লগইন করুন
মক্কা বিজয়ের পর থেকে সমস্ত আরব উপদ্বীপের লোকদের মধ্যে ইসলামের বিজয়ী ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা জন্মে এবং ৯ম ও ১০ম হিজরী সনেই চারদিক থেকে দলে দলে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিদের আগমন ঘটে। এমন কথাও জানা যায় যে, ইয়ামন থেকে ৭০০ মুসলমান কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে এবং কেউ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে পড়তে মদীনায় উপস্থিত হয়। তাদের উৎসাহ দেখে রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের কাছে ইয়ামানীরা এসেছে। অন্তরের দিক দিয়ে তারা সবচেয়ে দুর্বল ও নরম। দ্বীনের বুঝ হ’ল ইয়ামানীদের এবং প্রজ্ঞা হ’ল ইয়ামানীদের।[1] অনুরূপ উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল আরবের প্রায় সর্বত্র। প্রকৃত অর্থে ‘মদীনা’ তখন আরব উপদ্বীপের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিল। ইচ্ছায় হৌক, অনিচ্ছায় হৌক মদীনার আনুগত্য স্বীকার করা ব্যতীত কারু কোন উপায় ছিল না।
একথা অনস্বীকার্য যে, দলীয় হুজুগের মধ্যে ভাল-মন্দ সবধরনের লোক যুক্ত হয়ে যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ফলে এইসব লোকদের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যাদের হৃদয়ে ইসলাম শিকড় গাড়তে পারেনি। পূর্বেকার জাহেলী মনোভাব ও অভ্যাস তাদের মধ্যে তখনও জাগরুক ছিল। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,
الْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَّنِفَاقًا وَّأَجْدَرُ أَلاَّ يَعْلَمُوا حُدُوْدَ مَا أَنْزَلَ اللهُ عَلَى رَسُوْلِهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ- وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يَّتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ مَغْرَمًا وَّيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ- ( التوبة 97-98)-
‘বেদুঈন লোকেরা কুফরী ও মুনাফেকীতে অতি কঠোর এবং তারাই এ ব্যাপারে অধিক যোগ্য। কেননা তারা জানেনা ঐসব বিধানসমূহ, যা আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী’। ‘বেদুঈনদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করাকে জরিমানা মনে করে এবং তোমাদের উপরে কালের আবর্তন সমূহ (অর্থাৎ বিপদসমূহ) আপতিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। অথচ তাদের উপরেই হয়ে থাকে কালের অশুভ আবর্তন। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (তওবাহ ৯/৯৭-৯৮)।
আবার এদের মধ্যে ছিলেন বহু প্রকৃত ঈমানদার মুসলমান। যাদের মধ্য হ’তেই মুসলিম সমাজ লাভ করে ইয়ামন থেকে আগত আশ‘আরী গোত্রের খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আবু মূসা আশ‘আরী, দাউস গোত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী হাদীছজ্ঞ ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা, ত্বাঈ গোত্রের হযরত ‘আদী বিন হাতেম প্রমুখ অগণিত বিশ্বখ্যাত মনীষী ছাহাবীবৃন্দ। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,
وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يُّؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ قُرُبَاتٍ عِنْدَ اللهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُوْلِ أَلاَ إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَهُمْ سَيُدْخِلُهُمُ اللهُ فِيْ رَحْمَتِهِ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ-(التوبة ৯৯)-
‘বেদুঈনদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের উপরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে এবং তারা যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ও রাসূল-এর দো‘আ লাভের উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করে। মনে রেখ, নিশ্চয়ই তাদের এই ব্যয় (আল্লাহর) নৈকট্য স্বরূপ। আল্লাহ তাদেরকে সত্বর স্বীয় অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করাবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/৯৯)।
১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) শিরকী জাহেলিয়াতের চির অবসানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন,أَلاَ كُلُّ شَيْءٍ مِّنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَيَّ مَوْضُوْعٌ ‘শুনে রাখো, জাহেলী যুগের সকল রীতিনীতি আমার পায়ের তলে পিষ্ট হ’ল’। অতঃপর তিনি বলেন, أَلاَ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ مِنْ أَنْ يُعْبَدَ فِى بِلاَدِكُمْ هَذِهِ أَبَدًا وَلَكِنْ سَتَكُونُ لَهُ طَاعَةٌ فِيمَا تَحْتَقِرُونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ فَسَيَرْضَى بِهِ ‘মনে রেখ, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের এই দেশে পূজা পেতে চিরদিনের মত নিরাশ হয়ে গেছে। তবে তার অনুসরণ হবে ঐসব কাজে যেগুলিকে তোমরা তুচ্ছ মনে করবে। আর তাতেই সে সন্তুষ্ট হবে’।[2]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরোক্ত ভাষণ সমূহের মধ্যে যে ভবিষ্যদ্বাণী ফুটে উঠেছিল, তাতে আরব উপদ্বীপে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন ও তাদের অনুসারীদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার ইঙ্গিত ছিল এবং সেটাই বাস্তবায়িত হ’তে দেখা গেছে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত হ’তে বিভিন্ন গোত্রীয় প্রতিনিধি দল সমূহের দলে দলে মদীনা আগমনের মধ্য দিয়ে। এভাবেই সূরা নছরের ভবিষ্যদ্বাণী রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই বাস্তবায়িত হয় এবং সমস্ত আরবে ইসলাম সর্বতোভাবে বিজয় লাভ করে। পূর্ণতা লাভের পর আর কিছুই বাকী থাকে না। তাই উক্ত সূরা নাযিলের মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুসংবাদ খুঁজে পেয়েছিলেন দূরদর্শী তরুণ ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)’ (বুখারী হা/৪৯৭০)।
[2]. তিরমিযী হা/২১৫৯; মিশকাত হা/২৬৭০।