লগইন করুন
জানা আবশ্যক যে, ২৫ বছরের টগবগে যৌবনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বিবাহ করেন পরপর দুই স্বামী হারা বিধবা ও কয়েকটি সন্তানের মা ৪০ বছরের একজন প্রৌঢ়া মহিলাকে। এই স্ত্রীর মৃত্যুকাল অবধি দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তাকে নিয়েই সংসার করেছেন। অতঃপর ৬৫ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা স্ত্রী খাদীজার মৃত্যু হ’লে তিনি নিজের ৫০ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন আর এক ৫০ বছর বয়সী কয়েকটি সন্তানের মা একজন বিধবা মহিলা সাওদাকে নিতান্তই সাংসারিক প্রয়োজনে। এরপর মক্কা হ’তে হিজরত করে তিনি মদীনায় চলে যান। যেখানে শুরু হয় ইসলামী সমাজ গঠনের জীবন-মরণ পরীক্ষা। ফলে মাদানী জীবনের দশ বছরে বিভিন্ন বাস্তব কারণে ও ইসলামের বিধানসমূহ বাস্তবায়নের মহতী উদ্দেশ্যে আল্লাহর হুকুমে তাঁকে আরও কয়েকটি বিবাহ করতে হয়। উল্লেখ্য যে, চারটির অধিক স্ত্রী একত্রে রাখার অনুমতি আল্লাহপাক স্রেফ তাঁর রাসূলকে দিয়েছিলেন। অন্য কোন মুসলিমের জন্য নয় (আহযাব ৩৩/৫০)।
আরও উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন যে, مَا لِى فِى النِّسَاءِ مِنْ حَاجَةٍ ‘আমার জন্য মহিলার কোন প্রয়োজন নেই’ (বুখারী হা/৫০২৯)। প্রশ্ন হ’ল, তাহ’লে কেন তিনি এতগুলো বিয়ে করলেন? এর জওয়াবে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলি পেশ করব।-
(১) শত্রু দমনের স্বার্থে (لدفع الأعداء) : গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন রীতির মধ্যে একটি রীতি ছিল এই যে, তারা জামাতা সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিত। জামাতার সঙ্গে যুদ্ধ করা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারটি ছিল তাদের নিকটে দারুণ লজ্জা ও অসম্মানের ব্যাপার। তাই আল্লাহ পাক স্বীয় নবীকে একাধিক বিবাহের অনুমতি দেন বর্বর বিরুদ্ধবাদী শক্তিকে ইসলামের সহায়ক শক্তিতে পরিণত করার কৌশল হিসাবে। যা দারুণ কার্যকর প্রমাণিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ।-
(ক) ৪র্থ হিজরীতে উম্মে সালামাহকে বিবাহ করার পর তাঁর গোত্র বনু মাখযূমের স্বনামধন্য বীর খালেদ বিন অলীদের যে দুর্ধর্ষ ভূমিকা ওহোদ যুদ্ধে দেখা গিয়েছিল, তা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং ৭ম হিজরীর শুরুতে তিনি মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন।
(খ) ৫ম হিজরীতে জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে বনু মুছত্বালিক্ব গোত্রের যুদ্ধবন্দী একশত জন ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান হয়ে যান এবং চরম বিরুদ্ধবাদী এই গোত্রটি মিত্রশক্তিতে পরিণত হয়। জুওয়াইরিয়া (রাঃ) তার কওমের জন্য বড় ‘বরকত মন্ডিত মহিলা’ (كَانَتْ أَعْظَمَ بَرَكَةً) হিসাবে বরিত হন এবং তাঁর গোত্র রাসূল (ছাঃ)-এর শ্বশুর গোত্র (أَصْهَارُ رَسُولِ اللهِ) হিসাবে সম্মানজনক পরিচিতি লাভ করে’ (আবুদাঊদ হা/৩৯৩১)।
(গ) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে উম্মে হাবীবাহকে বিবাহ করার পর তাঁর পিতা কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান আর রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেন না। বরং ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের পূর্বরাতে তিনি ইসলাম কবুল করেন।
(ঘ) ৭ম হিজরীর ছফর মাসে ছাফিয়াকে বিবাহ করার ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইহূদীদের যুদ্ধ তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সন্ধি করে তারা খায়বরে বসবাস করতে থাকে।
(ঙ) ৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সর্বশেষ মায়মূনা বিনতুল হারেছকে বিবাহ করার ফলে নাজদবাসীদের অব্যাহত শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। কেননা মায়মূনার এক বোন ছিলেন নাজদের সর্দারের স্ত্রী। এরপর থেকে উক্ত এলাকায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার বাধাহীনভাবে চলতে থাকে। অথচ ইতিপূর্বে এরাই ৪র্থ হিজরীতে ৭০ জন ছাহাবীকে দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। যা ‘বি’রে মা‘ঊনার ঘটনা’ নামে প্রসিদ্ধ।
২য় কারণ : ইসলামী বন্ধন দৃঢ়করণ (تقوية صلة الإسلام) :
আয়েশা ও হাফছাকে বিবাহ করার মাধ্যমে হযরত আবুবকর ও ওমরের সঙ্গে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব দৃঢ়তর ভিত্তি লাভ করে। ওছমান ও আলীকে জামাতা করার পিছনেও রাসূল (ছাঃ)-এর অনুরূপ উদ্দেশ্য থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে ইসলাম জগত চারজন মহান খলীফা লাভে ধন্য হয়।
৩য় কারণ : কুপ্রথা দূরীকরণ (إزالة الرسم الجاهلى) :
পোষ্যপুত্র নিজের পুত্রের ন্যায় এবং তার স্ত্রী নিজের পুত্রবধুর ন্যায় হারাম- এ মর্মে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক কুপ্রথার অপনোদনের জন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র যায়েদ বিন হারেছাহর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহশকে বিবাহ করেন। এ বিষয়ে সূরা আহযাবের ৩৭ ও ৪০ আয়াত দু’টি নাযিল হয়। বস্ত্ততঃ এ বিষয়গুলি এমন ছিল যে, এসব কুপ্রথা ভাঙার জন্য কেবল উপদেশই যথেষ্ট ছিল না। তাই আল্লাহর হুকুমে স্বয়ং নবীকেই সাহসী পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হয়েছিল।
৪র্থ কারণ : মহিলা সমাজে ইসলামের বিস্তার (انتشار الإسلام بين النساء) :
শিক্ষা-দীক্ষাহীন জাহেলী সমাজে মহিলারা ছিল পুরুষের তুলনায় আরো পশ্চাদপদ। তাই তাদের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যোরদার করার জন্য মহিলা প্রশিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা ছিল সর্বাধিক। পর্দা ফরয হওয়ার পর এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ তাঁর সহযোগী হিসাবে একাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অধিক স্ত্রী অর্থই ছিল অধিক প্রশিক্ষিকা। কেবল মহিলারাই নন, পুরুষ ছাহাবীগণও বহু বিষয়ে পর্দার আড়াল থেকে তাঁদের নিকট হ’তে হাদীছ জেনে নিতেন। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরেও মা আয়েশা, হাফছাহ, উম্মে সালামাহ প্রমুখের ভূমিকা ছিল এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, একাধিক বিবাহ ব্যবস্থাকে যারা কটাক্ষ করতে চান, তাদের জানা উচিত যে, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য সবার প্রতি সমান ব্যবহারের শর্তে সর্বোচ্চ চার জন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাধ্য করেনি। পক্ষান্তরে আধুনিক সভ্যতার দাবীদার পাশ্চাত্যের ফ্রি ষ্টাইল যৌন জীবনে অভ্যস্ত হতাশাগ্রস্ত সমাজ জীবনের গভীরে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, সেখানে অশান্তির আগুন আর মনুষ্যত্বের খোলস ব্যতীত কিছুই নেই। অথচ প্রকৃত মুসলিমের পারিবারিক জীবন পরকালীন কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও নিষ্কাম ভালোবাসায় আপ্লুত থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পারিবারিক জীবন যার বাস্তব দৃষ্টান্ত।