্যক্তিকে মন্দকাজের মন্দ প্রতিদান দেওয়া হয়; আর এর একমাত্র কারণ হল নিয়ত।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক যুদ্ধের সময় তাবুকে অবস্থান কালে বলেন:

« لَقَدْ تَرَكْتُمْ بِالْمَدِينَةِ أَقْوَامًا مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا ، وَلاَ أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ ، وَلاَ قَطَعْتُمْ مِنْ وَادٍ إِلاَّ وَهُمْ مَعَكُمْ فِيهِ ». قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ وَكَيْفَ يَكُونُونَ مَعَنَا وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ ؟ فَقَالَ : « حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ » . (فَشَرَكُوا بِحُسْنِ النيةِ ) » . (رواه أبو داود و البخاري).

“তোমরা মদীনাতে এমন সম্প্রদায়কে রেখে এসেছ, যারা কোনো দূরপথ ভ্রমণ করেনি, কোনো অর্থ-সম্পদ খরচ করেনি এবং কোনো উপত্যকাও অতিক্রম করেনি, তবুও তারা তোমাদের সাথে (সাওয়াবে) শরীক রয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রা. নিবেদন করলেন: তারা কিভাবে আমাদের সাথে সাওয়াবের অংশীদার হবে, অথচ তারা মদীনাতেই ছিল? তখন তিনি বললেন: ‘ওযর’ তাদেরকে আটকিয়ে রেখেছিল। (তারা ভালো নিয়তের মাধ্যেমে আমাদের সাথে শরীক হয়েছে)।”[7] সুতরাং ভালো নিয়তের কারণে গাযী না হয়েও গাযীর মত সাওয়াবে অংশীদার হবে, আর মুজাহিদ না হয়েও মুজাহিদের মত সাওয়াব পাবে। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِذَا التَقَى الْمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا فَالْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِى النَّارِ ». فَقِيلَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ! هَذَا الْقَاتِلُ ، فَمَا بَالُ الْمَقْتُولِ ؟ فَقَالَ : « إِنَّهُ قَدْ أَرَادَ قَتْلَ صَاحِبِهِ » . (متفق عليه).

“যখন দু’জন মুসলিম তাদের তরবারি নিয়ে মুখোমুখি হবে, তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ে জাহান্নামে যাবে। প্রশ্ন করা হল: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এ হত্যাকারী (তো অপরাধী), কিন্তু নিহত ব্যক্তির কী অপরাধ? তখন তিনি বললেন: কারণ, সে তার সঙ্গীকে হত্যা করার ইচ্ছা (নিয়ত) করেছিল।”[8] সুতরাং হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মাঝে জাহান্নাম আবশ্যক হওয়ার বিষয়টিকে সমান করে দিল তাদের উভয়ের মন্দ নিয়ত ও খারাপ উদ্দেশ্য। তার নিয়ত যদি খারাপ না হত, তাহলে সে জান্নাতের অধিবাসী হত। অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« من تَزوَّج بصدَاقٍ لا يَنْوِي أداءَهُ فهو زَانٍ , و من أدَانَ دَيْناً و هو لا يَنْوِي قَضَاءَهُ فهو سارقٌ » . (رواه أحمد و ابن ماجه).

“যে ব্যক্তি এমন পরিমাণ মোহরের বিনিময়ে বিয়ে করেছে, যা সে পরিশোধ করার নিয়ত নেই, সে ব্যক্তি ব্যভিচারী; আর যে ব্যক্তি এমন ঋণ গ্রহণ করেছে, যা তার পরিশোধ করার ইচ্ছা নেই, সে ব্যক্তি চোর।”[9] সুতরাং মন্দ নিয়ত বৈধ জিনিসকে হারামে রূপান্তরিত করল এবং জায়েয বিষয়কে নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত করল; আর যা সমস্যামুক্ত ছিল, তা সমস্যাযুক্ত হয়ে গেল।

এ সব কিছুই মুসলিম ব্যক্তি যে নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাব এবং তার বড় ধরনের গুরুত্বের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও নিবিড় আস্থা পোষণ করে, সে বিষয়টিকে আরও মজবুত করে; ফলে সে বিশুদ্ধ নিয়তের উপর তার সকল কর্মকাণ্ডের ভিত রচনা করে; ঠিক অনুরূপভাবে সে সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করে যাতে তার একটি কাজও নিয়ত ছাড়া বা বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া সংঘটিত না হয়; কারণ, নিয়ত হলো কর্মের প্রাণ ও ভিত্তি; সুতরাং নিয়ত সঠিক তো কাজও সঠিক, আর নিয়ত শুদ্ধ নয় তো কাজও শুদ্ধ নয়; আর কর্তার বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কাজ হলো মোনাফেকী, কৃত্রিম, নিন্দিত ও ঘৃণিত।

আর অনুরূপভাবে মুসলিম ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, আমলসমূহ বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম রুকন ও শর্ত হলো নিয়ত; তারপর সে মনে করে যে, নিয়ত শুধু মুখে (হে আল্লাহ! আমি এরূপ নিয়ত করেছি) উচ্চারণ করার নাম নয়, আবার নিয়ত বলতে শুধু মনের ভাবকেই বুঝায় না, বরং নিয়ত হলো সঠিক উদ্দেশ্যে— উপকার হাসিল বা ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথাযথ কাজের প্রতি মনের ঝোঁক বা জাগরণ এবং অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অথবা তাঁর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। আর মুসলিম ব্যক্তি যখন বিশ্বাস করে যে, ভালো নিয়তের কারণে বৈধ কাজ প্রতিদান ও সাওয়াবের উপযুক্ত আনুগত্যে পরিণত হয় এবং বিশুদ্ধ নিয়তের অভাবে সাওয়াবের কাজও গুনাহ্ ও শাস্তির উপযুক্ত অন্যায় ও অবাধ্যতায় পরিণত হয়, তখন সে মনে করে না যে, অন্যায় ও অবাধ্যতার ক্ষেত্রে ভালো নিয়তের ফলে তা সাওয়াবের কাজে পরিণত হয়; সুতরাং যিনি কোনো ব্যক্তির গিবত করবেন অপর কোনো ব্যক্তির মন ভালো করার জন্য, তিনি এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবেন, তার তথা কথিত ভালো নিয়ত এখানে তার কোনো উপকারে আসবে না; আর যে ব্যক্তি হারাম অর্থ দ্বারা মাসজিদ নির্মাণ করবে, তাকে এ কাজের জন্য সাওয়াব দেয়া হবে না; আর যে ব্যক্তি নাচ-গান ও রঙ্গ-তামাশার অনুষ্ঠানে হাজির হয় জিহাদ ও অনুরূপ কোনো কাজে উৎসাহ পাওয়ার জন্য অথবা লটারীর টিকেট ক্রয় করে কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহিত করার নিয়তে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে এবং সাওয়াব পাওয়ার পরিবর্তে গুনাহগার হবে; আর যে ব্যক্তি সৎ ব্যক্তিগণের প্রতি ভালোবাসার নিয়তে তাদের কবরের উপর গম্বুজ তৈরি করবে অথবা তাদের উদ্দেশ্যে পশু যবাই করবে অথবা তাদের জন্য মানত করবে, সে ব্যক্তিও তার এ কাজের জন্য আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে, যদিও তার ধারণা মতে তার নিয়তটি ভালো হয়ে থাকে; কারণ, অনুমোদিত ‘মুবাহ’ (বৈধ) কাজের ক্ষেত্রে ছাড়া অন্য কোনো কাজই সৎ নিয়তের কারণে সাওয়াবের কাজ বলে গণ্য হবে না; আর হারাম কাজ তো কোনো অবস্থাতেই সাওয়াবের কাজে রূপান্তরিত হবে না।[10]

>
[1] সূরা আল-বায়্যেনা, আয়াত: ৫

[2] সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১

[3] বুখারী, হাদিস নং- ১; মুসলিম, হাদিস নং- ৫০৩৬

[4] মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭০৮

[5] মুসলিম, হাদিস নং- ৩৫৪

[6] ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৪২২৮; তিনি হাদিসটি উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন।

[7] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৫১০; বুখারী, হাদিস নং- ৪১৬১

[8] বুখারী, হাদিস নং- ৩১ ও ৬৬৭২; মুসলিম, হাদিস নং- ৭৪৩৪

[9] হাদসটি ইমাম আহমাদ ও ইবনু মাজাহ রহ. বর্ণনা করেছেন এবং ইবনু মাজাহ রহ. ‘মোহর’-এর বিষয়টিকে বাদ দিয়ে শুধু ‘ঋণ’-এর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বর্ণনা করেছেন।

[10] আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, দারুশ্ শুরুক, জেদ্দা, চতুর্থ সংস্করণ, দশম মুদ্রণ: ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ. ১০৩
আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুসলিম বান্দার আদব

মুসলিম ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অগণিত নি‘য়ামতের প্রতি লক্ষ্য করে; আরও লক্ষ্য করে ঐসব নি‘য়ামতের প্রতি, যেসব নি‘য়ামত তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে শুরু করে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ (মৃত্যু) করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ফলে সে তার নিজ মুখে তাঁর যথাযথ প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার দ্বারা এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে তাঁর আনুগত্যের অধীনস্থ করে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে; আর এটাই হলো তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে আদব; কেননা, নি‘য়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা, তাকে এবং তার ইহসান ও অবদানকে অবজ্ঞা করাটা কোনো আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

وَمَا بِكُم مِّن نِّعۡمَةٖ فَمِنَ ٱللَّهِۖ

“তোমাদের নিকট যেসব নিয়ামত রয়েছে, তা তো আল্লাহর নিকট থেকেই (এসেছে)।”[1] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

وَإِن تَعُدُّواْ نِعۡمَةَ ٱللَّهِ لَا تُحۡصُوهَآۗ

“তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না।”[2] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

فَٱذۡكُرُونِيٓ أَذۡكُرۡكُمۡ وَٱشۡكُرُواْ لِي وَلَا تَكۡفُرُونِ

“কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।”[3]

আর মুসলিম ব্যক্তি গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সম্পর্কে জানেন এবং তার সকল অবস্থা অবলোকন করেন; ফলে তার হৃদয়-মন তাঁর ভয়ে ও তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে; যার কারণে সে তাঁর অবাধ্যতায় লজ্জিত হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ ও তাঁর আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটাকে রীতিমত অপমান মনে করে। সুতরাং এটাও তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে আদব; কেননা, গোলাম কর্তৃক তাঁর মালিকের সাথে অবাধ্য আচরণ করা অথবা মন্দ ও ঘৃণ্য কোনো বস্তু বা বিষয় নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হওয়া, অথচ তিনি তা সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন— তা কোনো ভাবেই আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارٗا ١٣ وَقَدۡ خَلَقَكُمۡ أَطۡوَارًا

“তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহ‌র শ্রেষ্ঠত্বের পরওয়া করছ না। অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে।”[4] তিনি আরও বলেন:

وَيَعۡلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعۡلِنُونَۚ

“আর তিনি জানেন তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর।”[5] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَمَا تَكُونُ فِي شَأۡنٖ وَمَا تَتۡلُواْ مِنۡهُ مِن قُرۡءَانٖ وَلَا تَعۡمَلُونَ مِنۡ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيۡكُمۡ شُهُودًا إِذۡ تُفِيضُونَ فِيهِۚ وَمَا يَعۡزُبُ عَن رَّبِّكَ مِن مِّثۡقَالِ ذَرَّةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِي ٱلسَّمَآءِ ﴾ [يونس: ٦١]

“আর আপনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন এবং আপনি সে সম্পর্কে কুরআন থেকে যা-ই তিলাওয়াত করেন এবং তোমরা যে আমলই কর না কেন, আমরা তোমাদের সাক্ষী থাকি- যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও। আর আসমানসমূহ ও যমীনের অণু পরিমাণও আপনার রবের দৃষ্টির বাইরে নয়।”[6]

আবার মুসলিম ব্যক্তি গভীরভাবে এটাও লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ক্ষমতাবান, সে তাঁর আয়াত্তাধীন এবং তাঁর দিকে ছাড়া তার পালানোর, মুক্তির ও আশ্রয় নেয়ার আর কোনো জায়গা নেই; সুতরাং সে আল্লাহর দিকে ধাবিত হবে, তাঁর সামনে নিজেকে সমর্পণ করে দেবে, তার বিষয়াদি তাঁর নিকট সোপর্দ করবে এবং তাঁর উপর ভরসা করবে; ফলে এটা তার পক্ষ থেকে তার প্রতিপালক ও সৃষ্টা আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব বলে গণ্য হবে; কেননা, যাঁর থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো সুযোগ নেই তাঁর কাছ থেকে পালানো, যার কোনো ক্ষমতা নেই তার উপর নির্ভর করা এবং যার কোনো শক্তি ও ক্ষমতা নেই তার উপর ভরসা করা কোনো আদব বা শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

مَّا مِن دَآبَّةٍ إِلَّا هُوَ ءَاخِذُۢ بِنَاصِيَتِهَآۚ

“এমন কোন জীব-জন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়।”[7] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

فَفِرُّوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۖ إِنِّي لَكُم مِّنۡهُ نَذِيرٞ مُّبِينٞ

“অতএব তোমরা আল্লাহর দিকে ধাবিত হও, নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক স্পষ্ট সতর্ককারী।”[8] তিনি আরও বলেন:

وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ

“এবং আল্লাহর উপরই তোমরা নির্ভর কর, যদি তোমরা মুমিন হও।”[9]

আবার মুসলিম ব্যক্তি এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সকল বিষয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তার প্রতি ও তাঁর (আল্লাহর) সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া ও করুণা করেন, যার কারণে সে এর চেয়ে আরও বেশি আশা করে; ফলে সে খালেসভাবে তাঁর নিকট অনুনয়, বিনয় ও নিবেদন করে এবং ভালো কথা ও সৎ আমলের অছিলা ধরে তাঁর নিকট প্রার্থনা করে; সুতরাং এটা তার পক্ষ থেকে তার মাওলা আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব বলে গণ্য হবে; কারণ, যে রহমত সকল কিছুকে বেষ্টন করে রেখেছে তার থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া, যে ইহসান সকল সৃষ্টিকে শামিল করে তার থেকে হতাশ বা নিরাশ হওয়া এবং যে দয়া ও অনুগ্রহ সকল সৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করে তার আশা ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো আদব বা শিষ্টাচার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ

“আর আমার দয়া তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে।”[10] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

ٱللَّهُ لَطِيفُۢ بِعِبَادِهِ

“আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত কোমল।”[11] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

وَلَا تَاْيۡ‍َٔسُواْ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ

“এবং আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না।”[12] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ

“তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না।”[13]

আর মুসলিম ব্যক্তি এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা’র ধরা বড় কঠিন, তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি খুব দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী; ফলে সে তাঁর আনুগত্য করার মাধ্যমে তাঁকে ভয় করে এবং আত্মরক্ষা করে তাঁর অবাধ্য না হওয়ার মধ্য দিয়ে; ফলে এটাও আল্লাহ তা‘আলার সাথে তার পক্ষ থেকে আদব বলে গণ্য হয়; কারণ, কোনো বুদ্ধিমানের নিকটই এটা আদব বলে গণ্য হবে না যে, একজন দুর্বল আক্ষম বান্দা মহাপরাক্রমশালী প্রবল শক্তিধর মহান ‘রব’ আল্লাহ তা‘আলার মুখোমুখী হবে বা তাঁর বিরোধিতা করবে; অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَإِذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِقَوۡمٖ سُوٓءٗا فَلَا مَرَدَّ لَهُۥۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَالٍ

“আর কোনো সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছে করেন, তবে তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই।”[14] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

إِنَّ بَطۡشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ

“নিশ্চয় আপনার রবের পাকড়াও বড়ই কঠিন।”[15] তিনি আরও বলেন:

وَٱللَّهُ عَزِيزٞ ذُو ٱنتِقَامٍ

“আর আল্লাহ মহা-পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।”[16]

আর মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়ার মুহূর্তে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁর প্রতি এমনভাবে লক্ষ্য করে যে, মনে হয় যেন আল্লাহর দেওয়া হুমকি তাকে পেয়ে বসেছে, তাঁর আযাব বুঝি তার প্রতি নাযিল হয়ে গেল এবং তাঁর শাস্তি যেন তার আঙ্গিনায় আপতিত হল; অনুরূপভাবে সে তাঁর আনুগত্য করার মুহূর্তে এবং তাঁর শরী‘য়তের অনুসরণ করার সময় তাঁর প্রতি এমনভাবে লক্ষ্য করে যে, মনে হয় যেন তিনি তাঁর দেয়া প্রতিশ্রুতি তার জন্য সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন এবং তাঁর সন্তুষ্টির চাদর খুলে তাকে ঢেকে দিয়েছেন; সুতরাং এটা হলো মুসলিম ব্যক্তির পক্ষ থেকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সুধারণা বিশেষ; আর আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটা আদব বা শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত; কেননা, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করাটা কোনো ভাবেই আদবের মধ্যে পড়ে না; কারণ, সে তাঁর অবাধ্য হয়ে চলবে এবং তাঁর আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে, আর ধারণা করবে যে, তিনি তার ব্যাপারে অবগত নন এবং তিনি তাকে তার পাপের জন্য পাকড়াও করবেন না; অথচ তিনি বলেন:

﴿ وَلَٰكِن ظَنَنتُمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَا يَعۡلَمُ كَثِيرٗا مِّمَّا تَعۡمَلُونَ ٢٢ وَذَٰلِكُمۡ ظَنُّكُمُ ٱلَّذِي ظَنَنتُم بِرَبِّكُمۡ أَرۡدَىٰكُمۡ فَأَصۡبَحۡتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٢٣ ﴾ [فصلت: ٢٢، ٢٣]

“বরং তোমরা মনে করেছিলে যে, তোমরা যা করতে তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না। আর তোমাদের রব সম্বন্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদের ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা হয়েছ ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।”[17] অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার সাথে এটাও আদব নয় যে, বান্দা তাঁকে ভয় করবে ও তাঁর আনুগত্য করবে এবং ধারণা করবে যে, তিনি তাকে তার ভালো কাজের প্রতিদান দিবেন না এবং তার পক্ষ থেকে তিনি তাঁর আনুগত্য ও ‘ইবাদতকে কবুল করবেন না; অথচ তিনি বলেন:

وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَخۡشَ ٱللَّهَ وَيَتَّقۡهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَآئِزُونَ

“আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে তারাই কৃতকার্য।”[18] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧ ﴾ [النحل: ٩٧]

“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।”[19] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ عَشۡرُ أَمۡثَالِهَاۖ وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَا وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ

“কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার দশ গুণ পাবে। আর কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু তার অনুরূপ প্রতিফলই দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।”[20]

আর মূলকথা হলো: মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক তার প্রতিপালকের দেয়া নি‘য়ামতের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করা, তাঁর অবাধ্যতার দিকে ধাবিত হওয়ার সময় তাঁকে লজ্জা পাওয়া, তাঁর কাছে সত্যিকার অর্থে তাওবা করা, তাঁর উপর ভরসা করা, তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে এবং তাঁর ইচ্ছা মাফিক তাঁর কোনো বান্দার প্রতি শাস্তিমূলক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাঁর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটাই হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে তার আদব রক্ষা করে চলা; আর বান্দা কর্তৃক এ আদবের যতটুকু ধারণ ও রক্ষা করে চলবে, ততটুকু পরিমাণে তার মর্যাদা সমুন্নত হবে, মান উন্নত হবে এবং সম্মান বৃদ্ধি পাবে; ফলে সে আল্লাহর অভিভাবকত্ব ও তা তাঁর তত্ত্ববধানে থাকা ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাঁর রহমত ও নি‘য়ামত পাওয়ার উপযুক্ত হবে।আর এটাই মুসলিম ব্যক্তির দীর্ঘ জীবনের একমাত্র চাওয়া এবং চূড়ান্ত প্রত্যাশা। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার অভিভাবকত্ব নসীব করুন, আপনি আমাদেরকে আপনার তত্ত্ববধান থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার নিকটতম বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত করুন; হে আল্লাহ! হে জগতসমূহের প্রতিপালক! আমাদের আবেদন কবুল করুন।

>
[1] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৩

[2] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৮

[3] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫২

[4] সূরা নূহ, আয়াত: ১৩ - ১৪

[5] সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৪

[6] সূরা ইউনুস, আয়াত: ৬১

[7] সূরা হুদ, আয়াত: ৫৬

[8] সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫০

[9] সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২৩

[10] সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৬

[11] সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ১৯

[12] সূরা ইউসূফ, আয়াত: ৮৭

[13] সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩

[14] সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১১

[15] সূরা আল-বুরূজ, আয়াত: ১২

[16] আলে ইমরান, আয়াত: ৪

[17] সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ২২ - ২৩

[18] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫২

[19] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৯৭

[20] সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬০
আল্লাহর বাণী ‘আল-কুরআনুল কারীম’-এর সাথে বান্দার আদব

মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার বাণী এবং সকল বাণীর উপর তাঁর বাণীর সম্মান ও মর্যাদায় বিশ্বাস করে। আরও মনে করে, যে ব্যক্তি কুরআন দ্বারা কথা বলে, সে সত্য বলে; আর যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারা বিচার ফয়সালা করে, সে ন্যায়বিচার করে; আর তাঁর ধারক-বাহকগণ আল্লাহর পরিবার ও তাঁর নিকটতম বিশেষ ব্যক্তিবর্গ; আর তাঁকে যারা আকড়ে ধরবে, তারা নাজাতপ্রাপ্ত সফলকাম; আর যারা তাঁকে পরিহার করে চলে, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

আর আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের মহত্ব, পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে মুসলিম ব্যক্তির ঈমানে আরও বৃদ্ধি ঘটাবে, যা বর্ণিত হয়েছে ওহী’র ধারক সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ আমাদের নেতা মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহ- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে; যেমন— তিনি বলেন:

« اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ » . (أخرجه مسلم) .

“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর; কেননা, কিয়ামতের দিন তা তিলাওয়াতকারীদের জন্য সুপারীশকারীরূপে উপস্থিত হবে।”[1] তিনি আরও বলেন:

« خَيْركُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآن وَعَلَّمَهُ » . (أخرجه البخاري) .

“তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যে আল-কুরআনের শিক্ষা লাভ করে এবং তা অন্যকে শিক্ষা দেয়।”[2] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« أَهْلُ الْقُرْآنِ هُمْ أَهْلُ اللَّهِ وَخَاصَّتُهُ » . (رواه النسائي و ابن ماجه و أحمد و الحاكم).

“আল-কুআনের ধারক-বাহকগণ আল্লাহর পরিবার ও তাঁর নিকটতম বিশেষ ব্যক্তিবর্গ।”[3] তিনি আরও বলেন:

« إن القلوبَ تصدأ كما يصدأ الحديدُ ، فقيل : يا رسول الله ! وما جلاؤها ؟ فقال: تلاوةُ القرآن ، وذكرُ الموتِ » . (رواه البيهقي).

“অন্তর মরিচাযুক্ত হয়, যেমনিভাবে লোহতে মরিচা পড়ে; অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হল: হে আল্লাহর রাসূল! তা দূর করার উপায় কী? জবাবে তিনি বললেন: কুরআন তিলাওয়াত করা এবং মুত্যুর কথা স্মরণ করা।”[4] আরেক বার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে চরমভাবে ঝগড়াকারীদের কোনো একজন তাঁর নিকট এসে বলল: হে মুহাম্মাদ! তুমি আমার নিকট কুরআন তিলাওয়াত কর, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করেন:

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَٰنِ وَإِيتَآيِٕ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَيَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِ وَٱلۡبَغۡيِۚ يَعِظُكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ ٩٠ ﴾ [النحل: ٩٠]

“আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচারণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকাজ ও সীমালংঘ করতে; তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।”[5] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করে শেষ করতে না করতেই প্রচণ্ড ঝগড়াটে ব্যক্তি তাঁর শব্দের মহত্বে ও অর্থের পবিত্রতায় বিস্মিত হয়ে, তার স্পষ্টতায় আক্রান্ত হয়ে এবং প্রভাবিত করার শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে তা পুনরায় তিলাওয়াত করার আবেদন করল; আর সে দেরি করেনি আল্লাহর বাণীর পবিত্রতা ও মহত্বের ব্যাপারে স্বীকৃতি ও সাক্ষ্য প্রদান করতে; কেননা, সে এক বাক্যে বলে ফেলল:

والله ، إنَّ لَه لحلاوةً ، وإنّ عَليه لطَلاوَة ، وإنّ أسفَلَه لمورِقٌ ، وإنَّ أعلاَه لمثمِر ، وما يقول هذا بشر

“আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই তার মধুরতা রয়েছে, রয়েছে তার সৌন্দর্য ও উজ্জ্বলতা, তার নীচের অংশ সবুজ-শ্যামল এবং উপরের অংশ ফলদায়ক; আর এটা কোনো মানুষের কথা নয়!।”[6]

আর এ জন্য মুসলিম ব্যক্তি তাঁর প্রতি বিশ্বাস করার পাশাপাশি তার হালাল বিষয়কে হালাল মনে করে, তার হারাম বিষয়কে হারাম মনে করে, তার আদবসমূহ যথাযথভাবে পালন করে এবং তার চারিত্রিক ও নৈতিক বিষয়সমূহকে স্বীয় চরিত্র বলে গ্রহণ করে; সুতরাং সে আল-কুরআন তিলাওয়াত করার সময় নিম্নোক্ত আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে:

১. অবস্থার পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করে পবিত্রতাসহ কিবলামুখী হয়ে আদব ও সম্মানের সাথে বসে কুরআন পাঠ করা।

২. ধীরস্থিরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং এ ক্ষেত্রে তাড়াহুরা না করা; সুতরাং কমপক্ষে তিন দিনের কমে কুরআন খতম করবে না; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِي أَقَلَّ مِنْ ثَلَاثٍ لَمْ يَفْقَهْهُ » . (رواه أصحاب السنن و أحمد) .

“যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ের মধ্যে আল-কুরআন পাঠ করে শেষ করে, সে ব্যক্তি তা বুঝতে পারেনি।”[7] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা প্রতি সপ্তাহে কুরআন খতম করার নির্দেশ দিয়েছেন।[8] যেমন আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ, উসমান ইবন ‘আফ্ফান ও যায়েদ ইবন সাবেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম প্রতি সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করতেন।[9]

৩. কুরআন তিলাওয়াতের সময় বিনয়ী ও ভীতশ্রদ্ধ হওয়া এবং দুঃখ প্রকাশ করা; আর ক্রন্দন করা, অথবা কাঁদতে না পারলে কাঁদার ভান করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« اتْلُوُا الْقُرْآنَ وَابْكُوْا ، فَإِنْ لَمْ تَبْكُوا فَتَبَاكَوْا » . (رواه ابن ماجه).

“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর এবং ক্রন্দন করো; আর যদি কাঁদতে না পারো, তাহলে কাঁদার ভান কর।”[10]

৪. মধুর সুরে কুরআন তিলাওয়াত করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ » . (رواه أحمد و ابن ماجه و النسائي و الحاكم).

“তোমরা সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত কর।”[11] তিনি আরও বলেন:

« لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ » . (رواه البخاري) .

“যে ব্যক্তি ভাল আওয়াজে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”[12] তিনি আরও বলেন:

« ما أذِنَ اللهُ لشيءٍ ما أَذِنَ لِنَبيٍّ أنْ يتَغنَّى بالقُرآن » . (متفق عليه) .

“আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কোনো এক নবী থেকে (মধুময় সুরে) যেভাবে কুরআন শ্রবণ করেছেন, সেভাবে আর কিছুই তিনি শুনেননি।”[13]

৫. গোপনে তিলাওয়াত করা, যদি সে তার নিজের ব্যাপারে প্রদর্শনী বা সুখ্যাতি ছড়ানোর আশঙ্কা করে অথবা তার দ্বারা সালাত আদায়কারীর সালাত আদায়ে বিঘ্ন ঘটে; কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« الْجَاهِرُ بِالْقُرْآنِ كَالْجَاهِرِ بِالصَّدَقَةِ » . (رواه أبو داود و الترمذي).

“আল-কুরআনের মাধ্যমে নিজেকে প্রচারকারী ঐ ব্যক্তির মত, যে সাদকা করার মাধ্যমে নিজেকে প্রচার করে বেড়ায়।”[14] উল্লেখ্য যে, গোপনে সাদকা করাই উত্তম, কিন্তু প্রকাশ করার মধ্যে নির্দিষ্ট কেনো ফায়দা থাকলে ভিন্ন কথা, যেমন— মানুষকে সাদকা করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রকাশ্যে সাদকা করা; আর কুরআন তিলাওয়াতের বিষয়টিও অনুরূপ।

৬. তাঁর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও মনোযোগসহ চিন্তা ও গবেষণার সাথে তা তিলাওয়াত করা এবং তাঁর অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করা।

৭. কুরআন তিলাওয়াতের সময় তাঁর ব্যাপারে অমনোযোগী এবং তাঁর বিরোধী না হওয়া; কারণ, এমনটি করলে নিজেই নিজের অভিশাপের কারণ হবে; কেননা, সে যদি পাঠ করে:

لَّعۡنَتَ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰذِبِينَ

(মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লা‘নত)।[15] অথবা পাঠ করে:

أَلَا لَعۡنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلظَّٰلِمِينَ

(সাবধান! আল্লাহর লা‘নত যালিমদের উপর)[16] এবং নিজে যদি মিথ্যাবাদী বা যালিম হয়, তাহলে সে নিজেকে নিজে অভিশাপ বা লা‘নতকারী বলে গণ্য হবে।

আর নিম্নোক্ত বর্ণনাটি আল্লাহর কিতাব থেকে মুখ ফিরেয়ে নেয়া গাফিল ব্যক্তিগণের ভুলের পরিমাণ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছে; বর্ণিত আছে: “তাওরাত কিতাবে এসেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তুমি কি আমাকে লজ্জা পাও, তোমার কোনো ভাইয়ের নিকট থেকে তোমার কাছে একটি গ্রন্থ আসে এমতাবস্থায় যে, তুমি রাস্তার মধ্যে হাঁটছ, তারপর তুমি সে বইটির কারণে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ছ, তারপর তা পাঠ করছ এবং তা নিয়ে অক্ষরে অক্ষরে গবেষণা করছ, এমনকি তার কোনো কিছুই তোমার কাছ থেকে বাদ যায় না; আর এটা আমার কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, তুমি লক্ষ্য কর তো, তোমার জন্য আমি তাতে কথাগুলো কিভাবে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি, আর তাতে কতবার আমি তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য তোমাকে তাগিদ দিয়েছি, তারপর তুমি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, সুতরাং আমি তোমার তথাকথিত ভাইদের কারো কারো চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল, তাই না ? হে আমার বান্দা! তোমার কোনো ভাই তোমার নিকট এসে বসে, তারপর তুমি একেবারে তার মুখোমুখি হয়ে বসে যাও এবং তোমার ষোলআনা মন দিয়ে কান পেতে তার কথা শ্রবণ করতে থাক, তারপর কোনো কথক যদি কথা বলে অথবা তার কথা শুনার সময় কেউ তোমাকে বিরক্ত করে, তাহলে তুমি তার দিকে ইশারা করে বলো যে, তুমি থাম বা চুপ কর; আর আমি তোমার কাছে এসে তোমার সাথে কথা বলি, অথচ তুমি মন- দিল দিয়ে সচেতনভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও; সুতরাং তুমি কি তোমার ভাইদের কারো কারো চেয়ে আমাকে তোমার নিকটে সবচেয়ে বেশি দুর্বল বলে ধারণা করেছ?![17]

৮. আল-কুরআনের ধারক ও বাহকগণ তথা আল্লাহর পরিবার ও তাঁর বিশেষ ব্যক্তিবর্গের গুণাবলী দ্বারা গুণান্বিত হওয়ার এবং তাদের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা; যেমনটি আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:

« ينبغي لقارئ القرآن أن يُعْرَف بليله إذ الناس نائمون , وبنهاره إذ الناس مُفْطِرون , وببكائه إذ الناس يضحكون , وبورعه إذ الناس يخلطون ، وبصمته إذ الناس يخوضون , وبخشوعه إذ الناس يختالون , وبحزنه إذ الناس يفرحون » .

“আল-কুরআনের পাঠককে এমন হতে হবে যে, তাকে রাতের বেলায় চেনা যাবে, যখন জনগণ ঘুমিয়ে থাকবে, আর দিনের বেলায় চেনা যাবে, যখন জনগণ সাওম পালন না করে পানাহার করবে; আর তাকে চেনা যাবে তাঁর ক্রন্দন দ্বারা, যখন জনগণ হাসবে; আর তাকে চেনা যাবে তার ‘তাকওয়া’ এর দ্বারা, যখন জনগণ পরস্পর মিশে যাবে এবং তাকে চেনা যাবে তার মৌনতার দ্বারা, যখন জনগণ কথাবার্তায় নিমগ্ন হবে; আর তাকে চেনা যাবে তার নম্রতা দ্বারা, যখন জনগণ গর্ব-অহঙ্কার করবে এবং তাকে চেনা যাবে তার দুঃখ-কষ্টের দ্বারা, যখন জনগণ আনন্দ প্রকাশ করবে।”[18]

আর মুহাম্মাদ ইবন কা‘ব বলেন: আমরা আল-কুরআনের পাঠককে চিনতাম তার ফেকাশে বর্ণের চেহারার দ্বারা; তিনি এর দ্বারা তার রাত্রি জাগরণ ও দীর্ঘ সময় ধরে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আর ওহাইব ইবনুল ওয়ারদ বলেন: জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হলো তুমি কি ঘুমাও না? জবাবে সে বলল: আল-কুরআনের বিস্ময়কর দিকগুলো আমার ঘুমকে ঘেরাও করে রেখেছে।[19] আর যূন নূন আল-মিসরী আবৃত্তি করে বলেন:

منع القرآن بوعده ووعيده

مُقَل العيون بليلها لا تهجَعُ

(আল-কুরআন তাঁর প্রতিশ্রুতি ও হুমকির দ্বারা বারণ করে

অক্ষিগোলককে তার রাতের বেলায়— তুমি ঘুমাবে না)।

فهموا عن الملك العظيم كلامه

فهماً تَذِلُّ له الرقابُ وتخضَعُ

(তারা মহান অধিপতির বাণী সম্পর্কে এমনভাবে অনুধাবন করে,যে অনুধাবনে তাঁর উদ্দেশ্য তাদের ঘাড় বিনীতভাবে অবনত হয়)।[20]

>
[1] মুসলিম, হাদিস নং- ১৯১০

[2] বুখারী, হাদিস নং- ৪৭৩৯

[3] হাদসটি ইমাম নাসায়ী, ইবনু মাজাহ, আহমাদ ও হাকেম রহ. ‘হাসান’ সনদে বর্ণনা করেছেন।

[4] হাদসটি ইমাম বায়হাকী রহ. দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন।

[5] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৯০

[6] ইবনু জারীর আত-তাবারী; আর ঝগড়াটে ব্যক্তিটি হল ওয়ালিদ ইবন মুগীরা, যেমনটি ইমাম বায়হাকী রহ. উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন; আল-গাযালী রহ., ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ্ দীন’, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৪

[7] সুনান চতুষ্টয় ও আহমাদ; তিরমিযী রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।

[8] বুখারী ও মুসলিম।

[9] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১০৯

[10] হাদসটি ইমাম ইবনু মাজাহ রহ. উৎকৃষ্ট সনদে বর্ণনা করেছেন।

[11] হাদসটি ইমাম আহমাদ, ইবনু মাজাহ, নাসায়ী ও হাকেম রহ. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং তা সহীহ।

[12] বুখারী, হাদিস নং- ৭০৮৯

[13] বুখারী, হাদিস নং- ৭০৪৪; মুসলিম, হাদিস নং- ১৮৮১

[14] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ১৩৩৫; তিরমিযী, হাদিস নং- ২৯১৯

[15] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬১

[16] সূরা হুদ, আয়াত: ১৮

[17] আল-গাযালী রহ., ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ্ দীন’, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৭৫

[18] ‘আখলাকু আহলিল কুরআন’ ( أخلاق أهل القرآن ), ১ম খণ্ড, পৃ. ১০

[19] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১১১

[20] প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুমিন বান্দার আদব

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে পরিপূর্ণ আদব রক্ষা করার আবশ্যকতার বিষয়টি মুসলিম ব্যক্তি তার মনে প্রাণে অনুভব করে; আর এ আবশ্যকতার ব্যাপারটি নিম্নোক্ত কারণে:

১. আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও নারীর উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে পরিপূর্ণ আদব রক্ষা করে চলার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বাণীর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُقَدِّمُواْ بَيۡنَ يَدَيِ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِ

“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সমক্ষে তোমরা কোনো বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না।”[1] আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَرۡفَعُوٓاْ أَصۡوَٰتَكُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ ٱلنَّبِيِّ وَلَا تَجۡهَرُواْ لَهُۥ بِٱلۡقَوۡلِ كَجَهۡرِ بَعۡضِكُمۡ لِبَعۡضٍ أَن تَحۡبَطَ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَأَنتُمۡ لَا تَشۡعُرُونَ ٢ ﴾ [الحجرات: ٢]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর কন্ঠস্বরের উপর নিজেদের কন্ঠস্বর উঁচু করো না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচ্চস্বরে কথা বল, তার সাথে সেরূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না; এ আশঙ্কায় যে, তোমাদের সকল কাজ বিনষ্ট হয়ে যাবে, অথচ তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।”[2] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصۡوَٰتَهُمۡ عِندَ رَسُولِ ٱللَّهِ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱمۡتَحَنَ ٱللَّهُ قُلُوبَهُمۡ لِلتَّقۡوَىٰۚ لَهُم مَّغۡفِرَةٞ وَأَجۡرٌ عَظِيمٌ ٣ ﴾ [الحجرات: ٣]

“নিশ্চয় যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে নিজেদের কন্ঠস্বর নীচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।”[3] আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِن وَرَآءِ ٱلۡحُجُرَٰتِ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ ٤ وَلَوۡ أَنَّهُمۡ صَبَرُواْ حَتَّىٰ تَخۡرُجَ إِلَيۡهِمۡ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۡۚ ﴾ [الحجرات: ٤، ٥]

“নিশ্চয় যারা হুজরাসমূহের পিছন থেকে আপনাকে উচ্চস্বরে ডাকে, তাদের অধিকাংশই বুঝে না। আর আপনি বের হয়ে তাদের কাছে আসা পর্যন্ত যদি তারা ধৈর্য ধারণ করত, তবে তা-ই তাদের জন্য উত্তম হত।”[4] তিনি আরও বলেন:

لَّا تَجۡعَلُواْ دُعَآءَ ٱلرَّسُولِ بَيۡنَكُمۡ كَدُعَآءِ بَعۡضِكُم بَعۡضٗاۚ

“তোমরা রাসূলের আহ‌বানকে তোমাদের একে অপরের আহ্বানের মত গণ্য করো না।”[5] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَإِذَا كَانُواْ مَعَهُۥ عَلَىٰٓ أَمۡرٖ جَامِعٖ لَّمۡ يَذۡهَبُواْ حَتَّىٰ يَسۡتَ‍ٔۡذِنُوهُۚ ﴾ [النور: ٦٢]

“মুমিন তো তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনে এবং রাসূলের সঙ্গে সমষ্টিগত ব্যাপারে একত্র হলে তারা অনুমতি ছাড়া সরে পড়ে না।”[6] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَ‍ٔۡذِنُونَكَ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۚ فَإِذَا ٱسۡتَ‍ٔۡذَنُوكَ لِبَعۡضِ شَأۡنِهِمۡ فَأۡذَن لِّمَن شِئۡتَ مِنۡهُمۡ ﴾ [النور: ٦٢]

“নিশ্চয় যারা আপনার অনুমতি প্রার্থনা করে, তারাই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান রাখে। অতএব তারা তাদের কোনো কাজের জন্য আপনার অনুমতি চাইলে তাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছে আপনি অনুমতি দেবেন।”[7] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا نَٰجَيۡتُمُ ٱلرَّسُولَ فَقَدِّمُواْ بَيۡنَ يَدَيۡ نَجۡوَىٰكُمۡ صَدَقَةٗۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ لَّكُمۡ وَأَطۡهَرُۚ فَإِن لَّمۡ تَجِدُواْ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ ١٢ ﴾ [المجادلة: ١٢]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন রাসূলের সাথে চুপি চুপি কথা বলতে চাও, তখন তোমাদের এরূপ কথার পূর্বে কিছু সাদাকাহ্ পেশ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় ও পরিশোধক; কিন্তু যদি তোমরা অক্ষম হও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[8]

২. আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার বিষয়টিকে ফরয করে দিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে তাঁকে মহব্বত করার বিষয়টিকেও তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর।”[9] তিনি আরও বলেন:

فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“কাজেই যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”[10] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ

“আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাক।”[11] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ

“বলুন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন।”[12]

৩. আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ইমাম (নেতা) ও বিচারক বানিয়ে দিয়েছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

إِنَّآ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ لِتَحۡكُمَ بَيۡنَ ٱلنَّاسِ بِمَآ أَرَىٰكَ ٱللَّهُۚ

“আমরা তো আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করতে পারেন।”[13] তিনি আরও বলেন:

وَأَنِ ٱحۡكُم بَيۡنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَهُمۡ

“আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, আপনি সে অনুযায়ী বিচার নিষ্পত্তি করুন এবং আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না।”[14] তিনি আরও বলেন:

﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء: ٦٥]

“কিন্তু না, আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।”[15] তিনি আরও বলেন:

لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ

“অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ, তার জন্য যে আশা রাখে আল্লাহ ও শেষ দিনের।”[16]

আর ইমাম ও বিচারকের সাথে ভদ্রতা ও সভ্যতা বজায় রেখে চলার বিষয়টিকে শরী‘য়তের বিধিবিধানসমূহ ফরয করে দিয়েছে, বিবেক-বুদ্ধি তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সঠিক যুক্তি তাকে মেনে নিয়েছে।

৪. আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মহব্বত করার বিষয়টিকে তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের) ভাষায় ফরয করে দিয়েছেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ » . (متفق عليه).

“সেই সত্তার কসম করে বলছি, যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার সন্তান-সন্ততি, তার পিতামাতা ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হব।”[17] আর যাঁকে ভালোবাসা আবশ্যক, তাঁর সাথে আদব রক্ষা করে চলাটাও বাধ্যতামূলক এবং তাঁর সাথে সভ্য আচরণ করা বাঞ্ছনীয়।

৫. যাঁকে তাঁর রব আল্লাহ তা‘আলা শারীরিক গঠনাকৃতি ও নৈতিক চরিত্রের সৌন্দর্যের দ্বারা বিশেষিত করেছেনে এবং যাঁকে আত্মসম্মান ও বৈশিষ্ট্যের পূর্ণতা দান করেছেন, তিনি হলেন সবচেয়ে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠতর সৃষ্টি; সুতরাং যাঁর এ অবস্থা, তাঁর সাথে ভদ্র ও সভ্য আচরণ করার বিষয়টি আবশ্যক হবে না কিভাবে!এসব হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আদব রক্ষা করে চলার কিছু জরুরি বিষয় এবং এগুলো ছাড়া আরও অনেক বিষয় রয়েছে; কিন্তু কিভাবে আদব রক্ষা করা যাবে? আর কিসের দ্বারা সে আদব রক্ষা করা সম্ভব হবে? এ বিষয়টি ভালভাবে জানতে হবে!

>
[1] সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১

[2] সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ২

[3] সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৩

[4] সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৪ - ৫

[5] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩

[6] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬২

[7] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬২

[8] সূরা আল-মুজাদালা, আয়াত: ১২

[9] সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৩

[10] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩

[11] সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭

[12] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১

[13] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৫

[14] সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৪৯

[15] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫

[16] সূরা, আল-আহযাব, আয়াত: ২১

[17] বুখারী, হাদিস নং- ১৪ ও ১৫; মুসলিম, হাদিস নং- ১৭৮
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আদব হবে:

১. দীন ও দুনিয়ার সকল নিয়মনীতি ও কর্মপদ্ধতিতে তাঁর আনুগত্য করা, পদাঙ্ক অনুসরণ করা এবং তাঁর পদক্ষেপ অনুযায়ী পরিকল্পনা করা।

২. তাঁর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও মর্যাদার উপর অপর কোনো সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, অথবা সম্মান, বা মর্যাদাকে অগ্রাধিকার না দেওয়া।

৩. তিনি যাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতেন, তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা; তিনি যাকে শত্রু বলে গ্রহণ করতেন, তাকে শত্রুরূপে গ্রহণ করা; তিনি যাতে সন্তুষ্ট থাকতেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা; আর তিনি যার প্রতি রাগান্বিত হতেন, তার প্রতি রাগ করা।

৪. তাঁর নামকে সম্মান করা এবং তাঁর নাম উচ্চারণের সময় শ্রদ্ধা করা; তাঁর প্রতি সালাত (দুরূদ) ও সালাম পেশ করা; তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা এবং তাঁর মহৎ গুণাবলী ও মর্যাদাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা।

৫. দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে তিনি যেসব সংবাদ দিয়েছেন এবং দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের ব্যাপারে গায়েবী বিষয়ে যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেসব ব্যাপারে তাঁকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করা।

৬. তাঁর সুন্নাতকে জীবিত করা এবং তাঁর শরী‘য়তকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা; আর তাঁর দা‘ওয়াতকে পৌঁছিয়ে দেওয়া এবং তাঁর অসীয়ত তথা নির্দেশসমূহ বাস্তবায়ন করা ।

৭. আল্লাহ তা‘আলা যাকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর ও মাসজিদে নববী যিয়ারত করার মত সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছেন, তাঁর কবরের নিকট এবং মাসজিদে নববীতে তার কণ্ঠস্বরকে নিম্নগামী করা।

৮. তাঁর ভালোবাসার কারণে সৎব্যক্তিগণকে ভালোবাসা ও বন্ধরূপে গ্রহণ করা; আর তাঁর ঘৃণার কারণে ফাসীকদেরকে ঘৃণা করা এবং তাদের সাথে শত্রুতা করা।

এগুলো হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আদব তথা শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহারের কিছু বাহ্যিক চিত্র। সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি সেসব আদব পরিপূর্ণভাবে পালন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সব সময় সচেষ্ট থাকবে; কেননা, এর উপর তার জীবনের পরিপূর্ণতা ও সফলতা নির্ভর করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট আমাদের নিবেদন, তিনি যেন আমাদেরকে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আদব রক্ষা করে চলার তাওফীক দান করেন এবং আমাদেরকে তাঁর অনুসারী, সাহায্যকারী (আনসার) ও তাঁর অনুকরণকারীদের মাঝে আন্তর্ভুক্ত করে নেন; আর তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার সুযোগ করে দেন এবং আমাদেরকে তাঁর শাফা‘আত (সুপারিশ করা) থেকে বঞ্চিত না করেন। ‘আল্লাহুম্মা আমীন’ (হে আল্লাহ! আপনি আমাদের আবেদন কবুল করুন)।[1]

>
[1] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১১৪ - ১১৫
স্বীয় নাফসের সাথে মুসলিম বান্দার আদবসমূহ

মুসলিম ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, তার দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনের সফলতা নির্ভর করে তার ‘নাফস’ তথা স্বীয় মনকে সংশোধন, পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার পরিধির উপর; যেমনিভাবে তার জীবনের ব্যর্থতা নিশ্চিত হয় তার মনের ভ্রষ্টতা, নিষ্ক্রিয়তা, কলুষতা, অবিত্রতা ও অশুদ্ধতার কারণে; আর এর পিছনে দলীল বা যুক্তিগুলো নিম্নরূপ:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩ وَقَدۡ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا

“সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে নিজেকে পবিত্র করেছে। আর সে-ই ব্যর্থ হয়েছে, যে নিজেকে কলুষিত করেছে।”[1] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا وَٱسۡتَكۡبَرُواْ عَنۡهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمۡ أَبۡوَٰبُ ٱلسَّمَآءِ وَلَا يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ ٱلۡجَمَلُ فِي سَمِّ ٱلۡخِيَاطِۚ وَكَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلۡمُجۡرِمِينَ ٤٠ لَهُم مِّن جَهَنَّمَ مِهَادٞ وَمِن فَوۡقِهِمۡ غَوَاشٖۚ وَكَذَٰلِكَ نَجۡزِي ٱلظَّٰلِمِينَ ٤١ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ لَا نُكَلِّفُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَآ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٤٢ ﴾ [الاعراف: ٤٠، ٤٢]

“নিশ্চয় যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা সম্বন্ধে অহংকার করে, তাদের জন্য আকাশের দরজা খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না- যতক্ষণ না সূঁচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। আর এভাবেই আমরা অপরাধীদেরকে প্রতিফল দেব। তাদের শয্যা হবে জাহান্নামের এবং তাদের উপরের আচ্ছাদনও; আর এভাবেই আমরা যালিমদেরকে প্রতিফল দেব। আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে- আমরা কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত ভার চাপিয়ে দেই না- তারাই জান্নাতবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।”[2] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَٱلۡعَصۡرِ ١ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَفِي خُسۡرٍ ٢ إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡحَقِّ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ ٣ ﴾ [العصر: ١، ٣]

“সময়ের শপথ, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মাঝে নিপতিত; কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, আর পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে হকের এবং উপদেশ দিয়েছে ধৈর্যের।”[3] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« كُلُّ أُمَّتِي يَدخُلُونَ الجَنَّةَ إلاَّ مَنْ أبَى . قَالُوا : وَمَنْ يَأبَى يَا رَسُول الله ؟ قَالَ : مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الجَنَّةَ ، وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أبَى » . (رواه البخاري).

“আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করে, সে ব্যতীত; তারা প্রশ্ন করল: হে আল্লাহ রাসূল! কে অস্বীকার করবে? জবাবে তিনি বললেন: যে আমার অনুসরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; আর যে আমার অবাধ্য হবে, সেই মূলত অস্বীকারকারী।”[4] তিনি আরও বলেন:

« كُلُّ النَّاسِ يَغْدُو فَبَائِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا » . (رواه مسلم).

“প্রত্যেক মানুষ সকালে উঠে নিজেকে বিক্রি করে দেয়; তারপর সে নিজেকে মুক্ত করে অথবা ধ্বংস করে।”[5]

অনুরূপভাবে মুসলিম ব্যক্তি এটাও বিশ্বাস করে যে, যার উপর ভিত্তি করে আত্মা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হবে, তা হলো ঈমানের সৌন্দর্য ও সৎকাজ; আর যার কারণে আত্মা কলুষিত, অপবিত্র ও ধ্বংস হবে, তা হলো কুফরী ও অবাধ্যতার মত খারাপ কাজ; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ طَرَفَيِ ٱلنَّهَارِ وَزُلَفٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِۚ إِنَّ ٱلۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِۚ

“আর আপনি সালাত কায়েম করুন দিনের দুই প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথমাংশে। নিশ্চয় সৎকাজ অসৎকাজকে মিটিয়ে দেয়।”[6] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

بَلۡۜ رَانَ عَلَىٰ قُلُوبِهِم مَّا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ

“বরং তারা যা অর্জন করেছে, তা-ই তাদের হৃদয়ে জঙ্ ধরিয়েছে।”[7] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا أَذْنَبَ ذنباً كَانَ نُكْتَةً سَوْدَاءَ فِي قَلْبِهِ ، فَإِنْ تَابَ وَنَزَعَ وَاسْتَعْتَبَ ، صُقِلَ قَلْبُهُ ، وَإِنْ زَادَ زَادَتْ حَتَّى تَغْلقَ قَلْبَهُ » . (رواه النسائي و الترمذي و أحمد).

“নিশ্চয় মুমিন বান্দা যখন একটি গুনাহ করে, তখন তার অন্তরের মধ্যে তা একটি কালো দাগ সৃষ্টি করে; তারপর যদি সে তাওবা করে, গুনাহ থেকে দূরে থাকে এবং অনুতপ্ত হয়, তাহলে তার অন্তরকে চকচকে পরিষ্কার করে দেয়া হয়; আর যদি গুনাহর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে (অন্তরের মধ্যে) কালো দাগের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত তা তার অন্তরকে ঢেকে ফেলবে।”[8] আর এটাই হলো অন্তরে মরিচা বা জঙ্ ধরা, যা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

كَلَّاۖ بَلۡۜ رَانَ عَلَىٰ قُلُوبِهِم مَّا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ

“কখনো নয়; বরং তারা যা অর্জন করেছে তা-ই তাদের হৃদয়ে জঙ্ ধরিয়েছে।”[9] তিনি আরও বলেন:

« اتَّقِ اللَّهَ حَيْثُ مَا كُنْتَ ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا ، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ » . (رواه أحمد و الترمذي و الحاكم).

“তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহকে ভয় কর; আর অসৎকাজ করলে তার পরপরই সৎকাজ কর, তাহলে তা মন্দ কাজকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; আর মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার কর।”[10]এ জন্য মুসলিম ব্যক্তি সার্বক্ষণিক কাজ করবে তার ‘নাফস’ তথা আত্মার সংশোধন, পরিশুদ্ধকরণ ও পবিত্রকরণে জন্য; কারণ, ঐ ব্যক্তির আত্মাই উত্তম, যে আদব রক্ষা করে চলে; সুতরাং সে তার নাফসের জন্য এমন কতগুলো আদব রক্ষা করবে, যা তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করবে এবং তার ময়লাসমূহকে দূর করে তাকে পবিত্র করবে; অনুরূপভাবে তাকে দূরে রাখবে খারাপ আকিদা-বিশ্বাস এবং মন্দ কথা ও কাজের মত এমন সব বিষয় থেকে, যা তাকে কলুষিত ও নষ্ট করে দেয়; আর সে তার উন্নতির জন্য রাতদিন চেষ্টা-সাধনা করবে এবং প্রতি মুহূর্তে আত্মসমালোচনা করবে; সে তাকে ভালোকাজে পরিচালিত করবে এবং তাকে (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের) আনুগত্য করতে বাধ্য করবে; ঠিক অনুরূপভাবে সে তাকে দূরে রাখবে যাতীয় খারাপ ও মন্দ থেকে; আর তাকে সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহের অনুসরণ করবে:

>
[1] সূরা আশ-শামছ, আয়াত: ৯ - ১০

[2] সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৪০ - ৪২

[3] সূরা আল-আসর, আয়াত: ১ - ৩

[4] বুখারী, হাদিস নং- ৬৮৫১

[5] মুসলিম, হাদিস নং- ৫৫৬

[6] সূরা হুদ, আয়াত: ১১৪

[7] সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন, আয়াত: ১৪

[8] নাসায়ী ও তিরমিযী এবং হাদিসটি ‘হাসান সহীহ; আর আহমাদ রহ. হাদিসটি প্রায় একই রকম অর্থে কিছু শাব্দিক হেরফেরসহ হাদিসটি তাঁর মুসনাদে বর্ণনা করেছেন, হাদিস নং- ৭৯৫২

[9] সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন, আয়াত: ১৪

[10] আহমাদ, তিরমিযী ও হাকেম।

তাওবার উদ্দেশ্য হলো সকল প্রকার অপরাধ ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা, পূর্বের কৃত প্রত্যেকটি গুনাহ’র জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যৎ জীবনে পুনরায় সেসব গুনাহ না করার ব্যাপারে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আর এটা এ জন্য যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ ﴾ [التحريم: ٨]

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর- বিশুদ্ধ তাওবা; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত।”[1] তিনি আরও বলেন:

وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ

“আর তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে আস, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”[2] আর আল্লাহ তা‘আলা শু‘আইব আ. এর বক্তব্য বর্ণনা করে বলেন:

وَٱسۡتَغۡفِرُواْ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِۚ إِنَّ رَبِّي رَحِيمٞ وَدُودٞ

“আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর ও তাঁর দিকে ফিরে আস; আমার রব তো পরম দয়ালু, অতি স্নেণহময় ।”[3] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّى أَتُوبُ فِى الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ » . (رواه مسلم ).

“হে মানবগোষ্ঠী! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর; কারণ, আমি তাঁর কাছে দিনে একশত বার তাওবা করি।”[4] তিনি আরও বলেন:

« مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا تَابَ اللَّهُ عَلَيْهِ » . (رواه مسلم).

“যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে তাওবা করবে, তার তাওবা আল্লাহ কবুল করবেন।”[5] তিনি আরও বলেন:

« إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ النَّهَارِ ، وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ اللَّيْلِ ، حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا » . (رواه مسلم ).

“আল্লাহ তা‘আলা পশ্চিম দিকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত (কিয়ামত পর্যন্ত) প্রত্যেক রাতে তাঁর ক্ষমার হাত প্রসারিত করবেন, যাতে দিনের গুনাহগার তাওবা করে। আবার তিনি দিনের বেলায় ক্ষমার হাত প্রসারিত করবেন, যাতে রাতের গুনাহগার তাওবা করে।”[6] তিনি আরও বলেন:

« لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ الْمُؤْمِنِ مِنْ رَجُلٍ فِى أَرْضٍ دَوِيَّةٍ مَهْلَكَةٍ مَعَهُ رَاحِلَتُهُ عَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ ، فَنَامَ فَاسْتَيْقَظَ وَقَدْ ذَهَبَتْ فَطَلَبَهَا حَتَّى أَدْرَكَهُ الْعَطَشُ ، ثُمَّ قَالَ أَرْجِعُ إِلَى مَكَانِى الَّذِى كُنْتُ فِيهِ ، فَأَنَامُ حَتَّى أَمُوتَ ، فَوَضَعَ رَأْسَهُ عَلَى سَاعِدِهِ لِيَمُوتَ فَاسْتَيْقَظَ وَعِنْدَهُ رَاحِلَتُهُ وَعَلَيْهَا زَادُهُ وَطَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَاللَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ الْعَبْدِ الْمُؤْمِنِ مِنْ هَذَا بِرَاحِلَتِهِ وَزَادِهِ » . (رواه مسلم ).

“আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দার তাওবায় ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশি আনন্দিত হন, যে ব্যক্তি খাদ্য ও পানীয় নিয়ে তার বাহন তথা উটসহ মরুভুমিতে অবস্থান করে, অতঃপর ঘুমিয়ে পড়ে, তারপর জেগে উঠে দেখে সেই উটটি চলে গেছে; অতঃপর সে তাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যায়; অতঃপর সে বলে: আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে ফিরে যাব, অতঃপর মৃত্যু পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকব। অতঃপর সে মরে যাওয়ার জন্য তার বাহুর উপর মাথা রাখল; অতঃপর সে জেগে উঠে দেখল, তার নিকটেই খাদ্য ও পানীয়সহ তার উটটি অবস্থান করছে। সুতরাং ঐ ব্যক্তি তার উট ও রসদপত্র ফিরে পেয়ে যেমন আনন্দিত হল, আল্লাহ তা‘আলা মুমিন বান্দার তাওবায় তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দিত হন।”[7] আরও বর্ণিত আছে যে, ফেরেশ্তাগণ আদম আ. কে তাঁর তাওবার কারণে অভিনন্দন জানিয়েছে, যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওবা কবুল করেছেন।[8] তিনি আরও বলেন:

« يَضْحَكُ اللهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى إِلَى رَجُلَيْنِ يقْتلُ أَحَدهُمَا الآخَرَ يَدْخُلانِ الجَنَّةَ ، يُقَاتِلُ هَذَا في سَبيلِ اللهِ فَيُقْتَلُ ، ثُمَّ يتُوبُ اللهُ عَلَى القَاتلِ فَيُسْلِم فَيُسْتَشْهَدُ » . (رواه البخاري).

“আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এমন দুই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে হাসবেন, যাদের একজন অপরজনকে হত্যা করবে এবং উভয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। একজন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে শহীদ হবে। তারপর আল্লাহ হত্যাকারীর তাওবা কবুল করবেন এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে (জিহাদে) শহীদ হয়ে যাবে।”[9] আরও বর্ণিত আছে যে, ফেরেশ্তাগণ আদম আ. কে তাঁর তাওবার কারণে অভিনন্দন জানিয়েছে, যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওবা কবুল করেছেন।[10]

>
[1] সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৮

[2] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩১

[3] সূরা হুদ, আয়াত: ৯০

[4] মুসলিম, হাদিস নং- ৭০৩৪

[5] মুসলিম, হাদিস নং- ৭০৩৬

[6] মুসলিম, হাদিস নং- ৭১৬৫

[7] মুসলিম, হাদিস নং- ৭১৩১

[8] আল-গাযালী, ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ্ দীন’ ।

[9] বুখারী, হাদিস নং- ২৬৭১

[10] আল-গাযালী, ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ্ দীন’ ।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 পরের পাতা »