লগইন করুন
হোদায়বিয়ায় অবতরণের কিছু পরে মুসলমানদের মিত্র বনু খোযা‘আহর নেতা বুদাইল বিন অরক্বা(بُدَيلُ بنُ وَرْقَاءَ) কিছু লোক সহ উপস্থিত হ’লেন। তিনি এসে খবর দিলেন যে, কুরায়েশ নেতা কা‘ব ও ‘আমের বিন লুওয়াই সৈন্য-সামন্ত এমনকি নারী-শিশু নিয়ে হোদায়বিয়ার পর্যাপ্ত পানিপূর্ণ ঝর্ণার ধারে শিবির স্থাপন করেছে, আপনাদের বাধা দেওয়ার জন্য ও প্রয়োজনে যুদ্ধ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি তাদেরকে গিয়ে বল যে,إِنَّا لَمْ نَجِئْ لِقِتَالِ أَحَدٍ، وَلَكِنَّا جِئْنَا مُعْتَمِرِينَ ‘আমরা কারু সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি। বরং আমরা এসেছি কেবল ওমরাহ করার জন্য’। তিনি বললেন, কুরায়েশরা ইতিপূর্বে যুদ্ধ করেছে এবং তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। তারা চাইলে আমি তাদের জন্য একটা সময় বেঁধে দেব, সে সময়ে তারা সরে দাঁড়াবে (এবং আমরা ওমরাহ করে নেব)। এরপরেও তারা যদি না মানে এবং কেবল যুদ্ধই তাদের কাম্য হয়, তাহ’লে যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে এই দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করব যতক্ষণ না আমার আত্মা বিচ্ছিন্ন হয় অথবা আল্লাহ স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে একটা ফায়ছালা করে দেন’।
অতঃপর বুদাইল কুরায়েশ নেতাদের কাছে গেলেন। তরুণরা তার কোন কথা শুনতে চাইল না। জ্ঞানীরা শুনতে চাইলেন। তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য যথাযথভাবে বিবৃত করলেন।
ফলে সেখানে উপস্থিত উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী বলে উঠলেন, আমাকে একবার তার কাছে যেতে দাও’। অতঃপর নেতাদের অনুমতি নিয়ে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হ’লেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সেসব কথাই বললেন, যা তিনি ইতিপূর্বে বুদাইলকে বলেছিলেন। জবাবে উরওয়া বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! যদি তুমি নিজ সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দাও, তবে ইতিপূর্বে কোন আরব এরূপ করেনি। আর যদি বিপরীতটা হয়, (অর্থাৎ তুমি পরাজিত হও) তবে আল্লাহর কসম! তোমার পাশে এমন কিছু নিকৃষ্ট লোককে দেখছি, যারা তোমার থেকে পালিয়ে যাবে অথবা ছেড়ে যাবে’। তার এ মন্তব্য শুনে ঠান্ডা মেযাজের মানুষ আবুবকর (রাঃ) রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন,امْصُصْ بَظْرَ اللاَّتِ، أَنَحْنُ نَفِرُّ عَنْهُ وَنَدَعُهُ؟ ‘লাতের গুপ্তাঙ্গের ঝুলন্ত চর্ম চুষতে থাক! আমরা রাসূলকে রেখে পালিয়ে যাব ও তাঁকে ছেড়ে যাব’?
এরপর উরওয়া রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বারবার রাসূল (ছাঃ)-এর দাড়িতে হাত দিচ্ছিলেন। ওদিকে পাশে দাঁড়ানো মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) নিজ তরবারির বাঁটে হাত দিচ্ছিলেন ও উরওয়াকে ধমক দিয়ে বলছিলেন,أَخِّرْ يَدَكَ عَنْ لِحْيَةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘তোমার হাতকে রাসূল (ছাঃ)-এর দাড়ি থেকে দূরে রাখ’। এভাবে উরওয়া রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছাহাবীগণের ভালাবাসার নমুনা সমূহ প্রত্যক্ষ করলেন। উল্লেখ্য যে, মুগীরা ছিলেন উরওয়ার ভাতিজা।
আলোচনা শেষে উরওয়া কুরায়েশদের নিকটে ফিরে গিয়ে বললেন,أَىْ قَوْمِ، وَاللهِ لَقَدْ وَفَدْتُ عَلَى الْمُلُوكِ، وَوَفَدْتُ عَلَى قَيْصَرَ وَكِسْرَى وَالنَّجَاشِىِّ وَاللهِ إِنْ رَأَيْتُ مَلِكًا قَطُّ يُعَظِّمُهُ أَصْحَابُهُ مَا يُعَظِّمُ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا‘হে আমার কওম! আল্লাহর কসম! আমি ক্বায়ছার, কিসরা, নাজাশী প্রমুখ সম্রাটদের দরবারে প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছি। কিন্তু কোন সম্রাট-এর প্রতি তার সহচরদের এমন সম্মান করতে দেখিনি, যেমনটি দেখেছি মুহাম্মাদের প্রতি তার সাথীদের সম্মান করতে’। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের সম্মান প্রদর্শনের এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার কতগুলি উদাহরণ পেশ করে বলেন, আল্লাহর কসম! তারা তাঁর থুথু হাতে ধরে মুখে ও গায়ে মেখে নেয়। তার ওযূর ব্যবহৃত পানি ধরার জন্য প্রতিযোগিতা করে। তার নির্দেশ পালনের জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকে। তাঁর সাথে কথা বলার সময় সকলের কণ্ঠস্বর নীচু হয়ে যায়। অধিক সম্মান প্রদর্শনের কারণে তাঁর প্রতি কেউ পূর্ণভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে না’। তিনি বললেন,وَإِنَّهُ قَدْ عَرَضَ عَلَيْكُمْ خُطَّةَ رُشْدٍ، فَاقْبَلُوهَا ‘এই লোকটি (মুহাম্মাদ) তোমাদের নিকটে একটা ভাল প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তোমরা সেটা কবুল করে নাও’ (বুখারী হা/২৭৩১)।
ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন যে, উরওয়ার উপস্থিতিতে ছাহাবীগণ ভক্তির এই বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করেছিলেন, তাকে বাস্তবে একথা বুঝিয়ে দেবার জন্য যে, যারা তাদের নেতার ভালোবাসায় এতদূর করতে পারে ও এতবড় সম্মান ও ভক্তি দেখাতে পারে, তাদের সম্পর্কে উরওয়া কিভাবে ধারণা করতে পারেন যে, কুরায়েশদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলে তারা রাসূলকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে ও তাঁকে শত্রুদের হাতে সমর্পণ করবে? বরং বিভিন্ন গোত্রীয় যুদ্ধে স্রেফ গোত্রীয় স্বার্থের চাইতে তারা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দ্বীনের প্রতি সাহায্যের ক্ষেত্রে সবচাইতে অগ্রণী ও আপোষহীন। ইবনু হাজার বলেন, এই ঘটনায় বুঝা যায় যে, বৈধ উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য যেকোন বৈধ পন্থা অবলম্বন করা যায়’।[1] বস্ত্ততঃ এই ধরনের বাড়াবাড়ি আচরণের ঘটনা অন্য সময়ে দেখা যায়নি।
উরওয়া বিন মাসঊদ-এর রিপোর্ট পাওয়ার পর সেখানে উপস্থিত কুরায়েশ মিত্র বনু কেনানা গোত্রের বেদুঈন নেতা হুলাইস বিন আলক্বামা(حُلَيسُ بنُ عَلْقَمةَ) বললেন, আমাকে একবার যেতে দিন! অতঃপর নেতাদের অনুমতি নিয়ে তিনি গেলেন। দূর থেকে তাকে দেখে রাসূল (ছাঃ) মন্তব্য করলেন,هُوَ مِنْ قَوْمٍ يُعَظِّمُونَ الْبُدْنَ ‘এ ব্যক্তি এমন একটি গোত্রের, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে’। অতএব তোমরা পশুগুলিকে দাঁড় করিয়ে দাও। কাছে এলে লোকটি কুরবানীর পশুসমূহ দেখে খুশীতে বলে উঠলো,سُبْحَانَ اللهِ مَا يَنْبَغِي لِهَؤُلاَءِ أَنْ يُصَدُّوا عَنِ الْبَيْتِ ‘সুবহানাল্লাহ! এইসব লোককে আল্লাহর ঘর থেকে বিরত রাখা উচিত নয়’। কথা বলেই লোকটি ফিরে গেল এবং কুরায়েশদের নিকটে তার উত্তম মতামত পেশ করল’ (বুখারী হা/২৭৩১)। কিন্তু নেতারা বললেন,اجْلِسْ فَإِنَّمَا أَنْتَ أَعْرَابِىٌّ لاَ عِلْمَ لَكَ ‘তুমি বস! তুমি একজন বেদুঈন মাত্র। তোমার কোন জ্ঞান নেই’ (আহমাদ হা/১৮৯৩০, সনদ হাসান)।
এরপর নেতারা মিকরায বিন হাফছ(مِكْرَزُ بنُ حَفْصٍ) কে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে দূর থেকে দেখেই মন্তব্য করলেন,هَذَا مِكْرَزٌ وَهْوَ رَجُلٌ فَاجِرٌ ‘লোকটি মিকরায। সে একজন দুষ্টু লোক’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে সেসব কথাই বললেন, যা ইতিপূর্বে বুদাইল ও তার সাথীদের বলেছিলেন।
মিকরায কথা বলছেন। এমতাবস্থায় সুহায়েল বিন আমর(سُهَيلُ بنُ عَمْرو) এসে উপস্থিত হন। তাকে দেখে রাসূল (ছাঃ) মন্তব্য করলেন,قَدْ سَهَّلَ اللهُ لَكُمْ أَمْرَكُمْ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের বিষয়টি সহজ করে দিবেন’।[2] অতঃপর সুহায়েল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হয়। অবশেষে তাঁরা একটি আপোষ প্রস্তাবে সম্মত হন। যা ‘হোদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত।
[2]. বুখারী হা/২৭৩১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২।