লগইন করুন
হাজারের ঊর্ধ্বে মাত্র সাতজন সাহাবি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যথা: ১. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (৫৩৭৪), ২. আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (২৬৩০), ৩. আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (২২৮৬), ৪. উম্মুল মুমেনিন আয়েশা রাদিয়াল্লাহ ‘আনহা, হাদিস সংখ্যা: (২২১০), ৫. আব্দুল্লাহ ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১৬৬০), ৬. জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১৫৪০), ৭. আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহ ‘আনহু, হাদিস সংখ্যা: (১১৭০), তাদের উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন।
২. সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন:
হাদিসের শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সাহাবিগণ হাদিস বলতেন না। তবু ভুল হয়েছে ভয়ে হাদিস বর্ণনার সময় কেউ আঁতকে উঠতেন, কোথাও সন্দেহ হলে বিনা সংকোচে বলে দিতেন। কেউ একটি হাদিস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বহুদূর পর্যন্ত সফর করেন, যেমন জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ একটি হাদিসের জন্য আব্দুল্লাহ ইব্ন উনাইসের নিকট শামে গিয়েছেন।[1] আবু আইয়ূব আনসারি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটি হাদিসের জন্য উকবাহ ইব্ন আমের-এর নিকট মিসরে গিয়েছেন।[2]
৩. সাহাবিগণ হুবহু হাদিস বর্ণনার চেষ্টা করেন:
সাহাবিগণ হ্রাস-বৃদ্ধি ব্যতীত হুবহু হাদিস বর্ণনার চেষ্টা করতেন। কখনো হুবহু শব্দ বলা কঠিন হলে ভাবার্থ বলতেন। তারা ভাষা জানতেন, শরীয়তের উদ্দেশ্য বুঝতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেক্ষাপট দেখেছেন, তাই এতে সাধারণত তাদের ভুল হত না।
৪. সাহাবিগণ হাদিস যাচাই করেন:
সাহাবিগণ কোনো হাদিস প্রসঙ্গে সন্দেহ হলে যাচাই করেন। বিশেষভাবে আবু বকর এরূপ বেশী করেন, অতঃপর তার অনুসরণ করেন ওমর। তারা কখনো রাবির নিকট সাক্ষী তলব করেন, যেমন মুগিরা ইব্ন শু‘বা যখন বলেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাতির পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে দাদিকে এক ষষ্ঠাংশ মিরাস প্রদান করেছেন, তখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার নিকট সাক্ষী তলব করেন, আর মুহাম্মদ ইব্ন মাসলামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।[3] অনুরূপ আবু মুসা আশ‘আরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন তিনবার অনুমতি প্রসঙ্গে হাদিস বলেন, ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার হাদিস গ্রহণ করেননি যতক্ষণ না আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সাথে সাক্ষ্য দিয়েছেন।[4] আলি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাদিসের শুদ্ধতার জন্য কখনো রাবি থেকে কসম নিতেন।
তাদের উদ্দেশ্য কখনো হাদিসের পথ সংকীর্ণ কিংবা রুদ্ধ করা ছিল না, বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভুল ও মিথ্যার সুযোগ নষ্ট করা, যেন সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোনো হাদিস সম্পৃক্ত করার পূর্বে সতর্ক হয়।
৫. সাহাবিগণ সনদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন:
সাহাবিগণ হাদিসের শুদ্ধতা রক্ষার স্বার্থে হাদিসের সনদ তলব করেন, অপরকে গ্রহণযোগ্য রাবি থেকে শ্রবণ করার নির্দেশ দেন। কারণ মানুষ যখন দলেদলে ইসলামে প্রবেশ করছিল, তখন একটি কুচক্রী মহল দীনের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা আরম্ভ করে, তাই হাদিস গ্রহণ করার পূর্বে রাবির অবস্থা জানা আবশ্যক হয়, বিশেষ করে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর শাহাদাত পরবর্তী সময়ে। তখন মুসলিম সমাজে প্রসিদ্ধ ছিল:
«إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ»
“নিশ্চয় এ ইলম দীনের অংশ, অতএব পরখ করে দেখ কার থেকে তোমরা তোমাদের দীন গ্রহণ করছ”।[5] মুহাম্মদ ইব্ন সিরিন রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন:
«لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنِ الإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ، قَالُوا: سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ، فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ، وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ، فَلَا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ».
“তারা সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না, কিন্তু যখন ফিতনা (উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর শাহাদাত) সংঘটিত হল, তারা বলল: তোমরা আমাদেরকে তোমাদের রাবিদের নাম বল, আহলে সুন্নাহ হলে তাদের হাদিস গ্রহণ করা হবে, আর বিদআতি হলে তাদের হাদিস ত্যাগ করা হবে”।[6]
উকবাহ ইব্ন ‘আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সন্তানদের উপদেশ দিয়ে বলেন: “হে বৎসগণ, আমি তোমাদেরকে তিনটি বিষয় থেকে নিষেধ করছি, ভালো করে স্মরণ রেখ: নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ব্যতীত কারো থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস গ্রহণ কর না, উলের মোটা কাপড় পরলেই দীনদার হবে না, আর কবিতা লিখে তোমাদের অন্তরকে কুরআন বিমুখ করো না”।[7]
আনাস ইব্ন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু স্বীয় ছাত্র সাবিত ইব্ন আসলাম আল-বুনানিকে বলেন: “হে সাবিত আমার থেকে গ্রহণ কর, তুমি আমার অপেক্ষা নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না, কারণ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছি, তিনি জিবরীল থেকে গ্রহণ করেছেন, আর জিবরীল আল্লাহ তা‘আলা থেকে গ্রহণ করেছেন”।[8]
৬. সাহাবি সাহাবির নিকট হাদিস পেশ করেন:
এক সাহাবি অপর সাহাবির নিকট হাদিস পেশ করে শুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তাদের বিশ্বাস ছিল কোনো সাহাবি মিথ্যা বলে না, বা সজ্ঞানে বিকৃতি করে না, তবে কারো ভুল হতে পারে, কারো স্মৃতি থেকে কোনো বিষয় হারিয়ে যেতে পারে, তাই ভুল হওয়া অসম্ভব নয়। অতএব তারা অপরকে শুনিয়ে হাদিস যাচাই করতেন। ইমাম বুখারি ও মুসলিম[9] বর্ণনা করেন: ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
«إِنَّ الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبَعْضِ بُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ»
“নিশ্চয় মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের কতক কান্নায় শাস্তি দেওয়া হয়”। ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মৃত্যুর পর আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে এ হাদিস বলি। তিনি বললেন: আল্লাহ ওমরের উপর রহম করুন। আল্লাহর শপথ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বলেননি:
«إِنَّ الْمَيِّتَ يُعَذَّبُ بِبَعْضِ بُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ»
তবে তিনি বলেছেন:
«إِنَّ اللَّهَ لَيَزِيدُ الْكَافِرَ عَذَابًا بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ»
“নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরের শাস্তি বৃদ্ধি করেন, তার উপর তার পরিবারের কান্নার কারণে”। অতঃপর তিনি বলেন: (এ ব্যাপারে) তোমাদের জন্য কুরআন যথেষ্ট।
﴿ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰۚ ١٨ ﴾ [فاطر: ١٨]
“কোনো বোঝা বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না”।[10]
৭. রাবিদের সমালোচনার সূচনা:
সাহাবিদের যুগ থেকে রাবিদের যাচাই করা আরম্ভ হয়। কারো হাদিস তারা প্রত্যাখ্যান করেন, কারো হাদিস সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ্ মুজাহিদ ইব্ন জাবর থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “ইব্ন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট বুশাইর আদাবি এসে বলতে লাগল: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন”, কিন্তু ইব্ন আব্বাস তাকে হাদিস বলার অনুমতি দেননি, তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেননি। সে বলল: হে ইব্ন আব্বাস, আপনি কেন মনোনিবেশ করছেন না! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বলছি, আপনি শুনছেন না! ইব্ন আব্বাস বলেন: “আমরা এক সময়ে ছিলাম, যখন কাউকে বলতে শুনতাম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাদের চোখ তাকে লুফে নিত, তার দিকে আমরা মনোযোগ দিতাম, কিন্তু লোকেরা যখন কঠিন ও নরম বাহনে আরোহণ করল (হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রশংসিত ও নিন্দনীয় উভয় পন্থা অবলম্বন করল), তখন থেকে পরিচিত বস্তু গ্রহণ করি”। অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যখন মিথ্যা বলা হত না, তখন আমরা হাদিস বলতাম, কিন্তু লোকেরা যখন উঁচু-নিচু উভয় বাহনে আরোহণ করল, আমরা তার থেকে হাদিস বর্ণনা করা ত্যাগ করি”।[11]এভাবে সাহাবিদের যুগ শেষ না হতেই সনদ তলব করা আরম্ভ হয় এবং علم الجرح والتعديل তথা ‘সমালোচনা শাস্ত্রে’র সূচনা হয়। তারা সহি হাদিস ও সেকাহ রাবি চিহ্নিত করার কতক নীতি তৈরি করেন, যা সবার নিকট প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণে স্বতন্ত্র গ্রন্থে জমা করার প্রয়োজন হয়নি।
[2] আহমদ: (৪/১৫৩, ১৫৯), ‘মুসনাদ’ লিল হুমাইদি: (১/১৮৮৯-১৯০), হাদিস নং: (৩৮৪), ‘মারেফাতু উলুমুল হাদিস’ লিল হাকেম: (৭-৮), ‘আর-রেহলাহ’ লিল খতিব: (পৃ.ই১১৮), হাদিস নং: (৩৪), ‘আল-আসমাউল মুবহামাহ’: (পৃ.৬৩-৬৪), হাদিস নং: (৩৭), ‘জামে বায়ানুল ইলম’: (১/৩৯২), হাদিস নং: (৫৬৭)
[3] আবু দাউদ: (৩/১২১), হাদিস নং: (২৮৯৪), তিরমিযি: (৪/৪১৯), হাদিস নং: (৪১৯-৪২০), ইব্ন মাজাহ: (২/৯০৯-৯১০), মালেক: (৪০৭)
[4] বুখারি: (১১/২৬-২৭), হাদিস নং: (৬২৪৫), মুসলিম: (৩/১৬৯৪-১৬৯৬)
[5] মুসলিম: (১/১৪), মুসলিমের ভূমিকা দেখুন।
[6] মুসলিম: (১/১৪), মুসলিমের ভূমিকা দেখুন।
[7] মু‘জামুল কাবির: (১৭/২৬৮), মাজমাউয যওয়ায়েদ: (১/১৪০)
[8] তিরমিযি: (৫/৬১৪), হাদিস নং: (৩৮৩১)
[9] বুখারি: (৩/১৫০), হাদিস নং: (১২৮৭), মুসলিম: (২/৬৪২), হাদিস নং: (৯২৯)
[10] সূরা ফাতের: (১৭)
[11] মুসলিম: (১/১৩), দেখুন: মুকাদ্দামাহ।