মহান আল্লাহ্ আছেন সাত আসমানের উর্ধে আরশের উপর। তিনি বলেছেন "পরম দয়াময় আরশে সমুন্নত" (সুরা ত-হাঃ ৫)। তিনি স্রষ্টা, সৃষ্টি থেকে উর্ধে থাকেন। তবুও তিনি বান্দার নিকটবর্তী। তার জ্ঞান ও দৃষ্টি সর্বত্র আছে। মুমিনের হৃদয়ে তার যিকর বা স্মরণ থাকে।
মহান আল্লাহ্র আকার আছে। তিনি নিরাকার নন। তবে সেই আকার কেমন, তা কেউ জানে না। তিনি বলেছেন "কোন কিছুই তার সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা " (সুরা শূরাঃ১১) তাকে বেহেশতে দেখা যাবে। তার দীদারই হবে বেহেশতে সবচেয়ে বড় সুখ। মহানবী (ﷺ) স্বপ্নে আল্লাহকে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, আমি আমার প্রতিপালককে সবচেয়ে সুন্দর আকৃতিতে দর্শন করেছি (৪)
বৈধ নয়, যেহেতু মহানবী (ﷺ) তা নিষেধ করে গেছেন। আর তার কবর মসজিদের ভিতরে মনে হলেও তাতে কিন্তু বৈধতার দলীল নেই। কারনঃ
প্রথমতঃ মসজিদে নববী নবী (ﷺ) নিজে বানিয়েছেন। সুতরাং তার কবরের উপর মসজিদ হয়নি।
দ্বিতীয়তঃ তার ইন্তেকালের পর তার কবর মসজিদ হয়নি। বরং তার কবর হয়েছিল মা আয়েশা (রাঃ) ঘরের ভিতরে।
তৃতীয়তঃ মসজিদে নববী সম্প্রসারণের সময় মা আয়েশার ঘর যখন মসজিদের শামিলে আনা হয়, তখন তা সাহাবাগনের ঐক্যমতে ছিল না। বরং সেই সময় অধিকাংশ সাহাবা পরলোকগত। আর তা ছিল প্রায় ৯৪ হিজরীতে। যে সকল সাহাবা তখন বর্তমান ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সে কাজের প্রতিবাদ করেছেন। তাবেঈনদের মধ্যে যারা প্রতিবাদ করেছেন, তাদের মধ্যে সাঈদ বিন মুসাইয়িব অন্যতম।
চতুর্থতঃ মা আয়েশার হুজরা মসজিদে শামিল হওয়ার পরেও কবর মসজিদে নয়। বরং তা পৃথক কক্ষে সংরক্ষিত আছে। তিন তিনটি দেওয়াল ও রেলিং দিয়ে তা পৃথক করা আছে। ভিতরের দেওয়াল দেওয়া আছে তিনকোণা আকারে, যাতে তার পশ্চাতে কেউ নামায পড়তে দাঁড়ালে সরাসরি কবর সামনে না পড়ে ।
বলা বাহুল্য, মহানবী (ﷺ) এর কবর দেখে মসজিদের ভিতর কবর দেওয়ার বৈধতার দলীল পেশ করা শুদ্ধ নয়। (৫)
মহান আল্লাহ্ই তাদেরকে মুশরিক ও কাফের গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন "আর ইয়াহুদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খ্রিষ্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র । এটা তাদের মুখের কথা মাত্র (বাস্তবে তা কিছুই নয়)। তারা তো তাদের মতই কথা বলছে, যারা তাদের পূর্বে অবিশ্বাস করেছে। আল্লাহ্ তাদেরকে ধ্বংস করুন, তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে! তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের পণ্ডিত-পুরোহিতদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়াম পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদেরকে শুধু এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র একক উপাস্যের উপাসনা করবে, যিনি ব্যাতিত (সত্য) উপাস্য আর কেউই নেই, তিনি তাদের অংশী স্থির করা হতে পবিত্র " (সুরা তাওবাহঃ ৩০-৩১)
নিশ্চয় তারা অবিশ্বাসী (কাফের) যারা বলে মারইয়াম তনয় মসীহই আল্লাহ্ (সুরা মায়ীদাহঃ ১৭,৭২)
আর মহানবী (ﷺ) বলেছেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ আছে! এই উম্মতের যে কেউ, ইয়াহুদী অথবা খ্রিষ্টান আমার কথা শুনবে, অতঃপর সে আমি যা দিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার প্রতি ঈমান না এনে মারা যাবে, সে জাহান্নামবাসী হবে। (৬)
সুতরাং রাজনৈতিক তোষামোদির কারনে কাফেরকে কাফের মনে না করা, কাফেরদের ভজনালয়কে আল্লাহর ঘর ধারনা করা কুফরী (৭)
না। কবরপূজা, আস্তানাপূজা ইত্যাদি ইসলামে কোন পূজা নেই। ইসলামে আছে ইবাদত। আর তা কেবলমাত্র মহান আল্লাহ্র জন্য। কবরপূজা মূর্তিপূজার শামিল। কবরকে কেন্দ্র ক’রে তাওয়াফ করা, নযর বা মানত মানা, কবরকে সিজদা করা, কবরবাসীর কাছে কামনা বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি শিরকে আকবর। এমন কাজে মুসলিম ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। কবরকে উঁচু করা, কবর বাঁধানো, রং করা, তার উপর চাদর চড়ানো, তার উপর ঘর বা গম্ভুজ নির্মাণ করা, কবরের পাশে বাতি বা ধুপধুনো দেওয়া, উরস করা ইত্যাদিতেও ইসলামের অনুমোদন নেই। (৮)
আল্লাহ্র নবী (সঃ)-এর ইন্তিকালের পর তাঁর দেহ মা আয়েশার ঘরে সমাহিত আছে এবং তাঁর রূহ আছে জান্নাতে। সে এক ভিন্ন জগৎ। সে (মধ্য) জগৎ ও এ (পার্থিব) জগতের মাঝে আছে যবনিকা। সে জগৎ থেকে তিনি এ জগতের কোথাও হাযির (উপস্থিত) ও নাযির (পরিদর্শন) বা বিরাজমান হতে পারে না। তিনি না বিদআতী মীলাদের সময়, আর না অন্য কোন শুভ সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হতে পারেন। সে জগৎ থেকে তিনি এ জগতের কোন খবর ও জানতে পারেন না। ভক্তির আতিশয্যে শুধু বিশ্বাস করলেই হয় না, বাস্তবে তাঁর দলীল-প্রমাণ থাকা আবশ্যক।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ্ও সর্বত্র বিরাজমান নন। বরং তাঁর জ্ঞান, দৃষ্টি ও সাহায্য গগণে-ভুবনে সর্বত্র আছে। আর তিনি আছে সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে আরশের উপরে।
উদ্দেশ্য যদি আপদে-বিপদে আহবানে বা সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, তাহলে তা শিরকে আকবর। এমন শিরক মুসলিমকে ইসলাম থেকে খারিজ ক’রে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, “অথবা তিনি, যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীর প্রতিনিধি করেন। আল্লাহ্র সঙ্গে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই উপদেশ গ্রহণ ক’রে থাক।" (নামলঃ৬২)
“সে, ব্যাক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে, যে আল্লাহ্র পরিবর্তনে এমন কিছুকে ডাকে, যা কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তাঁর ডাকে সাড়া দেবে না? আর তারা তাঁদের ডাক সম্বন্ধে অবহিতও নয়।”(আহকাফঃ৫)
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কোন সৃষ্টির কাছে সাহায্য প্রার্থনার আহবান তিন শর্তে বৈধঃ
১। যার নিকট সাহায্য চাওয়া হবে, তাঁকে পার্থিব জীবনে জীবিত থাকতে হবে।
২। তাকে উপস্থিত বা আহবান শুনতে পাচ্ছে এমন অবস্থায় থাকতে হবে।
৩। যে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে, সে সাহায্য করার মতো তাঁর ক্ষমতা থাকতে হবে। ৯
আল্লাহ ছাড়া কেউ ‘বিপত্তারণ’ বা ‘গওস’ নেই। সুতরাং বিপদে একমাত্র আল্লাহকেই ডাকতে হবে, একমাত্র তারই কাছে সাহায্য চাইতে হবে। বিপদে ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, ইয়া আলী, ইয়া জীলানী’ বলে সাহায্য চাওয়া শিরকে আকবর। মহান আল্লাহ বলেন,
“অথবা তিনি, যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীর প্রতিনিধি করেন। আল্লাহ্র সঙ্গে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই উপদেশ গ্রহণ করে থাক।”(নামলঃ৬২)
মহানবী (সঃ) বলেন, “যখন তুমি চাইবে, তখন আল্লাহ্র কাছেই চেয়ো। আর যখন তুমি প্রার্থনা করবে, তখন একমাত্র আল্লাহ্র কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করো।” ১০
মহানবী (সঃ) আমাদের মত রক্ত, মাংস ও অস্তির গড়া মানুষ ছিলেন। আমাদের মত পিতার ঔরসে ও মাতার গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিল। আমাদের মত তিনি খেতেন, পান করতেন। সুস্থ-অসুস্থ থাকতেন। বিস্মৃত হতেন, স্মরন করতেন। বিবাহ-শাদী করেছেন, তাঁর একাধিক স্ত্রী ছিল। তিনি সন্তানের জনক ছিলেন। ব্যবসা- বাণিজ্য করতেন। দুঃখ শোক, ব্যাথা ও যন্ত্রণা অনুভব করতেন। তাঁর প্রস্রাব- পায়খানা হত এবং তা অপবিত্র ছিল। তাঁর নাপাকীর উযু-গোসলের প্রয়োজন হতো। ১১ জীবিত ছিলেন, ইন্তিকাল করেছেন। মানুষের সকল প্রকৃতি ও প্রয়োজন তাঁর মাঝে ছিল।
মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সঃ)-কে বলেছেন,
তুমি বল, ‘আমি তো তোমাদেরই মতই একজন মানুষ; আমার প্রতি প্র্যত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য; সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকেও শরীক না করে।’(কাহফঃ ১১০, হা-মীম সাজদাহঃ৬)
পক্ষান্তরে কোন মানুষই তাঁর মত (সমান) নয়। আমরা তাঁর মতো মানুষ নই। অতিপ্রাকৃত বিষয়ে কেউই তাঁর মতো নয়। তিনি একটানা রোযা রাখতেন। সাহাবীগন তাঁর মতো রোযা রাখতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘এ বিষয়ে তোমরা আমার মতো নও। আমি তো রাত্রি অতিবাহিত করি, আর আমার প্রতিপালক আমাকে পানাহার করান।’১২
তাঁর দেহের ঘাম ছিল সুগন্ধি। একদা তিনি উম্মে সুলাইম (রঃ)'র ঘরে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। তিনি ঘর্মাক্ত হলে উম্মে সুলাইম সেই ঘাম জমা করতে লাগলেন। তিনি জেগে উঠে তা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার উম্মে সুলাইম?’ বললেন ‘আপনার ঘাম। আমাদের সুগন্ধিতে মিশিয়ে দেব। আর তা হবে শ্রেষ্ঠ সুগন্ধি।’১৩
তিনি বিশেষ ক’রে নামাযে সামনে যেমন দেখতেন, তেমনি পিছনেও দেখতেন। একদা এক নামাযের সালাম ফিরে তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের রুকু ও সিজদাকে পরিপূর্ণভাবে আদায় কর। সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রান আছে, আমার নিকট তোমাদের রুকু, সিজদাহ ও বিনয়-নম্রতা অস্পষ্ট নয়। আমি আমার পিঠের পিছনে থেকে দেখতে পাই, যেমন সামনে দেখতে পাই। ১৪
তাঁর চক্ষু নিদ্রাভিভূত হতো, কিন্তু হৃদয় নিদ্রাভিভূত হতো না। ১৫
তাঁর দেহ ও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন চুল, থুথু, তাঁর ব্যবহারিত জিনিস ইত্যাদি বরকতময় ছিল। ১৬
১৪ (আহমাদ ৯৭৯৬, বুখারী ৪১৮, মুসলিম ৯৮৬, হাকেম ১/৩৬১, ইবনে খুজাইমা ৪৭৪, মিশকাত ৮৬৮ নং)
১৫ (বুখারী ৮৫৯, ১১৪৭, মুসলিম ১৭৫৭, ১৮২৬, আবূ-দাঊদ ২০২, তিরমিযী ৪৩৯, নাসাঈ ৬৯৭ নং)
১৬ (বুখারী, মুসলিম ৩২১৩ নং)
নূরের তৈরি ফিরিশতামণ্ডলী। মহানবী (সঃ) আদমের অন্যতম সন্তান। সুতরাং তারাও আদিসৃষ্টি মাটি থেকেই।
তিনি আল্লাহ্র তরফ থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত পথভ্রষ্ট মানুষের জন্য প্রেরিত নূর (জ্যোতি বা আলো) ছিলেন। সেই নূর বা আলোতে জাহেলিয়াতে তমসাচ্ছন্ন যুগ ও সমাজ আলোকিত হল। অন্ধকারে দিশাহারা মানুষ সেই আলোকবর্তিকায় সরল পথের দিশা পেল। তাঁর দেহ নূরানি ছিল, কিন্তু তিনি নূর বা নূর থেকে সৃষ্টি ছিলেন না। মহান আল্লাহ্র সৃষ্টি বৃত্তান্তে একমাত্র ফিরিশতাই নূর থেকে সৃষ্টি। আর নবী মুস্তফা (সঃ) ফিরিশতা ছিলেন না।১৭ সর্বপ্রথম আল্লাহপাক আরশ ও কলম সৃষ্টি করেন।১৮ নূরে মুহাম্মাদী আল্লাহ্র প্রথম সৃষ্টি নয়। পক্ষান্তরে যে হাদীসে নূরে মুহাম্মাদীর কথা বলা হয়েছে, তা জাল বা বাতিল হাদীস।