প্রচলিত বিভিন্ন খতম তাৎপর্য ও পর্যালোচনা ইসলামহাউজ.কম ২৫ টি
প্রচলিত বিভিন্ন খতম তাৎপর্য ও পর্যালোচনা ইসলামহাউজ.কম ২৫ টি

সমস্ত প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামিনের, যিনি আমাদেরকে তাঁর শ্রেষ্ঠ মাখলুক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত বানিয়েছেন। দিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ চিরস্থায়ী কিতাব আল-কুরআন। এ দুইয়ের মাধ্যমে আমাদেরকে সর্বদা ও সর্বত্র কার্যকর বিধানের ধারক বাহক বানিয়েছেন। আমাদের উপর মহান আল্লাহর এসব নেয়ামত অপরিসীম। এক নবীর পর যখন আরেক নবী নতুন দীন নিয়ে আসেন, এক কিতাবের পর যখন আরেক কিতাব নতুন কিছু বিধান নিয়ে অবতীর্ন হয়, তখন স্বভাবত উম্মতের মধ্যেই দুই শ্রেণি হয়ে যেতে দেখে যায়। এক শ্রেণি নতুন নবীর উপর ঈমান আনেন, ফলে তারা মুমিনই থাকেন। আরেক শ্রেণি নতুন নবীকে মিথ্যুক আখ্যায়িত করে বেঈমান বা কাফের হয়ে যায়। আল্লাহর কৃপায় সর্বশেষ নবীর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্যে আমরা এমন পরীক্ষামুক্ত। না নতুন নবী আসবেন, না কোনো নতুন বিধান আসবে। নতুন কোনো দীন বা পদ্ধতির অনুসরণ করব কি করব না এই ঝামেলায় আমাদেরকে কখনো পড়তে হয় না। যে নবীর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন সেই নবীর উম্মত হতে পারা কতই বড় সোভাগ্যের কথা তা পূর্বের উম্মতের ইতিহাস নিয়ে একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসবে। তাই আল্লাহ আমাদেরকে এই বড় নেয়ামত প্রদানের জন্য আবারো তাঁর শুকরিয়া আদায় করছি।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দীন, তাঁর তরিক্বা, তাঁর আদর্শ প্রচারে সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে যুগে যুগে একশ্রেণি তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে ইবাদত সংক্রান্ত যেকোনো খুটিনাটি বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ আমাদের মাঝে বিদ্যমান। এখন আমাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র তাঁর রেখে যাওয়া দীনের অনুসরণ। দীন পালনে তাঁর পদ্ধতির অনুসরণ। সালাত, যাকাত, সওম, হজ্জ, তেলাওয়াত দো‘আ, দুরূদ, যিকর সর্বক্ষেত্রে তাঁর রেখে যাওয়া পদ্ধতির অনুসরণ অনূকরণই একজন মুমিনের কর্তব্য। এমন কোনো ইবাদত বা নেক আমল নেই যেখানে তাঁর আদর্শ নেই। ইবাদত সংক্রান্ত সব বিষয় বিবেক কর্তৃক নির্ধারণের উর্ধ্বের বিষয়, যা একমাত্র ওহীর মাধ্যমেই জানা যায়, জ্ঞানের শেষ সীমা থেকেই ওহীর সুচনা, সুতরাং তাঁর আদর্শ, পদ্ধতি, উদ্দেশ্য যেখানে নেই তা ইবাদত বা নেক আমল বলে গণ্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অনেক দিন থেকেই মনে প্রশ্ন ছিল যে, কুরআন তেলাওয়াত একটি নেক আমল, হাদীস চর্চা একটি নেক আমল। অনুরূপ দো‘আ, দুরূদ, যিকর সবই নেক আমল। তাই এগুলোর মাঝে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন করা, অথবা এগুলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্য বর্জিত অর্থাৎ তিনি এগুলোকে যে উদ্দেশ্যে করেন নি সে উদ্দেশ্যে করার সুযোগ থাকে কীভাবে? আমাদের সমাজের প্রচলিত ‘খতম’ কি এর ব্যতিক্রম? খতমের নামে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটানো, তিনি যে উদ্দেশ্যে এগুলো করেন নি তা করা কতটুকু সিদ্ধ? আল-হামদু লিল্লাহ, দেখা যায় অনেক প্রজ্ঞাবান আলেম যারা যুক্তির উর্ধ্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতকে স্থান দেন, পূর্ণাঙ্গ সুন্নাতের অনুসরণের সর্বদা চেষ্টা করেন, তারা সব সময়ই এসবের বিরোধিতা করে আসছেন। বাংলাদেশে এদের মাঝে অন্যতম বিশিষ্ট মুফতি, সবার কাছেই যার সুন্নাতের পাবন্দির কথা প্রসিদ্ধ, মুফতি ফয়জুল্লাহ রাহ.-আল্লাহ তাকে মাগফেরাত ও রাহমাত দিয়ে ঢেকে নিন- তিনি সর্বদা এসবের কঠোর বিরোধিতা করতেন। তাঁর রচিত কাব্যের কিতাব ‘পান্দে নামাহ খাকী’তে প্রচলিত খতম সম্পর্কে একটি পাঠ লিখেছেন, যাতে সর্বপ্রকার খতম বিদ‘আত ও সুন্নাহ বহির্ভূত আখ্যা দিয়ে এসব বিদ‘আত কুসংস্কার পরিহার করে সুন্নাতকে আকড়ে ধরার নসীহত করেছেন।[1] তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ‘হামিউস্-সুন্নাহ’ মেখল, চট্টগ্রামে অধ্যয়ন থেকেই মূলত সুন্নাত এবং সুন্নাতের ধারক আলেমদের প্রতি মহব্বত এবং বিদ‘আতের প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয়। আসাতিযায়ে কেরাম সব সময় তাঁর একটি মূল্যবান নসীহত শুনাতেন। নসীহতটি ছিল,

"نیست حجت قول و فعل ھیچ پیر * قول حق گو فعل احمد را بگیر "

‘‘কোন পীরের কথা ও কর্ম দলীল নয় * হক্ব বল, আহমদ এর কর্মকে ধর।’’

যদিও শয়তানের ধোঁকায় বা না জেনে অনেক সময় সুন্নাত বিরোধি বিদআতি কর্মে লিপ্ত হয়ে যাই। আল্লাহর কাছে তার জন্যে সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করি।

সুন্নাহ বহির্ভূত এসব খতম পদ্ধতির প্রতি অনীহা থাকা সত্বেও অনেক সময় ঈমানী দুর্বলতা বা পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিজেকে এসবের মধ্যে জড়িয়েছি। জড়িয়ে থাকার কারণে এসবের আরো অনেক না-জায়েয দিক সামনে আসলে দিন দিন এগুলোর প্রতি আরো বেশি অনীহা ও সাধারণ জনগণের অজ্ঞতার উপর আফসোস জন্ম নেয়। সহজভাবে সুন্নাহর পদ্ধতিতে নেক আমল পালন করা ছেড়ে দিয়ে অযথা এসবে লিপ্ত হয়ে নিজের সময়, টাকা পয়সা কেন ব্যয় করি? এতে আমার কী লাভ? আমার অজ্ঞতার কারণে এক গোত্রের দুনিয়াবী কিছু স্বার্থ অর্জন হচ্ছে, এই যা। এই কি আমার চাওয়া পাওয়া? একে কি আমি একবারও নবীর সুন্নাতের সাথে মিলিয়ে দেখেছি? আমাদের এসব কর্ম কতটুকু গ্রহণযোগ্য এই কথাটি উপলব্ধি করার জন্য এ বিষয়ে কিছু লিখার ইচ্ছা দীর্ঘ দিন থেকে লালন করে আসছিলাম। সর্বশেষ মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এই ক্ষুদ্র রচনাটি লিখতে সক্ষম হয়েছি। এতে যা কিছু ভাল সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যা মন্দ সব আমি অধমের। এতে কিছু মানুষের উপকার হলে এটাই আমার স্বার্থকতা। এ বিষয়ে সামান্য হলেও আলোচনা করতে পারায় আবারো আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

হাদীসে রয়েছে : ‘‘যে ব্যক্তি মানুষের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেনি সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেনি।’’[2] তাই সর্বপ্রথম আমার পিতার জন্য দো‘আ করি, আল্লাহ যেন তাকে মাগফিরাত ও রাহমাত দ্বারা বেষ্টন করে নেন। যার সর্বাত্মক চেষ্টার ফলেই হয়ত আল্লাহ তাঁর রহমতে দ্বীনি ইলমের সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ট রাখার তওফিক্ব দিয়েছেন। যিনি দীর্ঘ দিন সরকারী মাদ্রাসায় হাদীসের খেদমাত করলেও আমাকে শুধু এজন্য কওমি মাদ্রাসায় পড়িয়েছেন যাতে করে আমার মাঝে ইলমি দক্ষতা ও সুন্নাতের পাবন্দি এই দুটি জিনিস অর্জিত হয়। জানি না তাঁর এ আশা কতটুকু কার্যকর হয়েছে। আজ তিনি জীবিত থাকলে এই ক্ষুদ্র মেহনতটি দেখলে হয়ত অত্যন্ত খুশি হতেন। আল্লাহ যেন এই খেদমাতটুকু ক্ববুল করেন। ক্ববুল হলে হাদীসের ভাষায় তিনি অবশ্যই এর ছওয়াবের অংশ পাবেন।

এরপর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি আমার সকল উস্তাদদের যাদের যোগ্যতা ও পরিশ্রমের ফলেই আমার মাঝে যেটুকুই হোক ইলমের বীজ বপন হয়েছে। তাদের ইলমি অনুদানের সাথে সাথে বিভিন্ন জনের আরো বিভিন্ন ধরণের অনুদান রয়েছে, ছোট পরিসরে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। এক কথায় জীবিত সবার কৃতজ্ঞতা, দীর্ঘ বরকতময় হায়াত কামনা এবং মৃতদের জন্য রাহমাত ও মাগফিরাতের দো‘আ করছি।

একজনের নাম নিলেই আরেকজনের অবমূল্যায়ন নয়, এর আলোকে যার নাম উল্লেখ না করে পারছি না, তিনি হলেন আমার উস্তায মুহতারাম মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া। যার ইলমি সহ বিভিন্ন অনুদান আমার রক্তের প্রতিটি কণায় কণায়। তাঁর ঋন পরিশোধ করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। দ্বীনি ইলমের কিঞ্চিত যা কিছুই অর্জন করেছি তার সিংহভাগই মূলত তাঁর সাথে দীর্ঘ দিনের সুহবতের ফসল বলে মনে করি। হক্ব বোঝার পর কারো দোহাই দিয়ে এক ইঞ্চি না সরার চেষ্টা মূলত তাঁরই দীক্ষা। আরো কিছু লিখার ইচ্ছা থাকলেও এ কথাগুলো লিখতেই চক্ষু ছলছল করায় আর লিখতে পারছি না। আশাকরি তিনি আমার এই ক্ষুদ্র রচনা দেখে আনন্দিত হবেন এবং এটিকে আমার মাঝে তাঁর নিজের দীক্ষার প্রকাশ মনে করে আমার জন্য দো‘আ করবেন। দো‘আ করি আল্লাহ তাঁর হায়াতকে বরকতময় করে তুলুন। জাতিকে তাঁর থেকে উপকৃত হওয়ার ধারাবাহিকতা দীর্ঘ করে দিন।

রচনাটি লিখার ক্ষেত্রে আরো যারা উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে সাহস দিয়েছেন তাদের সবার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। বিশেষ করে মাওলানা আব্দুল্লাহ মানসুর ও আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছাত্র হাফেজ মাওলানা ইয়াহ্ইয়া রচনাটির প্রুফ দেখার কষ্ট বরণ করায় তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদের সাথে সাথে তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ তাদেরকে জাযায়ে খাইর দান করুন।

রচনাটি লিখতে হাদীসের ক্ষেত্রে একমাত্র সহীহ হাদীসের উপরেই নির্ভর করা হয়েছে। দু-একটি হাসান পর্যায়ের হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে যা মুহাদ্দিসীনে কেরামের নিকট গ্রহণযোগ্য। দ‘য়িফ বা দুর্বল কোনো হাদীসের উপর নির্ভর করা হয় নি।

নির্ভুল তথ্য প্রদানের লক্ষে, প্রতিটি হাদীস, অন্যান্য তথ্য, কারো উদ্ধৃতির উপর নির্ভর না করে মূল কিতাব দেখে সেখান থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। সাথে সাথে প্রতিটি হাদীসের অধ্যায়, অনুচ্ছেদ উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে মুদ্রনের কমবেশের কারণে হাদীস বা অন্যান্য তথ্য অনুসন্ধান করে বের করতে বেগ পেতে না হয়।

হাদীস সহ অন্যান্য তথ্যসূত্র টিকা আকারে বাংলায় উল্লেখের সাথে সাথে আলেমগণের সুবিধার্থে মূল মতনের পাশাপাশি আরবীতে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিটি তথ্যসূত্র উল্লেখের পাশাপাশি সাধ্যানূযায়ী বর্ণিত কিতাবের লিখকের নাম, তাঁর জন্ম-মৃত্যু বা শুধু মৃত্যু সন মূল বইয়ে অথবা টিকায় উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে তাঁর যুগ দেখে আসলাফিয়্যাত তথা সিনিয়ারিটির মূল্যায়ণ করা হয়।

হাদীসের বর্ণনায় বিষয়বস্তু এক থাকা সত্বেও অনেক সময় শব্দের সামান্য ব্যতিক্রম থাকে। তাই অনেক হাদীস একাধিক কিতাবে থাকা সত্বেও একাধিক কিতাবের উদ্ধৃতি দেওয়া হয় নি। বরং যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হাদীসের যে কিতাবে হুবহু রয়েছে শুধুমাত্র সেই কিতাবের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।

নিজের ইলমি ও ভাষাগত দুর্বলতা থাকা সত্বেও এ বিষয়ে রচনার কাজে হাত দেওয়ার সাহস যোগার কারণ পাঠকগণ আশাকরি বুঝতে পেরেছেন। ভুল হতে পারে এই আশায় কোনো কিছু না লিখলে আজ পৃথিবীতে কোনো রচনাই থাকত না। ভুলের উর্ধ্বে থাকার মু‘জিযা একমাত্র আল্লাহর কালামের। ‘মানুষ মাত্রই ভুল’ এই প্রবাদ যিনি বিশ্বাস করেন, তিনি ভুলের সমালোচনা করেন না। নবীগণ ছাড়া কেউই যেখানে ভুলের উর্ধ্বে নয়, সেখানে আমার মত দুর্বলের কথা কী হতে পারে। তাই ভুল থাকবেই। আপনার কাজ হচ্ছে ‘‘দীন উপদেশের নাম’’ হিসেবে বাস্তব ভুলের সংশোধনের পথ খোঁজা। যথাসাধ্য বিশুদ্ধ কথা লিখার চেষ্টা করেছি, তবুও ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। তাই যে কোনো ইলমি, ভাষাগত, তথ্যগত ভুল কারো দৃষ্টিগোচর হলে আমাকে অবগত করা আপনার ইলমি আমানত মনে করবেন। আপনার সঠিক পরামর্শ শ্রদ্ধার সাথে সাদরে গ্রহণ করে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধনের চেষ্টা করা হবে। ইনশা-আল্লাহ।


বিনীত: মোস্তফা সোহেল হিলালী

>
[1] মুফতি ফয়জুল্লাহ, পান্দে নামাহ খাকী, মুফতি ইযহারুল ইসলামের ব্যাখ্যাসহ, খতমে শবীনাহ, খতমে বুখারী, খতমে দু‘আ ইউনুস এবং অন্যান্য ফাসেদ কুসংস্কার যেমন...আলোচনা, পৃষ্টা: ৩১।

[2] তিরমিযী, সুনান, যে তোমার প্রতি দয়া করেছে তার শুকরিয়া অনুচ্ছেদ, নং:১৯৫৫। হাদিসটি সহীহ লিগাইরিহি।

 সুন্নাতের পরিচয় ও গুরুত্ব অনেক জরুরী ও দীর্ঘ বিষয়। শরয়ী বিধানের দ্বিতীয় উৎস এই সুন্নাত, তাই তা অনেক দীর্ঘ হওয়ার কথা। উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ের উপর অনেক কিতাব রচনা করেছেন।[1] আমাদের মূল আলোচনা সুন্নাত বা বিদ‘আত নিয়ে নয়। তাই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার কথা নয়। তথাপি প্রচলিত বিভিন্ন খতম যা আমাদের মূল আলোচনার বিষয় তা বুঝতে সুন্নাত ও বিদ‘আত বোঝার বিকল্প নেই। তাই অত্যন্ত সংক্ষেপে দুটি বিষয়েই একেবারেই সামান্য আলোচনার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। যাতে করে খতমের তাৎপর্য বুঝা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। বাস্তব কথা হলো, যিনি প্রকৃতপক্ষ সুন্নাত ও বিদ‘আত চিনে নিয়েছেন তার কাছে প্রচলিত খতমের তাৎপর্য আলোচনা করে বোঝাবার প্রয়োজন নেই। যাই হোক, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে সুন্নাত ও বিদ‘আত দুটি বিষয়কে একটু বোঝার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর তওফিক কাম্য।

সুন্নাতের পরিচয়

সুন্নাত শব্দের শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ: ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবন পদ্ধতি, কর্মধারা, রীতি, আদর্শ ইত্যাদি।[2] শরয়ী পারিভাষিক অর্থ উল্লেখ করতে ইবনু মানযুর[3] লিখেন:

"وإذا أطلقت في الشرع فإنما يراد بها ما أمر به النبي صلى الله عليه وسلم ونهى عنه وندب إليه قولا وفعلا مما لم ينطق به الكتاب العزيز ولهذا يقال في أدلة الشرع الكتاب والسنة أي القرآن والحديث".

‘‘তবে যখন শরীয়তে সুন্নাত শব্দটি প্রয়োগ করা হয় তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব বিষয়ের আদেশ করেছেন, যে সব থেকে নিষেধ করেছেন, কথা ও কর্মের মাধ্যমে যে দিকে আহ্বান করেছেন, যা সম্মানিত কিতাব কুরআনে বলা হয় নি। এ জন্যই বলা হয়, শরীয়তের দলীল কিতাব ও সুন্নাত। অর্থাৎ হাদীস এবং কুরআন’’[4]

উসূলে ফিকহের কিতাবাদিতে সুন্নাতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে:

" السنة في اصطلاح الأصوليين هي "ما صدر عن النبي - صلى الله عليه وسلم - غير القرآن" وهذا يشمل: قوله:- صلى الله عليه وسلم-، وفعله، وتقريره، وكتابته، وإشارته، وهمه، وتركه ". )معالم اصول الفقة عند اهل السنة والجماعة 1-118)

‘‘উসূলীদের পরিভাষায় সুন্নাত হচ্ছে, ‘‘কুরআন ছাড়া যা কিছুই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশ পেয়েছে’’ এই সংজ্ঞায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কর্ম, স্বীকৃতি, লিখা, ইঙ্গিত, প্রতিজ্ঞা ও বর্জন সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।’’[5]

আল্লামা শাওকানী[6] রাহ. সুন্নাতের সংজ্ঞাটি যেভাবে বর্ণনা করেন:

" وأما معناها شرعًا: أي: في اصطلاح أهل الشرع فهي: قول النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وفعله وتقريره، وتطلق بالمعنى العام على الواجب وغيره في عرف أهل اللغة والحديث، وأما في عرف أهل الفقه فإنما يطلقونها على ما ليس بواجب، وتطلق على ما يقابل البدعة كقولهم: فلان من أهل السنة ". (ارشاد الفحول الى تحقيق الحق من علم الاصول ، الفصل الاول، في معنى السنة لغة وشرعا 1-95)

‘‘শরয়ী পরিভাষায় সুন্নাতের অর্থ, অর্থাৎ শরীয়তবিদদের পরিভাষায় সুন্নাত হচ্ছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ ও সমর্থন। ভাষাবিদ ও হাদীস বিশারদদের নিকট ব্যাপক অর্থে তা ওয়াজিব এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রয়োগ করা হয়। তবে ফিক্ব্হবিদদের পরিভাষায় তারা ওয়াজিব নয় এমন বিষয়ের উপর সুন্নাতের প্রয়োগ করে থাকেন। এর বিপরীতে বিদ‘আত শব্দটি ব্যবহার হয়, যেমন বলা হয়: অমুক আহলুস্-সুন্নাহ।’’[7]

উপরের সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, ফিক্বহের পরিভাষায় সুন্নাতের একটি অর্থ, ফরয এবং ওয়াজিব ব্যতীত অন্যান্য আমল।

তবে সুন্নাতের মৌলিক অর্থ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্বিক জীবন আদর্শ। ফরয, ওয়াজিব ও নফল সবকিছুর উপর সুন্নাতের ব্যবহার হাদীসে প্রসিদ্ধ। মোটকথা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন আদর্শই দীন। জীবনাদর্শের বিভিন্ন দিকের গুরুত্বের তারতম্য থেকে বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা থেকে ফরয, ওয়াজিব, নফল ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। ইবাদতের মধ্যে সুন্নাতের ব্যতিক্রম মানেই দীনের মধ্যে তাহরিফ বা পরিবর্তন। দীনকে আল্লাহ তা‘আলা পরিপূর্ণ করার ঘোষণা[8] এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শই সর্বোচ্চ আদর্শ বলে ঘোষণা[9] দিয়ে দিয়েছেন। তাই কোনো ধরণের কম-বেশি, যোগ-বিয়োগ করার সুযোগ নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যে ইবাদত যেভাবে করেছেন তা তখন সেভাবে করতে হবে। এর ব্যতিক্রম করলে তা খেলাফে সুন্নাত বলে অগ্রাহ্য হবে।

[1] বাংলাভাষীদের জন্য এ বিষয়ের উপর প্রখ্যাত আলেমে দীন ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গির রচিত ‘এহ্ইয়াউস সুনান’ বইটি আমার ধারণা মতে অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয়। সাধারণের চেয়ে আলেমদের জন্য বইটি অত্যন্ত বেশি উপকারী বলে পড়ে বুঝতে পেরেছি। বইটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য উলামায়ে কেরামের কাছে অনুরোধ রইল। উনার প্রতিটি বই একেকটি তাজদীদি খেদমাত বলে অধমের কাছে মনে হয়েছে। আল্লাহ উনার হায়াতকে বরকতময় করে দীনের আরো বেশি খেদমাত করার সুযোগ দিন।

[2] ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব, মাদ্দাহ: سنن , ১৩/১২৪।

[3] আরবী ভাষার বিশাল শব্দ ভান্ডার সম্বলিত বিখ্যাত অভিধান ‘লিসানুল-আরব’ এর রচয়িতা আবুল ফযল জামালুদ্দীন ইবনু মানযুর আল-আনসারী, জন্ম: ৬৩০ ওফাত: ৭১১ হিজরী, মোতাবেক: ১২৩২-১৩১১ ঈসায়ী। মূল আফ্রিক্বী বংশীয়, তবে তার জন্ম ও মৃত্যু মিশরে। (আল-আ‘লাম: ৭/১০৮।

[4] লিসানুল আরব, প্রাগুক্ত।

[5] ড. মুহাম্মদ হুসাইন ইবন হাসান, মা‘আলিমুল উসূলিল ফিক্বহী ‘ইনদা আহলিস্-সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, দ্বিতীয় আলোচনা, সুন্নাতের সংজ্ঞা, পৃষ্টা:১১৮।

[6] মুহাম্মদ ইবন আলী ইবন মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ আশ্-শাওকানী। ১১৭৩-১২৫০ হিজরী, ১৭৬০-১৮৩৪ ঈসায়ী। ইয়ামান এর সান‘আর ফক্বীহ, মুজতাহিদ। উসূল, হাদীস, ফিক্ব্হ, তাফসীর সর্ব বিষয়ে তার পান্ডিত্য ও রচনা বিদ্যমান।

[7] আল্লামা শাওকানী, ইরশাদুল ফুহুল ইলা তাহ্ক্বীক্বিল হাক্বি মিন ইলমিল উসূল, প্রথম পরিচ্ছেদ, সুন্নাতের আভিধানিক এবং শরয়ী অর্থ, ১/৯৫।

[8] সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৩।

[9] সূরা আহযাব, আয়াত: ২১।

 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শকে পূর্ণাঙ্গরূপে মেনে নেওয়াই একজন মুমিনের কর্তব্য। তার জীবনাদর্শের বাইরে যাওয়ার চিন্তা করা মুমিন কল্পনা করতে পারেন না। সুন্নাতের বাইরে যাওয়াকে তিনি তার আখিরাতের ঝুঁকি মনে করেন। মুমিন জায়েয না-জায়েযের বাহাসে লিপ্ত না হয়ে হুবহু নবীর আদর্শের উপর থাকাকেই কর্তব্য মনে করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস তাকে এক সুঁতো পরিমাণ বাইরে যেতে দেয় না। কদাচিৎ এমন হয়ে গেলে তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:

«ما من نبى بعثه الله فى أمة قبلى إلا كان له من أمته حواريون وأصحاب يأخذون بسنته ويقتدون بأمره ثم إنها تخلف من بعدهم خلوف يقولون ما لا يفعلون ويفعلون ما لا يؤمرون فمن جاهدهم بيده فهو مؤمن ومن جاهدهم بلسانه فهو مؤمن ومن جاهدهم بقلبه فهو مؤمن وليس وراء ذلك من الإيمان حبة خردل ». )صحيح مسلم، كتاب الايمان، باب كون النهي عن المنكر من الايمان...، رقم:188)

‘‘আল্লাহ তা‘আলা আমার পূর্বে যখনই কোনো জাতির মাঝে নবী প্রেরণ করেছেন তখনই উম্মাতের মধ্যে তার এমন হাওয়ারী ও সাথী দিয়েছেন, যারা তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে চলতেন, তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। অনন্তর তাদের পরে এমনসব লোক তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে, যারা মুখে যা বলে বেড়াত কাজে তা পরিণত করত না, আর সেসব কর্ম সম্পাদন করত যেগুলোর জন্য তারা আদিষ্ট ছিল না। এদের বিরুদ্ধে যারা হাত দ্বারা জিহাদ করবে তারা মুমিন, যারা এদের বিরুদ্ধে মুখের কথা দ্বারা জিহাদ করবে তারাও মুমিন এবং যারা এদের বিরুদ্ধে অন্তরের ঘৃণা দ্বারা জিহাদ করবে তারাও মুমিন। এর বাইরে সরিষার দানা পরিমানও ঈমান নেই।’’[1]

সুন্নাতের উপর থাকার গুরুত্ব এবং এর বাইরে যাওয়ার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে এই একটি হাদীসই যথেষ্ট। কুরআনের একাধিক জায়গা এবং একাধিক হাদীসে এ বিষয়ের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় সুন্নাত নয়, তাই আর কোনো আয়াত বা হাদীস উল্লেখ করছি না।

সাহাবায়ে কেরাম, তাবিঈন, তাব‘য়ি তাবিঈন, অনুসৃত চার ইমাম সহ কল্যাণের সাক্ষ্যপ্রাপ্ত যুগের আলেমগণ উপরোক্ত হাদীসের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করেছেন। আল্লাহ তাঁর দীন তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ রক্ষা করার জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন নায়েব তৈরী করেছেন। যুক্তি বা বিবেক দ্বারা দীনের মধ্যে নতুন কিছুর সংযোজন, ইবাদতে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে সজাগ থেকে সর্বদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত সংরক্ষন করার চেষ্টা করেছেন এবং সক্ষম হয়েছেন। সুন্নাতের বাইরে যাওয়া মানেই ভ্রান্তির পথ উম্মুক্ত করা এ কথা বুঝতে তাদেরকে বেগ পেতে হয় নি। সর্বযুগেই আল্লাহ তা‘আলা এমন একদল লোকের মাধ্যমে তার নবীর সুন্নাতকে রক্ষা করবেন যারা নবীর হুবহু সুন্নাতের উপর থাকার চেষ্টা করবেন। সুন্নাতের বাইরে কিছু দেখলেই যথাসাধ্য তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এই দল বা তাদের সহযোগী হিসেবে কবুল করুন। শাহওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী[2] রাহ. সুন্নাতের উপর থাকার গুরুত্ব বুঝাতে উপরোক্ত হাদীস সহ আরো কিছু হাদীস উল্লেখের পূর্বে লিখেন,

" قد حذرنا النبي صلى الله عليه وسلم مداخل التحريف بأقسامها . وغلظ النهي عنها ، وأخذ العهود من أمته فيها ، فمن أعظم أسباب التهاون ترك الأخذ بالسنة ".

‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সর্বপ্রকার তাহরিফ তথা দীনের বিকৃতি প্রবেশ করানো থেকে সতর্ক করেছেন, তাহরিফ থেকে কঠোর নিষেধ করেছেন, উম্মত থেকে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন, এ ব্যাপারে শিথিলতার সবচেয়ে বড় কারণ হলো সুন্নাতের উপর আমল ছেড়ে দেওয়া...’’[3]

এরপর তিনি হুবহু সুন্নাতের অনুকরণ না করার সতর্কতা সম্বলিত বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করেন। আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে বিধায় তা উল্লেখ করছি না। পাঠকের কাছে তার এই আলোচনাটি দেখে নিতে অনুরোধ রইল। সারকথায় তিনি সুন্নাতের মধ্যে কম বেশ, সংযোজন, বিয়োজন, বাড়াবাড়ি সবকিছুকেই দীনের তাহরীফ বা বিকৃতি গণ্য করেছেন এবং তা বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছেন।

সারকথা হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামগ্রিক জীবন-পদ্ধতিই সুন্নাত। যা তিনি ফরয হিসেবে করেছেন তা ফরয হিসেবে পালন করা সুন্নাত। যা নফল হিসেবে করেছেন তা নফল হিসেবে পালন করা সুন্নাত। যা সর্বদা করেছেন তা সর্বদা করা, যা মাঝে মাঝে করেছেন তা মাঝে মাঝে করা সুন্নাত। যা সর্বদা বর্জন করেছেন তা সর্বদা বর্জন করা, যা মাঝে মাঝে বর্জন করেছেন তা মাঝে মাঝে বর্জন করা সুন্নাত। যেই কাজ যেই পদ্ধতিতে করেছেন তা সেই পদ্ধতিতে পালন করাই সুন্নাত। কোনো কিছুতে বেশ কম হলেই খেলাফে সুন্নাত বলে গণ্য হবে। করণীয় বর্জনীয় সকল ক্ষেত্রে তাঁরই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। আনাস ইবনু মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীস দেখুন:

"جاء ثلاث رهط إلى بيوت أزواج النبي صلى الله عليه و سلم يسألون عن عبادة النبي صلى الله عليه و سلم فلما أخبروا كأنهم تقالوها فقالوا أين نحن من النبي صلى الله عليه و سلم ؟ قد غفر الله له ما تقدم من ذنبه وما تأخر قال أحدهم أما أنا فإني أصلي الليل أبدا وقال آخر أنا أصوم الدهر ولا أفطر وقال آخر أنا أعتزل النساء فلا أتزوج أبدا فجاء رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال (أنتم الذين قلتم كذا وكذا ؟ أما والله أتي لأخشاكم لله وأتقاكم له لكني أصوم وأفطر وأصلي وأرقد وأتزوج النساء فمن رغب عن سنتي فليس مني ". (صحيح البخاري، كتاب النكاح، باب الترغيب في النكاح، رقم:4776)

‘‘তিন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের নিকট গিয়ে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। যখন তাদেরকে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জানানো হলো প্রশ্নকারী সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইবাদত কিছুটা কম ভাবলেন বলে মনে হলো। তারা বললেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কি আমাদের তুলনা হতে পারে? আল্লাহ তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। (তাঁর কোনো গোনাহ নেই, আর আমরা গোনাহ্গার উম্মত, আমাদের উচিৎ তাঁর চেয়ে বেশি ইবাদত করা) তখন তাদের একজন বললেন: আমি সর্বদা সারা রাত জেগে নামায পড়ব। অন্যজন বললেন: আমি সর্বদা রোজা রাখব, কখনই রোজা ভাঙ্গব না। অন্যজন বললেন: আমি আজীবন নারী সংসর্গ পরিত্যাগ করব, কখনো বিবাহ করব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কথা জানতে পেরে তাদের কাছে এসে বললেন: তোমরাই কি এমন এমন কথা বলেছ? তোমরা জেনে রাখ! আমি তোমাদের সকলের চেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি, আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ তাক্বওয়াবান। তা সত্বেও আমি মাঝে মাঝে নফল রোজা রাখি, আবার মাঝে মাঝে নফল রোজা রাখা পরিত্যাগ করি। রাতে কিছু সময় নফল সালাত আদায় করি আবার কিছু সময় ঘুমাই। আমি বিবাহ করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত অপছন্দ করল তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’’[4]

পাঠক, একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। এখানে তিনজন সাহাবীর কেউই নাজায়েয কোনো কাজের ইচ্ছা পোষণ করেন নি। প্রত্যেকেই ভালো কাজের নিয়ত করেছেন। নফল নামায কতই না উত্তম ইবাদত, নফল সালাতের মাধ্যমে সময় কাটানো মুমিনের উত্তম ব্যবস্থা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন বলে উল্লেখ রয়েছে।[5] নফল সিয়াম পালন করা কতই না উত্তম কাজ। বেশি বেশি ইবাদতের জন্য বিবাহ শাদিতে নিজেকে জড়িত না করা কতই না উত্তম নিয়ত বা কল্পনা। তথাপি এই কর্মগুলোকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাত অপছন্দ বলে আখ্যায়িত করলেন তার কারণ কি? সাধারণ অপছন্দ নয়, এমন অপছন্দ যার কারণে তাঁর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় না। বাহ্যত তাদের এমন নিয়তের উপর নবীজীর বাহবা দেওয়ার কথা ছিল। মাশাআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, এমন অনেক বাহবামুলক শব্দ প্রয়োগ করে, আমি যা পারি না তোমরা তা করছ বলে তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরার কথা। আমাদের যুক্তি বা সমাজের বাস্তব চিত্র এমনটিরই দাবী রাখে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্টো তাদের উপর রাগ করলেন কেন? বাহ্যত বিষয়টি একটু উল্টো মনে হলেও একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের জন্য এর রহস্য বুঝতে কোনো সমস্যা হবে না। কেননা ইবাদত মূলত কম বা বেশি করার নাম নয়। বরং আল্লাহর হুকুম তাঁর রাসূলের পদ্ধতির পূর্ণ অনুসরণ করে পালনের নাম। এখানে যদিও মূল ইবাদতের মধ্যে পূর্ণ অনুসরণের বৈপরিত্য নেই, তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শের সাথে বৈপরিত্য আবশ্যই। কেননা, রাত কাটাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত হচ্ছে, কিছু সময় সালাত আদায় করা, কিছু সময় ঘুমানো। যিনি সারা রাত সালাতে কাটাচ্ছেন তাঁর আমল বেশি হলেও রাত কাটানোটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত মোতাবেক নয়। ঠিক এমনিভাবে সিয়াম ও বিবাহের বিষয়টিও। এমন আমলকারীর মনে ধীরে ধীরে সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞা জন্ম নেয়। সুন্নাত মোতাবেক চলা তার কাছে কম মনে হয়। যেমনটি সাহাবিদের মত ব্যক্তিত্বের মনে জড় বাঁধতে শুরু করেছিল বলে বর্ণিত হাদীস থেকেই আমরা বুঝতে পারছি। এটি একটি বাস্তব বিষয় যা আমরা আমাদের সমাজ বা আমাদের নিজ থেকেই যাচাই করতে পারি। যেমন ধরুন, এক ব্যক্তি রাতে এশার সালাত জামাতে আদায় করে ঘুমিয়ে পড়েন, রাতের শেষভাগের দিকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়েন এবং ফজরের সালাত জামাতে আদায় করেন। আরেক ব্যক্তি এশা এবং ফজর জামাতে আদায়ের সাথে সাথে সারা রাত জেগে সালাত আদায় করেন, স্বাভাবিকত দ্বিতীয় ব্যক্তির মনে একথা জড় পাকাবে যে, আমি প্রথম ব্যক্তির চেয়ে বেশি ইবাদত করছি, তার থেকে আমার কাজ উত্তম, কেননা সে কিছু সময় ঘুমিয়ে নামাযের মত শ্রেষ্ট ইবাদত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আল্লাহর শোকর আমি বঞ্চিত হচ্ছি না। তার মনে একথার জড় না পাকালে তিনি প্রথম ব্যক্তির মত কিছু সময় ঘুমানোর কথা। যদি আমরা ধরেই নেই যে, তিনি এমন মানুষ যার মাঝে এমন কল্পনা আসতে পারে না, তবে অন্য মানুষের মনে একথার বীজ অবশ্যই বপন হবে। সমাজের সাধারণ থেকে নিয়ে বড় বড় ব্যক্তিত্বের কথাবার্তা থেকে এমন বিশ্বাস পাওয়া যায়। যেমন কেউ সারা রাত জেগে ইবাদত করলে তাকে ঐ ব্যক্তির চেয়ে বেশি তুলে ধরা হয় বা বেশি পরহেযগার মনে করা হয়, যিনি রাতে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করেছেন আবার ঘুমিয়েছেন। যেমন বলা হয়, অমুক এত বছর ঘুমাননি, অমুক এত বছর এক অযু দিয়ে এশা এবং ফজর আদায় করেছেন[6]। এবার আপনি প্রথম ব্যক্তি ও দ্বিতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের সাথে তুলনা করুন। প্রথম জনের রাতের ইবাদত কম, তবে রাত কেটেছে সুন্নাত মোতাবেক। দ্বিতীয় জনের রাতের ইবাদত বেশি, তবে তাঁর রাত হুবহু সুন্নাত মোতাবেক কাটেনি। এই দুই ব্যক্তির মাঝে দ্বিতীয় ব্যক্তির রাত কাটানোকে উত্তম মনে করা সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞার নামান্তর। কেননা যার রাত কাটানো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলল তাকে অনুত্তম, আর যার রাত কাটানো তাঁর সাথে মিলেনি তাকে উত্তম মনে করা সুন্নাতকে অনুত্তম মনে করা ছাড়া কিছু নয়। এভাবে লোকটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতি থেকে সরে যাওয়া এবং অন্য পদ্ধতিকে উত্তম জ্ঞান করা তাঁর মনে স্থান নিবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে তাঁর ইবাদত বেশি এ কথা দিলে বদ্ধমুল হবে। আর এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত সাহাবিদের উপর তাদের নিয়ত মহৎ থাকা সত্বেও রাগ করেছেন।

মোটকথা: সর্বক্ষেত্রে আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করতে হবে। তবেই আমরা আমাদেরকে মুত্তাবি‘য়ি সুন্নাত বা সুন্নাত অনুসারী বলে দাবী করতে পারব। নামাযে তার কি শিক্ষা, তিনি কীভাবে তা আদায় করতেন, কোনো নামাযকে কতটুকু গুরুত্ব দিতেন। রোজার ক্ষেত্রে তার কি শিক্ষা, তিনি কোনো রোজা কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে আদায় করতেন। এভাবে প্রতিটি ইবাদতের ক্ষেত্রে তার কি শিক্ষা, কি পদ্ধতি সবকিছুই আমাদেরকে তাকে ফলো করতে হবে।

কুরআন তেলাওয়াতে তাঁর কি শিক্ষা, তিনি কীভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতেন, কী উদ্দেশ্যে তেলাওয়াত করতেন, তাঁর আদর্শ থেকে গ্রহণ করতে হবে। হাদীসের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সাহাবিদের কি শিক্ষা দিলেন, সাহাবিরা হাদীসের সাথে কি আচরণ করলেন, তাঁর হাদীসের মাধ্যমে আমাদের কী করা উচিত, সর্বক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ বিদ্যমান। এভাবে কালেমার ক্ষেত্রে তিনি কী শিক্ষা দিলেন, যিকরের বেলায় তার শিক্ষা কী, তিনি যিকরে কী কী শব্দ ব্যবহার করেছেন, তিনি কোন যিকর কোন পদ্ধতিতে করতেন তা জেনে সেই পদ্ধতিতেই আমল করতে হবে। অনুরূপ তাসমিয়া, দো‘আ, এক কথায় কোনো আমলের ক্ষেত্রেই তার শিক্ষা ও আদর্শের বাইরে যাওয়া যাবে না। তার আদর্শের ব্যতিক্রম করতে কোনো যুক্তি যোগ করা যাবে না। তবেই আমরা আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী বলে নিজেকে দাবী করতে পারব। আল্লাহ আমাদেরকে তার রাসূলের সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ করার তওফিক দিন। আমীন।

[1] সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা ঈমানের অঙ্গ....,নং: ১৮৮।

[2] হিন্দের প্রখ্যাত মুহাদ্দীস, আহমদ ইবন আব্দুর রহীম আশ-শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী। যার তাজদীদি বা সংস্কারমুলক কর্ম আরব ‘আজম সর্বজন স্বীকৃত। তার লিখিত বিভিন্ন কিতাব এর জলন্ত প্রমান। জন্ম: ১১১৪ হিজরী, ওফাত: ১১৭৬ হিজরী। আফসোসের বিষয়, উপমহাদেশের এ মহান ব্যক্তিত্বের নাম আমাদের মুখে থাকলেও তার চিন্তাধারার বাস্তব কোনো মূল্যায়ন আমাদের মাঝে নেই। তাঁর চিন্তাধারা ও তাঁর রচনা সমগ্রের বাস্তব মূল্যায়ন আরব আলেমগণ করে থাকেন। তাঁর রচনা তাদের পাঠ্য সিলেবাস এর প্রমাণ।

[3] মুহাদ্দিসে দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, কিতাব ও সুন্নাত আকড়ে ধরা অধ্যায়, ১/৩৫৭।

[4] সহীহুল বুখারী, নিকাহ অধ্যায়, নিকাহের প্রতি উৎসাহ অনুচ্ছেদ, নং: ৪৭৭৬।

[5] সুয়ূতী, আল-জামি‘উল কবীর, হামযা হরফে হাদীস, নং: ৭৯৩৫, আলবানী, সহীহ ওয়া দ‘য়ীফুল জামি‘য়িস সাগীর, নং: ৭৩১৭, সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব, তারগীব ফিস সালাত অনুচ্ছেদ, নং:৩৯০, হাদীসটি হাসান। হাদীসের ইবারতটি হচ্ছে: ‘‘الصلاة خير موضوع فمن استطاع أن يستكثر فليستكثر ’’

[6] কারো মনে আসতে পারে, আবু হানিফা রাহ. যেহেতু ৪০ বছর এক ওযু দিয়ে এশা ফজর আদায় করেছেন বলে শুনা যায়, অতএব তার চল্লিশ বছর খেলাফে সুন্নাত ভাবে রাত কেটেছে, অথচ এমন রাত কাটানো শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ করেছেন। অধমের খেয়াল মতে এ সব হচ্ছে প্রশংসা না বুঝে প্রশংসায় সীমালঙ্গন। এসব কথার যেহেতু সহীহ কোনো ভিত্তি নেই, সুতরাং আবু হানিফার মত মহান পন্ডিত, মুজতাহিদ, যিনি হবহু সুন্নাতের অনুসরণ থেকে এক চুল পরিমান সরতে চান না, বিদ‘আত সন্দেহ হলে যিনি সুন্নাত ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন,অনেক মাসআলা মাসাঈল যার প্রমাণ বহন করে, এমন ব্যক্তির দিকে এ সব কথা সম্পৃক্ত করার কোনো যুক্তি বা প্রয়োজন নেই।

 বিদ‘আত শব্দের শাব্দিক অর্থ নব উদ্ভাবন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ইবনু মানযুর লিখেন : ‘‘বিদ‘আত অর্থ : নতুন সৃষ্ট এবং দীনের পূর্ণতার পর যা উদ্ভাবন করা হয়েছে’’।[1]দ্বিতীয় অর্থটি মূলত পরিভাষিক। ইবনু ফারিস[2] বিদ‘আতের অর্থ লিখেন : পূর্ব নমুনা ব্যতিরেকে কোনো কিছু সৃষ্টি করা, শুরু করা বা প্রচলন করা।[3]

লিসানুল আরব অভিধান থেকে আমরা শাব্দিক অর্থের সাথে সাথে বিদআতের পরিভাষিক অর্থ জানতে পেরেছি। আরেকটু স্পষ্ট হওয়ার জন্য ফিক্বহী পরিভাষায় বিদ‘আতের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা উল্লেখ করা হল :

"البدعة طريقة في الدين مخترعة تضاهي الشرعية يقصد بالسلوك عليها ما يقصد بالطريقة الشرعية".(الاعتصام، الباب الأول في تعريف البدع وبيان معناها...،1-26)

‘‘বিদ‘আত হচ্ছে, দীনের মধ্যে আবিষ্কৃত পদ্ধতি, যা শরয়ী পদ্ধতির সামঞ্জস্য, এই পদ্ধতির উপর চলার সেই উদ্দেশ্য যা শরয়ী পদ্ধতির উপর চলার উদ্দেশ্য।’’[4]

কেউ কেউ বলেন :

‘‘দীনের মধ্যে আবিষ্কৃত পদ্ধতি, যা শরয়ী পদ্ধতির সামঞ্জস্য, এই পদ্ধতির উপর চলার উদ্দেশ্য হলো : আল্লাহ সুব্হানাহুর ইবাদতের মধ্যে বৃদ্ধি করা।’’[5]

শরয়ী পদ্ধতি বলতে ইবাদতের সুন্নাত পদ্ধতি বুঝানো হয়েছে। কেননা সুন্নাত পদ্ধতি বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত জাতীয় যে বিষয়ে তিনি যে পদ্ধতি উম্মতকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন তাই শরয়ী পদ্ধতি। এর বাইরে কোনো শরয়ী পদ্ধতি নেই। এই অর্থেই আহলুস্সুন্নাহ শব্দের বিপরীতে আহলুল বিদ‘আহ শব্দটি উলামায়ে কেরাম প্রয়োগ করে থাকেন বলে আমরা ইতোপূর্বে দেখে এসেছি।

বিভিন্ন হাদীসে বিদ‘আত বা নব উদ্ভাবিত বিষয় বুঝাতে ‘মুহ্দাসাত’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে, যা একটু পরেই আমরা দেখতে পাব ইনশাআল্লাহ। বিদ‘আত বা মুহদাসাতের শরয়ী সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আত শুধুমাত্র ইবাদত কেন্দ্রিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে। যে কোনো নব অবিস্কৃত জিনিসের উপর শাব্দিক অর্থে বিদআতের প্রয়োগ করা গেলেও শরয়ী অর্থে তার উপর বিদ‘আত শব্দ প্রয়োগ হবে না এবং তা বিদ‘আত ও মুহদাসাত সংক্রান্ত হাদীসের আওতাধীন হবে না। যেমন ধরুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটে সওয়ার হয়ে সফর করেছেন, যানবাহনের আবিষ্কার আজ আপনাকে বিমান আরোহন করাচ্ছে, আপনি বিমান আরোহন করে সফর করছেন। বিমান নব আবিষ্কার। উটের পরিবর্তে আপনি বিমান আরোহন করছেন। এটাকে শরয়ী বিদ‘আত বলা যাবে না। কেননা উট বিমান কোনোটি ইবাদত নয়। এটি একটি বাহন মাত্র। তবে বাহনে সওয়ার হতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দো‘আ পড়তেন, তিনি সফরের যে দো‘আ পড়তেন তা ইবাদত। এই দো‘আর মধ্যে কোনো সংযোজন বা বিয়োজন করার সুযোগ নেই। এই দো‘আ তিনি যে পদ্ধতিতে পড়তেন আমাকেও সেই পদ্ধতিতেই পড়তে হবে। যুক্তির আলোকে এখানে কোনো পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। যেমন, উট একটি সাধারণ জন্তু, সে মাটিতে চলে, নবীজী উটে উঠতে এই দো‘আ পড়তেন। আমি আজ আকাশে চড়ছি, এই নেয়ামত অনেক বড়, সুতরাং দো‘আকে একটু বৃদ্ধি করতে হবে। অথবা নবীজী স্বাভাবিকভাবে দো‘আ পড়তেন, কেননা নেয়ামতটি স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আমার নেয়ামতটি অসাধারণ, তাই বিমানে উঠেই সেজদায় পড়ে এই দো‘আ করতে হবে, অথবা সেজদায় পড়ে দো‘আটি পড়লে ছওয়াব বেশি হবে, এজাতীয় চিন্তাধারা সবই ভ্রান্ত। কেননা দো‘আ একটি ইবাদত। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গেলেই তা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। মোটকথা : বিদ‘আতের সম্পর্ক ইবাদতের বিষয় ও তার পদ্ধতির সাথে। বস্তুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

জনৈক ব্যক্তি একবার এক বিদ‘আত বিরোধী আলেমকে গিয়ে বললেন : আপনারা সবকিছুই শুধু বিদ‘আত বিদ‘আত করেন, তবে আপনি চশমা পরেছেন কেন? আল্লাহর রাসূল কি জীবনে কখনো চশমা পরেছেন? চশমা তো নবীজীর সময়ে ছিল না, তাহলে এটা কি বিদ‘আত নয়? আলেম বললেন : ভাই, তাহলে তো আপনি নিজেই বিদ‘আত। আপনিও তো নবীজীর সময়ে ছিলেন না। বিদ‘আত না বোঝার কারণেই মাঝে মাঝে এমন কৌতুকের সৃষ্টি হয়। চশমা কোনো ইবাদত নয়। তাই এর সাথে বিদআতের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন লোকটি নিজে কোনো ইবাদত নয়, তাই সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় না থাকা, আবার এখন থাকা বিদ‘আতের বিষয় নয়। যে ইবাদত বা তার পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রমাণিত নয় একমাত্র তার আবিষ্কার শরয়ী পরিভাষায় বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।

[1] ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব, মাদ্দাহ ‘ بدع ’, ৮/৬।

[2] আরবী ভাষা ও সাহিত্যের ইমাম আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস ইবন যাকারিয়া আল-কাযবীনি আর-রাযি, ৩২৯-৩৯৫ হিজরী, ৯৪১-১০০৪ ঈসায়ী।

[3] ইবনু ফারিস, মু‘জামু মাক্বায়িসিল লুগাহ, মাদ্দাহ ‘ بدع ’, ১/২০৭, লিসানুল আরব, প্রাগুক্ত।

[4] আবু ইসহাক্ব ইবরাহিম ইবনু মুসা আশ-শাত্বিবী আল-মালিকী, ৭৯০ হিজরী, আল-ই‘তিসাম, প্রথম অনুচ্ছেদ, বিদআতের সংজ্ঞা ও তার অর্থ..., ১/২৬।

[5] প্রাগুক্ত।

 বিদ‘আত মানেই ক্রমান্বয়ে দীনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়া। কেননা দীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত জীবন পদ্ধতির নাম। তাঁর পদ্ধতি থেকে বিভিন্ন যুক্তির আলোকে যে ব্যক্তি বেরিয়ে পড়ে, সে মূলত দীন থেকেই বেরিয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতি থেকে যে যতটুকু বের হয়, সে মূলত ততটুকু দীন থেকে বের হয়। তাই এব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে পূর্ব থেকে সতর্ক করে গেছেন, যাতে করে যুক্তির আলোকে কেউ তাঁর দেখানো আদর্শ ও পদ্ধতি থেকে সরে না যায়। ইরবায ইবন সারিয়া আস্সুলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :

" وعظنا رسول الله صلى الله عليه و سلم يوما بعد صلاة الغداة موعظة بليغة ذرفت منها العيون ووجلت منها القلوب فقال رجل : إن هذه موعظة مودع فماذا تعهد إلينا يا رسول الله ؟ قال : أوصيكم بتقوى الله والسمع والطاعة وإن عبد حبشي فإنه من يعش منكم يرى اختلافا كثيرا وإياكم ومحدثات الأمور فإنها ضلالة فمن أدرك ذلك منكم فعليه بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين عضوا عليها بالنواجذ ". (سنن الترمذي، كتاب العلم عن رسول الله، باب ما جاء في الاخذ بالسنة واجتناب البدعة، رقم:2676)

‘‘একদিন ফজরের সালাতের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী নসীহত করলেন, এতে সবার চোখে অশ্রু বয়ে গেল, হৃদয়গুলো ভীত শঙ্কিত হলো। এক লোক বলে উঠল : নিশ্চয় এটি বিদায়ী নসীহত, অতএব আপনি আমাদের থেকে কী অঙ্গিকার নিবেন হে আল্লাহর রাসূল? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি অর্জনের ওসিয়্যত (অঙ্গিকার, গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ) করছি, নেতার কথা মান্য ও তাঁর আনুগত্যের নির্দেশ দিচ্ছি, যদিও সে হাবশী দাস হয়। কেননা তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। আর তোমরা সব নব অবিস্কৃত বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে, কেননা এগুলো পথভ্রষ্টতা। তোমাদের মধ্যে যে এই অবস্থা পাবে সে যেন আমার সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নাত আকড়ে ধরে। তোমরা সুন্নাতকে মাড়ির দাঁত দিয়ে আকড়ে ধর।’’[1]

বিদ‘আত কাকে বলে বুঝতে এবং তা থেকে সতর্ক থাকতে সুন্নাত প্রেমিকদের জন্য এই একটি হাদীসই যথেষ্ট। আল্লাহর রহমতে সর্বদা একদল এর উপর ছিলেন বলেই সুন্নাত সংরক্ষিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে। জান্নাতে পৌঁছতে, তাযকিয়ার চূড়ান্তে উপনীত হতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতই আমাদের জন্য যথেষ্ট। সুন্নাতের বাইরে কোনো কিছুকে যে কোনো ক্ষেত্রে মনে স্থান দেওয়া মানেই গোমরাহীর পথ খুলে দেওয়া, যা উপরোক্ত হাদীসে স্পষ্ট। এভাবে বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীনের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন।

সাহল ইবনে সা‘দ, আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত একটি হাদীস দেখুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

" إني فرطكم على الحوض من مر علي شرب ومن شرب لم يظمأ أبدا ليردن علي أقوام أعرفهم ويعرفونني ثم يحال بيني وبينهم، فأقول إنهم مني فيقال إنك لا تدري ما أحدثوا بعدك فأقول سحقا سحقا لمن غير بعدي ". (صحيح البخاري،كتاب الرقاق، باب في الحوض، رقم:6212، كتاب الفتن، باب ما جاء في قول الله تعالى (واتقوا فتنة..., رقم:6643)

‘‘আমি তোমাদের আগে হাওযে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। যে আমার কাছে যাবে সে (হাউয থেকে) পান করবে, আর যে পান করবে সে কখনো পিপাসার্ত হবে না। অনেক মানুষ আমার কাছে (হাওযে পানি পানের জন্য) আসবে, যাদেরকে আমি চিনব, তারাও আমাকে চিনবে, তবে তাদের এবং আমার মাঝে বাঁধা সৃষ্টি করা হবে, (আমার কাছে আসতে দেওয়া হবে না) আমি বলব এরা আমার উম্মত। তখন (প্রতি উত্তরে) বলা হবে : আপনি জানেন না, এরা আপনার পরে কী সব নব উদ্ভাবন করেছিল। একথা শুনে আমি বলব : যারা আমার পর পরিবর্তন করেছেন তারা দূর হয়ে যাক, তারা দূর হয়ে যাক!’’[2]

ইবাদতের যে কোনো নবআবিষ্কৃত পদ্ধতি বিদ‘আত। এতে জড়িত হওয়ার কী করুণ পরিণতি তা আমরা লক্ষ্য করতে পেরেছি। তেলাওয়াত, যিকর, দো‘আ, দুরূদ ইত্যাদির নতুন পদ্ধতি আবিস্কারের কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাড়িয়ে দিলে আমাদের মত হতভাগা আর কে আছে? আরো লক্ষ্যণীয় যে, নবীজী সবচেয়ে বেশি যে জিনিস থেকে বারণ করতেন তা হচ্ছে বিদ‘আত। সর্বদা বারণের কারণ আশাকরি স্পষ্ট হয়েছে।

এবার নবীজীর খুতবার সিফাত বর্ণনার হাদীসটি দেখি:

" كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول في خطبته : يحمد الله ويثني عليه بما هو له أهل ثم يقول : من يهد الله فلا مضل له و من يضلل فلا هادي له إن أصدق الحديث كتاب الله و أحسن الهدى هدى محمد و شر الأمور محدثاتها و كل محدثة بدعة و كل بدعة ضلالة و كل ضلالة في النار". (صحيح ابن خزيمة، باب صفة خطبة النبي، رقم: 1785)

‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর খুতবায় প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও তার যথাযথ গুণাবলী বর্ণনা করতেন, এরপর বলতেন: যাকে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন তাকে কেউ গোমরাহ করতে পারে না, আর যাকে আল্লাহ গোমরাহ করেন তাকে কেউ হেদায়াত প্রদান করতে পারে না। নিশ্চয় সর্বাধিক সত্য কথা আল্লাহর কিতাব এবং সর্বাধিক সুন্দর আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ, নব উদ্ভাবিত বিষয় সর্বাধিক নিকৃষ্ট, প্রত্যেক নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদ‘আত, প্রত্যেক বিদ‘আত ভ্রষ্টতা এবং এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিক্ষেপ্ত।’’[3]

উপরোক্ত হাদীসটির দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে আমাদের যত কথা বলে গেছেন সবই হাদীস। তিনি যা বলেছেন, যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন তা কতবার বলেছেন? নিশ্চয় একবার, দুইবার, তিনবার, একাধিক বার, ক্ষেত্র বিশেষে অনেক বার। কিন্তু উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত কথাগুলো তিনি কতবার বলেছেন? নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে কতটি খুতবা দিয়েছেন? একটি? দুইটি? একাধিক? অনেক? অগণিত? যতবারই তিনি খুতবা দিয়েছেন, উপরের বিষয়গুলো আলোচনা করতেন বলে আমরা জানতে পারলাম। এখান থেকে একটি ধারণা নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে কতবার বলেছেন: ‘‘একমাত্র আদর্শ তাঁরই আদর্শ, তাঁর আদর্শের বাইরের সবকিছুই নব উদ্ভাবিত, সব নব উদ্ভাবিত কর্ম বিদ‘আত, সব বিদ‘আতই গোমরাহী এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিক্ষেপ্ত।’’ এছাড়া অন্যান্য হাদীসতো আছেই। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ বহির্ভূত কোনো আমল গ্রহণযোগ্য নয়, চাই তা যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক না কেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসটি দেখুন:

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : "من أحدث في أمرنا هذا ما ليس فيه فهو رد". (صحيح البخاري، كتاب الصلح، باب إذا اصطلحوا على صلح جور فالصلح مردود، رقم: 2550، صحيح مسلم، كتاب الأقضية، باب نقض الأحكام الباطلة ورد محدثات الأمور، رقم: 4589)

‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমাদের এই দীনে যে ব্যক্তি নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে তা প্রত্যাখ্যাত।’’[4]

এই হলো বিদ‘আতের অবস্থা। আমলের ক্ষেত্রে সুন্নাতের বিপরীত চিন্তা মানেই বিদআতে লিপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া, আর বিদ‘আত মানেই দীন ধ্বংসের প্রক্রিয়া। তাই সাহাবায়ে কেরাম ও কল্যাণপ্রাপ্ত যুগ তথা খাইরুল ক্বুরুনের আলেমদেরকে এব্যাপারে সর্বাধিক সতর্ক থাকতে দেখা গেছে। বিদ‘আত দূরের কথা, বিদ‘আতের সন্দেহযুক্ত বিষয়কেও তারা প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন। এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রাহ.কে এতই সতর্ক থাকতে দেখা যায় যে, প্রমাণিত সুন্নাতের মাঝেও সমান্যতম হেরফের হলেই তিনি তা বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করতেন এবং এ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতেন। ফিক্বহে হানাফিতে বিদ্যমান অসংখ্য মাস‘আলা এর জলন্ত প্রমাণ। এথেকেই হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত হলো: কোনো বিষয় সুন্নাত ও বিদ‘আতের মাঝে সংশয়যুক্ত হলে তা বিদ‘আত বলে গণ্য করে পরিহার করতে হবে। কারণ কাজটি যদি বাস্তবেই সুন্নাত হয়ে থাকে তবে ছেড়ে দিলে গোনাহ্গার হবে না, শুধুমাত্র ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে, কিন্তু বিদ‘আত হয়ে থাকলে গোনাহ্ হবে। তাই ইমাম আবু হানিফা রাহ. এমন কাজ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করতেন। আর ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে চলাই জ্ঞানির কাজ। আল্লামা সারাখসী[5]লিখেন:

"وما تردد بين البدعة والسنة يتركه لأن ترك البدعة لازم وأداء السنة غير لازم ".(المبسوط،2-146)

‘‘আর যে বিষয়টি বিদ‘আতও হতে পারে আবার সুন্নাতও হতে পারে বলে উভয় সম্ভাবনা রয়েছে এমন বিষয় পরিত্যাগ করবে, কেননা বিদ‘আত পরিত্যাগ করা অপরিহার্য জরুরী, আর সুন্নাত পালন করা অপরিহার্য নয়।’’[6]

তিনি অন্যত্র লিখেন:

"وما تردد بين المباح والبدعة لا يؤتى به فإن التحرز عن البدعة واجب... وما تردد بين السنة والبدعة لا يؤتى به".(3-357)

‘‘যে বিষয়টি বৈধও হতে পারে আবার বিদ‘আত হতে পারে বলে উভয় সম্ভাবনা রয়েছে এমন বিষয়ের উপর আমল করা যাবে না, কেননা বিদ‘আত পরিহার করে চলা ওয়াজিব,... এবং যে কাজ সুন্নাতও হতে পারে আবার বিদ‘আতও হতে পারে বলে উভয় সম্ভাবনা রয়েছে এমন কাজ করা যাবে না।’’[7]

এই ছিল খাইরুল ক্বুরুন থেকে নিয়ে হানাফী মাযহাবের মূলধারার আলেমদের আদর্শ। তাই বিভিন্ন দো‘আ দুরূদ ইত্যাদির মাঝে নতুন যে কোনো সংযোজনের সবই তাদের যুগের অনেক পরের সৃষ্ট বলে দেখতে পাবেন।এখন বিভিন্ন আমল, আমলের বিভিন্ন পদ্ধতি, দুরূদের বিভিন্ন পদ্ধতি, যিকরের বিভিন্ন পন্থা, সংযোজন বিয়োজন। দো‘আ, যিকর, তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদির নতুন সংখ্যা ও তার লাভ নির্ধারণ। ইবাদতের নতুন নতুন উদ্দেশ্যের প্রণয়ন করে যদি বলি তা বিদ‘আত নয় তবে, আমি আমার নিজেকে সম্বোধন করে বলব: তুমি পৃথিবীর কাউকে বিদ‘আতি বলে আখ্যায়িত করো না। রাসূলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য বর্জিত হয়ে তোমার কাজ যদি বিদ‘আত না হয়, তবে যাকে তুমি বিদ‘আতি বলছ তাঁর কাজ বিদ‘আত হবে কেন? তোমার বানানো পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পন্থায় না হলেও তুমি তোমার ইলম, কুরআন, হাদীস, যুক্তি ইত্যাদির অকাট্য (?) দলীল দ্বারা জায়েয প্রমাণ করতে পার। তবে তুমি যাকে বিদ‘আতি বলছ তাঁর কাছেও তোমার মত হাজারো দলীল রয়েছে। আলোচনা আর দীর্ঘ না করে আমাদের মূল বিষয়ে চলে যাচ্ছি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে বিদ‘আত বুঝা ও তা এড়িয়ে চলার তওফিক দিন। আমীন।

[1] তিরমিযী, সুনান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত ইলম অধ্যায়, সুন্নাতকে আকড়ে ধরা এবং বিদ‘আত পরিহার করা অনুচ্ছেদ, নং:২৬৭৬, হাদীস সহীহ।

[2] সহীহুল বুখারী, কিতাবুর রিক্বাক্ব, হাউয অনুচ্ছেদ, নং: ৬২১২, কিতাবুল-ফিতান, নং: ৬৬৪৩।

[3] মুহাম্মদ ইবন ইসহাক্ব ইব্নু খুযায়মাহ আস-সুলামী, ২২৩-৩১১ হিজরী, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খুতবার গুণাবলী অনুচ্ছেদ, নং ১৮৭৫।

[4] সহীহুল বুখারী, সন্ধি অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: অন্যায়ের উপর লোকেরা সন্ধিবদ্ধ হলে তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য, নং: ২৫৫০, সহীহ মুসলিম, বিচার সংক্রান্ত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: বাতিল সিন্ধান্ত খণ্ডন এবং বিদ‘আতি কার্যকালাপ প্রত্যাখ্যান, নং: ৪৫৮৯।

[5] শামসুল আয়িম্মাহ মুহাম্মদ ইবন আহমদ ইবন সাহাল আস্-সার্খাসি, হানাফী মাযহাবের অন্যতম মুজতাহিদ আলেম। ওফাত: ৪৮৩ হিজরী, মোতাবেক ১০৮০ ঈসায়ী। (আল-আ‘লাম: ৫/৩১৫)

[6] সার্খাসী, আল-মাবসূত,২/১৪৬।

[7] প্রাগুক্ত,৩/৩৫৭।

‘খতম’ শব্দটি মূলত আরবী ‘ ختم ’ শব্দের বাংলা ব্যবহার। যার মূল অর্থ হচ্ছে : কোনো বস্তুতে মোহর লাগানো বা তাকে সিলযুক্ত করা। কর্ম যুগে শব্দটির অর্থ হয়, কাজটি শেষ করা। এভাবে বিভিন্ন শব্দযোগে তার বিভিন্ন অর্থ হয় যেমন, মাটি দ্বারা মুখ বন্ধ করা, এড়িয়ে যাওয়া, হৃদয়ে মোহর এঁটে দেওয়া তথা অবুঝ করে দেওয়া, কোনো বস্তুর শেষে পৌঁছা ইত্যাদি। কিতাব বা কুরআন শব্দযোগে তার অর্থ হয়: সম্পূর্ণটুকু পড়ে শেষ করা।[1]

কুরআনে শব্দটি ক্রিয়ামুলে শুধুমাত্র হৃদয়ে মোহর এঁটে দেওয়ার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন :

﴿ خَتَمَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَعَلَىٰ سَمۡعِهِمۡۖ وَعَلَىٰٓ أَبۡصَٰرِهِمۡ غِشَٰوَةٞۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٧ ﴾ [البقرة: ٧]

‘‘আল্লাহ তাদের হৃদয়ে ও কানে মোহর এঁটে দিয়েছেন, আর তাদের চোখের উপর রয়েছে আবরণ রয়েছে’’।[2]

তবে বিভিন্ন হাদীসে ‘ختم’ শেষ করা অর্থে ব্যবহার হয়েছে। যেমন আয়াতটি শেষ পর্যন্ত পড়া, সুরাটি শেষ পর্যন্ত পড়া ইত্যাদি শব্দ হাদীসে ব্যবহার হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পড়া বলতে যেমন পুরোটা পড়া বুঝায়, তেমনি যে কোনো জায়গা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত পৌছলেও এ শব্দ ব্যবহার হয়। এ ক্ষেত্রে পুরো সূরা পড়া উদ্দেশ্য নয়। যেমন, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘুম থেকে উঠে মিসওয়াক ও ওযু করার পর সূরা আলে ইমরানের ১৯০ নং আয়াত থেকে পড়তে শুনেন, অতঃপর ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন :

" فقرأ هؤلاء الآيات حتى ختم السورة...". (صحيح مسلم، باب الدعاء في صلاة الليل وقيامه، رقم:1835)

‘‘অতঃপর তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই আয়াতগুলো পড়েন, এমনকি সূরা শেষ করেন’’।[3]

এখানে সূরা খতম বলতে পুরো সূরা পড়া নয়, বরং ১৯০ নং আয়াত থেকে শুরু করে সূরার শেষ পর্যন্ত পড়া।

কুরআন সম্পূর্ণটা পড়ার ক্ষেত্রে খতম শব্দের ব্যবহার সাহাবিদের মধ্যে ছিল। তবে ‘হাদীস খতম’ বা ‘হাদীসটি খতম’ এমন কোনো ব্যবহার বা প্রয়োগ তাদের মাঝে ছিল বলে জানতে পারি নি। ‘খতমে বুখারী’র আলোচনায় এমন ব্যবহার না থাকার কারণ আমরা বুঝতে পারব ইন-শাআল্লাহ। তবে হাদীসটি খতম বলতে তা পুরোটা পড়া বুঝাবে। তাই কেউ একটি হাদীস পড়ে হাদীসটি খতম করেছি বলতে কোনো বাধা নেই। এভাবে খতমে দো‘আ ইউনুস বললে পুরো দো‘আটা পড়া বুঝাবে, যদিও এমন বলার প্রচলন ছিল না। কিন্তু খতমে ইউনুস বললে: এতবার পড়া, অমুক খতম বললে: এতবার পড়া, তমুক খতম বললে এতবার পড়া, এসব ব্যবহার সম্পূর্ণ নতুন মনগড়া বানানো।

খতম শব্দটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছা বা পুরোটা পড়ার অর্থে ব্যবহার হলেও ‘খতম করানো’ বা ‘খতম পড়ানো’, এমন কোনো ব্যবহার বা প্রয়োগ না সাহাবিদের যুগে ছিল, না খাইরুল ক্বুরুনে ছিল। কেননা কুরআন, হাদীস, দো‘আ, দুরূদ, যিকর ইত্যাদির আমলের এই সিস্টেম বা পদ্ধতিটি একেবারেই নতুন। তাই ‘খতম’ শব্দের শাব্দিক অর্থ অভিধানে পেলেও আমাদের সিস্টেমের তার পারিভাষিক কোনো অর্থ আহলে ইলমদের কোনো কিতাবে পাবেন না। আমরা ‘খতম’ বলতে যা বুঝি এ সবকিছু সোনালীযুগ দূরের কথা, মুহাক্কীক্ব কোনো আলেম থেকে এ গুলোর আবিষ্কার হয়নি বলে পরিস্কার বুঝা যায়। আমাদের জানামতে প্রচলিত যে খতমগুলো রয়েছে সেগুলোর আলোচনায় আমরা এগুলোর তাৎপর্য, যথার্থতা, গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করব। মহাগ্রন্থ আলকুরআন আল্লাহর কালাম এবং প্রতিটি মানুষের জীবন বিধান। এর গুরুত্ব কারো কাছে অজানা নয়। তাই সর্বপ্রথম আমাদের সমাজে অধিকহারে প্রচলিত এই মহাগ্রন্থ আল কুরআনের খতম দিয়েই শুরু করছি। নিজে কুরআন না পড়ে, কুরআনের শিক্ষা নিজে গ্রহণ না করে, যে কোনো কারণে অন্যকে ভাড়া করে কুরআন পড়িয়ে নেওয়ার যথার্থতা কতটুকু তা আলোচনা করলে বুঝতে পারব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর তওফিক কাম্য।

>
[1] ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব, মাদ্দাহ: ‘ ختم ’ ১২/১৬৩।

[2] সূরা বাক্বারা, ৭।

[3] সহীহ মুসলিম, সালাত অধ্যায়, রাতের সালাতে দু‘আ ও রাতে জাগা অনুচ্ছেদ, নং:১৮৩৫।

 কুরআন প্রতিটি মুসলিমের জীবন বিধান। এই কুরআন তাকে নিয়মিত তেলাওয়াত করতে হবে এবং এর মর্ম বুঝে তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা ও তেলাওয়াতের ফযিলত বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,

«خيركم من تعلم القرآن وعلمه» (صحيح البخاري، كتاب فضائل القرآن، باب خيركم من تعلم القرآن وعلمه)

‘‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়’’।[1]

এভাবে কুরআন তেলাওয়াতের বেলায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,

" مثل الذي يقرأ القرآن كالأترجة طعمها طيب وريحها طيب . والذي لا يقرأ القرآن كالتمرة طعمها طيب ولا ريح لها ومثل الفاجر الذي يقرأ القرآن كمثل الريحانة ريحها طيب وطعمها مر . ومثل الفاجر الذي لا يقرأ القرآن كمثل الحنظلة طعمها مر ولا ريح لها". (صحيح البخاري، باب فضل القرآن على سائر الكلام)

‘‘কুরআন পাঠকারী (মুমিনের) উদাহরণ সুস্বাদু সুগন্ধযুক্ত লেবুর ন্যায়। আর যে (মুমিন) কুরআন পাঠ করে না তার উদাহরণ এমন খেজুরের মত যা সুগন্ধহীন তবে খেতে সুস্বাদু। আর যে ফাসিক কুরআন পাঠ করে তার উদাহরণ রায়হান জাতীয় গুল্মের মত যার সুগন্ধ আছে কিন্তু খেতে বিস্বাদযুক্ত। আর যে ফাসেক কুরআন তেলাওয়াত করে না তার উদাহরণ ঐ মাকাল ফলের মত যা খেতেও বিস্বাদ (তিক্ত) আবার কোনো সুঘ্রানও নেই।[2]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন,

" من قرأ حرفا من كتاب الله فله به حسنة والحسنة بعشر أمثالها لا أقول آلم حرف ولكن ألف حرف ولام حرف وميم حرف ". ( سنن الترمذي، باب فيمن قرأ حرفا من القرآن ما له من الأجر)

‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি অক্ষর তিলাওয়াত করবে আল্লাহ তার আমলনামায় একটি নেকী প্রদান করেন, আর এই নেকীটি দশটি নেকীর সমান। আমি বলি না, ‘‘ الم ’’ একটি অক্ষর, বরং ‘‘ أ ’’ একটি অক্ষর, ‘‘ل ’’ একটি অক্ষর, ‘‘ م ’’ একটি অক্ষর’’।[3]

কুরআন তেলাওয়াতের এত মর্যাদা, গুরুত্ব, ছওয়াব কুরআন হাদীস থেকে প্রমাণিত থাকা সত্বেও প্রচলিত খতমের রূপরেখায় নবী আদর্শ ও সাহাবা আদর্শের বৈপরিত্য থাকার কারণে এই কুরআন খতমের হুকুম যদি না বাচক হয় তবে যার কোনো অস্তিত্ব নবী জীবনে, নবীর শিক্ষা প্রাপ্ত সাহাবিদের জীবনে নেই তার হুকুম কী হবে তা সহজেই অনুমেয়।

রূপরেখায় বৈপরিত্য বলতে যেমন, সাহাবায়ে কেরাম কুরআন নিজে শিখতেন, নিজে পড়তেন। যিনি জানেন না তিনি শিখতেন। এই শিক্ষাই তাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন। অনেক সময় কেউ কুরআন অপরের কাছে শুনতে চাইতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কোনো কোনো সাহাবী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে শুনার আগ্রহ প্রকাশ করতেন, শুনতেন। তবে অন্যকে এনে বাড়ীতে খতম করানোর কোনো রেওয়াজ তাদের মাঝে ছিল না। কেউ মারা গেলে তাদের যা করণীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন তারা শুধু তাই করতেন। কেউ অসুস্থ হলে, বিপদে পড়লে কী করণীয় তাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিয়েছেন। কেউ মারা গেলে বা অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে কুরআন খতম করা বা খতম করানোর কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে একটিবার কাউকে বলেন নি নিজেও করেন নি। তাই সাহাবিরা এমন কর্ম কখনো করেন নি।

এখন আমরা জানতে চেষ্টা করব প্রচলিত খতমের হুকুম সম্পর্কে আদর্শবান আলেমদের কী মত। এ ব্যাপারে আমাদের আলেম সমাজে অত্যন্ত সুপরিচিত কিতাব ‘‘আহসানুল ফাতওয়া’’ এর লিখক প্রসিদ্ধ ফক্বিহ রশিদ আহমদ রহ. তার কিতাবে প্রচলিত কুরআন খতম সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে যে দলীলভিত্তিক আলোচনা করেছেন, অসংখ্য আলেমের বক্তব্যের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন তার এই লেখাটির অনুবাদ তুলে দেওয়াই যথেষ্ট মনে করছি। তার এ বক্তব্যের পর এ ব্যাপারে আর কিছু লেখার কোনো প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না। এতে আমরা প্রচলিত খতমের তাৎপর্য যেমন বুঝতে পারব তেমনি অগণিত আলেমের মতামত পেয়ে যাব। তার আলোচনা পড়ার পর সত্য সন্ধানী মানুষের মনে আর কোনো দ্বিধা থাকবে না বলে আশা করি। নিম্নে তার কিতাবের প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু তুলে ধরছি।

প্রশ্ন: বর্তমানে কুরআন খতমের প্রচলন ব্যাপক হয়ে গেছে। যেমন, নতুন ঘর ক্রয় করা হলে কুরআন খতম করা হয়। দোকান উদ্বোধন করা হলে খতম করা হয়। কারো চল্লিশা হলে কুরআন খতম করা হয়, কারো মৃত্যুর তৃতীয় দিনে কুরআন খতম করা হয়; যাতে মৃত ব্যক্তির কাছে ছওয়াব পৌঁছে। কোনো সময় এর ঘোষণা পত্রিকায় দেওয়া হয় এবং মানুষ দুর-দুরান্ত থেকে শুধুমাত্র কুরআন খতমের জন্য আসে। এমন কুরআন খতমের আমলের হুকুম কী? কুরআন হাদীসের আলোকে এর কোনো প্রমাণ আছে কি? এতে আমাদের বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের লোক শরীক হতে পারবে কি? আমরা নিজে কি এমন কর্মে শরীক হয়ে গোনাহগার হচ্ছি না?

بينوا توجروا - -

সুমতি দানকারীর নামে উত্তর

    قال الإمام محمد إسماعيل البخاري رحمه الله تعالى: " حدثنا قتيبة حدثنا جرير عن منصور عن مجاهد قال : دخلت أنا وعروة بن الزبير المسجد فإذا عبد الله بن عمر رضي الله عنهما جالس إلى حجرة عائشة وإذا ناس يصلون في المسجد صلاة الضحى قال فسألناه عن صلاتهم فقال بدعة ".

) صحيح البخاري ص:238ج:1)

(মুহাম্মদ ইসমাইল বুখারী রাহ. বলেন: ...........মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং উরওয়া ইবনু যুবাইর (র) মসজিদে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা- আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর হুজরার পাশে বসে আছেন। ইতোমধ্যে কিছু লোক মসজিদে সালাতুদ্দোহা আদায় করতে লাগল। আমরা তাকে এদের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, এটা বিদ‘আত।[4]

    وقال الإمام أبو الحسين مسلم بن الحجاح بن مسلم القشيري وحدثنا إسحاق بن إبراهيم أخبرنا جرير عن منصور عن مجاهد قال دخلت أنا وعروة بن الزبير المسجد فإذا عبد الله بن عمر جالس إلى حجرة عائشة والناس يصلون الضحى فى المسجد فسألناه عن صلاتهم فقال بدعة.

(صحيح مسلم ص:409 ج:1

(এবং ইমাম আবুল-হুসাইন মুসলিম ইবন হাজ্জাজ ইবন মুসলিম আল-কুশাইরী বলেন: ........... মুজাহিদ (র) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং উরওয়া ইবনু যুবাইর (র) মাসজিদে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, আবদুল্লাহ ইবনু উমররাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা - আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এর হুজরার পাশে বসে আছেন। আর কিছু লোক মসজিদে সালাতুদ্দোহা আদায় করছে। আমরা তাকে এদের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, এটা বিদ‘আত।[5]

    وقال الشيخ محي الدين أبو زكريا يحيى بن شرف النووي رحمه الله تعالى: انهم سألوا ابن عمر عن صلاة الذين كانوا يصلون الضحى في المسجد فقال بدعة ) هذا قد حمله القاضي وغيره على أن مراده أن اظهارها في المسجد والاجتماع لها هو البدعة لا أن أصل صلاة الضحى بدعة وقد سبقت المسألة في كتاب الصلاة.

( شرح النووي على صحيح مسلم صفحه مندرجه بالا)

(এবং শাইখ মুহিউদ্দীন আবু যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া ইবন শরফ নববী রাহ. বলেন, তারা ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে যারা মসজিদে সালাতুদদ্বোহা আদায় করছিল তাদের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিল, তিনি বললেন বিদ‘আত। এটা ক্বাযী[6] এবং অন্যান্যরা এর অর্থ নিয়েছেন, তার উদ্দেশ্য হলো সালাতকে মসজিদে প্রকাশ করা এবং এর জন্য সমবেত হওয়াটাই হচ্ছে বিদ‘আত। মূল সালাতুদদ্বোহা বিদ‘আত নয়। সালাত অধ্যায়ে মাসআলাটির আলোচনা হয়েছে।)[7]

4- وقال الامام محمد بن شهاب المعروف بابن البزار الكردري الحنفي رحمه الله تعالى: وقد صح عن ابن مسعود رضي الله عنه أنه سمع قوما اجتمعوا في مسجد يهللون ويصلون عليه الصلاة والسلام جهرا، فراح إليهم فقال ما عهدنا دلك على عهده عليه السلام وما أراكم إلا مبتدعين، فما زال يذكر ذلك حتى أخرجهم من المسجد.

( بزازية بهامش الهنديه، ج:6 ص:378)

(এবং ইমাম মুহাম্মদ ইবন শিহাব আল-কুরদুরী আল-হানাফী রাহ.[8] যিনি ইবনে বায্যার নামে পরিচিত, তিনি বলেন, ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত যে, তিনি শুনতে পান একদল লোক মসজিদে সমবেত হয়ে উচ্চস্বরে তাহলীল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ পড়ছে। অতএব তিনি তাদের কাছে গেলেন এবং বললেন, আমরাতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এমনটি পাইনি। আমিতো তোমাদেরকে বিদ‘আতি ছাড়া কিছু দেখছি না। তিনি একথা বলতে বলতে তাদেরকে মসজিদ হতে বের করে দেন।)[9]

    وقال في موضع آخر: ويكره اتخاذ الطعام في اليوم الأول والثالث وبعد الأسبوع والأعياد ونقل الطعام إلى القبر في المواسم واتخاذ الدعوة بقراءة القرآن وجمع الصلحاء والقراء للختم أو لقراءة سورة الأنعام أو الإخلاص. فالحاصل أن اتخاذ الطعام عند قراءة القرآن لأجل الأكل يكره. ( بزازية بهامش الهنديه، ج:4 ص:81)

(এবং তিনি আরেক জায়গায় বলেন, আর মৃত্যুর প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, সাপ্তাহ পর এবং অনুষ্ঠানে খাবারের আয়োজন করা, বিভিন্ন মৌসুমে কবরে খাবার নিয়ে যাওয়া, কুরআন পড়ার জন্য দাওয়াতের আয়োজন করা এবং সৎ লোক ও ক্বারীদেরকে খতমের জন্য বা সূরা আন‘আম অথবা সূরা ইখলাস পড়ার জন্য সমবেত করা মাকরূহ।

মোটকথা, কুরআন পড়ার সময় খাওয়ার জন্য দাওয়াতের আয়োজন করা মাকরূহ।)[10]

    وقال الفقيه المخدوم محمد جعفر بن العلامة عبد الكريم البوبكاني السندي رحمه الله تعالى في الصيرفية: قراءة القرآن لأجل المهمات والبأس مكروه. (وبعد صفحة) يكره للقوم أن يقرأ القرآن جملة لتضمنها ترك الاستماع والإنصات المأمور بهما. وقيل لا بأس به. في التتارخانية من المحيط: من المشايخ من قال: إن ختم القرآن بالجماعة جهرا ويسمى "سيباره خوانده" مكروه، (الى قوله) في عين العلم: ولا يختم في أقل من ثلاثة أيام(وبعد صفحة) في مفيد المستفيد من النصاب: قراءة القرآن في المجالس يكره، لأنه يقرأ طمعا في الدنيا، وكذلك في الأسواق، وكذلك على رأس القبر. قيل، ولو قرأ ولا يسأل والناس أعطوه من غير سؤال قال يكره أيضا، لأنه إذا لم يقصد السؤال لِمَ لا يجلس في بيته يقرأ. ( المتانة في المرمة عن الخزانة، 632، 633، 634)

(এবং ফক্বীহ মুহাম্মদ জাফর[11]....সিন্দি বলেন, সাইরাফিয়্যাহ কিতাবে[12] ‘‘কঠিন বিষয় এবং অসুবিধার কারণে কুরআন পড়া মাকরূহ’’। (এবং এক পৃষ্ঠা পর) মুফিদুল মুস্তাফিদ কিতাবে এসেছে, ‘‘দলবদ্ধ হয়ে বৈঠকে কুরআন পড়া মাকরূহ, কেননা এতে শ্রবণ করা এবং চুপ থেকে শোনা পরিত্যাগ করা হয় অথচ এ দুটি বিষয় নির্দেশিত।’’ কেউ কেউ বলেন, ‘‘এতে অসুবিধা নেই’’। ‘মুহিত’[13]কিতাবের উদ্ধৃতিতে ‘তাতারখানিয়া’[14]কিতাবে রয়েছে, ‘‘মাশায়েখের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, নিশ্চয় দলবদ্ধ হয়ে উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করা যাকে বলা হয় ‘সীপারা পড়া’ তা মাকরূহ। (আরো বলেন) আইনুল ইলমে রয়েছে, তিন দিনের কমে খতম করবে না ’’। (আরো এক পৃষ্ঠা পর), ‘‘মুফিদুল মুসতাফিদে নেসাব[15]থেকে বলা হয়েছে, সমাবেশস্থলে কুরআন পড়া মাকরূহ, কেননা পাঠক তা দুনিয়ার লোভে পড়ছে। এভাবে বাজারে পড়া মাকরূহ। কবরের কাছে পড়াকেও এভাবে মাকরূহ বলা হয়েছে। যদি পড়ে কিন্তু (কারো কাছে কিছু) না চায়, আর মানুষ তাকে চাওয়া ব্যতীতই দান করে তবে তাও মাকরূহ বলেছেন, কেননা চাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে সে কেন ঘরে বসে পড়ছে না’’।[16]

7 - وقال العلامة ابن عابدين رحمه الله تعالى: (تتمة) أشار بقوله فرادى إلى ما ذكره بعد في متنه من قوله ويكره الاجتماع على إحياء ليلة من هذه الليالي في المساجد وتمامه في شرحه وصرح بكراهة ذلك في الحاوي القدسي قال وما روي من الصلوات في هذه الأوقات يصلي فرادى غير التراويح". قال في البحر: قال في البحر ومن هنا يعلم كراهة الاجتماع على صلاة الرغائب التي تفعل في رجب أو في أولى جمعة منه وأنها بدعة وما يحتاله أهل الروم من نذرها لتخرج عن النفل والكراهة فباطل ا هـ قلت: وصرح بذلك في البزازية كما سيذكره الشارح آخر الباب وقد بسط الكلام عليها شارحا المنية وصرحا بأن ما روي فيها باطل موضوع. وللعلامة نور الدين المقدسي فيها تصنيف حسن سماه ( ردع الراغب عن صلاة الرغائب ) أحاط فيه بغالب كلام المتقدمين والمتأخرين من علماء المذاهب الأربعة. (رد المحتار،ج:2ص:26)

(এবং আল্লামা ইবনে আবেদিন[17]রাহ. বলেন, (পরিশিষ্ট) মুসান্নিফ[18]তার কথা ‘‘একা একা’’ বলে তিনি সেদিকে ইঙ্গিত করেন যা একটু পরে তিনি তার মতনে (বইয়ের মূল অংশে) এই বলে উল্লেখ করেন, ‘‘আর এই রাতগুলো জাগ্রত থেকে কাটানোর জন্য মসজিদে সমবেত হওয়া মাকরূহ’’ পুরো আলোচনা তার ব্যখ্যাগ্রন্থে রয়েছে। আল-হাবীল ক্বুদসীতে[19]তা মাকরূহ বলে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, ‘‘এই রাতগুলোতে যে সালাতের কথার বর্ণনা রয়েছে তা একা একা পড়তে হবে, একমাত্র তারাবীহ ব্যতীত’’।আল-বাহরে[20]বলেন, ‘‘এথেকে জানা যায় যে, সালাতুর রাগাইব যা রজবের প্রথম জুমুআয় পড়া হয়, এর জন্য সমবেত হওয়া মাকরূহ এবং এটি বিদ‘আত। এটাকে নফল ও মাকরূহ থেকে বের করার জন্য রোমবাসীরা এই সালাতের মান্নতের যে হীলা অবলম্বন করে তা বাতিল’’।

[1] সহীহুল বুখারী, কুরআনের ফযিলত সমূহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিখায়, নং:৪৭৩৯।

[2] সহীহুল বুখারী, কুরআনের ফযিলতসমূহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: সব কালামের উপর কুরআনের শ্রেষ্টত্ব, নং:৪৭৩৯, সহীহ মুসলিম, কুরআনের ফযিলতসমূহ অধ্যায়, হাফিজে কুরআনের মর্যাদা অনুচ্ছেদ, নং:১৮৯৬।

[3] সুনানুত তিরমিযি, হাদীস সহীহ, কুরআনের ফযিলত সমূহ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: যে কুরআনের একটি অক্ষর পড়ল তার কতটুকু ছওয়াব রয়েছে, নং: ২৯১০।

[4] সহীহুল বুখারী, উমরা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতবার উমরা করেছেন।

[5] সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: উমরা, অনুচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উমরার সংখ্যার বর্ণনা।

[6] কাযী আয়ায, মালেকি মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম মুহাদ্দীস, ফকীহ, আদীব, ঐতিহাসিক, একাধিক কিতাবের রচয়িতা। ৪৭৩-৫৪৪ হিজরী।

[7] ইমাম নববীর মুসলিমের ব্যখ্যগ্রন্থ, প্রাগুক্ত অধ্যায়। কিতাবুস-সালাত, (باب استحباب صلاة الضحى وأن أقلها ركعتان) এর অধীনে আলোচনা সালাতুদ দ্বোহার আলোচনা করেছেন।

[8] ফাতওয়া বায্যাযিয়ার মুসান্নিফ, ইমাম মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ ইবন শিহাব, ইবনে বায্যার আলকুরদুরী আল-হানাফী। মৃত্যু: ৮২৭ হিজরী।

[9] বায্যাযিয়া, হিন্দিয়ার টিকা, ৬/৩৭৮ (লেখকের দেওয়া তথ্য সুত্র মোতাবেক)।

[10] বায্যাযিয়া, হিন্দিয়ার টিকা, ৪/৮১ (লেখকের দেওয়া সুত্রে)

[11] মুহাম্মদ জা‘ফর ইবন আব্দুল করীম আল-বুবাকানী আস-সিন্দি আল-হানাফী। তার লিখিত কিতাব, ‘আল-মাতানাহ ফিল-মারাম্মাতে আনিল খিযানাহ’।

[12] আল-ফাতাওয়া আস-সাইরাফিয়্যাহ। লিখক, হানাফী ফক্বীহ আসআদ ইবন ইউসুফ ইবন আলী মাজ্দুদ্দীন আস-সাইরাফী আল-বুখারী। মৃত:১০৮৮ হিজরী। (আল-আ‘লাম, ১/৩০২)

[13] দেখুন, বুরহানুদ্দীন ইবনু মাযাহ (৬১৬ হি.) রচিত কিতাব ‘আল-মুহিত্বুল বুরহানী, পৃষ্টা:১৪৪, খ-:৫।

[14] ফিকহে হানাফী নিয়ে রচিত কিতাব ‘আল-ফাতাওয়া আত্তাতার খানিয়া’, লিখক, ইবনুল আলা আল-আনসারী আদ-দেহলবী আল-হিন্দি।

[15] ‘আইনুল ইলম’ ‘মুফিদুল মুস্তাফিদ’ ‘কিতাবুন-নেসাব’ ফিক্বহে হানাফীতে রচিত বিভিন্ন কিতাবের নাম।

[16] আল-মাতানাহ ফিল-মারাম্মাতে আনিল খিযানাহ, ৬৩৩,৬৩৪,৬৩৫ (লেখকের দেওয়া সুত্রে)।

[17] বিশিষ্ট হানাফী ফক্বীহ মুহাম্মদ আমীন ইবন উমর ইবন আব্দুল আযীয ইবন আবেদীন। ১১৯৮-১১২৫ হিজরী। দামেশ্কে জন্ম এবং মৃত্যু। যাকে ইমামুল হানাফিয়্যাহ ফিশ্-শাম বলে ভূষিত করা হয়। আল্লামা ইবনে আবেদীন বা আল্লামা শামী নামে তিনি প্রসিদ্ধ। তার কিতাব ‘রাদ্দুল মুহতার‘ যা ফাতওয়া শামী হিসেবে পরিচিত তা ফিকহে হানাফীর মাসাঈলে আলাউদ্দীন হাসকাফী রচিত ‘আদ্দুররুল-মুখতারের’ ব্যাখ্যাগ্রন্থ। (আল-আ‘লাম: ৬/৪২)

[18] মুসান্নিফ আর্থাৎ ‘আদ্দুররুল-মুখতারের’ রচয়িতা মুহাম্মদ ইবন আলী আলাউদ্দীন আল-হাসকাফী। দামেশ্কের একজন হানাফী মুফতী। ১০২৫-১০৮৮ হিজরী। (আল-আ‘লাম: ৬/৪২)

[19] ‘আল-হাবীল ক্বুদসী ফিল ফুরু’ লিখক, কাযী জামাল উদ্দীন আহমদ ইবন মুহাম্মদ আল-গাযনবী আল-হানাফী। (কাশ্ফুয যুনুন:১/৬২৭)

[20] যাইনুদ্দীন ইবনে নুজাইম মিসরী আল-হানাফী ৯২৬-৯৭০ হিজরী রচিত কিতাব ‘আল-বাহরুর রায়িক্ব’। সালাত অধ্যায়। বিতর ও নফল অনুচ্ছেদ, ২/৫৬।

 আমি বলি (ইবনে আবেদীন) বায্যাযিয়ায় তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, যেমন ব্যাখ্যাকার অধ্যায়ের শেষে উল্লেখ করবেন। আল-মুনইয়াহ এর দুই ব্যাখ্যাকার[1]এর উপর দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং তারা উভয়ে স্পষ্ঠভাবে বলেছেন যে, ‘‘এ ব্যাপারে যা বর্ণনা করা হয় সব বাতিল মনগড়া। আল্লামা নুরুদ্দীন মাক্বদিসীর[2]এ বিষয়ে একটি সুন্দর রচনা রয়েছে তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘রাদ্উর রাগিব আন সালাতির রাগাইব’ তিনি এখানে চার মাযহাবের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আলেমেদের কথার অধিকাংশ সংকলন করেছেন।[3]

وقال في موضع آخر: ويكره اتخاذ الضيافة من الطعام من أهل الميت لأنه شرع في السرور لا في الشرور وهي بدعة مستقبحة

وروى الإمام أحمد وابن ماجه بإسناد صحيح عن جرير بن عبد الله قال كنا نعد الاجتماع إلى أهل الميت وصنعهم الطعام من النياحة اهـ وفي البزازية ويكره اتخاذ الطعام في اليوم الأول والثالث وبعد الأسبوع ونقل الطعام إلى القبر في المواسم واتخاذ الدعوة لقراءة القرآن وجمع الصلحاء والقراء للختم أو لقراءة سورة الأنعام أو الإخلاص والحاصل أن اتخاذ الطعام عند قراءة القرآن لأجل الأكل يكره وفيها من كتاب الاستحسان وإن اتخذطعاما للفقراء كان حسنا اه وأطال في ذلك المعراج وقال وهذه الأفعال كلها للسمعة والرياء فيحترز عنها لأنهم لا يريدون بها وجه الله تعالى اهـ (رد المحتار:ج:2ص:240)

(এবং তিনি আরেক জায়গায় বলেন, আর মৃত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে যিয়াফত খাবারের আয়োজন করা মাকরূহ। কেননা তা আনন্দের বেলায় শরীয়ত সম্মত, অনিষ্টতার বেলায় নয়। আর এটা মন্দ বিদ‘আত। ইমাম আহমদ এবং ইবনে মাজাহ বিশুদ্ধ সনদে জারীর ইবন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন,[4]জারীর বলেন, ‘‘মৃত ব্যক্তির পরিবারের নিকট সমবেত হওয়া এবং তারা খাবারের আয়োজন করাকে আমরা নিয়াহাহ (বিলাপ) গণ্য করতাম’’। বায্যাযিয়ায় রয়েছে, ‘‘আর মৃত্যুর প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, সপ্তাহ পর এবং অনুষ্ঠানে খাবারের আয়োজন করা, বিভিন্ন মৌসুমে কবরে খাবার নিয়ে যাওয়া, কুরআন পড়ার জন্য দাওয়াতের আয়োজন করা এবং সৎ লোক ও ক্বারীদেরকে খতমের জন্য বা সূরা আন‘আম অথবা সূরা ইখলাস পড়ার জন্য সমবেত করা মাকরূহ। মোটকথা, কুরআন পড়ার সময় খাওয়ার জন্য দাওয়াতের আয়োজন করা মাকরূহ’’ এবং উক্ত কিতাবের ইসতেহসান অধ্যায়ে রয়েছে, ‘‘যদি দরিদ্র মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করে তবে ভাল’’। আর মি‘রাজে[5]এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন, ‘‘এই সবগুলো হচ্ছে লোক দেখানো ও লোক শুনানো। তাই এ সব থেকে বিরত থাকবে, কেননা তারা এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে না’’।)[6]

وقال في موضع آخر: وقد أطنب في رده صاحب تبيين المحارم مستندا إلى النقول الصريحة فمن جملة كلامه قال تاج الشريعة في شرح الهداية إن القرآن بالأجرة لا يستحق الثواب لا للميت ولا للقارىء وقال العيني في شرح الهداية ويمنع القارىء للدنيا والآخذ والمعطي آثمان فالحاصل أن ما شاع في زماننا من قراءة الأجزاء بالأجرة لا يجوز لأن فيه الأمر بالقراءة وإعطاء الثواب للآمر والقراءة لأجل المال فإذا لم يكن للقارىء ثواب لعدم النية الصحيحة فأين يصل الثواب إلى المستأجر ولولا الأجرة ما قرأ أحد لأحد في هذا الزمان بل جعلوا القرآن العظيم مكسبا ووسيلة إلى جمع الدنيا إنا لله وإنا إليه راجعون (وبعد أسطر) كما صرح به في التاتارخانية حيث قال لا معنى لهذه الوصية ولصلة القارىء بقراءته لأن هذا بمنزلة الأجرة والإجارة في ذلك باطلة وهي بدعة ولم يفعلها أحد من الخلفاء (رد المحتار:ج:6ص:56)

(এবং তিনি আরেক জায়গায় বলেন, তাবয়িনুল-মাহারিমের লিখক[7]স্পষ্ট উদ্ধৃতির মাধ্যমে এসব প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে অনেক দীর্ঘ আলোচনা করেন। তার বক্তব্যের মধ্য থেকে রয়েছে,‘‘তাজুশ্-শরীয়াহ বলেন,[8]পারিশ্রামিকের মাধ্যমে কুরআন পড়া ছওয়াবের উপযুক্ত হয় না, না মৃতব্যক্তির জন্য, না পাঠকের জন্য’’। হেদায়ার ব্যখ্যাগ্রন্থে আইনি[9]লিখেন, ‘‘দুনিয়ার জন্য কুরআন পাঠককে বাধা দেওয়া হবে, দাতা, গ্রহিতা উভয়ে গোনাহগার হবে’’। মোটকথা, আমাদের যুগে পারিশ্রমিকের মাধ্যমে কুরআনের অংশ পড়ার যে প্রচলন বিস্তার লাভ করেছে তা জায়েয নেই, কেননা এখানে পড়ার নির্দেশ এবং ছওয়াব নির্দেশদাতাকে দেওয়া রয়েছে, আর পড়া হচ্ছে অর্থের কারণে। অতএব বিশুদ্ধ নিয়্যাত না থাকার কারণে পাঠকই যখন ছওয়াব পাচ্ছে না তাহলে কী-ভাবে পাঠক নিয়োগকারীর কাছে ছওয়াব পৌছবে। যদি পারিশ্রমিক না থাকত তবে আজকাল কেউ কারো জন্য পড়ত না। বরং কুরআনকে তারা উপার্জনের বস্তু ও দুনিয়া সংগ্রহের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। ইন্না লিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন। (কয়েক লাইন পর) যেমন তাতারখানিয়ায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলেন, ‘‘এই (খতমের) অসিয়্যাতের এবং পড়ার কারণে পাঠককে দানের অসিয়্যাতের কোনো অর্থ নেই। কেননা এটা ভাড়া করার ন্যায়, আর এসবের বেলায় ভাড়া করা বাতিল এবং তা বিদ‘আত। খুলাফাদের মধ্যে কেউই এমন কর্ম করেননি।)[10]

10- وقال ايضا: ونقل العلامة الحلواني في حاشية المنتهى الحنبلي عن شيخ الإسلام تقي الدين ما نصه ولا يصح الاستئجار على القراءة وإهداؤها إلى الميت لأنه لم ينقل عن أحد من الأئمة الإذن في ذلك وقد قال العلماء إن القارىء إذا قرأ لأجل المال فلا ثواب له فأي شيء يهديه إلى الميت وإنما يصل إلى الميت العمل الصالح والاستئجار على مجرد التلاوة لم يقل به أحد من الأئمة (وبعد اسطر) وحينئذ فقد ظهر لك بطلان ما أكب عليه أهل العصر من الوصية بالختمات والتهاليل مع قطع النظر عما يحصل فيها من المنكرات التي لاينكرها إلا من طمست بصيرته وقد جمعت فيها رسالة سميتها (شفاء العليل وبل الغليل في حكم الوصية بالختمات والتهاليل) ) رد المحتار: ج:6ص:57)

(তিনি আরো বলেন, আল্লামা হুলওয়ানী ‘আল-মুনতাহাল হান্বলী’[11]এর টিকায় শায়খুল ইসলাম তাক্বী উদ্দীন থেকে বর্ণনা করেন যার ভাষ্য হলো, ‘‘পড়ার জন্য পারিশ্রমিকের উপর নিয়োগ দেওয়া এবং এর ছওয়াব মৃতব্যক্তিকে পাঠানো শুদ্ধ নয়, কেননা কোনো ইমাম থেকে এর অনুমোদন পাওয়া যায় না। বরং আলেমগণ বলেন, নিশ্চয় ক্বারী যখন সম্পদের কারণে পড়বে তখন তার কোনো ছওয়াব নেই, অতএব সে মৃতব্যক্তির কাছে কি জিনিস পাঠাবে, মৃত ব্যক্তির কাছে কেবল সৎকর্মই পৌঁছে। আর শুধুমাত্র তেলাওয়াতের উপর পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা কোনো ইমাম বলেননি’’।

(কয়েক লাইন পর) অতএব, এখন তোমার কাছে খতম এবং তাহালিলের অসিয়্যাত, যে দিকে মানুষ ঝুঁকেছে তার অন্যান্য খারাবীর দিকে দৃষ্টি দেওয়া ছাড়াই তা বাতিল হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল। দৃষ্টিশক্তি লোপ করা হয়েছে এমন ব্যক্তি ছাড়া যার খারাবী কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমি এতে একটি পুস্তিকা সংকলন করেছি যার নাম দিয়েছি ‘শিফাউল-আলীল ও বাল্লু-গালীল ফি হুকমিল-অসিয়্যাতে বিল-খাতামাতে ওয়াত্তাহালীল’[12]

এসমস্ত বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত কুরআন খতম বিদ‘আত এবং না-জায়েয। কুরআন, হাদীস এবং কল্যাণের সাক্ষ্যপ্রাপ্ত যুগে এর কোনো প্রমাণ নেই। এতে অংশ নেওয়া জায়েয নয়। এছাড়া প্রচলিত খতমে কুরআনে আরো অসংখ্য খারাবী রয়েছে যার কিছু নিম্নে তুলে ধরছি:

ঘোষণা এবং বলপূর্বক এতে লোকজনদের সমবেত করা হয়, যাকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘‘তাদাঈ’’ (ডাকাডাকি) বলা হয় যা নফল ইবাদতে নিষিদ্ধ। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সামনে কিছু মানুষ সালাতুদ্দ্বোহা জামাতের আকারে পড়ছিল, যখন তার কাছে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো তিনি তাদের আমলকে বিদ‘আত আখ্যা দিলেন। অথচ সালাতুদ্দ্বোহা একাকি পড়া প্রমাণিত। এভাবে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এক গোত্রের ব্যাপারে শুনলেন, তারা উচ্চস্বরে তাহলিল এবং দুরূদ পড়ছে, তখন তিনি তাদেরকে বিদ‘আতি বলে মসজিদ থেকে বের করে দিলেন। অথচ একাকি তাসবীহ, তাহলীল এবং দুরূদ পড়া পূণ্য ও ছওয়াবের কাজ।
ডাকার পর যদি কিছু মানুষ কুরআন খতমে না আসে তাহলে তাকে বিভিন্নভাবে তিরস্কার করা হয়। অথচ মুস্তাহাব কাজ ছাড়ার উপর তিরস্কার জায়েয নেই।
অনুপস্থিতদের ব্যাপারে মনে বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ বদ্ধমূল করা হয়।
কুরআন খতমের আয়োজকরা বেশি লোকের উপস্থিতিতে গর্ব করে।
প্রচলিত কুরআন খতম এত জরুরী মনে করা হয় যে, যদি কোনো মানুষ কুরআন খতম না করায় অথবা তার খতমের আয়োজনে মানুষ কম হয় তবে সে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
পুরো কুরআন খতম জরুরী মনে করা হয়, অথচ শরীয়তে বরকত এবং ছওয়াবের জন্য কোনো পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই। কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া যিকর আযকার, তাসবীহাত, নফল এবং সাদাকাত ইত্যাদি অন্যান্য পদ্ধতিতেও এই উদ্দেশ্য অর্জন হয়।
যদি পড়ার জন্য মানুষ কম জমা হয় তখন তার পুরো কুরআন খতমকে নিজের উপর চাপ এবং বিষের ঢোক মনে করে যে কোনভাবে তা গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয়। অথচ হাদীসে বর্ণিত হচ্ছে,

(اقرؤوا القرآن ما ائتلفت قلوبكم فإذا اختلفتم فقوموا عنه) (صحيح بخاري:ج:2ص:757)

অর্থাৎ (ঐ সময় পর্যন্ত কুরআন পড় যতক্ষন মনে বিরক্তিবোধ না হয় এবং যখন ক্লান্ত হয়ে পড় তখন ছেড়ে দাও)[13]

৮. এই অবস্থায় তাজবীদের নিয়ম কানুন, হুরূফের সিফাতের বিশুদ্ধ আদায়, গুন্নাহ, ইখফা, ইজহার এবং মদসমূহের প্রতি খেয়াল করা ব্যতীত শব্দ ও অক্ষর কেটে প্রাণ পরিত্রাণের চেষ্টা করা হয়।

প্রচলিত কুরআন খতমে এমন লোক আসে যে কুরআন পড়া জানে না। তখন সে কুরআন হাতে নিয়ে প্রত্যেক লাইনে বিসমিল্লাহ পড়ে অথবা শুধু আঙ্গুল ফিরিয়ে পারা রাখা দেয়। একে আঙ্গুল এবং বিসমিল্লাহ খতম বলা হয়, শরীয়তে যার কোনো প্রমাণ নেই। বরং এতে কুরআনের অবমাননা।
খতমের শেষ পর্যন্ত বসাকে জরুরী মনে করা হয়। তাই কোনো ব্যক্তি নিজের পারা শেষ করে কঠিন প্রয়োজন সত্বেও উঠার সাহস করে না। কেননা এটাকে অত্যন্ত দোষনীয় মনে করা হয়।
কোনো কোনো মানুষের তেলাওয়াতে সেজদার জ্ঞান থাকে না, ফলে সে সেজদার আয়াত পড়ে এবং শোনে তেলাওয়াতে সেজদা না করার কারণে নেকীর পরিবর্তে ওয়াজিব ছাড়ার গোনাহ নিজের মাথায় বহন করে।
কোনো কোনো জায়গায় কুরআন খতমের আয়োজক সবার পক্ষ থেকে চৌদ্দ সাজদা আদায় করে নেয়। এতে পাঠকদের দায়িত্ব আদায় হয় না এবং শরীয়ত বিরোধী কাজের কারণে সাজদাকারী গোনাহগার হয়।
প্রচলিত কুরআন খতমে মিঠাইর ব্যবস্থা করা হয়। ‘‘প্রচলিত নিয়ম শর্তের ন্যায়’’ মূলনীতির আলোকে এটা পাঠকদের পারিশ্রমিক, আর কুরআন পড়ার পারিশ্রমিকের দাতা, গ্রহিতা উভয় গোনাহগার। তাহলে এখানে নেকীর কী প্রত্যাশা করা যায়? আর যেখানে পাঠকের নিজের ছওয়াব হচ্ছে না, সেখানে মৃত ব্যক্তির জন্য তার ঈসাল কিভাবে হতে পারে ?
দাওয়াত বা মিঠাইকে এমন জরুরী করে রাখা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি এর ব্যবস্থা করে না তার উপর অভিশাপ ও তিরস্কারের ঝুড়ি পড়ে।
প্রচলিত কুরআন খতমের জন্য তিনদিনা, চল্লিশা ইত্যাদি বিশেষ দিন নির্দিষ্ট করা হয়। আর অনির্দিষ্ট ইবাদতের জন্য নিজের পক্ষ থেকে দিন নির্দিষ্ট করা মাকরূহ, না-জায়েয বরং বিদ‘আত।
জারীর ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

" كنا نعد الاجتماع إلى أهل الميت وصنعهم الطعام من النياحة ".

‘‘মৃতব্যক্তির পরিবারে সমবেত হওয়া এবং তারা খাবারের আয়োজন করাকে আমরা ‘নাওহা’[14](বিলাপ) গণ্য করতাম’’ আর বিলাপ করা হারাম।

প্রচলিত কুরআন খতমে অংশগ্রহণকারী এবং যিনি অংশগ্রহণ করান সবার উদ্দেশ্য থাকে লোক দেখানো। লোকদেখানোর কারণে মানুষের বড় বড় আমল নষ্ট হয়ে যায়।

হাদীসে রয়েছে লোক দেখানো আমলকারীর আমল এমন ধ্বংস হয় যেমন আগুন লাকড়ি খেয়ে ফেলে[15]এবং আল্লাহর কাছে এমন আমল প্রত্যাখ্যাত। অতএব যে আমলটি আল্লাহর জন্য করার ছিল, বরকত এবং ছওয়াব পৌছা উদ্দেশ্য ছিল, লোকদেখানোর কারণে সমস্ত আমলে আগুন লেগে গেছে। ছওয়াব কি মিলবে? উল্টো লোকদেখানোর আযাব মাথার উপর আসলো।এই সমস্ত খারাবী শরীয়ত এবং সুন্নাত থেকে চেহারা ফিরিয়ে নেওয়ার ফলাফল। এর বিপরীত যদি শরীয়তের পদ্ধতি অবলম্বন করা হত তাহলে আরাম হত। এত কষ্ট উঠাতে হত না। ইখলাসের সহিত ও আল্লাহর জন্য হত। যার বদলে পাঠক ছওয়াব পেত। মৃত ব্যক্তির কাছেও ছওয়াব পৌছত। লোক দেখানো মারাত্মক গোনাহও মাথায় নিতে হত না।

[1] ‘আল-মুনইয়াহ’ অর্থাৎ ‘মুনইয়াতুল মুসাল্লী’, এই কিতাবের দু্ই ব্যাখ্যাকার দ্বারা উদ্দেশ্য সম্ভবত, ‘গুনইয়াতুল মুতামাল্লী’ এবং ‘আল-ক্বুনইয়া’ কিতাবদ্বয়ের রচয়িতা। দুটি কিতাবই ‘মুনইয়াতুল মুসাল্লী’র শরাহ। কিতাব দুটি দুর্লভ ও সম্মুখে না থাকায় এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারিনি। (সংকলক)

[2] ইমাম নুরুদ্দীন আলী ইব্নু গানিম আল-মাক্দিসী আল-হানাফী। মৃত্যু:১০০৪ হিজরী (কাশফুয যুনুন:১/৮৪০)। সালাতুর রাগাইব নামে সালাতের বিদ‘আত সম্পর্কে তার লিখিত কিতাবের নাম, ردع الراغب عن الجمع في صلاة الرغائب

[3] রাদ্দুল মুহ্তার, কিতাবুস সালাত, বিতর ও নফল অধ্যায়, ২/২৬

[4] ইবনে মাজাহ, সনদ সহীহ, মৃত ব্যক্তির পরিবারে সমবেত হওয়া এবং খাবারের আয়োজন করা নিষেধ অনুচ্ছেদ, হাদীস নং ১৬১২, ইবনে মাজাহ এর হাদীসটির শব্দ হলো:

كنا نرى الاجتماع إلى أهل الميت وصنعة الطعام من النياحة

মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং:৬৯০৫, মুসনাদে আহমদের শব্দ:

كُنَّا نَعُدُّ الِاجْتِمَاعَ إِلَى أَهْلِ الْمَيِّتِ وَصَنِيعَةَ الطَّعَامِ بَعْدَ دَفْنِهِ مِنْ النِّيَاحَةِ

[5] সম্ভবত আবুল ক্বাসিম আল-কুশাইরী নাইসাবুরী রচিত ‘কিতাবুল মি‘রাজ’ উদ্দেশ্য।

[6] রাদ্দুল মুহতার, সালাত অধ্যায়, সালাতুল-জানাযা অনুচ্ছেদ, ২/২৪০।

[7] সিনানুদ্দীন ইউসুফ আল-আমাসী আল-হানাফী, আল-মক্কী, মৃত্যু: ১০০০ হিজরীর পাশাপাশি।

[8] আল-ইমাম তাজুশ-শরীয়াহ, আহমদ ইবন উবাইদুল্লাহ আল-মাহবুবী আল-হানাফী উমর ইবন সাদরুশ-শরীয়াহ আল-আওয়াল, মৃত্যু:৬৭২ হিজরী। তার লিখিত হেদায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘নিহায়াতুল কিফায়াহ ফি দিরায়াতিল হিদায়াহ। (কাশফুয-যুনুন ২/২০২২)

[9] প্রখ্যাত হানাফী মুহাদ্দীস আবু মুহাম্মদ আল্লামা বদরুদ্দীন আল-আইনি। ৭৬২৮৫৫ – হিজরী১৩৬১ - -১৪৫১ ঈসায়ী। তার লিখিত হেদায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আল-বিনায়াহ’। দেখুন, বর্ণিত কিতাবের কারাহিয়্যাহ অধ্যায়, মাসাঈলু মুতাফার্রিক্বাহ, ১১/২৬৭।

[10] রাদ্দুল-মুহতার, কিতাবুল ইজারাহ, মাতলাবুন ফিল-ইসতিজার আলাত্-ত্বা‘আত, : ৬/৫৬।

[11] ফিক্বহে হাম্বলীতে রচিত কিতাব, মূল নাম ‘মুনতাহাল-ইরাদাত ফিল জাম্‘ঈ বাইনাল মুক্বান্না‘ঈ ওয়াত্-তানক্বীহি ওয়ায্-যিয়দাত’, লেখক, তাক্বীউদ্দীন মুহাম্মদ ইবন আহমদ ইবন আব্দুল আযিয ইবনুন্-নাজ্জার আল-ফুতুহী আল-মিসরী, মৃত্যু: ৯৭২ হিজরী।

[12] রাদ্দুল মুহতার, প্রাগুক্ত অধ্যায়:৬/৫৭।

[13] সহীহুল বুখারী, অধ্যায়: কুরআনের ফযিলত সমূহ, অনুচ্ছে: যতক্ষন মন চায় ততক্ষন কুরআন তেলাওয়াত করা। নং: ৪৭৭৩।

[14] ‘নাওহা’ বা ‘নিয়াহাহ’, অর্থাৎ বিলাপ করে মৃত ব্যক্তির উপর ক্রন্দন করা। ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগে কেউ মারা গেলে বিলাপ করে ক্রন্দনের প্রচলন ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কর্মকে জাহেলী কর্ম আখ্যা দেন এবং তা হারাম ঘোষণা করেন। দেখুন, বুখারী, ‘মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ মাকরূহ অধ্যায়’। সহীহ মুসলিম, নিয়াহার উপর কঠোরতা অধ্যায়। বুখারীর একাধিক অধ্যায়ে এ বিষয় সংক্রান্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

[15] লোকদেখানো আমলকে শরয়ী পরিভাষায় ‘রিয়া’ বলা হয়। কুরআন হাদীস উভয়ের মাধ্যমে ‘রিয়া’ হারাম প্রমাণিত। হাদীসে ‘রিয়া’কে শিরকে আসগর বা ছোট শিরক গণ্য করা হয়েছে। ‘রিয়া’ হারাম বা কবীরা গোনাহের অন্যতম এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে লেখক এখানে হাদীসে রয়েছে বলে যে কথা উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ ‘‘লোক দেখানো আমলকারীর আমল এমন ধ্বংস হয় যেমন আগুন লাকড়ি খেয়ে ফেলে’’ এই মর্মের কোনো হাদীস রয়েছে বলে অবগত হতে পারিনি। (সংকলক)

ঈসালে ছওয়াবের সঠিক পদ্ধতি এই যে, মৌখিক এবং শারীরিক ইবাদতের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ ঘরে একাকীভাবে যে ইবাদত করে, নফল নামায পড়ে, নফল রোজা রাখে, তাসবীহ আদায় করে, তেলাওয়াত করে, নফল হজ্ব বা উমরা করে, তাওয়াফ করে এগুলোতে শুধু এই নিয়্যাত করে নিবে যে, এর ছওয়াবটুকু আমাদের অমুক দোস্তের কাছে পৌঁছুক। তা পৌঁছে যাবে। এটাই হচ্ছে ঈসালে সওয়াব। যে ছওয়াবটুকু তোমার নিজের পাবার কথা তা তোমার জন্য অর্জিত হয়ে যাবে এবং যে সমস্ত লোকদের নিয়্যাত করা হয়েছে তারাও এর পুরো ছওয়াব পেয়ে যাবে।[1]

আর্থিক সাদাকা খায়রাতের সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো, নিজের সামর্থানুযায়ী নগদ অর্থ কোনো কল্যাণমূলক কাজে লাগিয়ে দিবে অথবা কোনো মিসকিনকে দিয়ে দিবে।

এই পদ্ধতি এ জন্য উত্তম যে, এতে মিসকিন নিজের প্রয়োজন পুরা করতে পারে। যদি আজ তার কোনো প্রয়োজন না হয় তবে কালকের জন্য রাখতে পারে। তা ছাড়া এই ব্যবস্থাটি লোকদেখানো হতে মুক্ত। হাদীসে গোপনে সাদাকাকারীর এই ফযিলত বর্ণিত হয়েছে যে, এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ কিয়ামত দিবসে নিজের রহমতের ছায়ায় জায়গা দিবেন, যখন আর কোনো ছায়া থাকবে না এবং গরমের কারণে মানুষ ঘামে ডুবে যাবে।

ফযিলতের দিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির সাদাকা হচ্ছে, মিসকিনের প্রয়োজন অনুসারে তাকে সাদাকা করবে। অর্থাৎ প্রয়োজন দেখে তা পুরা করবে।

ঘর ও দোকানের বরকতের জন্যও মালিক নিজে উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো অবলম্বন করবে।

والله سبحانه وتعالى أعلم

১৪ রবিউল আওয়াল ১৪১৭ হিজরী।

পাঠক, এই হলো উনার বক্তব্য। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, উনার লেখায় অসংখ্য কিতাব ও ফকীহের বক্তব্য ও তথ্য রয়েছে। এই লেখা পড়ার পর আশা করি সত্যসন্ধানী আলেমের জন্য বিষয়টি বুঝতে কোনো সমস্যা পেতে হবে না। একমাত্র পেটপূজারী আলেম ছাড়া কেউই হিলার বাহানা তালাশ করে উনার লিখার বিরুদ্ধে কলম ধরবেন না। শরীয়তে বৈধ বা হালাল থাকা এক কথা, আর বৈধ বানানো আরেক কথা। কুরআন হাদীসে কোনো জিনিসের বৈধতা থাকা এক কথা, কুরআন হাদীস দিয়ে বৈধ বানানো আরেক কথা। তবে প্রথমটি আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলেমদের গুণ। আর দ্বিতীয়টি গুমরাহ পেটপূজারী আলেমদের গুণ। বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য একটি উপমা পেশ করছি। যেমন ধরুন, রাসূল আলিমুল গাইব নন বিষয়টি কুরআন ও হাদীসে দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যিনি বলছেন রাসূল আলিমুল গাইব নন, তার দলীল কুরআন ও হাদীসের একাধিক জায়গায় রয়েছে। পক্ষান্তরে যে আলেম দাবী করছেন রাসূল আলিমুল গাইব, তিনি কুরআন হাদীস থেকেই তার মতের স্বপক্ষে দলীল দিচ্ছেন। তবে তার দাবীর পক্ষে কোনো দলীল কুরআন বা হাদীসে নেই। তিনি কিছু দ্ব্যর্থবোধক আয়াত ও হাদীসকে তার মতের পক্ষে দলীল বানাচ্ছেন। এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের আলেম ছাড়া কেউই প্রচলিত খতমে কুরআনের স্বপক্ষে ওকালতি করতে পারেন না, কেননা এসবের অস্তিত্ব কুরআন, হাদীস, সাহাবা জীবনে নেই, এমনকি খাইরুল কুরুন তথা সোনালী প্রজন্ম (রাসূল, সাহাবা ও তাবে‘ঈ) এর কোনো যুগেও এর অস্তিত্ব খোঁজে পাবেন না।

প্রচলিত খতমের অস্তিত্ব খাইরুল কুরুনে না থাকায় বিষয়টি বিদ‘আত হওয়ার সাথে সাথে লেখক আরো অনেক খারাবী তুলে ধরেছেন, যা উনার অভিজ্ঞতার আলোকে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে উল্লেখিত কারণ ছাড়াও আরো যে সমস্ত খারাবী রয়েছে তার কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরছি। এই অভিজ্ঞতা সবার নাও থাকতে পারে। আমি অধমের কাছে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে তার কয়েকটি উল্লেখ করব।

  1. পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ সৃষ্টি। মনের হিংসার জ্বালা প্রকাশ্যে রুপ নিতে অনেকের বেলায় দেখা গেছে। যেমন, একজন কোথাও দশজন নিয়ে যাওয়ার কথা। বাস্তবতা হলো, দশজন হলে এক প্রতিষ্ঠানের সবাইকে খতমের তালিকায় রাখা সম্ভব নয়। এ থেকেই হিংসা ও সমালোচনার সুত্রপাত। যা খতমের দু একদিন পর্যন্ত বা আরো বেশি চলতে থাকে।
  2. অন্যের মনে জ্বালা সৃষ্টির জন্য অযথা ঠাট্টাস্বরূপ খতমের কথা বলা। অথচ হাদীসের দৃষ্টিতে মিথ্যা বলা কাজে হোক বা ঠাট্টায় হোক সর্বাবস্থায় হারাম। সাধারণ নিমণ শ্রেণির উস্তাদ নয় বরং অনেক শ্রদ্ধাভাজন আলেম যারা দাওরায়ে হাদীসে পড়ান তাদের অনেকের কাছ থেকেও এ সব আচরণ পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
  3. মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া। যেমন অনেক সময় খতম না করেই খতমের আয়োজককে মিথ্যা বলা।
  4. কুরআনের সাথে ব্যবসায়িক পণ্যের মত লেনদেনের আচরণ করা এবং কুরআন নিয়ে বেয়াদবীমূলক কথা বলা। যেমন, অহরহ একথা বলতে শুনা গেছে, সিলেটি ভাষায় ‘যেলা পয়সা ওলা খতম’ অর্থাৎ টাকা হিসেবে খতমের মান নির্ণয় করা হয়। অনেককে আগেই ‘কয়টেকি খতম’ অর্থাৎ কত টাকার খতম, একথা বলতে শুনা যায়। এভাবে টাকার উপর কুরআন পড়ার মান নির্ণয় করা কুরআনের সাথে কতটুকু বেয়াদবী? তা পাঠক নিজেই বলুন। অসতর্কতায় আমার মুখ থেকেও দু-একদিন এমন কথা বের হয়েছে। আল্লাহর কাছে তওবা করেছি। আবারো করছি, তিনি যেন আমাকে মাফ করেন।
  5. কুরআন সামনে নিয়ে হাসি, তামাশা, গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে তেলাওয়াত করা। আয়োজক সামনে থাকলে তার ভয়ে একটু মনোযোগ দিয়ে পড়া। এ থেকে স্পষ্ট যে, টাকাই প্রচলিত খতমের মূল টার্গেট।
  6. টাকাই যে মূল টার্গেট তা সবার মনে জানা রয়েছে। সবার আচরণে একথা স্পষ্ট। মূল টার্গেট টাকা থাকাবস্থায় আল্লাহর কাছে এসব খতমের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, আলেম বলতেই একথা জানেন। একথা জানা থাকা সত্বেও নিজের পেট পালার তাগিদে দীন সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাকে ধোঁকা দেয়া। তাকে রাসূলের শিক্ষার আদেশ না দিয়ে খতমের কথা বলা, অথবা নিজ থেকে না বললেও তাকে তার অজ্ঞতার উপর রাখা। সঠিক সুন্নাতের দিশা না দেওয়া। অথচ সঠিক ইলম প্রকাশের সুযোগ থাকা সত্বে তা গোপন রাখা অবৈধ। হাদীসে এর উপর ধমকি এসেছে।

এছাড়া সমাজিকভাবে আরো অনেক বিষয় রয়েছে যা আলেমদের জন্য লজ্জাজনক ও তাদের মান সম্মানে আঘাত, এই খতমকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। আহসানুল ফাতওয়ার লিখাটি অনুবাদ করার পর এ বিষয়ে নিজ থেকে কিছু লিখার প্রয়োজন ছিল না। যা নিজেই পূর্বে উল্লেখ করেছি, তথাপি দু-একটি কথা না লিখে পারলাম না। আল্লাহ প্রথমে আমাকে এবং আমাদের সবাইকে হেদায়াতের উপর পরিচালিত করুন। সহীহ সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনার তওফীক দান করুন। আমীন।

>
[1] আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ ঈসালে ছওয়াবের বেলায় দুই ভাগে বিভক্ত। একদল কুরআনের আয়াত,‘‘وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى ’’ অর্থাৎ: আর মানুষের জন্য তার চেষ্টা ব্যতীত কোনো কিছু নেই, (সূরা নাজম:৩৯) এই মর্মের আয়াত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস,

"إذا مات الإنسان انقطع عمله إلا من ثلاث صدقة جارية وعلم ينتفع به وولد صالح يدعو له"

‘‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তাঁর তিনটি আমল ব্যতীত সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। সাদাকায়ে জারিয়াহ, যে ইলম দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং নেক সন্তান যে তার জন্য দু‘আ করে।’’ (তিরমিযী, হাদীস সহীহ, ওয়াক্বফ অনুচ্ছেদ, নং:১৩৭৬) এই হাদীসের আলোকে তারা বলেন: হাদীসে উল্লেখিত তিন বস্তু ব্যতীত অন্য কিছুর ঈসাল হয় না। কেননা; হাদীসে তিন বস্তু ছাড়া সব আ‘মাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা এসেছে। আর এ তিনটি মূলত তার নিজের চেষ্টার ফসল। সুতরাং এই হাদীস আর আয়াতে কোনো বিরোধ নেই। তবে সাদাকা যেহেতু শারীরিক ইবাদত নয়, জীবিত ব্যক্তিকে তা দেওয়া যায়, তার পক্ষ থেকে অন্যকে দেওয়া যায়, মৃত্যুর পরও তার পক্ষ থেকে দেওয়া যাবে। কিন্তু শারীরিক ইবাদত কাউকে দেওয়া যায় না তাই তার ঈসাল ও নেই। তবে শারীরিক কিছু ইবাদত যার ঈসাল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সেগুলো মানসুস হওয়ার কারণে তা এই কায়দা থেকে মুসতাসনা বা ব্যতিক্রম থাকবে। এই দল আলেমদের মতে কুরআন তেলাওয়াত যেহেতু একটি শারীরিক ইবাদত তাই তার ঈসালই হবে না, কেননা এব্যাপারে কোনো নস নেই। আর ইবাদতে বিষয় গাইরে মা‘কুল, তাই আমরা তাকে অন্য ইবাদতের উপর ক্বিয়াস করতে পারি না। আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অপরদল মনে করেন, যে কোনো ইবাদতের ঈসাল হতে পারে। আমাদের লেখক এমতের প্রবক্তা হিসেবে কুরআন তেলাওয়াতের ঈসালের সঠিক পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন।

ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী। আল্লাহর নির্দেশের পূর্বে তিনি তাঁর গোত্র থেকে হিজরত করে চলে যান। আল্লাহর কাছে তাঁর এ কাজ অপছন্দনীয় হলে ইউনুস আলাইহিস সালামকে মাছের পেটে যেতে হয়। যার বিবরণ কুরআন পাকে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। কমবেশ আমাদের সবারই ঘটনাটি জানা আছে। বিপদে পড়ে যে কেউ নিজের গোনাহের স্বীকারোক্তি বা তওবা করে আন্তরিকভাবে আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ তাঁর ডাক শুনেন। ইউনুস আলাইহিস সালামের মাছের পেটে পড়ার বিপদ থেকে উদ্ধারের এই কাহিনিটি থেকে আল্লাহ আমাদেরকে এই খবরটি দেন। উদ্ধারের কাহিনিটি আল্লাহ যেভাবে উল্লেখ করেন তাতে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি সাল্লামকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলা কয়েকজন নবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন,

﴿ وَذَا النُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَن لا إِلَهَ إِلا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُؤْمِنِينَ ﴾ ( سورة الأنبياء: 87-88 )

‘‘আর আপনি মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন, তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাকে আটকাবো না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করে বললেন, তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তুমি দোষমুক্ত, নিশ্চয় আমি গোনাহগার। অতঃপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম। এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনিভাবে মুমিনদের মুক্তি দিয়ে থাকি’’।[1]

এই ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? একটু চিন্তা করলেই যে কেউ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে। অর্থাৎ যে কোনো বিপদে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনই একজন মুমিনের করণীয়। সকাতরে আল্লাহকে ডাকলে তিনি তাঁর ডাকে অবশ্যই সাড়া দিবেন।

এবার আমরা দেখি হাদীসে এ দো‘আর ব্যাপারে আমাদের জন্য কী দিকনির্দেশনা রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

" دعوة ذي النون إذا دعا وهو في بطن الحوت لا إله إلا أنت سبحانك إني كنت من الظالمين فإنه لم يدع بها رجل مسلم في شيء قط إلا استجاب الله له ". ( سنن الترمذي،كتاب الدعوات عن رسول الله صلى الله عليه و سلم، باب 82 ، رقم: 3505، مسند احمد، مسند سعد بن أبي وقاص، رقم: 1462)

‘‘মাছওয়ালা যখন মাছের পেটে থাকাবস্থায় দো‘আ করেছিলেন তখন তার দো‘আ ছিল,

لا إِلَهَ إِلا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

(তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তুমি দোষমুক্ত, নিশ্চয় আমি গোনাহগার) অতএব যখনই কোনো মুসলিম ব্যক্তি কোনো বিষয়ে এর মাধ্যমে দো‘আ করেছে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।’’[2]

কুরআন হাদীসের শিক্ষা থেকে যে বিষয়টি উপলব্ধি হয় তা অত্যন্ত স্পষ্ট। সাধারণ ব্যক্তিও চিন্তা করলে বিষয়টি বুঝতে পারবেন। কুরআন হাদীসের শিক্ষা থেকে আমরা বুঝলাম, যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো বিপদে পড়লে এই দো‘আটি করতে পারে। এই দো‘আ করলে আল্লাহ তাকে বিপদ মুক্ত করবেন বলে আমরা পূর্ণ আশাবাদী হতে পারি। কিন্তু কে বা কারা প্রথমে কুরআন হাদীসের এই শিক্ষার পরিবর্তন ঘটিয়ে খতমে ইউনুস নামে খতম আবিষ্কার করেছে তার ইতিহাস আমাদের কাছে না থাকলেও অভিজ্ঞতার নামে আমরা কুরআন হাদীসের শিক্ষার বিপরীত চলছি। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাকে পূঁজি করে আমাদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার প্রচার না করা কতটুকু আমানতদারী তা প্রশ্নযোগ্য। বিবেকের কাছে কি আমরা কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হই না? না কি পেটের তাগিদে আমাদের বিবেকই নষ্ট হয়ে গেছে?

এই খতমের বিবরণ যেভাবে দেওয়া হয়েছে:

‘‘কঠিন বিপদ মামলা-মোকাদ্দমা ও সঙ্কটের সময় এই দো‘আ সোয়া লক্ষ বার পড়িবে। প্রত্যেক একশতবার পড়া হইলে শরীর বা মুখে পানি দিবে। পাক অবস্থায় পাক বিছানায় বসিয়া কেবলামুখী হইয়া পড়িবে। ৩,৭ কিংবা ৪০ দিনে শেষ করিবে। মাছের পেটের ভিতর অন্ধকারের এই দোয়া জন্মলাভ করিয়াছে বলিয়া অন্ধকারে বসিয়া পড়িলে আরও সত্বর ফল লাভ হয়। খতম শেষ হইলে একবার এই আয়াত পড়িবেঃ

( فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِينَ (الانبياء: 88) )

উচ্চারণঃ ফাসতাজাবনা লাহু ওয়া নাজ্জাইনাহু মিনাল গাম্মি ওয়া কাযালিকা নুনজিল মুমিনীন। (১৭ পারা, সূরা আম্বিয়া, আয়াত:৮৮)

অর্থঃ ‘‘তৎপর আমি তাঁহার (হযরত ইউনুস নবীর) দোয়া কবুল করিয়াছিলাম এবং তাঁহাকে কঠিন বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছিলাম এবং এইরূপে আমি বিশ্বাসীগণকে উদ্ধার করিয়া থাকি।’’ এই তাদবীরকে খতমে ইউনুস বলা হয়। ইহা প্রত্যেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী ও অব্যর্থ ফলপদ বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে।’’[3]

এখানে আমরা কুরআন হাদীসের শিক্ষার সাথে দুই ধরণের বৈপরীত্য দেখতে পাই।

এক: নির্দিষ্ট সংখ্যার ব্যাপারটি। যা কুরআন হাদীসের শিক্ষার বিপরীত।

দুই: বিপদে যিনি পড়েন তিনি আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করে দো‘আটি না পড়ে অন্যকে দিয়ে পড়ানো। যার কোনো শিক্ষা কুরআন বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকে আমরা পাই না। সবচেয়ে হাসির ব্যাপার হলো, বিপদে পড়লাম আমি, আর আরেকজনকে এনে তাকে দিয়ে দো‘আ পড়াচ্ছি, সে তার দো‘আয় বলছে ‘নিশ্চয় আমি গোনাহগার’ আমি বিপদে পড়ে অন্যকে গোনাহগার বলানোর মাধ্যমে আমার নিজের কী লাভ?

একটু ভেবে দেখলাম না। একদিন একজন সাধারণ মানুষ আমাকে কথাটি বলে হাসিয়ে দিয়েছেন। আলেম না হয়েও তার এই উপলব্ধি দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম এবং নিজেকে ধিক্কার দিলাম এই বলে যে, বুঝেও কেন এতে জড়িত রয়েছি। আল্লাহ আমাকে মাফ করুন।

এভাবে এসব খতমের মাধ্যমে সমাজে ‘পুরোহিততন্ত্র’ চালু হয়েছে। ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে সুন্নাত সম্মত দো‘আ পড়ে মনের আবেগ নিয়ে আল্লাহর কাছে কাঁদবে এবং বিপদমুক্তি প্রার্থনা করবে। নেককার মানুষের কাছে দো‘আ চাওয়া যাবে। তিনি তার মত করে তার জন্য দো‘আ করবেন।

অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে বৈধ করা

এসব খতম বৈধ করার স্বার্থে অভিজ্ঞতার কথা বলে ফতোয়া চালিয়ে দিতে দেখা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার বিপরীত কার অভিজ্ঞতা বা কার কথার এত মূল্যায়ন যা রাসূলের শিক্ষাকেও হার মানায়? আর যিনি এ নির্দিষ্ট সংখ্যার অভিজ্ঞতার কথা বললেন, তিনি নিজে পড়ার কথা বললেন, না কি অন্যকে দিয়ে পড়ানোর? যাই হোক এর কোনটিই যেহেতেু রাসূলের শিক্ষা নয় তাই আমরা এ সবের পিছনে পড়ার প্রয়োজন বোধ করি না। এ সব কথাবার্তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে করে শরীয়ত পরিবর্তন হয় বলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটি সহজ উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে বলে আশা করছি।

যেমন ধরুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের আলোকে আমরা জানি, সাদাকা বা দানের মাধ্যমে বালা মুসিবত দূর হয়। এবার মনে করুন কোনো ব্যক্তি কোনো এক তারিখের নির্দিষ্ট সময়ে, যেমন সে শাওয়াল মাসের ৬ তারিখ শনিবার বিকাল ৫টার সময় ১০ টাকা দান করল। আল্লাহর অনুগ্রহে তার একটি মুসিবত দূর হলো। আমরা বলতে পারি এই সাদাকার ওসীলায় হয়ত আল্লাহ তাঁর মুসিবত দূর করেছেন। কেননা সাদাকায় মুসিবত দূর হয় বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে আমরা পেয়েছি। এমন কয়েকবার হলে সে বলতে পারে, অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে সাদাকায় মুসিবত দূর হয়। কিন্তু এ দানকারী লোকটি যদি বলে, অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা গেছে ১০ টাকা দান করলে মুসিবত দূর হয় তাই সবাই দশ টাকা দান করাকে আমল বানান। আরেকটু এগিয়ে যদি বলে, শাওয়াল মাসে দশ টাকা দান করলে মুসিবত দূর হয়, আরো বাড়িয়ে যেমন, শাওয়াল মাসের ৬ তারিখ দশ টাকা দান করলে মুসিবত দূর হয়, আরেকটু এগিয়ে যেমন, শাওয়াল মাসের ৬ তারিখ শনিবার বিকাল ৫টার সময় ১০ টাকা দান করলে মুসিবত দূর হয়। তাই সবাই এভাবে আমল করুন। তাঁর এই কথাগুলো একেবারে মুর্খ ছাড়া কেউ গ্রহণ করবেন বলে জানি না। যদিও সে তার আমলের ফলাফল এভাবে পেয়েছে। কিন্তু তার এই অনুভূতি রাসূলের শিক্ষা বিবর্জিত।

এতে শরীয়তের মূল শিক্ষা পরিবর্তন হয়, তাই তার অনুভূতি কখনো গ্রহণ করা যায় না বা অভিজ্ঞতার নাম দিয়ে এ ধরণের আমল শুরু করা যায় না। এবার এর আলোকে আমরা ‘খতমে ইউনুস’ নামের খতমের কথাটি চিন্তা করি। আশাকরি এসবের অসারতা বুঝতে আর কারো কোনো দ্বিধা থাকবে না।এতো হলো খতমের নামে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন থেকেই খতমকে কেন্দ্র করে অন্যান্য খারাবী ও নাজায়েযের সুচনা। যে কোনো সুন্নাতকেই তার স্বাভাবিক অবস্থা তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমলের রূপরেখা থেকে সরিয়ে দিলে সুন্নাত নিমজ্জিত হওয়ার সাথে সাথে আরো অনেক নাজায়েয যোগ হয়। যার অনেকটা আমরা ইতোপূর্বে খতমে কুরআনের শেষে উল্লেখ করেছি। অধিক সংখ্যক পড়া নিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, খতম পাঠকারী হুজুর ও খতমের আয়োজকের মাঝে সন্দেহ, মন কষাকষির সৃষ্টি হওয়া, টাকার পরিমাণ হিসেবে খতমের সংখ্যায় কমবেশ করা, আলেমদের সাথে জাহেলের বেয়াদবীমূলক আচরণ ইত্যাদি। টাকার স্বার্থে বুঝে না বোঝার ভান করে অনেক শ্রদ্ধাভাজন আলেমকে তাঁর সম্মান বা নিজ অবস্থানের অনেক নিচে নামতে দেখা যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ সব থেকে পরিত্রাণ দান করুন এবং হুবহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীক্বার উপর চলার তওফিক দান করুন।

>
[1] সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭-৮৮।

[2] তিরমিযী, সুনান, হাদীস সহীহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু‘আ অধ্যায়, ৮২ নং অনুচ্ছেদ, হাদীস নং: ৩৫০৫, আলবানী, তিরমিযির সহীহ ও দয়ীফ, ৮/৫, মুসনাদে আহমদ, সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্বাসের হাদীস, নং:১৪৬২।

[3] নেয়ামুল কুরআন, মৌলবী শামছুল হুদা, রহমানিয়া লাইব্রেরী, একাদশ সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১২০।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »