লগইন করুন
৮ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে ওমানের খ্রিষ্টান সম্রাট জায়ফার ও তার ভাই আব্দ-এর নামে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) পত্র লেখেন। পত্রবাহক ছিলেন হযরত আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ مِنْ مُحَمّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ إلَى جَيْفَرَ وَعَبْدٍ ابْنَيِ الْجُلَنْدَى سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى، أَمَّا بَعْدُ : فَإِنِّي أَدْعُوكُمَا بِدِعَايَةِ الْإِسْلاَمِ أَسْلِمَا تَسْلَمَا فَإِنِّي رَسُولُ اللهِ إلَى النَّاسِ كَافَّةً لِأُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ، فَإِنَّكُمَا إنْ أَقْرَرْتُمَا بِالْإِسْلاَمِ وَلَّيْتُكُمَا وَإِنْ أَبَيْتُمَا أَنْ تُقِرَّا بِالْإِسْلاَمِ فَإِنَّ مُلْكَكُمَا زَائِلٌ عَنْكُمَا وَخَيْلِيْ تَحُلُّ بِسَاحَتِكُمَا وَتَظْهَرُ نُبُوَّتِيْ عَلَى مُلْكِكُمَا-
‘... আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে জুলান্দা আযদীর দুই পুত্র জায়ফার ও আব্দের প্রতি। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। অতঃপর আমি আপনাদের দু’জনকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছি। আপনারা ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। আমি সমগ্র মানবজাতির প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি, যাতে আমি জীবিতদের সতর্ক করি এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অতঃপর যদি আপনারা ইসলাম কবুল করেন, তবে আপনাদেরকেই আমি গবর্ণর নিযুক্ত করে দেব। আর যদি ইসলাম কবুলে অস্বীকার করেন, তাহ’লে আপনাদের রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে। আমার ঘোড়া আপনাদের এলাকায় প্রবেশ করবে ও আমার নবুঅত আপনাদের রাজ্যে বিজয়ী হবে’।
আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) বলেন, পত্রটি নিয়ে আমি ওমান গেলাম এবং ছোট ভাই আব্দের নিকটে আগে পৌঁছলাম। কেননা ইনি ছিলেন অধিক দূরদর্শী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। আমি তাকে বললাম যে, ‘আমি আপনার ও আপনার ভাইয়ের নিকটে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর দূত হিসাবে এসেছি’। তিনি বললেন, বয়সে ও রাজত্বে ভাই আমার চেয়ে বড়। আমি আপনাকে তাঁর নিকটে পৌঁছে দিচ্ছি, যাতে তিনি আপনার পত্র পাঠ করেন। অতঃপর তিনি বললেন,وَمَا تَدْعُو إلَيْهِ ؟ ‘কোন দিকে আপনি আমাদের দাওয়াত দিচ্ছেন’? আমি বললাম, আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। যিনি এক, যার কোন শরীক নেই। তিনি ব্যতীত অন্য সকল উপাস্য হ’তে আপনি পৃথক হয়ে যাবেন এবং সাক্ষ্য দিবেন যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি বললেন, হে আমর! আপনি আপনার গোত্রের নেতার পুত্র। বলুন, আপনার পিতা কেমন আচরণ করেছেন? কেননা তাঁর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় রয়েছে। আমি বললাম, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এমতাবস্থায় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেননি। কতই না ভাল হ’ত যদি তিনি ইসলাম কবুল করতেন ও রাসূলকে সত্য বলে জানতেন। আমিও তাঁর মতই ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে ইসলামের পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি বললেন, কবে আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন? আমি বললাম, অল্প কিছুদিন পূর্বে’।[1]
তিনি বললেন, কোথায় আপনি ইসলাম কবুল করলেন? বললাম, নাজাশীর দরবারে এবং আমি তাকে এটাও বললাম যে, নাজাশীও মুসলমান হয়ে গেছেন। তিনি বললেন, তাঁর রাজত্বের ব্যাপারে তাঁর সম্প্রদায় কি আচরণ করল? আমি বললাম, তারা তাঁকে স্বপদে রেখেছে ও তাঁর অনুসারী (মুসলমান) হয়েছে’। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, বিশপ ও পাদ্রীগণও তাঁর অনুসারী হয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে আমর! আপনি কি বলছেন ভেবে-চিন্তে দেখুন। কেননা মিথ্যা বলার চাইতে নিকৃষ্ট স্বভাব মানুষের জন্য আর কিছুই নেই। আমি বললাম, আমি মিথ্যা বলিনি এবং আমাদের ধর্মেও এটা সিদ্ধ নয়। অতঃপর তিনি বললেন, আমার ধারণা হেরাক্বল নাজাশীর ইসলাম কবুলের খবর জানেন না। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি জানেন। তিনি বললেন, কিভাবে এটা আপনি বুঝলেন? আমি বললাম, নাজাশী ইতিপূর্বে তাঁকে খাজনা দিতেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি বললেন,وَاللهِ لَوْ سَأَلَنِي دِرْهَمًا وَاحِدًا مَا أَعْطَيْتُهُ ‘আল্লাহর কসম! এখন যদি তিনি আমার নিকটে একটি দিরহামও চান, আমি তাকে দেব না’। হেরাক্বলের নিকটে এখবর পৌঁছে গেলে তার ভাই ‘নিয়াক্ব’ (نِيَاق) তাকে বলেন, আপনি কি ঐ গোলামটাকে ছেড়ে দিবেন, যে আপনাকে খাজনা দেবে না? আবার আপনার ধর্ম ত্যাগ করে একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করবে? জবাবে হেরাক্বল বললেন, একজন লোক একটি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং তা নিজের জন্য পসন্দ করেছে। এক্ষণে আমি তার কি করব?وَاللهِ لَوْلاَ الضَّنَّ بِمُلْكِيْ لَصَنَعْتُ كَمَا صَنَعَ ‘আল্লাহর কসম! যদি আমার মধ্যে সাম্রাজ্যের বিষয়টি না থাকত, তবে আমিও তাই করতাম, যা সে করেছে’। আব্দ বললেন, ভেবে দেখুন আমর আপনি কি বলছেন? আমি বললাম,وَاللهِ صَدَّقْتُكَ আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে সত্য বলছি’। আব্দ বললেন, এখন আপনি বলুন, তিনি কোন কোন বিষয়ে নির্দেশ দেন ও কোন কোন বিষয়ে নিষেধ করেন? আমি বললাম, তিনি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দেন এবং তাঁর অবাধ্য হ’তে নিষেধ করেন। তিনি সৎকাজের ও আত্মীয়তা রক্ষার আদেশ দেন এবং যুলুম, সীমা লংঘন, ব্যভিচার, মদ্যপান, পাথর, মূর্তি ও ক্রুশ পূজা হ’তে নিষেধ করেন।
আব্দ বললেন,مَا أَحْسَنَ هَذَا الَّذِيْ يَدْعُو إلَيْهِ ‘ইনি কতই না সুন্দর বিষয়ের দিকে আহবান করেন! যদি আমার ভাই আমার অনুগামী হ’তেন, তাহ’লে আমরা দু’জনে মুহাম্মাদ-এর দরবারে গিয়ে ঈমান আনতাম ও তাঁকে সত্য বলে ঘোষণা করতাম’। কিন্তু আমার ভাই এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে স্বীয় রাজত্বের জন্য অধিক ক্ষতিকর প্রমাণিত হবেন এবং আপাদমস্তক গোনাহগার হবেন’। আমি বললাম, যদি তিনি ইসলাম কবুল করেন, তবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁকে বাদশাহ হিসাবে বহাল রাখবেন। তিনি কেবল ধনীদের নিকট থেকে ছাদাক্বা গ্রহণ করবেন ও গরীবদের মধ্যে তা বণ্টন করবেন। তিনি বললেন, এটা খুবই সুন্দর আচরণ। তবে ছাদাক্বা কি জিনিষ? তখন আমি তাকে বিভিন্ন মাল-সম্পদের এমনকি উটের যাকাত সম্পর্কে বর্ণনা করলাম, যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ফরয করেছেন। তিনি বললেন, হে আমর! আমাদের চতুষ্পদ জন্তু সমূহ থেকেও ছাদাক্বা নেওয়া হবে, যারা স্বাধীনভাবে ঘাস-পাতা খেয়ে চরে বেড়ায়? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হয় না যে, আমার কওম তাদের রাজ্যের বিশালতা ও লোকসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও এটা মেনে নিবে’।
আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) বলেন, আমি সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করলাম। তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে গেলেন ও আমার ব্যাপারে তাকে সবকিছু অবহিত করলেন। অতঃপর একদিন তিনি (অর্থাৎ সম্রাট) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করলে তার প্রহরীরা আমাকে দু’বাহু ধরে নিয়ে গেল। তিনি বললেন, ওকে ছেড়ে দাও’। আমাকে ছেড়ে দেওয়া হ’ল। আমি বসতে গেলাম। কিন্তু তারা আমাকে বসতে দিল না। আমি তখন সম্রাটের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, আপনার প্রয়োজন সম্পর্কে বলুন। তখন আমি মোহরাংকিত পত্রটি তাঁর নিকটে দিলাম। তিনি সীলমোহরটি ছিঁড়লেন এবং পত্রটি পড়ে শেষ করলেন। অতঃপর সেটা তার ভাইয়ের হাতে দিলেন। তিনিও সেটা পাঠ করলেন। আমি দেখলাম যে, তার ভাই তার চাইতে অধিকতর কোমল হৃদয়ের।
অতঃপর সম্রাট আমাকে কুরায়েশদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম,تَبِعُوْهُ، إمَّا رَاغِبٌ فِي الدِّيْنِ وَإِمَّا مَقْهُوْرٌ بِالسَّيْفِ ‘তারা তাঁর অনুগত হয়েছে। কেউ দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, কেউ তরবারির দ্বারা পরাভূত হয়ে’। তিনি বললেন, তাঁর সাথে কারা আছেন? আমি বললাম, যারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং অন্য সবকিছুর উপরে একে স্থান দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতের সাথে সাথে নিজেদের জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করেছেন যে, তারা ইতিপূর্বে ভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলেন’। এতদঞ্চলে আপনি ব্যতীত আর কেউ (অর্থাৎ আর কোন সম্রাট তার দ্বীনে প্রবেশ করতে) বাকী আছেন বলে আমার জানা নেই। আজ যদি আপনি ইসলাম কবুল না করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুগামী না হন, তাহ’লে অশ্বারোহী বাহিনী আপনাকে পদদলিত করবে এবং আপনার শস্যক্ষেত সমূহ ধ্বংস করবে। অতএব আপনি ইসলাম কবুল করুন। নিরাপদ থাকুন। আপনাকে আপনার জাতির উপরে তিনি শাসক নিযুক্ত করবেন এবং আপনার এলাকায় অশ্বারোহী বা পদাতিক বাহিনী প্রবেশ করবে না। সম্রাট বললেন,دَعْنِيْ يَوْمِيْ هَذَا وَارْجِعْ إلَيَّ غَدًا ‘আজকের দিনটা আমাকে সময় দিন। কাল আপনি পুনরায় আসুন’।
সম্রাটের দরবার থেকে বেরিয়ে আমি পুনরায় তাঁর ভাইয়ের কাছে ফিরে গেলাম। তিনি বললেন,يَا عَمْرُو إنِّيْ لَأَرْجُو أَنْ يُسْلِمَ إنْ لَمْ يَضِنَّ بِمُلْكِهِ ‘হে আমর! আমি মনে করি সম্রাট মুসলমান হবেন, যদি তাঁকে রাজত্ব থেকে বিচ্যুত না করা হয়’।
কথা মত দ্বিতীয় দিন সকালে আমি দরবারে গেলাম। কিন্তু তিনি অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। আমি তার ভাইয়ের কাছে ফিরে গিয়ে বিষয়টি বললাম। তখন তিনি আমাকে সেখানে পৌঁছে দিলেন। অতঃপর সম্রাট আমাকে বললেন, আমি আপনার আবেদনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। দেখুন, যদি আমি এমন এক ব্যক্তির নিকটে আমার রাজত্ব সমর্পণ করি, যার অশ্বারোহী দল এখনো এখানে পৌঁছেনি, তাহ’লে আমি ‘আরবদের দুর্বলতম ব্যক্তি’(أَضْعَفُ الْعَرَبِ) হিসাবে পরিগণিত হব। আর যদি তার অশ্বারোহী দল এখানে পৌঁছে যায়, তাহ’লে এমন লড়াইয়ের সম্মুখীন তারা হবে, যা ইতিপূর্বে তারা কখনো হয়নি।’ একথা শুনে আমি বললাম, বেশ, আগামীকাল তাহ’লে আমি চলে যাচ্ছি(فَأَنَا خَارِجٌ غَدًا)।
অতঃপর যখন তিনি আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হ’লেন, তখন তার ভাইকে নিয়ে একান্তে বৈঠক করলেন। ভাই তাকে বললেন,مَا نَحْنُ فِيْمَا قَدْ ظَهَرَ عَلَيْهِ وَكُلُّ مَنْ أَرْسَلَ إلَيْهِ قَدْ أَجَابَهُ ‘আমরা তাদের তুলনায় কিছুই নই, যাদের উপরে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আর যার নিকটেই তিনি দূত পাঠিয়েছেন, তিনি তা কবুল করে নিয়েছেন’।
পরদিন সকালে সম্রাট আমাকে ডেকে পাঠালেন। সম্রাট ও তাঁর ভাই উভয়ে ইসলাম কবুল করলেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে সত্য বলে ঘোষণা করলেন। অতঃপর তারা আমাকে ছাদাক্বা গ্রহণ ও এ বিষয়ে লোকদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য ঢালাও অনুমতি দিলেন এবং আমার বিরুদ্ধাচারীদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী হলেন। অতঃপর প্রজাদের অধিকাংশ মুসলমান হয়ে যায়’।[2]
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৫-৬০৭, তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ১/২৬৩, যায়লাঈ, নাছবুর রা’য়াহ ৪/৪২৩-২৪।