লগইন করুন
ইতিপূর্বে আমরা দেখে এসেছি যে, মাদানী জীবনে মুসলিম ও কাফিরের মধ্যকার যুদ্ধে উভয় পক্ষে আমাদের হিসাবে ১৩৪২ জন এবং মানছূরপুরীর হিসাবে ১১৭১ জন নিহত হয়েছে। বিনিময়ে সমস্ত আরব উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী খেলাফত এবং যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার। জান-মাল ও ইযযতের গ্যারান্টি লাভে ধন্য হয়েছিল মানবতা। বিকশিত হয়েছিল সর্বত্র মানবিক মূল্যবোধের পুষ্পকলি। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা নাগরিক জীবনে এনেছিল এক অনির্বচনীয় সুখ ও সমৃদ্ধির বাতাবরণ। সৃষ্টি করেছিল সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তার অনাবিল পরিবেশ।
খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর উক্ত ইসলামী বিপ্লবের পর বিগত ১৪শ বছরে পৃথিবী অনেক দূর গড়িয়েছে। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, ফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইত্যাকার বহুতর মতবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে আধুনিক পৃথিবীতে। কিন্তু যুলুম ও গোলামী ব্যতীত মানুষ কিছুই পায়নি এইসব মতবাদের নেতাদের কাছ থেকে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে কেবল বিংশ শতাব্দীতেই সংঘটিত প্রধান তিনটি যুদ্ধে পৃথিবীতে কত বনু আদমকে হত্যা করা হয়েছে, তার একটা হিসাব আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব। তবে সরকারী এসব হিসাবের বাইরে প্রকৃত হিসাব যে নিঃসন্দেহে অনেক বেশী হবে, অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ তা ভালভাবেই জানেন।
১. ১ম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)(الغزوة العالمية الأولى ১৯১৪-১৯১৮م) :
মোট নিহতের সংখ্যা ৭৩ লাখ ৩৮ হাযার। তন্মধ্যে (১) রাশিয়ায় ১৭ লাখ (২) জার্মানীতে ১৬ লাখ (৩) ফ্রান্সে ১৩ লাখ ৭০ হাযার (৪) ইটালীতে ৪ লাখ ৬০ হাযার (৫) অষ্ট্রিয়ায় ৮ লাখ (৬) গ্রেট বৃটেনে ৭ লাখ (৭) তুরস্কে ২ লাখ ৫০ হাযার (৮) বেলজিয়ামে ১ লাখ ২ হাযার (৯) বুলগেরিয়ায় ১ লাখ (১০) রুমানিয়ায় ১ লাখ (১১) সার্বিয়া-মন্টিনিগ্রোতে ১ লাখ (১২) আমেরিকায় ৫০ হাযার। সর্বমোট ৭৩ লাখ ৩৮ হাযার। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের তালিকায় ভারতীয়দের এবং ফ্রান্সের তালিকায় সেখানকার নতুন বসতি স্থাপনকারীদের নিহতের সংখ্যা যুক্ত হয়েছে কি-না জানা যায়নি। তাছাড়া যুদ্ধে আহত, পঙ্গু, বন্দী, উদ্বাস্ত্ত ও নিখোঁজদের হিসাব উপরোক্ত তালিকার বাইরে রয়েছে। অন্য এক হিসাবে নিহত ৯০ লাখ, আহত ২ কোটি ২০ লাখ এবং নিখোঁজ হয়েছিল প্রায় ১ কোটি মানুষ।[1] এছাড়া খাদ্যাভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরা মানুষদের তালিকা কখনই প্রকাশ পাবে বলে মনে হয়না।
২. ২য় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৪১-১৯৪৫) (الغزوة العالمية الثانية ১৯৪১-১৯৪৫م) :
মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি।[2] তন্মধ্যে একা সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রায় ৮৯ লাখ সৈন্য হারায় বলে মস্কো থেকে এএফপি পরিবেশিত এবং ২০০৭ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। এ সময় জাপানের হিরোশিমাতে নিক্ষিপ্ত এটমবোমায় তাৎক্ষণিক ভাবে নিহত হয় ১ লাখ ৩৮ হাযার ৬৬১ জন এবং ১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তূপ ও ছাইয়ে পরিণত হয়। আমেরিকার ‘লিটল বয়’ নামক এই বোমাটি নিক্ষিপ্ত হয় ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট সকাল সোয়া ৮-টায়। এর তিনদিন পরে ৯ই আগষ্ট বুধবার দ্বিতীয় বোমাটি নিক্ষিপ্ত হয় জাপানের নাগাসাকি শহরে। যাতে সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে আড়াই লাখ বনু আদম। উভয় বোমার তেজষ্ক্রিয়তার ফলে ক্যান্সার ইত্যাদির মত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আজও সেখানকার মানুষ মরছে। বংশ পরম্পরায় জাপানীরা বহন করে চলেছে এসব মরণ ব্যাধির বীজ।[3] হিরোশিমা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ১৯৪৯ সালের ২০শে আগস্ট এক ঘোষণায় বলেন, ১৯৪৫ সালে ৬ই আগস্টের দিন বোমা হামলায় মৃত্যু বরণকারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১০ হাযার থেকে ৪০ হাযারের মধ্যে’।[4] এছাড়াও বর্তমানে সেখানে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের অধিকাংশ হচ্ছে পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী। মূল ধ্বংসস্থলে আজও কোন ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ।
৩. ভিয়েতনাম যুদ্ধ(১৯৫৫-১৯৭৩) (غزوة ويتنام ১৯৫৫-১৯৭৩م) :
আগ্রাসী মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে আক্রান্ত ভিয়েতনামীরা দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ এই যুদ্ধ করে। এতে এককভাবে আমেরিকা ৩৬ লাখ ৭২ হাযার মানুষকে হত্যা করে ও ১৬ লাখ মানুষকে পঙ্গু করে এবং ৯ লাখ শিশু ইয়াতীম হয়।[5]
সম্প্রতি মার্কিন আদালতে ‘ভিয়েতনাম এসোসিয়েশন ফর ভিকটিম্স অফ এজেক্ট অরেঞ্জ/ডায়োক্সিন’-এর পক্ষ হ’তে নিউইয়র্কের একটি আদালতে মামলা দায়ের করা হ’লে আদালত তা খারিজ করে দেয়। বাদীগণ এই রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টে আবেদন জানাবেন। বিবরণে বলা হয় যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রাসায়নিক অস্ত্র হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র এই ‘এজেক্ট অরেঞ্জ’ (Eject orange) স্প্রে করেছিল। যাতে ক্যান্সার ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। ‘এজেক্ট অরেঞ্জের’ ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ভিয়েতনামে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ রোগাক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়।[6] গত ৩০শে এপ্রিল ২০১৫ ভিয়েতনাম যুদ্ধের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, দেশটির প্রায় ৪৮ লাখ মানুষ এজেক্ট অরেঞ্জের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষ এজেক্ট অরেঞ্জের কারণে ক্যান্সারসহ নানা মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটে পড়েছেন। এদের মধ্যে অন্ততঃপক্ষে ৪ লাখ মানুষ মারা গেছেন বা বিকলাঙ্গ হয়েছেন। আর পরবর্তী সময়ে প্রায় ৫ লাখ শিশু মারাত্মক জন্মগত বৈকল্য নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছে।[7]
জন ডেভেনপোর্ট তার An Apology for Muhammed and the Koran বইয়ে কেবলমাত্র খ্রিষ্টান ধর্মীয় আদালতের নির্দেশে খ্রিষ্টান নাগরিকদের নিহতের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ বলেছেন। স্পেন সরকার ৩ লাখ ৪০ হাযার খ্রিষ্টানকে হত্যা করে। যার মধ্যে ৩২ হাযার খ্রিষ্টানকে তারা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/২১৪-১৫)।
এতদ্ব্যতীত ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এডলফ হিটলার কর্তৃক জার্মানীতে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে ৬০ লাখ ইহূদীকে এবং ৫০ লাখ নন-ইহূদীকে হত্যা করার মর্মান্তিক বিভীষিকা মানবেতিহাসের কলংকতম ঘটনা।[8] এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য নৃশংস হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক কাহিনী সমূহ। যা অহরহ ঘটছে।
৪. ইরাক-ইরান যুদ্ধ(১৯৮০-১৯৮৮) (غزوة العراق وإيران ১৯৮০-১৯৮৮م) :
আমেরিকার স্বার্থে ও তাদের উসকানিতে ইরাকী নেতা সাদ্দাম হোসেন ইরানের উপর এই হামলা চালান। যাতে আট বছরে দুই পক্ষে প্রায় দশ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।[9] যুদ্ধের দীর্ঘ বিশ বছর পরে গত ২রা মার্চ ’০৮ আহমেদিনেযাদই প্রথম ইরানী প্রেসিডেন্ট, যিনি ইরাক সফর করেন। পরের দিন ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সাথে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রই মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসের বীজ বপন করেছে’। একইভাবে সাদ্দাম ১৯৯০ সালের ২রা আগষ্টে কুয়েতে আগ্রাসন চালিয়ে ও সঊদী আরবে হামলা করে বহু মানুষকে হতাহত করেন। আল্লাহর অমোঘ বিধানে সাদ্দাম হোসেন (১৯৩৭-২০০৬) তার বিদেশী প্রভুদের চক্রান্তে স্বদেশী উপকার ভোগীদের হাতে ২০০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ঈদুল আযহার দিন সকালে নিজ রাজধানীতে ৬৯ বছর বয়সে ফাঁসিতে ঝুলে নিহত হন।
এতদ্ব্যতীত বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সোমালিয়া, সার্বিয়া, কসোভো, ফিলিস্তীন, সূদান, শ্রীলংকা, কাশ্মীর, নেপাল, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশ সমূহে এইসব কথিত গণতন্ত্রী ও মানবাধিকারবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা নানা অজুহাতে নিত্যদিন কত যে মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে?
[2]. মাওলানা আব্দুর রহীম, আল-কুরআনে : রাষ্ট্র ও সরকার ২৩৪ পৃঃ, টীকা-১।
[3]. দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা ৬ই আগষ্ট ২০০৭, ৭ পৃঃ।
[4]. আবুল হাসান আলী নাদভী, মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো? (ঢাকা : ৩য় মুদ্রণ ২০০৪) ২৬৩ পৃঃ।
[5]. দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা ১৮ই মে ২০০৭, ৬ পৃঃ।
[6]. দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা ২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০০৮, পৃঃ ৭/৩-৪ কলাম।
[7]. দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা ৩০শে এপ্রিল ২০১৫।
[8]. Snyder 2010, p. 45. ; Niewyk, Donald L. and Nicosia, Francis R. The Columbia Guide to the Holocaust, Columbia University Press, 2000, pp. 45-52.।
[9]. আমার দেশ, ৪ঠা মার্চ ২০০৮ পৃঃ ৫/২-৫ কলাম।