লগইন করুন
কা‘ব বিন যুহায়ের (হিঃ পূঃ ১৩-২৬ হিঃ/৬০৯-৬৪৬ খৃঃ) ‘মুখাযরামূন’ (الْمُخَضْرَمون) কবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যিনি জাহেলী ও ইসলামী উভয় যুগ পেয়েছিলেন।
৮ম হিজরীর শেষে হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি যুহায়ের বিন আবী সুলমার জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং আরবের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম এই স্বল্পায়ু কবি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন ও ইসলাম কবুল করেন। তার ছোট ভাই বুহায়েরও কবি ছিলেন এবং তিনি পিতার অছিয়ত মোতাবেক মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই কা‘ব পিতার অছিয়ত অমান্য করে রাসূল (ছাঃ)-এর কুৎসা রটনায় কবিতা লিখতে থাকেন। ফলে মক্কা বিজয়ের সময় যাদের রক্ত বৃথা ঘোষণা করা হয়, ইমাম হাকেমের মতে কা‘ব ছিলেন তাদের মধ্যকার অন্যতম। ৮ম হিজরীর শেষে হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর কা‘বের ছোট ভাই বুহায়ের (অথবা বুজায়ের) তাকে পত্র লিখলেন যে, মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন কুৎসা রটনাকারীকে হত্যা করেছেন। তবে কেউ তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে থাকেন। অতএব বাঁচতে চাইলে তুমি সত্বর মদীনায় গিয়ে তওবা করে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। দু’ভাইয়ের মধ্যে এভাবে পত্রালাপ চলতে থাকে এবং কা‘ব ক্রমেই ভীত হয়ে পড়তে থাকেন। অবশেষে তিনি একদিন মদীনায় এলেন এবং জোহায়না গোত্রের জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। অতঃপর তিনি জোহানী ব্যক্তির সাথে গিয়ে মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাত আদায় করেন। ছালাত শেষে জোহানীর ইশারায় তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে গিয়ে বসেন এবং তাঁর হাতে হাত রেখে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কা‘ব বিন যুহায়ের তওবা করে মুসলমান হয়ে এসেছে আপনার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য। আমি যদি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসি, তাহ’লে আপনি কি তার প্রার্থনা কবুল করবেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বলে উঠলেন, আমিই কা‘ব বিন যুহায়ের’।
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বকে চিনতেন না। এ সময় জনৈক আনছার লাফিয়ে উঠে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন, ওর গর্দান উড়িয়ে দেই’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ছাড় ওকে। সে তওবা করে এসেছে এবং সব কালিমা থেকে মুক্ত হয়েছে’। এই সময় কা‘ব রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসায় তার বিখ্যাত ক্বাছীদা (দীর্ঘ কবিতা) পাঠ করেন, যা ‘ক্বাছীদা বুরদাহ’ নামে খ্যাত। যার শুরু হ’ল নিম্নোক্ত চরণ দিয়ে-
بَانَتْ سُعَادُ فَقَلْبِي الْيَوْمَ مَتْبُوْلُ * مُتَيِّمٌ إثْرَهَا لَمْ يُفْدَ مَكْبُوْلُ
‘প্রেমিকা সু‘আদ চলে গেছে। বিরহ ব্যথায় আমার হৃদয় আজ বিদীর্ণ। তার ভালোবাসার শৃংখলে আমি আবদ্ধ। আমার মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি। আমি বন্দী’।
সে যুগের বিখ্যাত কবিরা এভাবে বিগত প্রেমিকার প্রতি বিরহ বেদনা প্রকাশ করেই তাদের দীর্ঘ কবিতাসমূহ শুরু করতেন।
অতঃপর ৩৯ লাইনে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসা এবং নিজের ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি বলেন,
نُبِّئْتُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ أَوْعَدَنِي * وَالْعَفْوُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ مَأْمُوْلُ
‘আমি জানতে পেরেছি যে, আল্লাহর রাসূল আমাকে হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল-এর নিকটে সর্বদা ক্ষমাই কাম্য’।
مَهْلاً هَدَاكَ الَّذِيْ أَعْطَاكَ نَافِلَةَ الْ * قُرْآنِ فِيْهَا مَوَاعِيْظُ وَتَفْصِيْلُ
‘থামুন! আল্লাহ আপনাকে সুপথ প্রদর্শন করুন! যিনি আপনাকে বিশেষ পুরস্কার হিসাবে কুরআন দান করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে উপদেশ সমূহ এবং সকল বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা সমূহ’।
لاَ تَأْخُذَنِّيْ بِأَقْوَالِ الْوُشَاةِ وَلَمْ * أُذْنِبْ وَلَوْ كَثُرَتْ فِيَّ الْأَقَاوِيْلُ
‘নিন্দুকদের কথায় আমাকে পাকড়াও করবেন না। আমি কোন অপরাধ করিনি। যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে।
لَقَدْ أَقُوْمُ مَقَامًا لَوْ يَقُوْمُ بِهِ * أَرَى وَأَسْمَعُ مَا لَوْ يَسْمَعُ الْفِيَلُ
‘আমি এমন এক স্থানে দাঁড়িয়েছি এবং দেখছি ও শুনছি, যদি কোন হাতি সেখানে দাঁড়াতো ও সেকথা শুনতো-
لَظَلَّ يَرْعَدُ إلاَّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ * مِنْ الرَّسُوْلِ بِإِذْنِ اللهِ تَنْوِيْلُ
‘তাহ’লে সে অবশ্যই কাঁপতে থাকত। তবে যদি আল্লাহর অনুমতিক্রমে রাসূলের পক্ষ হ’তে তার জন্য অনুকম্পা হয়’।
حَتَّى وَضَعْتُ يَمِيْنِيْ مَا أُنَازِعُهُ * فِي كَفِّ ذِيْ نَقِمَاتٍ قِيْلُهُ الْقِيْلُ
‘অবশেষে আমি আমার ডান হাত রেখেছি যা আমি ছাড়িয়ে নেইনি, এমন এক হাতের তালুতে, যিনি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতাশালী এবং যাঁর কথাই চূড়ান্ত কথা’।
فَلَهُوَ أَخْوَفُ عِنْدِيْ إذْ أُكَلِّمُهُ * وَقِيْلَ إنَّكَ مَنْسُوْبٌ وَمَسْئُوْلُ
‘অতঃপর নিশ্চয়ই তিনি আমার নিকটে অধিক ভীতিকর ব্যক্তি, যখন আমি তাঁর সাথে কথা বলি, এমন অবস্থায় যে আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তুমি (অমুক অমুক ব্যঙ্গ কবিতার দিকে) সম্পর্কিত এবং সেগুলি সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসিত হবে’।
مِنْ ضَيْغَمٍ بِضَرَّاءِ الْأَرْضِ مُخْدَرُهُ * فِيْ بَطْنِ عَثَّرَ غَيْلٌ دُوْنَهُ غَيْلُ
‘(তিনি আমার নিকট অধিক ভীতিকর) যমীনের কঠিনতম স্থানের ঐ সিংহের চাইতে, যার অবস্থানস্থল এমন উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছার আগেই ঘাতক নিহত হয়ে যায়’।
অতঃপর ৫১ লাইনে পৌঁছে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসায় বলেন,
إنَّ الرَّسُوْلَ لَنُوْرٌ يُسْتَضَاءُ بِهِ * مُهَنَّدٌ مِنْ سُيُوْفِ اللهِ مَسْلُوْلُ
‘নিশ্চয়ই রাসূল আলোকস্তম্ভ স্বরূপ, যা থেকে আলো গ্রহণ করা হয়। তিনি আল্লাহর তরবারি সমূহের মধ্যে কোষমুক্ত হিন্দুস্থানী তরবারি সদৃশ’ (ইবনু হিশাম ২/৫১২)।
এ সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে নিজের চাদর কবির গায়ে জড়িয়ে দেন (আল-ইছাবাহ, কা‘ব ক্রমিক ৭৪১৬)। এজন্য কবির এ দীর্ঘ কবিতাটি ‘ক্বাছীদাতুল বুরদাহ’(قَصِيْدَةُ الْبُرْدَةِ) বা চাদরের ক্বাছীদা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যা কবির ছেলের নিকট থেকে মু‘আবিয়া (রাঃ) খরীদ করে নেন। অতঃপর তা খলীফাগণ ঈদের দিন সমূহে পরিধান করতেন (আল-ইছাবাহ)।[1] কবিতা শেষে রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, সু‘আদ কে? তিনি বললেন, আমার স্ত্রী (আল-বিদায়াহ ৪/৩৭৩)। এরপর রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, যদি তুমি আনছারদের প্রশংসায় কিছু বলতে! কেননা তারাই এর উপযুক্ত। তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য আনছারদের অপূর্ব ত্যাগের প্রশংসায় ১৩ লাইন কবিতা বলেন (ইবনু হিশাম ২/৫১৪-১৫)। ক্বাছীদাহ বুরদার কবিতা সংখ্যা বায়হাক্বী ৪৮ বলেছেন (বায়হাক্বী কুবরা হা/২০৯৩১)। পক্ষান্তরে ইবনু হিশাম ৫৮ লাইন উদ্ধৃত করেছেন (ইবনু হিশাম ২/৫০৩-১৩)।
ইবনু কাছীর বলেন, উপরের কথাগুলি প্রসিদ্ধ হ’লেও আমি এমন কোন বিশুদ্ধ সূত্র পাইনি, যাতে আমি সন্তুষ্ট হ’তে পারি (আল-বিদায়াহ ৪/৩৭৩)। শাওকানী বলেন, হাফেয ইরাক্বী বলেন যে, উক্ত ক্বাছীদাটি আমরা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছি। যার একটিও বিশুদ্ধ নয় (নায়লুল আওত্বার ২/১৮৬)।
উল্লেখ্য যে, ‘ক্বাছীদাতুল বুরদাহ’ নামে প্রসিদ্ধ আরেকটি ক্বাছীদা হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসায় মিসরের কবি মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আল-বূছীরী (৬০৮-৬৯৬ হি./১২১২-১২৯৬ খৃ.) লিখিত ১৬৫ লাইনের দীর্ঘ কবিতা। যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। উক্ত দীর্ঘ কবিতাটি একটি অলৌকিক কবিতা হিসাবে পরিচিত। যেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত কবি স্বপ্নে রাসূল (ছাঃ)-এর দর্শন লাভ করেন এবং স্বপ্নের মধ্যেই তাঁকে তাঁর প্রশংসায় লিখিত উক্ত ক্বাছীদাটি শুনান। তাতে খুশী হয়ে রাসূল (ছাঃ) কবির গায়ে তাঁর চাদরটি জড়িয়ে দেন। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে কবি দেখেন যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তখন থেকে এটি রোগ নিরাময়ের বরকতময় কবিতা হিসাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করে।
বলা হয়ে থাকে যে, উক্ত ক্বাছীদা পাঠের ৮টি পূর্বশর্ত রয়েছে। যেমন প্রথমে ওযূ করতে হবে, ক্বিবলামুখী হ’তে হবে, বিশুদ্ধ উচ্চারণসহ অর্থ বুঝে ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে মুখস্থ পড়তে হবে, পাঠককে অনুমতিপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির নিকট থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হ’তে হবে এবং কবি মনোনীত বিশেষ দরূদ সহ পাঠ করতে হবে। দরূদটি হ’ল, مَولايَ صَلِّ وسلِّمْ دَائِمًا أبدًا عَلَى حَبِيبكَ خَيرِ الْخَلْقِ كُلِّهِمْ। বলা বাহুল্য এগুলির কোন শারঈ ভিত্তি নেই। তাছাড়া উক্ত ক্বাছীদার কিছু কিছু লাইনে তাওহীদ পরিপন্থী কুফরী বক্তব্য রয়েছে। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ সহ বিশ্ববিখ্যাত বিদ্বানগণ এই ক্বাছীদার বরকত সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা সমূহের তীব্র প্রতিবাদ করেন।[2]
[শিক্ষণীয় : মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা রটনা করা জঘন্যতম অপরাধ। এ থেকে তওবা করার পথ হ’ল পুনরায় প্রশংসা করা। এর মাধ্যমেই কেবল তাকে ক্ষমা করা যেতে পারে। গণমাধ্যম কর্মীদের উপরোক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।]
[2]. গৃহীত : ক্বাছীদাতুল বুরদাহ (কাব্যানুবাদ) ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান (প্রফেসর আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রকাশক : রিয়াদ প্রকাশনী (ঢাকা, পশ্চিম নাখালপাড়া, জানুয়ারী ২০০১) ৯-১০ পৃঃ।