লগইন করুন
কুরআন যারা মানেন এবং যারা মানেন না, সকলে কুরআনের বিভিন্নমুখী হেদায়াত থেকেই আলো নিয়েছেন। বরং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎসই হ’ল কুরআন। অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের এই বৈশিষ্ট্য নেই। বিজ্ঞানীদের মতে কুরআনের প্রতি ১১টি আয়াত বিজ্ঞান বহন করে। এর দ্বারা তারা হয়ত কেবল বস্ত্তগত বিজ্ঞান সমূহের হিসাব করেছেন। কিন্তু এছাড়াও সেখানে রয়েছে সমাজ বিজ্ঞান, অধ্যাত্ম বিজ্ঞান, ভাষা বিজ্ঞান, সমর বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব ও নভো বিজ্ঞান প্রভৃতি। তাছাড়া রয়েছে জীবনের বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখাগত বিষয়ক বিজ্ঞান। সে হিসাবে কুরআনের প্রতিটি আয়াতই বিজ্ঞান বহন করে। কুরআনী বিজ্ঞানের চর্চা করেই মুসলমানেরা কয়েক শতাব্দীব্যাপী বিশ্ব বিজ্ঞানের অগ্রনায়ক ছিল। অতঃপর বাগদাদ ও স্পেনের রাজনৈতিক পতনের ফলে বিজ্ঞানেরও পতন ঘটে এবং তাদেরই রেখে যাওয়া বিজ্ঞানের অনুসরণ করে বস্ত্তবাদী ইউরোপ আজ ক্রমে মুসলমানদের শূন্যস্থান পূরণ করে চলেছে।
মনুষ্য বিজ্ঞানের উৎস হ’ল অনুমিতি। যা যেকোন সময় ভুল প্রমাণিত হয়। যেমন বিজ্ঞানীরা বলেন, Science gives us but a partial knowledge of reality ‘বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয়’।[1] তারা স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে থাকেন। তারা বলেন, ‘আমরা কতিপয় বাহ্য প্রকাশকে দেখি মাত্র, মূল বস্ত্তকে দেখিনা’। যেমন ধোঁয়া দেখে মানুষ আগুনের সন্ধানে ছুটে থাকে। কিন্তু কুরআনী বিজ্ঞানের উৎস হ’ল আল্লাহর অহী। যেখানে ভুলের কোন অবকাশ নেই। যেমন আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ ‘সম্মুখ থেকে বা পিছন থেকে এর মধ্যে মিথ্যার কোন প্রবেশাধিকার নেই। এটি ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হয়েছে প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২)। আজকের যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমরা দেখছি তার প্রায় সবেরই উৎস রয়েছে কুরআনে। যা সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়েছিল চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে একজন মরুচারী নিরক্ষর নবীর মুখ দিয়ে- যা ছিল আল্লাহর কালাম। উদাহরণ স্বরূপ-
(১) জগত সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক তথ্য হিসাবে বলা হয়, ‘কোটি কোটি বছর পূর্বে বিশ্বজগত একটি অখন্ড জড়বস্ত্ত রূপে বিদ্যমান ছিল। পরে তার কেন্দ্রে একটি মহাবিস্ফোরণ ঘটে, যাকে Big-Bang বলা হয়। সেই মহা বিস্ফোরণের ফলে আমাদের সৌরজগত, ছায়াপথ, তারকারাজি ইত্যাদি সৃষ্টি হ’ল এবং বিনা বাধায় সর্বত্র সন্তরণ করে চলল’। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এ তথ্য প্রদান করেছে। আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَرَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقاً فَفَتَقْنَاهُمَا ‘অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরস্পরে মিলিত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৩০)। প্রশ্ন হ’ল, বিস্ফোরণ ঘটালো কে? সেখানে প্রাণের সঞ্চার হ’ল কিভাবে? অতঃপর বিশাল সৃষ্টি সমূহ অস্তিত্বে আনল কে? যদি কেউ বলে যে, প্রেস মেশিনে বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং তা ধ্বংস হয়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। অতঃপর সেখানে তৈরী হয়েছে বড় বড় গবেষণাগ্রন্থ। একথা কেউ বিশ্বাস করবে কি?
(২) প্রাণের উৎস কি? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পানি থেকেই প্রাণীজগতের উদ্ভব। অথচ কুরআন একথা আগেই বলেছে, وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلاَ يُؤْمِنُونَ ‘আমরা প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করেছি পানি হতে। তবুও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (আম্বিয়া ২১/৩০; নূর ২৪/৪৫)। প্রশ্ন হ’ল, পানি সৃষ্টি করল কে? অতঃপর তার মধ্যে প্রাণ শক্তি এনে দিল কে?
(৩) বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিটি প্রাণসত্তার মধ্যে রয়েছে বিপরীতধর্মী দু’টি শক্তির জোড়। যার একটি পজেটিভ বা প্রোটন এবং অপরটি নেগেটিভ বা ইলেকট্রন। এমনকি বিদ্যুতের ন্যায় প্রাণহীন বস্ত্তর মধ্যেও রয়েছে এই জোড়ার সম্পর্ক। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এর তথ্য দিয়েছে, سُبْحَانَ الَّذِيْ خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لاَ يَعْلَمُوْنَ ‘মহাপবিত্র সেই সত্তা, যিনি ভূ-উৎপন্ন সকল বস্ত্ত এবং মানুষ ও তাদের অজানা সবকিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন’ (ইয়াসীন ৩৬/৩৬)। (৪) উদ্ভিদের জীবন আছে, একথা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭ খৃ.) মাত্র সেদিন আবিষ্কার করলেন। অথচ বহু পূর্বেই একথা কুরআন বলে দিয়েছে। وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ ‘নক্ষত্ররাজি ও উদ্ভিদরাজি আল্লাহকে সিজদা করে’ (রহমান ৫৫/৬; ইসরা ১৭/৪৪; নূর ২৪/৪১ প্রভৃতি)। স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মানে পাথর ও বৃক্ষসমূহ ঝুঁকে পড়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। আকাশের মেঘমালা তাঁকে ছায়া করেছে।[2] এমনকি তাঁর হুকুমে ছায়াদার বৃক্ষ নিজের স্থান থেকে উঠে এসে তার নিকটে দাঁড়িয়ে তাঁকে ছায়া করেছে। আবার তাঁর হুকুমে স্বস্থানে ফিরে গেছে।[3] এগুলো সবই উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে, তার প্রমাণ বহন করে। (৫) এমনকি এর চাইতে বড় তথ্য কুরআন প্রকাশ করেছে, বিজ্ঞানীরা আজও যা প্রমাণ করতে পারেনি। আর তা হ’ল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রাণ আছে এবং আছে বোধশক্তি। যেমন আল্লাহ বলেন, ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاء وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ اِئْتِيَا طَوْعاً أَوْ كَرْهاً قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِيْنَ ‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রবিশেষ। অনন্তর তিনি ওটাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম অনুগত হয়ে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১১)।
(৬) নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল ও তন্মধ্যকার সবকিছু সর্বদা আল্লাহর গুণগান করে। কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেন, تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلاَّ يُسَبِّحُ بِحَمْدَهِ وَلَـكِن لاَّ تَفْقَهُونَ تَسْبِيْحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيْماً غَفُوْراً ‘সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যকার সবকিছু তাঁরই গুণগান করে। আর এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা করে না। কিন্তু ওদের গুণগান তোমরা বুঝতে পারো না। নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল ও ক্ষমাপরায়ণ’ (ইসরা ১৭/৪৪)। এগুলি সবই আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যে তথ্য কেবলমাত্র কুরআনই আমাদেরকে প্রদান করেছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
[2]. তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।
[3]. মুসলিম হা/৩০১২; দারেমী হা/২৩; মিশকাত, ঐ, হা/৫৮৮৫, ৫৯২৪।