শুরুতেই একটি কথা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলা রাখা ভালো। এটি যেহেতু বিকৃত মস্তিষ্ক নাস্তিকদের অপতৎপরতা বিষয়ে প্রামাণিক প্রবন্ধ তাই এখানে নাস্তিকদের লেখার নানা উদ্ধৃতি থাকবে। নাস্তিকরা এমন কিছু কথা বলেছেন, এমন অরুচিকর কথা লিখেছেন যা আসলে কোনো রুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে পড়া বা উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। বক্ষমাণ গ্রন্থকে প্রমাণসিদ্ধ করার স্বার্থে উদ্ধৃতি হিসেবে তাদের এমন অনেক অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য ও অশ্লীল শব্দ তুলে ধরতে হয়েছে। আশা করি সহৃদয় পাঠকগণ বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
নাস্তিক্যবাদ (ইংরেজি ভাষায় : Atheism; অন্যান্য নাম : নিরীশ্বরবাদ, নাস্তিকতাবাদ) একটি দর্শনের নাম যাতে ঈশ্বর বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ ভৌত ও প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। আস্তিক্যবাদ বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয় বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাস খণ্ডন নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। [বাংলা ইউকিপিডিয়া]
ইংরেজি ‘এইথিজম’ (Atheism) শব্দের অর্থ হল নাস্তিক্য বা নিরীশ্বরবাদ। এইথিজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। দিনদিনমুক্ত চিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩% মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয় এবং ১১.৯% মানুষ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না। জপানের৬৪% থকে ৬৫% নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮% এবংইউরোপিয় ইউনিয়নে৬% (ইতালি) থেকে শুরু করে ৮৫% (সুইডেন) পর্যন্ত।
পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণভাবে ধর্মহীন বা পারলৌকিক বিষয়সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তুবৌদ্ধ ধর্মেরমত যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু ধর্মের দর্শন,যুক্তিবাদ, মানবতাবাদএবংপ্রকৃতিবাদেবিশ্বাস করে।
নাস্তিকরা কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা বিশেষ কোনো আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ, যে কোনো মতাদর্শের সমর্থক হতে পারে, নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গায়ই, তা হলো, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অবিশ্বাস করা। [বাংলা মুক্ত বিশ্বকোষ ইউকিপিডিয়া]
ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশে নাস্তিকের সংখ্যা বরাবরই কম ছিল। এরা সংখ্যায় কম হলেও এদের প্রচার ও বুদ্ধিবৃত্তির বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপরীতে অবস্থান নেবার দুঃসাহস দেখাতে পারছে। মূলত গেল শতাব্দীর শুরুভাগে রাশিয়ার কমিউনিজমে বিশ্বাসীরা এ দেশে নাস্তিকতার প্রসার ঘটিয়েছে। সারাবিশ্বে সমাজতন্ত্রের জয়জয়কারের সঙ্গে হাত ধরে সেক্যুলারিজম আর সেক্যুলারিজমের গর্ভ থেকেই নাস্তিক্যবাদ বা এইথিজমের উদ্ভব ও আগমন। সমাজতন্ত্রের যৌবনে এরা প্রধানত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তাদের মতবাদ প্রচার করতে শুরু করে।
সমস্যা জর্জরিত সদ্য স্বাধীন অভাবী বাংলাদেশে এরা সহজেই তাদের সাম্যের মুখরোচক শ্লোগানে তরুণ সমাজকে মুগ্ধ করে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর এরা পরিবর্তিত বাস্তবতায় নিজেদের ভোল পাল্টাতে থাকলেও সাবেকি ধর্মবিদ্বেষ তথা ইসলামবিদ্বেষের ধারা ঠিকই বজায় রাখে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত পাকিস্তান রাষ্ট্র ব্যর্থ হওয়ায় এরা সেটাকে ধর্মের বিরোধিতায় কাজে লাগায়। সিংহভাগ ঈমানদার নারী-পুরুষের আত্মোৎসর্গের বদৌলতে পাওয়া অত্যাচারী ও অবিবেচক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়কে এরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে চালাবার অপকৌশল গ্রহণ করে।
স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদের প্রকাশ্য রূপ দেখা দেয়। ১৯৭৩ সালে তরুণ কবি দাউদ হায়দার একটি কবিতায় অত্যন্ত নোংরা ভাষায় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিশুখ্রিস্ট ও গৌতমবুদ্ধকে নিয়ে ন্যাক্কারজনক কবিতা লেখেন। যে কয়টি লাইনের জন্য তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তা ছিল এমন :
‘অদ্ভুত আলখেল্লা পরিহিত মিথ্যুক বুদ্ধ
বুধি বৃক্ষতলে যিশু ভন্ড শয়তান,
মোহাম্মদ আরেক বদমাশ
চোখে মুখে রাজনীতির ছাপ।’
সংবাদের সাহিত্যপাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ। সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে পুরো মুসলিম জাহান। বাংলাদেশ সরকার তখন চায় নি আন্তর্জাতিকভাবে মুসলিম সরকারদের সাহায্য হারাতে। ১৯৭৩ সালে বাধ্য হয়ে সরকার তাকে গ্রেফতার করে। কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়া হয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ’৭৪-এর ২১মে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশে সুকৌশলে কলকাতাগামী একটি ফ্লাইটে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই ফ্লাইটে সে ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তাঁর কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ।) কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’
’৭৬-এ দাউদ হায়দার তার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে জমা দিলে তা আটক করা হয়। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। তার পাসপোর্ট ফেরতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকারও।
কলকাতা ছিল তার কাছে একদম অচেনা বিদেশে যেখানে কাউকেই চিনতেন না। তিনি দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে কাঁদছিলেন। কলকাতায় তিনি প্রথম গৌরকিশোর ঘোষের কাছে আশ্রয় পান। তিনি সেখানে এক মাসের মতো ছিলেন। তিনি সেখানে লেখালেখি শুরু করেন। কলকাতার কঠিন বাস্তবতার মাঝে তিনি দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৬ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ভারত থেকেও তাকে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়।
পাসপোর্ট ছাড়া অন্য আরেকটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসে সমস্যা দেখা দেয়। ভারত সরকার দায়িত্ব নিতে চায় না নির্বাসিত কবির। তিনি অন্য কোনো দেশেও যেতে পারেন না পাসপোর্টের অভাবে। এমতাবস্থায় তার পাশে এসে দাঁড়ান কবিবন্ধু নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস। তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ শে জুলাই ১৯৮৭ এর কোনো এক ভোরে জার্মানির বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান দাউদ হায়দার। জাতিসংঘের বিশেষ ‘ট্রাভেল ডকুমেন্টস’ নিয়ে এখন ঘুরছেন দেশান্তরে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
তিনি প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানিজ ও স্প্যানিশ ভাষায়। এছাড়া সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত হওয়া তার আত্মজৈবনিক লেখা ‘সুতানটি সমামাচার” ২০০৭ সালে ধর্মীয় মুল্যবোধে আঘাত দেয়ার অভিযোগে সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদকে প্রকাশ্যে বলে বেড়াবার বিষয় হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রামের প্রয়াত জ্ঞানপাপী ড. আহমদ শরীফ। সারা জীবন তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে নাস্তিক্যবাদ প্রচার করেন। মারা যাবার আগে তিনি নিজের দেহখানি মেডিকেলে চিকিৎসা সেবার জন্য দান (?) করে যান। মহৎ শিরোনামে মূলত একজন নাস্তিককে আল্লাহর সৃষ্ট মাটি তার পেটে ধারণে অস্বীকার জানায়। সারা জীবনের পাপের ফসল স্বরূপ আল্লাহ তাঁকে মাটির ঘরেও জায়গা পাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখেন।
তাঁর জন্ম ১৯২১ খৃস্টাব্দে ১৩ ফেব্রুয়ারিচট্টগ্রামজেলার পটিয়া উপজেলার সূচক্রদণ্ডী গ্রামে। পিতার নাম আব্দুল আজিজ ও মাতার নাম মিরাজ খাতুন। তাঁর পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রামের প্রধানতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের একজন করণিক। এ মুসলিম পরিবারের অন্দর মহলে শিক্ষার আলো ঢুকিয়েছিল উনিশ শতকেই। তাঁর ষষ্ঠ পূর্ব্বপুরুষ কাদের রজা সন্তানের জন্য কাজী দৌলতেরসতী ময়না লোরচন্দ্রানীপুঁথিটি নিজ হাতে নকল করেছিলেন। তাঁর পিতামহ আইন উদ্দিন (১৮৪০-১৯৩৭) ছিলেন সরকারি জজ কোর্টের নকল নবিস। চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে প্রথম এন্ট্রাস পাস করা এবং বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি বলে খ্যাতআব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদছিলেন তাঁর কাকা ও পিতৃপ্রতিম। জন্মের পর থেকে আহমদ শরীফ সাহিত্যবিশারদ ও তাঁর স্ত্রীর কাছে পুত্র স্নেহে লালিত-পালিত হয়েছেন। ফলত অনেকের কাছেই তিনি সাহিত্য বিশারদের সন্তান হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৭ নভেম্বর সালেহা মাহমুদের সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর মৃত্যু ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। [বাংলা ইউকিপিডিয়া]
আহমদ শরীফ ১৯৩৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল হতে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পাস করেন। পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২য় বিভাগে ৪র্থ স্থান অধিকার করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালেসৈয়দ সুলতান তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ শীর্ষকঅভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর লিখিত পুস্তকের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থলায়লী মজনু ১৯৫৭ খৃস্টাব্দে প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ খৃস্টাব্দে মৌলিক গ্রন্থবিচিত চিন্তাপ্রকাশ করেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থের মধ্যে স্বদেশ অন্বেষা, মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ,বাংলার সুফি সাহিত্য,বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা,বাংলার বিপ্লবী পটভূমি,এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপ রেখা, নির্বাচিত প্রবন্ধ, প্রত্যয় ও প্রত্যাশাএবং বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। [প্রাগুক্ত]
ইউকিপিডিয়ায় তাঁর জীবনী আলোচনায় ‘ধর্মবিরোধিতা’ নামে একটি স্বতন্ত্র উপশিরোনাম লিখিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘তিনি জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও স্বঘোষিত নাস্তিক। কুসংস্কার, ক্ষুধা, রোগ শোকে জর্জরিত, ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন অবহেলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহী পুরুষ ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা শাস্ত্র ও প্রথা বিরোধিতার কারণেমুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে এক অসিয়তনামার মাধ্যমে তার মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করার কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। সে অসিয়তনামায় লেখা ছিল, ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ প্রতীক, কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাইতো বাঞ্ছনীয়’। তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের জন্য দান করে দেয়া হয়।’
নাস্তিকরা সংখ্যায় কম আর বিগত শতাব্দীর বাম সংগঠনগুলো রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ বা কোণঠাসা হলেও তাদের শিক্ষায় দীক্ষিত এবং তাদের মতবাদে পরিপুষ্ট লোকেরাই বর্তমান বাংলাদেশের সিংহভাগ মিডিয়ার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর্ণধার। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নাস্তিক্যবাদীরাই এ দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী। ফলে তাদের শতধা বিভক্ত সংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে সমর্থকের সংখ্যা হাস্যকর হলেও দেশের কর্তা ও পরিচালকদের প্রতি তাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। সতীর্থ মিডিয়াগুলো বরাবর তাদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মহাগুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করে। ইসলামপন্থীদের অবহেলা ও অনুপস্থিতির সুযোগে আজকের বাংলাদেশে যত ধারার মিডিয়া আছে সবগুলোয়ই তাদের প্রভাব ও দাপট ধ্রুব সত্য। তাদের পরিচালিত মিডিয়াগুলোর প্রতাপ এতোটাই বেশি যে এর বিপরীত দাঁড়ানো অনেক অনেক কঠিন ব্যাপার।
আহমদ শরীফের পর তার ভাবশিষ্য গণধিকৃত ও দেশান্তরিত সস্তা লেখিকা তসলিমা নাসরিন এবং তার মতো আরেক জ্ঞানপাপী ড. হুমায়ুন আজাদ বর্তমান প্রজন্মের নাস্তিকতায় পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন। ইউকিপিডিয়ায় তাঁর ধর্ম পরিচয়ে লেখা আছে, ‘স্বঘোষিত নাস্তিক’। সেখানে তাঁর বিশ্বাস ও দর্শন উপশিরোনামে বলা হয়েছে, ‘হুমায়ুন আজাদ ছিলেন স্বঘোষিতনাস্তিক। তাঁর অন্যতম প্রণোদনা ছিল প্রথা-বিরোধিতা। কবিতা, উপন্যাস ও রচনা সর্বত্রই তিনি প্রথাবিরোধী ও সমালোচনামুখর। তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার পক্ষে অনুকূল বলে মনে করতেন। [প্রাগুক্ত]
হুমায়ুন আজাদ রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশনথেকে ১৯৬২সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯৬৪ সালেঢাকা কলেজথেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। মেধাবী ছাত্র আজাদ ১৯৬৭সালেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি এবং১৯৬৮সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনিএডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেভাষাবিজ্ঞানেপিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ। তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর। তাঁর দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং একমাত্র পুত্র অনন্য আজাদ। হুমায়ুন আজাদ১১ আগস্ট২০০৪ সালেজার্মানিরমিউনিখশহরে মৃত্যুবরণ করেন।[প্রাগুক্ত]
১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধের বই নারী। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে বইটি নিষিদ্ধ করে। অবশ্য ৪ বছর পর ২০০০ সালে বইটি আবার পুনর্মূদ্রিত হয়। তাঁর লিখিত ‘আমার অবিশ্বাস’ (১৯৯৭), ‘ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ (২০০৪), ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ (১৯৯২) ‘১০,০০০, এবং আরো একটি ধর্ষণ’ (২০০৩), এবং ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪) প্রভৃতি বইতে চরম ধর্মবিদ্বেষ ও জ্ঞানপাপের পরিচয় দিয়ে ধর্মবিশ্বাস বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে মুক্ত কৃপাণ হাতে হামলা চালিয়েছেন। তাঁর লিখিত অনেকগুলো বই থেকে কেবল চরম ইসলামবিদ্বেষী, অরুচিকর ও পাঠকনিন্দিত উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র আলোচনা উপস্থাপন করছি। এ থেকেই যে কোনো পাঠক লেখকের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসলামবিদ্বেষ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবেন আশা করি।
বিখ্যাত হুমায়ুন আজাদের কুখ্যাত পাক সার জমিন সাদ বাদ বেশ কবার শুরু করেছি। অতি কষ্টেও দশম পৃষ্ঠা পেরোতে পারি নি। সম্ভবত চতুর্থবারের মতো এবার শেষ করার পণ নিয়ে শুরু করি। এবারও বুঝি রণে ভঙ্গ দিতে হয়। একদিনে ৩৮ পৃষ্ঠা পড়া হয়। বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রত্যেক শব্দ-হরফের অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ হেন ব্যবহার নেই যা তিনি এখানে আনেন নি। জানি না শিল্পিত বর্ণনায় এমন অশিল্পীসুলভ উপন্যাস দ্বিতীয়টি রচনা করেছেন কিনা। অন্ধ বিদ্বেষ, নির্জলা মিথ্যা আর কল্পনার অপব্যবহার কী ও কেমন তা জানতে এরচে আদর্শ কোনো বই হয় না। সংবাদপত্রের মতো উপন্যাসও সমাজের দর্পণ। সে অর্থে আলোচ্য উপন্যাস প্রয়োজনীয় পাশ নাম্বারও পায় না। লেখক জোর করে যেসব চরিত্র ও চিত্র উপস্থাপন করেছেন তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের মুসলিমপ্রধান সমাজে একটিও দেখানো সম্ভব নয়। অথচ বিবেকের মাথা খেয়ে লেখক এমনই সব চরিত্র বাংলাদেশের ইসলাম ও ডানপন্থী বৃহত্তম দল দুটির ওপর চাপিয়েছেন। ইসলামবিদ্বেষের সঙ্গে সঙ্গে লেখক যে বাংলাদেশের একটি বড় দলের দালালির এজেন্ডাও রাখতেন, তা এ উপন্যাসেই প্রথম টের পেলাম।
প্রতিভা থাকলেই তা পূজনীয় নয়। সুন্দর প্রতিভার যিনি অসুন্দর প্রয়োগ ঘটান, তিনি স্রষ্টার অকৃতজ্ঞ বান্দাই শুধু নন; আত্মোম্ভরি প্রচণ্ড জ্ঞানী শয়তানেরও দাস। এতদিন ইসলামবিদ্বেষী জানা সত্ত্বেও লেখকের প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করতাম, এখন জানলাম তিনি শুধু জ্ঞানী নন; জ্ঞানপাপী। এমনকি জ্ঞানপাপীই শুধু নন, বিবেকপ্রতিবন্ধীও। যে কোনো জাতি-ধর্মের লেখক কিংবা বিদগ্ধ পাঠক এমন বিকারগ্রস্ত বাস্তবতাবিবর্জিত আরোপিত চরিত্রের উপন্যাসের নিন্দা না করে পারবেন না। এদেশের তথাকথিত কিছু প্রগতিশীল লেখক এর পক্ষে কীভাবে সাফাই গান তাও গবেষণাসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে নিজেকে প্রগতিশীলদের কাতারে দেখাতেই যে তারা এমন আবর্জনার গুণ গেয়ে থাকেন, তা গবেষণা ছাড়াই বলা যায়।
লেখক প্রতিটি পৃষ্ঠায় একাধিক প্যারায় বিভিন্ন মানুষ ও দলের চরিত্র হননের প্রয়াস পেয়েছেন। কোনোটাই সবার সামনে উপস্থাপনযোগ্য নয়। যে কোনো দৃষ্টান্ত দিলেই পাঠকমাত্র ঘেন্নায় নাকে হাত দিতে বাধ্য হবেন। তথাপি একটি প্যারা উল্লেখ করে সামান্য বিশ্লেষণ না করলে কেউ অযথা নিন্দা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনতে পারেন। তাই বাধ্য হয়েই একটি উদ্ধৃতি পেশ করছি : ‘জিহাদি হাফিজুদ্দিনটা একটু বেতমিজ, মুখে চমৎকার চাপদাড়ি, স্বাস্থ্যটাও ভালো; একাই দু-তিনটি দোকান ভাঙতে পারে, কয়েকটিতে আগুন লাগাতে পারে, গুলি চালাতে পারে, ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আলি আলি জুলফিক্কার’ ব‘লে ছুরি ঢুকোতে পারে; ফিরে এসে একটির পর একটি এক্সএক্সএক্স দেখতে পারে, সবই ইন্ডিয়ান, বড়ো দুধ আর বড়ো মাজা ওর পছন্দ, চাকরানিটাকে ডেকে এনে ঘণ্টাখানেক ধ’রে অরাল-অ্যানাল-ভ্যাজাইনাল করতে পারে, তারপর উঠে গিয়েই মধুর স্বরে ওয়াজ করতে পারে, ফতোয়া দিতে পারে।’
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইসলামের শাশ্বত শান্তির সুমহান বাণী প্রচার করে বেড়ানো ওয়ায়েজদেরকে লেখক (১) জিহাদি ও জঙ্গি (২) ধর্ষক ও লম্পট এবং (৩) ভণ্ড ও চরিত্রহীন বানাতে চেয়েছেন। যে কিনা মুখে দাড়ি রেখে মানুষের বাড়ি বাড়ি খেয়ে মোটা-তাজা হয়ে সংখ্যালঘুদের দোকানপাট ভাঙে, তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে, আল্লাহর নাম নিয়ে মানুষ খুন করে, তারপর ব্লু-ফিল্ম দেখে, ইন্ডিয়ান বারবণিতাদের দেখে কাজের মেয়ের সঙ্গে নানাভাবে বিকৃত যৌনাচার চালায়। আর এতসব অপকর্ম করে তিনি মধুর সুরে ওয়াজ করেন আর ফতোয়া দেন! পাঠক বলুন, এমন মারাত্মকসব বিপরীতমুখী চরিত্রের একজন ব্যক্তিও কি দেখাতে পারবেন?
কী বিপদের কথা, এত বড় বড় সব পণ্ডিত লেখকরা যখন ইসলামের হক-বাতিল নানা ফেরকাকে একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, তখন তাদের মূর্খও বলতে পারি না। হতে পারে তারা সজ্ঞানে সবগুলো ইসলামের সপক্ষশক্তির চরিত্র হনন করে কেল্লা ফতে করতে চান। নিচের উদ্ধৃতি খেয়াল করুন। কিভাবে তিনি ইরানের কট্টর শিয়া আর আফগানের কট্টর সুন্নিদের এক কাতারে এনেছেন। বাংলাদেশের জামাতে ইসলামসহ সব ইসলামিদের একসঙ্গে ভজঘট পাকিয়েছেন :
‘জিহাদিদের একটি মহান গুণ হচ্ছে তারা মালাউন মেয়ে পছন্দ করে। আমিও করি, ওদের একটু খেলাতে পারলে ওরা উর্বশীদের মতো নাচে; আমার জিহাদিরা অবশ্য নাচটাচ পছন্দ করে না, ওরা ঢুকতে বেরোতে পারলেই শুকরিয়া আদায় করে। এতে প্রধান প্রতিভা তালেবান মোঃ হাফিজুদ্দিন, ও হয়তো ফেরেশতাদের কাছে থেকে কোনো হালুয়া লাভ করে; তবে মোঃ কেরামত আলি, মোঃ মোস্তফা, মোঃ আকবর আলিও কম যায় না, এটা আমি পছন্দই করি, জিহাদে কোনো কম যাওয়া-যাওয়ি নেই, তাতে জোশ কমে যায়। ওরা যখন একেকটি মালাউন মেয়ের ওপর চড়ে, তখন ওরা মনে করে ওরা একেকটি নাছারা নগর ধ্বংস করছে, যার নির্দেশ রয়েছে। আমি আশ্চর্য হই, ওরা রুহুল্লা খোমেনির কিছুই পড়ে নি, কিন্তু চিন্তা ও কর্মে তাঁকেও ছাড়িয়ে গেছে।’
না হলো না। আরও একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হয় : ‘জামাঈ জিহাদে ইছলাম আমাকে উদ্দীপ্ত করে, আমি প্রচণ্ড উত্তেজনা বোধ করি, ওই উত্তেজনা দেহের বিশেষাঙ্গের উত্তেজনার থেকে অনেক বেশি তীব্র, অনেক বেশি প্রচণ্ড; আমি দেখতে পাই আমি বেঁচে উঠছি, আমি বেহেশতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠি। মওলানা মওদুদি, ইমাম গাজালি, আয়াতুল্লা খোমেনির বই, আর কোরান-হাদিছ, নেয়ামুল কোরআন, মুকছেদুল মমেনিন, বেহেস্তের জেওর প’ড়ে আমি বুঝতে পারি এতোকাল আমি ভুল পথে ছিলাম, দোজগের রাস্তায় ছিলাম, এখন আমি ঠিক পথে এসেছি; এখানে সব সময়ই খোয়াব, সব সময়ই উত্তেজনা; পৃথিবীতে মুছলমান আর ইছলাম ছাড়া আর কিছু থাকবে না, এ-বিশ্বাস আমাকে মাতাল ক’রে তোলে- নাউজুবিল্লা, ‘মাতাল’ শব্দটি ঠিক হয় নি, আল্লা আমাকে মাফ করবেন; এ-সময়ই আমি একটি চমৎকার জীবন পাই। জামাঈ জিহাদে ইছলামে যোগ দেয়ার পর প্রায় সবই পাই, বেহেশত তো পাবোই। যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আমি জামাঈ জিহাদে ইছলাম-এর ‘মদিনাতুন্নবি’ অঞ্চলের নেতা হয়ে উঠি, আমার খুব চেষ্টা করতে হয় না; আমার প্রধান নেতারা বুঝতে পারেন যে-তিরিশটি মাদ্রাছার তালেব এলেম নিয়ে এ-আঞ্চলিক সংঘটি গঠিত, ওই সব হাফেজিয়া ফোরকানিয়া কওমি কামিল দাখিল সাধারণ মাদ্রাছার তালেবানদের মাথায় ঘিলু নেই, যেমন তাদের মাথাও নেই, তাদের মগজ অন্য জায়গায়; তাই যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি নেতা হয়ে উঠি, যা আমি কখনো হই নি।’
এ পর্যায়ে এসে আমি উপন্যাসের বাকি পৃষ্ঠাগুলোয়ও নজর বুলাই। আরও কত নোংরা বর্ণনা। অশ্লীল রচনা। লেখক প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় দিয়েছেন ইসলামপন্থী আর লেখকের ভাষায় জিহাদিদের ধর্ষণ ও নারীলিপ্সার কল্পিত দিগম্বর বর্ণনা। ইসলামের অনুসারীদের নানা চরিত্রহীনতা, নষ্টামী ও ভণ্ডামির চতুর উপস্থাপনা। শিল্পিত ভাষায় এবং অশ্লীল বয়ানে যে এমন সাহিত্য তৈরি হতে পারে তা এ উপন্যাস না পড়লে পাঠকের বিশ্বাস হত না। লেখক তার একাধিক বক্তব্যে নিজেকে শুধু নাস্তিক হিসেবেই প্রমাণ করেন নি, কুফরির শর্তগুলোও পূরণ করেছেন।
বইমেলা থেকে ফেরার পথে অজ্ঞাত পরিচয়ধারীদের হামলায় তিনি প্রচণ্ড আহত হন। পরবর্তীতে তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে মারা যান। তার মৃত্যুর পর এমন একজন ধর্মবিদ্বেষী আল্লাহদ্রোহীর জানাযা পড়াতে অস্বীকার করায় মসজিদের ইমামকে সমালোচনার শিকার হতে হয়। যে ইমাম তথা দীনদারদের সমালোচনা আর কলঙ্কিত করা ছিল মৃত লোকটির জীবনের প্রধানকর্ম তার জানাযা পড়াতে বাধ্য করা হয় তেমনি এক ইমামকে। নাস্তিক আর প্রগতিশীলদের স্ববিরোধ আর ভণ্ডামির এও এক নজির। আরে বাবা, এতই যদি তুমি ইসলামকে ঘৃণা করো, কুরআন আর আল্লাহকে অস্বীকার করো তবে কেন তোমাকে মৃত্যুর পর ইসলামের নিয়মে দাফন করা হবে? তোমাকে তো মাটিতে পুঁতে রেখে আসা উচিত।
এমন দেশ-ধর্ম ও বিবেকবিরোধী লেখার জন্য লেখকের মরণোত্তর ফাঁসি দেওয়া উচিত। আর আখিরাতে তাদের অবস্থা কী হবে সে তো বলাইবাহুল্য। যারা এখনো তার আদর্শের ধারক ও প্রচারক হয়ে বেঁচে আছেন, তাদেরকে সময়ের আগে সোজা হয়ে যাবার, সুপথে ফিরে শান্তির জীবন লাভের আহ্বান জানাই। মরার পর যখন আত্মীয়-পরিজন-সুহৃদরা আপনার জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ আর বেহেশত কামনা করবে, তার আগেই হেদায়েতের পথ ধরুন। পৃথিবীর জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি আল্লাহর দেয়া অবিনশ্বর জ্ঞানেরও স্বাদ নিন। নিজেকে জানুন এবং আল্লাহকে চিনুন।
নাস্তিক্যবাদী তৎপরতার আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যাক। বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার ফাঁসির দাবিতে রাজধানী শাহবাগ চত্বরে বাম ও নাস্তিকদের নেতৃত্বে কথিত গণজাগরণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। একদল দলনিরপেক্ষ তরুণের হাতে শাহবাগ চত্বরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনের সূচনা। গোড়ায় তাদের দাবিগুলোও ছিল অরাজনৈতিক। আয়োজকরা যদিও রাজনীতিকদের বক্তব্য না দেবার যুক্তি দেখিয়ে বলবেন, শুরুর মতো শেষ পর্যন্ত আন্দোলন তার নিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রেখেছে। তবে বাস্তবতা হলো, পরবর্তীতে ক্রমেই এ আন্দোলন দলীয় লোকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সরকার নিজেই এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পত্রিকায় তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে দেশের বাম অধ্যুষিত ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়াগুলো এ আন্দোলন থেকে তাদের আদি স্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে দাবির তালিকায় একে একে যোগ হয় নানা অগণতান্ত্রিক, ইসলামবিদ্বেষী ও দেশবিরোধী ধারা।
দাবি হতে পারত অপরাধীদের ফাঁসি চাই যদি সত্যিই তারা দোষী হয়ে থাকেন। অথচ এখন কথিত সব রাজাকারেরই ফাঁসি দাবি করা হচ্ছে। তাতেও সমস্যা ছিল না যদি প্রকৃতই সবাই রাজাকার হতেন। এখন রাজাকার বলতেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে একটি সম্প্রদায় কিংবা নির্বিচারভাবে টুপি-দাড়িওয়ালাদের দিকে। আরও ভয়ঙ্কর প্রবণতা হলো, বামদের মতলবি শ্লোগানে গলা না মেলালেই তাকে বলা হচ্ছে রাজাকার! স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াও রাজাকার! বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে নির্ভয় ও অকুণ্ঠ প্রতিবাদকারী মুক্তিযুদ্ধের অনন্য বীর কাদের সিদ্দিকীও রাজাকার! বলি, আন্দোলনের ফলে যদি একশ রাজাকারের যোগ্য শাস্তি হয় আর ফাঁসি হয় মাত্র একজন নির্দোষ ব্যক্তির তবে কি লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে না? আইনশাস্ত্রের ভাষায় তো দশজন অপরাধীর শাস্তির চেয়ে একজন নিরপরাধীকে বাঁচানো উত্তম।
সন্দেহ নেই নিরপেক্ষ পটভূমিতে দাঁড়িয়ে যে কোনো অপরাধীর ন্যায্য ও প্রাপ্য শাস্তি দাবি করা একটি প্রশংসনীয় কাজ। এ কাজে আর সবার মতো আমারও সমর্থন প্রশ্নাতীত। কিন্তু তাই বলে কি এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনকে দেশের প্রতি ভালোবাসার অপরিহার্য শর্ত মনে করা যায়? কোনো কারণে এ আন্দোলনে সমর্থন না করতে পারলে কি তার দেশপ্রেম মিথ্যে হয়ে যাবে? সাধারণ মানুষ আড়ালের অনেক খবর জানেন না। মিডিয়ার কারসাজি আর পুতুলখেলা অনেকেই বুঝতে পারেন না। কিন্তু যিনি অন্তরালের খবর রাখেন, মিডিয়ার ভেতরের অবস্থা যার নখদর্পনে তিনি তো ভিন্নমত দিতেই পারেন। এমতাবস্থায় দেশপ্রেমিক হিসেবে তার দায়িত্ব নয় কি অন্যদেরও প্রতারিত হওয়া থেকে সাবধান করা? অন্যের স্বার্থ হাসিলের গুটি হওয়া থেকে সতর্ক করা?
একটি শান্তিপূর্ণ গণজমায়েতে কেন ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে দাঁড়ানো আমার দেশ ও নয়াদিগন্ত পোড়ানো হবে? কেন ভিন্নমত প্রকাশ করায় গণমাধ্যমকে হুমকি দেয়া হবে? দলীয় ব্যক্তির অপরাধে কেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হবে? ভিন্নমত পোষণ করলেই কেন তার নাগরিকত্ব বাতিলের দানবীয় হুমকি প্রদান করা হবে? কেন শাহবাগে অনুষ্ঠিত ইসলাম ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের খবর তুলে ধরায় একটি দৈনিকের সম্পাদকের শাস্তি, কারাদণ্ড ও মৃত্যু কামনা করা হবে? কেন রাজাকারের শাস্তি চাওয়ার নামে টুপি-দাড়িসহ সব ইসলামী পোশাককে হেয় করা হবে। ইসলাম চর্চাকারীদের চরিত্র হনন করা হবে? একটি ভালো কাজের ছুতোয় কি দশটি মন্দ কাজকে প্রশ্রয় দেয়া যায়? আজ যারা দেশপ্রেমে গদগদ হয়ে পথে নেমেছেন ফেলানীর লাশ যখন তিনদিন পর্যন্ত ভারতের কাঁটাতারে ঝুলেছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন? পদ্মাসেতু, শেয়ারবাজার আর হলমার্কের কুমির-দস্যুদের অপরাধ দেখে তাদের দেশপ্রেম কেন জেগে উঠল না? ব্রাক হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক ধর্ষিতা হয়ে খুন হলে কেন তারা জাগলেন না? প্রতিদিন কত অসহায় নারী ধর্ষিতা ও খুন হচ্ছেন তাদের নির্যাতনে জড়িতদের বিচার চেয়ে কেন তারা পথে নামেন নি? মসজিদের মাইকে আযানের সুরে যারা রোগীদের কষ্টের কথা বলেন, তারা কেন বারডেম ও পিজি হাসপাতালের পাশে মাসের পর মাস এত চিৎকার-চেচামেচিতে রোগীদের কষ্ট অনুধাবন করেন না? মিডিয়া এদের পেছনে হাওয়া দিতে থাকায় অসহায় রোগী কিংবা হাসপাতাল দুটির চিকিৎসকরা এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস পাচ্ছেন না।
নিরপরাধ মানুষকে যারা হত্যা করেছে, নিরীহ মা-বোনকে যে নরপশুরা ধর্ষণ করেছে তাদের মৃত্যুদণ্ড দাবি তো কুরআনেরই দাবি। কিন্তু এদের ফাঁসির দাবির সঙ্গে কণ্ঠ মেলাবার পর শাহবাগে আর যা হচ্ছে একজন মুসলিম হিসেবে তার ক’টি কাজ আমরা সমর্থন করতে পারি? নাচ-গান, নারী-পুরুষের খোলামেলা ঘেঁষাঘেঁষি, মঞ্চে তরুণীদের উদ্বাহু নৃত্য কিংবা গলা ফাটানো গান ও শ্লোগান, মানুষের চেহারা বিকৃতি, প্রাণীর ছবি অঙ্কন ইত্যাদি- সবগুলোই ইসলামের দৃষ্টিতে চরম গর্হিত কাজ। কোনো মুসলিম এসব সমর্থন করতে পারেন না। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তির দাবি প্রতিটি মুসলিমেরই করা উচিত। কিন্তু এসবের কোনোটার সঙ্গে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী কেউ জড়িত হতে পারেন না। আন্দোলন থেকে যে কর্মসূচিগুলো ঘোষিত হচ্ছে তার মধ্যেও তো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কোনো ছাপ নেই। বিজাতীয় মোম প্রজ্বলন আর মৌনব্রত রীতি চর্চা কেন আমাদের প্রতিবাদের ভাষা হবে?! জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি স্থাপন আর তার সামনে খ্রিস্টীয় পদ্ধতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে কোন দুঃখে?!
শাহবাগের আন্দোলন তার কুমারিত্ব হারিয়েছে। অবশ্য আন্দোলনের অনেক অগ্নিকন্যা তাদের মূল্যবান সে জিনিসটি হারিয়েছেন অনেক আগেই। বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আড্ডা আর ঘনিষ্ট হবার এমন সুযোগ রাজধানীর কোন জুটিই বা লুফে নিতে চাইবে না। অদূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁকা হলও অনেকের জন্য সুবর্ণ সুযোগ বয়ে এনেছে। আর সরকারের প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগিতা এবং বামদলগুলোর নেতৃত্বও এ আন্দোলনের সতীত্ব হরণ করেছে। প্রকাশ্যে সাপের মতো করে মানুষ হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের মঞ্চে অবস্থানও একে কলঙ্কিত করেছে। কাদিয়ানী ও রাজাকার নুরুল ইসলাম আজ দল বদলেছেন বলে তিনি হয়ে গেছেন স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোক! হায় পরিহাস, রাজাকার নুরুল ইসলামও এখন ফাঁসির দাবির মঞ্চে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন! বলি, বন্ধুরা আমাকে ক্ষমা করো। সম্ভব হলে আমার প্রশ্নগুলোর সত্যনিষ্ঠ উত্তর তালাশ করো।
সময় হয়েছে শাহবাগ তথা নাস্তিক্যবাদীদের সীমালঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার। শাহবাগে যা হচ্ছে তার ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করার। ইতোমধ্যে অবশ্য সে আওয়াজ ধীরে ধীরে বিভিন্ন দিক থেকে উঠতেও শুরু করেছে। পত্রিকার ভাষ্য মতে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকেও শাহবাগ উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারে থাকা প্রতাপশালী বাম নেতৃত্বের প্রভাবে তা হয়ে উঠছে না। এখনই যদি শুভ বোধসম্পন্ন লোকেরা এর ইতি-নেতি নিয়ে আওয়াজ না তোলেন তবে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ দেশের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব হুমকির পড়বে। বিপক্ষ মত দমন আর একদলীয় লেজুড়বৃত্তির ফ্যাসিবাদী মনোভাব প্রতিষ্ঠা পাবে। আজ আপনারা যদি কথা না বলেন, তবে কালকে এরা মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতো শাহবাগ কোটা বরাদ্দের দাবি তুলবে সরকারি পদে। ইমাম সাহবেগণ যদি এর বিরুদ্ধে মুসল্লীদের সজাগ না করেন তবে এ দেশে ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়বে। আপনার মিম্বারের বিরুদ্ধেও শ্লোগান উঠবে। আজ এরা ত- তে তুই রাজাকার বলতে বলতে ই- তে তুই ইসলাম তুই রাজাকারও বলে বসেছে!
দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ যখন এই নাস্তিক ব্লগারদের ঘৃষ্টতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসার অপরিহার্য শর্ত পূরণে দগ্ধ হৃদয়ে পথে নেমে এদের শাস্তি দাবি করেন, তখন বাংলাদেশের নাস্তিক্যবাদপ্রভাবিত মিডিয়াগুলো এটাকে একটি দলের পক্ষের দালালি আন্দোলন বলে নির্জলা মিথ্যা প্রচারণা চালাতে থাকে। উপরন্তু মিডিয়াগুলো শাহবাগ ও নাস্তিকদের পক্ষে নির্লজ্জ মিথ্যাচার ও হলুদ সাংবাদিকতা চালিয়ে যায়।
আজ কয়েকদিন মনটা বড়ই ভারাক্রান্ত। কেবলই মিডিয়ার হলুদ সাংবাদিকতার বলি হচ্ছে আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যারা শহীদ হলেন আর যারা গুলি চালিয়েছেন- উভয় পক্ষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসেন। সমমনা দুই দল মানুষ কেন একজন আরেকজনকে হত্যা করতে উদ্যত হবে?! হলো শুধু নির্লজ্জ, বিবেক ও প্রকৃত দেশপ্রেমহীন মিডিয়াগুলোর কারণে। দলকানারা ছাড়া শাহবাগের আন্দোলন সমর্থন বা প্রত্যাখ্যানকারী উভয় শ্রেণীর কেউই রাসূলকে অসম্মানকারীর সমর্থক হতে পারেন না। হলেন কেবল মিডিয়ার চাতুরির শিকার হয়ে। একশ্রেণীর মিডিয়া নবীর সঙ্গে বেয়াদবি করার প্রতিবাদকে বানাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর ষড়যন্ত্র, আরেক শ্রেণীর মিডিয়া শাহবাগের আন্দোলনকে বলছে ইসলাম ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। উভয়পক্ষ কিছু বাগাড়ম্বর করেছেন নিজেদের স্বার্থে। অথচ তারা দেশের প্রতি তাকান নি।
শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে আমাদের মাথাব্যথার কিছু ছিল না, যদি না সেখানে রাসূলকে কটাক্ষকারী কেউ আহ্বায়ক সংগঠক হতেন। আমার রাসূলকে গালি দেবেন আর উহ পর্যন্ত করতে দেবেন না, তা তো হয় না। রাজনীতিবিদদের বলি, আপনাদের গদি আপনাদেরই থাকুক, আমাদের ফিরিয়ে দিন শুধু ঈমানের যিন্দেগী আর ইসলামের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের অধিকার। আমরা রাসূলের ভালোবাসার জায়গায় কোনো আপস করতে পারি না।
সত্য কথা বললেই যদি হাজী সাহেবের মুখ খারাপ বলা হয় তাহলে তারা আবার কিভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী দাবি করেন? তারা কীভাবে পরমত সহিষ্ণুতার পাঠ দেন? বিপক্ষ মত সহ্য করার কথা বলেন? কীভাবে তারা অন্যদের উগ্রবাদী আর মৌলবাদী বলেন? খোদ তারাই কি প্রতিক্রিয়াশীল অশুভ শক্তি নন? তারা আজ তাদের পুরনো যত আদর্শিক শত্রু রয়েছে, সবাইকে এই আন্দোলনের মাধ্যমে ঘায়েল করতে চাইছে। কাউকে এর বিপক্ষে কোনো যৌক্তিক প্রশ্নও তুলতে দিচ্ছে না। গণদাবির চেয়ে গোষ্ঠী ও শ্রেণীগত দাবিই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। এই হলো নাস্তিকদের প্রকৃত সততা।
নাস্তিকরা তাদের রাজনৈতিক গুরুর বিরুদ্ধে বললে স্বাধীন মত প্রকাশের কথা বলেন না, অথচ শত কোটি মানুষের প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব, সর্বাধিক ভালোবাসার পাত্র মানবতার মুক্তির দূত নবী মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্বোধ কিংবা বিবেকহীন সমালোচনা করা হলে, তাঁর বিরুদ্ধে অশালীন কটূক্তি করা হলে দোহাই দেয়া হয় এই মত প্রকাশের স্বাধীনতার! নেতার সমালোচনা করায় তৎক্ষণাত চাকরি হারায়, দিন না পেরোতেই জেলে বন্দি করা হয় অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমালোচনা এবং ইসলামকে তীব্র কটাক্ষকারী উন্মাদ ব্লগারদের রাষ্ট্র দেয় নিরাপক্তার জন্য গানম্যান! নাস্তিকদের ভণ্ডামি আর দ্বিমুখী নীতির দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারীরা ইন্টারনেট ব্লগগুলোয় যে ভাষা ও ভঙ্গি প্রচার করে বেড়ান, তা তাদের অন্তরালের জীবনের মতোই ঘৃণ্য। অকল্পনীয় অশ্লীল এবং অসহনীয় মিথ্যায় ভরা। অথচ এ দেশের বাম-নাস্তিক অধ্যুষিত মিডিয়াগুলো বরাবর তাদেরই পক্ষ নিয়ে এসেছে। এও এক দ্বিচারিতা। আবার এদের ভণ্ডামি আর মুখোশ উন্মোচনের উদ্যোগ নেয়ায় বামনিয়ন্ত্রিত সরকারও এমন উদ্যোগ নেয় যা শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভণ্ডামির অন্যতম। ইসলামপন্থী মিডিয়ায় নাস্তিক ব্লগারদের ইসলাম ও রাসূল অবমাননার সংবাদ প্রকাশ হলে যখন সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তখন তাদের বিরুদ্ধে নামকাওয়াস্তে ব্যবস্থা নিয়ে এসব প্রচার বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হয়! আর ‘উস্কানি’ ও ‘ধর্মাবননা’র অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় অন্যায় মানুষের সামনে তুলে ধরা মাহমুদুর রহমানকে। রাসূলকে কটুক্তি করা অপরাধ নয়; কটুক্তির সংবাদ প্রচার করা অপরাধ। কী বিচিত্র মুসলিম দেশ! হায় সেলুকাস!
তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে মত প্রকাশের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠা ব্লগকে একশ্রেণীর যুবক ইসলামের বিরুদ্ধে কুত্সা রটনার ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক যুবগোষ্ঠী মহান আল্লাহ, পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন, মহানুভব নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ঈদ, সালাত, সিয়াম ও হজ সম্পর্কে কদর্য ভাষায় বিষোদ্গার করে মুসলমানদের ঈমান ও আকীদায় আঘাত হানছে। তাদের কুৎসিত ও অশ্লীল লেখা পড়লে যে কোনো মুসলমানের স্থির থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি বিবেকবান অমুসলিমদেরও গা শিউরে ওঠার কথা। ব্লগে ইসলামী বিধান, রীতি-নীতিকে কটাক্ষ করা হচ্ছে প্রকাশের অযোগ্য ভাষায়। নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক কাহিনী ও মতামত লেখা হচ্ছে অবলীলায়। ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিরপুরে খুন হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা আহমেদ রাজিব হায়দার ওরফে থাবা বাবা।
নিহত ধর্মদ্রোহী নাস্তিক ব্লগার রাজিব :
ইসলাম বিদ্বেষী কুখ্যাত ব্লগার রাজিব আততায়ীর হাতে খুন হয়েছে। সে শুধু একজন স্বঘোষিত নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী মুরতাদই ছিল না, যথারীতি একজন লম্পট ও নারীলোলুপ নেশাকারীও ছিল। পত্রিকান্তরে সেসব খবর বেরিয়েছে। রাজিব খুন হওয়ার পর থেকেই এর জন্য বাংলাদেশের একটি ইসলামী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয়েছে। অথচ পুলিশি তদন্তে প্রথমেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তার স্ত্রী ও প্রেমিকাকে। অকুস্থলে তার ল্যাপটপে নারীর চুল পাওয়া গেছে বলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাবে রাজিব নামের এ আলোচিত ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার সম্পর্কে জেনে অবাক হয়ে গেলাম। সে যা লিখেছে তা মুসলিম বা অমুসলিম তো দূরের কথা কোনো ভদ্র মানুষের ভাষা হতে পারে না। সে কোথাও কোথাও নিজের এবং নিজ সতীর্থদের পীর ড. হুমায়ুন আজাদকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওসব লিখে সে নিজেকে ইসলাম থেকে ছিন্ন করে নিয়েছে।
রাজিব ‘নুরানী চাপা’ নামের একটি ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করত। সেখানে ‘মোহাম্মকের (মোহাম্মদ+আহাম্মক) সফেদ লুঙ্গি, ঈদ মোবারক আর ঈদের জামাতের হিস্টরি, ঢিলা ও কুলুখ, সিজদা, হেরা গুহা, ইফতারি ও খুর্মা খেজুর, সিয়াম সাধনার ইতিবৃত্ত, লাড়াইয়া দে, মদ ও মোহাম্মক, আজল’ ইত্যাদি শিরোনামে বেশ কিছু বিতর্কিত ব্লগ লিখেছেন।