লগইন করুন
৬ষ্ঠ হিজরীর যিলহজ্জ বা ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে এটি পাঠানো হয়। রোম সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের শাসক কনষ্ট্যান্টিনোপলের বিখ্যাত খ্রিষ্টান সম্রাট হেরাক্বল এ সময় যেরুযালেমে অবস্থান করছিলেন।[1] পত্রবাহক দেহিয়া বিন খালীফা কালবী ওরফে দেহিয়াতুল কালবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ মতে পত্রটি শামের বুছরা (بُصْرَى) প্রদেশের শাসনকর্তার নিকটে হস্তান্তর করেন এবং তিনি সেটা রোম সম্রাটকে পৌঁছে দেন’ (বুখারী হা/৭)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ عَبْدِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ إِلَى هِرَقْلَ عَظِيْمِ الرُّومِ. سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى، أَسْلِمْ تَسْلَمْ ، يُؤْتِكَ اللهُ أَجْرَكَ مَرَّتَيْنِ، فَإِنْ تَوَلَّيْتَ فَإِنَّ عَلَيْكَ إِثْمَ الأَرِيسِيِّينَ- يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَنْ لاَ نَعْبُدَ إِلاَّ اللهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ-
‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ-এর পক্ষ হ’তে রোম সম্রাট হেরাক্বল-এর প্রতি। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। ইসলাম কবুল করুন! নিরাপদ থাকুন। ইসলাম কবুল করুন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দান করবেন। যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহ’লে আপনার উপরে প্রজাবৃন্দের পাপ বর্তাবে। (আল্লাহ বলেন,) তুমি বল, হে আহলে কিতাবগণ! এসো! একটি কথায় আমরা একমত হই, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান। আর তা এই যে, আমরা অন্য কারু ইবাদত করব না আল্লাহ ব্যতীত এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করব না। আর আল্লাহকে ছেড়ে আমরা কেউ কাউকে ‘প্রতিপালক’ হিসাবে গ্রহণ করব না। এরপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমরা বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা ‘মুসলিম’ (আলে ইমরান ৩/৬৪; বুখারী হা/৭)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আবু সুফিয়ান ইবনু হারব (যখন তিনি মুসলিম ছিলেন) তাকে খবর দিয়েছেন এই মর্মে যে, যখন তার ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মধ্যে সন্ধি চলছিল, সে সময় আমরা কুরায়েশের একটি দলসহ ব্যবসা উপলক্ষ্যে শামে ছিলাম। হেরাক্বল তখন ঈলিয়া (যেরুযালেম) ছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ করেন। সে সময় রোমকদের বড় বড় নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর তিনি তাঁর দোভাষীর মাধ্যমে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে বংশের দিক দিয়ে এই ব্যক্তির সবচেয়ে নিকটবর্তী কে? যিনি ধারণা করেন যে, তিনি একজন নবী’। আবু সুফিয়ান বললেন, আমি। আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর তিনি আমাকে ডেকে তাঁর সামনে বসালেন এবং আমার সাথীদের পিছনে বসালেন। অতঃপর তিনি আমার সাথীদের বললেন, আমি এঁকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব। মিথ্যা বললে, তোমরা ধরে দিবে’। আবু সুফিয়ান বলেন, যদি আমাকে মিথ্যুক বলার ভয় না থাকত, তাহ’লে আমি অবশ্যই মুহাম্মাদ সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম’। (উভয়ের কথোপকথন ও হেরাক্বলের মন্তব্য সমূহ নিম্নে প্রদত্ত হ’ল)। ‘অতঃপর তিনি তাঁর দোভাষীকে বললেন, তুমি ওঁকে প্রশ্ন কর।-
প্রশ্ন-১ : নবীর বংশ মর্যাদা (حَسَبُهُ) কেমন?
উত্তর : উচ্চ বংশীয়।
(হেরাক্বলের মন্তব্য) : হ্যাঁ। রাসূলগণ উচ্চ বংশেই প্রেরিত হয়ে থাকেন।
প্রশ্ন-২ : নবীর বাপ-দাদাদের মধ্যে কেউ কখনো বাদশাহ ছিলেন কি?
উত্তর : না’।
মন্তব্য : এটা থাকলে আমি বুঝতাম যে, নবুঅতের বাহানায় বাদশাহী হাছিল করতে চায়।
প্রশ্ন-৩ : তাঁর অনুসারীদের মধ্যে দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা বেশী, না অভিজাত শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা বেশী?
উত্তর : দুর্বল শ্রেণীর’। মন্তব্য : প্রত্যেক নবীর প্রথম অনুসারী দল দুর্বলেরাই হয়ে থাকে।
প্রশ্ন-৪ : নবুঅতের দাবী করার পূর্বে তোমরা কি কখনো তাঁর উপরে মিথ্যার অপবাদ দিয়েছ?
উত্তর : না’। মন্তব্য : ঠিক। যে ব্যক্তি মানুষকে মিথ্যা বলে না, সে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলতে পারে না।
প্রশ্ন-৫ : তাঁর দ্বীন কবুল করার পর কেউ তা পরিত্যাগ করে চলে যায় কি?
উত্তর : না’। মন্তব্য : ঈমানের প্রভাব এটাই যে, তা একবার হৃদয়ে বসে গেলে আর বের হয় না।
প্রশ্ন-৬ : ঈমানদারগণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?
উত্তর : বাড়ছে’। মন্তব্য : ঈমানের এটাই বৈশিষ্ট্য যে, আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায় ও তা ক্রমে পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে যায়।
প্রশ্ন-৭ : তোমরা কি কখনো ঐ ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করেছ?
উত্তর : করেছি। কখনো তিনি জয়ী হয়েছেন (যেমন বদরে), কখনো আমরা জয়ী হয়েছি (যেমন ওহোদে)।
মন্তব্য : আল্লাহর নবীদের এই অবস্থাই হয়ে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নবীগণই লাভ করে থাকেন’।
প্রশ্ন-৮ : এই ব্যক্তি কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেছেন কি?
উত্তর : না’। তবে এ বছর আমরা (হোদায়বিয়ার) সন্ধিচুক্তি করেছি। দেখি তিনি কি করেন’। আবু সুফিয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! এতটুকু ছাড়া আর একটি শব্দও আমার পক্ষ থেকে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু হেরাক্বল (সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে) বললেন, নবীরা কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেন না।
প্রশ্ন-৯ : তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে কেউ নবুঅতের দাবী করেছেন কি?
উত্তর : না’। মন্তব্য : হ্যাঁ। এরূপ হ’লে বুঝতাম যে, বাপ-দাদার অনুকরণে এ দাবী করেছেন।
প্রশ্ন-১০ : তিনি তোমাদের কি নির্দেশ দেন?
উত্তর : তিনি আমাদের নির্দেশ দেন যে, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর তিনি আমাদেরকে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করেন। তিনি আমাদের ছালাত, যাকাত, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা এবং পবিত্রতা অর্জনের নির্দেশ দেন।
মন্তব্য:فَإِنْ كَانَ مَا تَقُولُ حَقًّا فَسَيَمْلِكُ مَوْضِعَ قَدَمَىَّ هَاتَيْنِ ، وَقَدْ كُنْتُ أَعْلَمُ أَنَّهُ خَارِجٌ ، لَمْ أَكُنْ أَظُنُّ أَنَّهُ مِنْكُمْ ، فَلَوْ أَنِّى أَعْلَمُ أَنِّى أَخْلُصُ إِلَيْهِ لَتَجَشَّمْتُ لِقَاءَهُ ، وَلَوْ كُنْتُ عِنْدَهُ لَغَسَلْتُ عَنْ قَدَمَيْهِ ‘যদি তুমি সত্য কথা বলে থাক, তবে সত্বর তিনি আমার পায়ের তলার মাটিরও (অর্থাৎ শাম ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের) মালিক হবেন। আমি জনতাম যে, তিনি আগমন করবেন। কিন্তু আমি ভাবিনি যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে হবেন। যদি আমি জানতাম যে, আমি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারব, তাহ’লে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য সাধ্যমত কষ্ট স্বীকার করতাম। আর যদি আমি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারতাম, তাহ’লে আমি তাঁর দু’পা ধুয়ে দিতাম’। ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে,إِنْ يَكُنْ مَا تَقُولُ فِيهِ حَقًّا فَإِنَّهُ نَبِىٌّ ‘তুমি যা বলছ তা যদি সত্য হয়, তাহ’লে তিনি অবশ্যই নবী’।
অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রেরিত পত্রটি নিয়ে পাঠ করলেন। পত্র পাঠ শেষ হ’লে (ভক্তির আবেশে) সভাসদগণের কণ্ঠস্বর ক্রমেই উচ্চমার্গে উঠতে লাগল এবং তাদের মধ্যে আলোচনা বৃদ্ধি পেতে থাকল। এ সময়ে আমাদেরকে চলে যেতে বলা হ’ল।
আবু সুফিয়ান বলেন যে, রাজদরবার থেকে বেরিয়ে এসে আমি সাথীদের বললাম,لَقَدْ أَمِرَ أَمْرُ ابْنِ أَبِيْ كَبْشَةَ إِنَّهُ يَخَافُهُ مَلِكُ بَنِي الْأَصْفَرِ ‘ইবনু আবী কাবশার ব্যাপারটি মযবুত হয়ে গেল। আছফারদের সম্রাট তাকে ভয় পাচ্ছেন’।[2] আবু সুফিয়ান বলেন, এরপর থেকে আমার বিশ্বাস বদ্ধমূল হ’তে থাকল যে, সত্বর তিনি বিজয় লাভ করবেন। অবশেষে আল্লাহ আমার মধ্যে ইসলাম প্রবেশ করিয়ে দিলেন’।[3] অর্থাৎ ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম কবুল করেন (ইবনু হিশাম ২/৪০৩)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পত্র রোম সম্রাটের উপরে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তা প্রতীয়মান হয়। পত্রবাহক দেহিয়া কালবীকে রোম সম্রাট বহুমূল্য উপঢৌকনাদি দিয়ে সম্মানিত করেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য মূল্যবান হাদিয়া প্রেরণ করেন। আল্লাহ পাকের এমনই কুদরত যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কাফের দুশমন নেতার মুখ দিয়েই আরেক অমুসলিম সম্রাটের সম্মুখে তার সত্যায়ন করালেন এবং সম্রাটকে হেদায়াত দান করলেন। ফালিল্লাহিল হামদ।
[2]. (ক) ‘আবু কাবশার ছেলে’ বলতে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। এই উপনামটি রাসূল (ছাঃ)-এর দুধ পিতার অথবা তার দাদা বা নানা কারু ছিল। এটি একটি অপরিচিত নাম। আরবদের নিয়ম ছিল, কাউকে হীনভাবে প্রকাশ করতে চাইলে তার পূর্বপুরুষদের কোন অপরিচিত ব্যক্তির দিকে সম্বন্ধ করে বলা হ’ত। আবু সুফিয়ান সেটাই করেছেন। (খ) ‘বানুল আছফার’ বলতে রোমকদের বুঝানো হয়েছে। ‘আছফার’ অর্থ হলুদ। আর রোমকরা ছিল হলুদ রংয়ের।
[3]. বুখারী হা/৭, ৪৫৫৩; মুসলিম হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬১।