লগইন করুন
৪৪. সারিইয়া আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ(سرية عبد الرحمن بن عوف) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাস। ‘দূমাতুল জান্দাল’(دُومةُ الْجَنْدل) এলাকায় বনু কলব খ্রিষ্টান গোত্রের বিরুদ্ধে এটি প্রেরিত হয় এবং সহজ বিজয় অর্জিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে আব্দুর রহমানের মাথায় পাগড়ী বেঁধে দেন ও যুদ্ধে উত্তম পন্থা অবলম্বনের উপদেশ দেন। তিনি এখানে তিনদিন অবস্থান করে সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দেন। ফলে খ্রিষ্টান গোত্রনেতাসহ সকলে মুসলমান হয়ে যায়।[1]
৪৫. সারিইয়া আলী ইবনু আবী ত্বালিব(سرية على بن أبي طالب) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাস। ২০০ জনের একটি সেনাদল নিয়ে আলী (রাঃ) খায়বরের ফাদাক অঞ্চলে বনু সা‘দ বিন বকর গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হন, যারা ইহূদীদের সাহায্যার্থে প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। বনু সা‘দ পালিয়ে যায়। তাদের ফেলে যাওয়া ৫০০ উট ও ২০০০ ছাগল মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হয়।[2]
৪৬. সারিইয়া আবুবকর ছিদ্দীক(سرية أبي بكر الصديق) : ৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাস। ওয়াদিল ক্বোরা এলাকার বনু ফাযারাহ গোত্রের একটি শাখার নেত্রী উম্মে ক্বিরফা (أم قِرْفَة) ৩০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহীকে প্রস্ত্তত করছিল। এ কথা জানতে পেরে হযরত আবুবকর অথবা যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সেখানে একটি বাহিনী প্রেরিত হয়। উক্ত ৩০ জনের সবাই নিহত হয় এবং দলনেত্রীর কন্যা অন্যতম সেরা আরব সুন্দরীকে(مِنْ أَحْسَنِ الْعَرَبِ) দাসী হিসাবে মক্কায় পাঠিয়ে তার বিনিময়ে সেখান থেকে কয়েকজন মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করা হয়।[3] কেউ এটিকে ৭ম হিজরীর ঘটনা বলেছেন’ (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৩৩৫, টীকা-১)।
৪৭. সারিইয়া কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী(سرية كرز بن جابر الفهري) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস। উরাইনা গোত্রের প্রতি তিনি ২০ জন অশ্বারোহী সহ প্রেরিত হন। দলনেতা কুরয ছিলেন সেই কুরায়েশ নেতা, যিনি ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে সর্বপ্রথম মদীনার উপকণ্ঠে হামলা চালিয়ে বহু গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যান এবং রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং যার পশ্চাদ্ধাবন করে বদরের উপকণ্ঠে সাফওয়ান পর্যন্ত পৌঁছে যান (দ্রঃ গাযওয়া সাফওয়ান ক্রমিক সংখ্যা-৬)। পরে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং মক্কা বিজয়ের দিন শহীদ হন।
অত্র অভিযানের কারণ ছিল এই যে, ওক্ল ও উরাইনা(عُكْل وعُرَيْنة) গোত্রের আটজন লোক ইসলাম কবুল করে মদীনায় বসবাস করতে থাকে। কিন্তু তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে কিছু দূরে ছাদাক্বার উটসমূহের চারণক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাদেরকে উটের দুধ ও পেশাব পান করতে বলা হয়। এতে তারা দ্রুত সুস্থতা লাভ করে। কিন্তু একদিন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর রাখালদের হত্যা করে উটগুলো সব নিজেদের এলাকায় খেদিয়ে নিয়ে যায় এবং পুনরায় কাফির হয়ে যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়।[4]
সেনাদল তাদের গ্রেফতার করেন এবং হাত-পা কেটে ও উত্তপ্ত লোহা দিয়ে চোখ অন্ধ করে ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী ‘হাররাহ’ (حرَّة) নামক পাথুরে স্থানে ছেড়ে দেন। ফলে সেখানেই তারা মরে পড়ে থাকে’ (বুখারী হা/২৩৩, ১৫০১)।
ক্বাতাদাহ ইবনু সীরীন থেকে বর্ণনা করেন যে, এটি ছিল ‘দন্ডবিধিসমূহ’ নাযিল হওয়ার পূর্বেকার ঘটনা। উক্ত হাদীছের রাবী হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর থেকে রাসূল (ছাঃ) ‘অঙ্গহানি নিষিদ্ধ করেন’(ثُمَّ نَهَى عَنِ الْمُثْلَةِ)।[5] আর এটি ছিল সূরা মায়েদাহ ৪৫ আয়াত নাযিলের অনুসরণে। ইমাম বুখারী (রহঃ) এদিকেই ঝুঁকেছেন (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৩৩-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
৪৮. সারিইয়া ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী(سرية عمرو بن أمية الضمري) : ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস। সালামাহ বিন আবু সালামাহ সহ দুইজনের এই ক্ষুদ্র দলটি মক্কায় প্রেরিত হয় আবু সুফিয়ানকে গোপনে হত্যা করার জন্য। কেননা তিনি ইতিপূর্বে একজন বেদুঈনকে মদীনায় পাঠিয়েছিলেন রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা করার জন্য। কিন্তু কারু কোন অভিযানই সফল হয়নি।[6]
৪৯. সারিইয়া আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ(سرية أبي عبيدة بن الجراح) : ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। এটাই ছিল হোদায়বিয়া সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত কুরায়েশ কাফেলা সমূহের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সর্বশেষ অভিযান। আবু ওবায়দাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৩০০ অশ্বারোহীর এ দলটি প্রেরিত হয় একটি কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য। অভিযানে কোন ফল হয়নি। কিন্তু সেনাদল দারুণ অন্নকষ্টে পতিত হন। ফলে তাদের গাছের ছাল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়। সেকারণ এই অভিযানجَيْشُ الْخَبَط বা ‘ছাল-পাতার অভিযান’ নামে আখ্যায়িত হয়। এই সময় সমুদ্র হ’তে একটি বিশালাকারের মাছ কিনারে নিক্ষিপ্ত হয়। যাকে আম্বর (الْعَنْبَرُ) বলা হয়। বাংলাতে যা ‘তিমি মাছ’ বলে পরিচিত। এই মাছ তারা ১৫ দিন যাবৎ ভক্ষণ করেন। এই মাছ এত বড় ছিল যে, সেনাপতির হুকুমে তার দলের মধ্যকার সবচেয়ে দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি সবচেয়ে উঁচু উটটির পিঠে বসে মাছের একটি কাঁটার ঘেরের মধ্য দিয়ে অনায়াসে চলে যায়। বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে উক্ত মাছের কিছু অংশ মদীনায় আনা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘হাদিয়া’ প্রদান করা হয়। তিনি বলেন,هُوَ رِزْقٌ أَخْرَجَهُ اللهُ لَكُمْ ‘এটি রূযী, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য (সাগর থেকে) বের করে দিয়েছিলেন’।[7]
স্থানটি বর্তমানে বদর থেকে জেদ্দা অভিমুখে ২৫ কি. মি. যাওয়ার পর ডানদিকে ১০ কি. মি. দূরে আর-রাইস (الرَّايِس) নামে পরিচিত। যা লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত ছোট্ট শহর। মুসলিম পর্যটকরা এখানে এসে সমুদ্রের মাছ কিনে তা ভেজে নিয়ে সাগরপাড়ে বসে খেয়ে থাকেন বরকতময় বিগত স্মৃতি ধারণ করে।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৪৯; ইবনু সা‘দ ২/৬৯; আর-রাহীক্ব ৩৩৪ পৃঃ।
[3]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩১৮; ইবনু সা‘দ ৪/২২০; আর-রাহীক্ব ৩৩৪ পৃঃ; মুসলিম হা/১৭৫৫ (৪৬)।
মুবারকপুরী কোনরূপ সূত্র ছাড়াই এখানে রাসূল (ছাঃ)-কে গোপন হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা বর্ণনা করেছেন (আর-রাহীক্ব ৩৩৪ পৃঃ)। ইবনু হিশামসহ অন্য কোন জীবনীকার এটি বর্ণনা করেননি বা কোন হাদীছেও এরূপ কথা বর্ণিত হয়নি।
[4]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৫৪; ইবনু সা‘দ ২/৭১।
[5]. আবু দাঊদ হা/৪৩৬৮ ‘দন্ডবিধিসমূহ’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ ।
[6]. ইবনু হিশাম ২/৬৩৩; আর-রাহীক্ব ৩৩৫ পৃঃ।
[7]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৪; ইবনু সা‘দ ৩/৩১৩-১৪; বুখারী হা/৪৩৬১; মুসলিম হা/১৯৩৫; মিশকাত হা/৪১১৪ ‘শিকার ও যবহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২।
মুবারকপুরী বলেন, চরিতকারগণ এটিকে ৮ম হিজরীর রজব মাসের ঘটনা বলে থাকেন। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক (السِّيَاق) বিবেচনায় দেখা যায় যে, এটি হোদায়বিয়ার পূর্বের ঘটনা। কেননা ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধি হওয়ার পরে কুরায়েশ কাফেলার উপর হামলা করার জন্য আর কোন মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হয়নি’ (আর-রাহীক্ব ৩২৪ পৃঃ)।