লগইন করুন
ফজরের সালাতের পরে যিকর-এর ফযীলত ও গুরুত্ব জানতে পেরেছি। এখন প্রশ্ন: এই সময়ে আমরা কোন যিকর কী-ভাবে করব? এ সময়ের যিকরের বিষয়ে সুন্নাতে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা আছে কিনা? রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ কোনো যিকর করতেন কিনা? নাকি আমার ইচ্ছামতো যিকর আযকার করব?
আমরা আগেই বলেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতকে উজ্জ্বল আলোকিত রাজপথে রেখে গিয়েছেন। কোনো প্রকার অস্পষ্টতা বা দ্বিধার মধ্যে রেখে যাননি। উম্মতকে সবকিছুই শিখিয়ে গিয়েছেন। উম্মতের কোনো কিছু বানানোর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু তার সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ।
এই সময়ে যিকরের গুরুত্ব যেমন বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তেমনি এই সময়ের যিকর আযকারও বিভিন্ন হাদীসে সুনির্দিষ্টভাবে শেখানো হয়েছে। এই সময়ের মাসনূন যিকরগুলি প্রথমত দুই প্রকার : নির্ধারিত ও অনির্ধারিত। নির্ধারিত যিকরগুলি নির্ধারিত সংখ্যায় ফজরের পরে আদায় করতে হবে। এরপর বাকি সময় অনির্ধারিত যিকরগুলি অনবরত বা যত বেশি সম্ভব পালন করতে হবে।
নির্ধারিত যিকরগুলি নিম্নরূপ :
(১) যে সকল যিকর ফজর সালাতের পরে পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এগুলি দুই প্রকার : শুধুমাত্র ফজর সালাতের পরে পালনীয় যিকর এবং ফজর ও মাগরিবের পরে পালনীয় যিকর।
(২) যে সকল যিকর পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে পালনীয়। স্বভাবতই সেগুলিকে ফজর সালাতের পরে আদায় করতে হবে।
(৩) যে সকল যিকর সকাল ও বিকালে বা সকাল ও সন্ধ্যায় পালন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুবহে সাদেক থেকেই সকাল শুরু, এজন্য এসকল যিকর ফজর সালাতের আগেও আদায় করা যায়। তবে সাধারণত মুমিন ফজরের ফরয সালাত আদায়ের পরেই এ সকল যিকর আদায় করেন।
আর অনির্ধারিত যিকর হিসাবে তাসবীহ, তাহলীল, ওয়ায ইত্যাদি এই সময়ে পালনের জন্য হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আমরা এখানে এ সকল যিকরের আলোচনা করব। যাকির নিজের সময়, আবেগ ও প্রেরণা অনুযায়ী সকল যিকর বা কিছু যিকর পালন করবেন। কিছু যিকর পালনের ক্ষেত্রে বাছাই করা ও ওযীফা তৈরি করার দায়িত্ব তিনি নিজে পালন করবেন বা কোনো নেককার আলিমের সাহায্য গ্রহণ করবেন।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, উপরে উল্লেখিত ও নিম্নে আলোচিত বিভিন্ন প্রকারের যিকরের মধ্যে কোনো সন্নাত-সম্মত ক্রম বা তারতীব নেই। কোনটি আগে ও কোনটি পরে এমন কোনো বর্ণনা হাদীসে নেই। যিকরের কোনো তরতীব বা ক্রম হাদীসে বর্ণিত হয়নি। যাকির নিজের সুবিধা, ক্বলবের হালত ও সময়-সুযোগ মতো যিকর নির্বাচন করতে পারেন বা আগে পিছে করে সাজাতে পারেন। কোনো যিকর আগে এবং কোনো যিকর পরে করার মধ্যে কোনো সাওয়াব নেই। সাওয়াব যিকর পালনের মধ্যে। সুন্নাতে নববীতে উল্লেখ করা হয়নি এমন কোনো নির্দিষ্ট তারতীব বা সাজানোকে অলঙ্ঘনীয় মনে করা বা এতে বিশেষ কোনো সাওয়াব আছে বলে মনে করা সুন্নাতের খেলাফ ও তা যাকিরকে বিদ’আতের মধ্যে নিপতিত করবে।
আমি এখানে আলোচনার সুবিধার জন্য একটি তারতীবে যিকরগুলি আলোচনা করছি। যাকির নিজের অবস্থা অনুসারে যিক্র নির্বাচন করবেন। প্রথমে আমি নির্ধারিত যিকরগুলি আলোচনা করছি। এগুলি সুন্নাত নির্ধারিত সংখ্যা পালন করতে হবে। যেখানে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি সেখানে একবার পড়তে হবে।
তিন প্রকার নির্ধারিত যিকর
প্রথম প্রকার যিকর : ফজরের পরে পালনের জন্য নির্ধারিত
এই পর্যায়ে তিনটি যিকর উল্লেখ করা হলো। একটি যিকর শুধু ফজরের পরে ও অন্য দুটি ফজর ও মাগরিবের পরে পালনীয়।
যিকর নং ৬৮ : ফজরের সালাতের পরের দু‘আ: (১ বার)
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا وَرِزْقًا طَيِّبًا
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আস্আলুকা ‘ইলমান না-ফি‘আন, ওয়া ‘আমালান মুতাক্বাব্বালান ওয়া রিযক্বান তবাইয়িবান।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে চাচ্ছি কল্যাণকর জ্ঞান, কবুলকৃত কর্ম ও পবিত্র রিযিক।” (১ বার)
উম্মু সালামা (রাঃ) বলেনঃ (إن النبي صلى الله عليه وسلم يقول في دبر الفجر إذا صلي) নবীয়ে আকরাম (সা.) ফজরের সালাতের শেষে, যখন সালাত আদায় হয়ে যেত তখন এই বাক্যগুলি বলতেন।”[1]
যিকর নং ৬৯ : ফজর ও মাগরিবের পরের যিকর-১
বিভিন্ন হাদীসে আমরা কিছু যিকরের কথা জানতে পারি যা রাসূলুল্লাহ (সা.) ফজর ও মাগরিবের সালাতের পরে পড়ার জন্য বিশেষভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। এ ধরনের যিকরের মধ্যে অন্যতম ইতঃপূর্বে উল্লেখিত ৩ নং যিকর:
لَا إلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الـمُلْكُ وَلَهُ الـحَمْدُ، يُحْيِي وَيُمِيتُ (بِيَدِهِ الـخَيْرُ) وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণ : লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া‘হদাহু লা- শারীকা লাহু, লাহুল মুলক, ওয়া লাহুল ‘হামদ, ইউ‘হয়ী ওয়া ইউমীতু (বিইয়াদিহিল খাইরু) ওয়া হুআ ‘আলা- কুলিল শাইয়িন কাদীর।
অর্থঃ “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনিই জীবন
দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন। তাঁর হাতেই সকল কল্যাণ এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।”
বিভিন্ন হাদীসে ফজর সালাতের পরেই সালাতের অবস্থায় পা ভেঙ্গে বসে থেকেই ১০০ বার অথবা ১০ বার এই যিকর করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঠিক অনুরূপভাবে মাগরিব সালাতের পরেই না নড়ে এবং পা না গুটিয়ে ১০ বার বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আবু যার (রাঃ), আব্দুর রাহমান ইবনু গানম (রাঃ), উমারাহ ইবনু শাবীব (রাঃ), আবু আইউব আনসারী (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি মাগরিবের সালাতের পর এবং ফজরের সালাতের পর, ঘুরে বসা বা নড়াচড়ার আগেই, পা গুটানো অবস্থাতেই, কোনো কথা বলার আগে এই যিকরটি ১০ বার পাঠ করবে আল্লাহ তার প্রত্যেক বারের জন্য জন্য ১০ টি সাওয়াব লিখবেন, ১০ টি গোনাহ ক্ষমা করবেন, তাঁর ১০ টি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন, ঐদিনের জন্য তাকে সকল অমঙ্গল ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করা হবে, শয়তান থেকে পাহারা দেওয়া হবে। ঐদিনে শির্ক ছাড়া কোনো গোনাহ তাঁকে ধরতে পারা উচিত নয়। যে ব্যক্তি তার চেয়ে বেশি বলবে সে ছাড়া অন্য সবার চেয়ে সে ঐ দিনের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আমলকারী বলে গণ্য হবে।” বিভিন্ন সহীহ ও হাসান সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত।[2]
আবু উমামাহ (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি ফজরের সালাতের পরেই তাঁর পা গুটানোর আগেই যিকরটি ১০০ বার পাঠ করবে, সে ব্যক্তি ঐ দিনের শ্রেষ্ঠ আমলকারী বলে বিবেচিত হবে। তবে যে ব্যক্তি তাঁর মতো বা তাঁর চেয়ে বেশি বলবে তাঁর কথা ভিন্ন।” হাদীসটির সনদ হাসান।[3]
একটি দুর্বল সনদের হাদীসে এই যিকরটি প্রত্যেক ফরয সালাতের শেষে সালাতের অবস্থায় পা ভাজ করে বসে থেকেই কথা বলার পূর্বে দশবার বলতে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং তার বিশেষ ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে।[4]
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে এই যিকরটির সাধারণ ফযীলত আলোচনা করেছি। পরবর্তীতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরের যিকরের মধ্যেও এই যিকরটি উল্লেখ করতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) এই যিকরটি খুব বেশি পালন করতেন ও শিক্ষা দিতেন। বিভিন্ন হাদীসে প্রত্যেক সালাতের পরে, সকালে, সন্ধ্যায় বা সারাদিন এই যিকরটি পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সকল সহীহ হাদীসের আলোকে প্রত্যেক মুসল্লীর উচিত কমপক্ষে সকল ফরয সালাতের সালাম ফেরানোর পরে অন্তত ১ বার, ফজর ও মাগরিবের পরে ১০ বার করে ও সারাদিনে ২০০ বার বা কমপক্ষে ১০০ বার এই যিকরটি পাঠ করা। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক প্রদান করুন ; আমীন।
[2] সহীহুত তারগীব ১/২৬২-২৬৪, ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল আসার ১/৪১-৪২, তিনি হাদিসটি ইমাম আবু হানিফার সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
[3] সহীহুত তারগীব ১/২৬৩।
[4] আব্দুর রাজ্জাক সান’আনী, আল-মুসান্নাফ ২/২৩৫।