লগইন করুন
খন্দক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে উম্মে সালামার ঘরে যোহরের সময় যখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) গোসল করছিলেন, তখন জিব্রীল এসে বললেন, আপনি অস্ত্র নামিয়ে ফেলেছেন, অথচ ফেরেশতারা এখনো অস্ত্র নামায়নি। দ্রুত তাদের দিকে ধাবিত হউন! রাসূল (ছাঃ) বললেন, কোন দিকে? জবাবে তিনি বনু কুরায়যার দিকে ইশারা করলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) সেদিকে বেরিয়ে গেলেন’ (বুখারী হা/৪১১৭)। বনু কুরায়যার দুর্গ ছিল মসজিদে নববী থেকে ৬ মাইল বা প্রায় ১০ কি. মি. দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষণা প্রচার করে দিলেন, لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الْعَصْرَ إِلاَّ فِى بَنِى قُرَيْظَةَ ‘কেউ যেন বনু কুরায়যায় পৌঁছানোর আগে আছর না পড়ে’ (বুখারী হা/৯৪৬)। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমের উপরে মদীনার প্রশাসন ভার অর্পণ করে ৩,০০০ সৈন্য নিয়ে তিনি বনু কুরায়যা অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। অবশ্য ছাহাবীদের কেউ রাস্তাতেই আছর পড়ে নেন। কেউ পৌঁছে গিয়ে আছর পড়েন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এজন্য কাউকে কিছু বলেননি (ঐ)। কেননা এর দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সকলের দ্রুত বের হওয়া। অতঃপর যথারীতি বনু কুরায়যার দুর্গ অবরোধ করা হয়, যা ২৫ দিন স্থায়ী হয়। অবশেষে তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের সাবালক ও সক্ষম পুরুষদের বন্দী করা হয়। এদের সম্পর্কে ফায়ছালার দায়িত্ব তাদের দাবী অনুযায়ী তাদের মিত্র আওস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে অর্পণ করা হয়। তিনি তাদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি স্বরূপ সবাইকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। সেমতে তাদের নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব সহ সবাইকে হত্যা করা হয়’ (বুখারী হা/৪১২১)।
নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইবনু ইসহাক ৬০০, ক্বাতাদাহ ৭০০ ও সুহায়লী ৮০০ থেকে ৯০০-এর মধ্যে বলেছেন। পক্ষান্তরে জাবের (রাঃ) বর্ণিত ছহীহ হাদীছ সমূহে ৪০০ বর্ণিত হয়েছে (তিরমিযী হা/১৫৮২ ও অন্যান্য)। এর সমন্বয় করতে গিয়ে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, সম্ভবতঃ ৪০০ জন ছিল যোদ্ধা। বাকীরা ছিল তাদের সহযোগী’ (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪১২২-এর আলোচনা)।
যদি তারা ফায়ছালার দায়িত্ব রাসূল (ছাঃ)-কে দিত, তাহ’লে হয়ত পূর্বেকার দুই গোত্রের ন্যায় তাদেরও নির্বাসন দন্ড হ’ত। অতঃপর তাদের কয়েদী ও শিশুদের নাজদে নিয়ে বিক্রি করে তার বিনিময়ে ঘোড়া ও অস্ত্র-শস্ত্র খরীদ করা হয়। অবরোধ কালে মুসলিম পক্ষে খাল্লাদ বিন সুওয়াইদ (خَلاَّد بن سُوَيْد) শহীদ হন এবং উক্কাশার ভাই আবু সিনান বিন মিহছান(أبو سنان بن مِحْصَن) স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন। তাঁকে বনু কুরায়যার গোরস্থানে দাফন করা হয়। উপর থেকে চাক্কি ফেলে খাল্লাদকে হত্যা করার অপরাধে বনু কুরায়যার একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়। উক্ত মহিলা ব্যতীত কোন নারী বা শিশুকে হত্যা করা হয়নি।[1]
সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর ফায়ছালা অনুযায়ী বনু নাজ্জার-এর বিনতুল হারেছ-এর বাগানে কয়েকটি গর্ত খুঁড়ে সেখানে খন্ড খন্ড দলে নিয়ে বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকদের হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। যার উপরে এখন মদীনার মার্কেট তৈরী হয়েছে।[2]
বনু কুরায়যার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পূর্বেই তাদের কিছু লোক ইসলাম কবুল করেছিল। কেউ কেউ দুর্গ থেকে বেরিয়েও এসেছিল। তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ থাকে। এতদ্ব্যতীত ‘আত্বিয়া কুরাযীর (عَطِيَّةُ الْقُرَظِيُّ) নাভির নিম্নদেশের লোম না গজানোর কারণে তিনি বেঁচে যান ও পরে ছাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। এভাবে কাছীর বিন সায়েবও বেঁচে যান।[3]
ছাবেত বিন ক্বায়েস (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট বৃদ্ধ ইহূদী নেতা যুবায়ের বিন বাত্বা আল-কুরাযী(الزُّبَيرُ بنُ بَاطَا الْقُرَظِيُّ) এবং তার পরিবার ও মাল-সম্পদ তাকে ‘হেবা’ করার জন্য আবেদন করেন। কারণ যুবায়ের ছাবেতের উপর জাহেলী যুগে কিছু অনুগ্রহ করেছিল। তখন ছাবেত বিন ক্বায়েস যুবায়েরকে বললেন, রাসূল (ছাঃ) তোমাকে তোমার পরিবার ও মাল-সম্পদসহ আমার জন্য ‘হেবা’ করেছেন। এখন এগুলি সবই তোমার। অতঃপর যখন যুবায়ের জানতে পারল যে, তার সম্প্রদায়ের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। তখন সে বলল, হে ছাবেত! তুমি আমাকে আমার বন্ধুদের সাথে মিলিয়ে দাও। তখন তাকে হত্যা করা হ’ল এবং তার নিহত ইহূদী বন্ধুদের সাথে তাকে মিলিয়ে দেওয়া হ’ল।[4] যুবায়ের-পুত্র আব্দুর রহমান নাবালক হওয়ার কারণে বেঁচে যান। অতঃপর তিনি ইসলাম কবুল করেন ও ছাহাবী হন।[5]
অনুরূপভাবে বনু নাজ্জারের জনৈকা মহিলা উম্মুল মুনযির সালমা বিনতে ক্বায়েস-এর আবেদনক্রমে রেফা‘আহ বিন সামাওয়াল(رِفَاعَةُ بْنُ سَمَوْأَلَ) কুরাযীকে তার জন্য ‘হেবা’ করা হয়। পরে রেফা‘আহ ইসলাম কবুল করেন ও ছাহাবী হন।
এদিন রাসূল (ছাঃ) বনু কুরায়যার গণীমতের মাল এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকীটা বণ্টন করে দেন। তিনি অশ্বারোহীদের তিন অংশ ও পদাতিকদের এক অংশ করে দেন। বন্দীদের সা‘দ বিন যায়েদ আনছারীর নেতৃত্বে নাজদের বাজারে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তাদের বিক্রি করে ঘোড়া ও অস্ত্র-শস্ত্র খরীদ করেন। বন্দীনীদের মধ্যে রায়হানা বিনতে ‘আমর বিন খানাক্বাহকে(رَيْحَانَةُ بِنْتِ عَمْرِو بْنِ خَنَاقَةَ) রাসূল (ছাঃ) নিজের জন্য মনোনীত করেন। কালবীর বর্ণনা মতে ৬ষ্ঠ হিজরীতে তাকে মুক্তি দিয়ে রাসূল (ছাঃ) তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। বিদায় হজ্জ শেষে রাসূল (ছাঃ) যখন মদীনায় ফিরে আসেন, তখন তাঁর মৃত্যু হয় এবং রাসূল (ছাঃ) তাকে বাক্বী‘ গোরস্থানে দাফন করেন’।[6]
[2]. ইবনু হিশাম ২/২৪০-৪১; সনদ ‘মুরসাল’ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১৩৯১)।
[3]. আর-রাহীক্ব ৩১৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/২৪২-৪৩। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ। বরং এটাই প্রমাণিত যে, বনু কুরায়যার ঐ সমস্ত পুরুষই কেবল হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যায়, যাদের গুপ্তাঙ্গে লোম গজায়নি (ইবনু হিশাম ২/২৪৪; সনদ ছহীহ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১৩৯৫)। তাদের মধ্যে অনেকেই ইসলাম কবুল করেন। যেমন কা‘ব আল-কুরাযী, কাছীর বিন সায়েব, ‘আত্বিয়া আল-কুরাযী, আব্দুর রহমান বিন যুবায়ের বিন বাত্বা প্রমুখ (মা শা-‘আ ১৭৫ পৃঃ)।
[4]. আর-রাহীক্ব ৩১৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/২৪২-৪৩। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক, ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৩৯৩)।
[5]. প্রসিদ্ধ আছে যে, অতি বৃদ্ধ ইহূদী নেতা যুবায়ের বিন বাত্বা, যিনি বু‘আছ যুদ্ধের সময় ছাবিত বিন ক্বায়েস বিন শাম্মাস (রাঃ)-এর প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন, তার নিকটে এসে নিজেকে তার নিহত ইহূদী বন্ধুদের মধ্যে শামিল করার জন্য অনুরোধ করেন এবং বলেন, ঐ সব বন্ধুদের মৃত্যুর পরে আমার দুনিয়াতে কোন আরাম-আয়েশ নেই।... অতঃপর ছাবিত তাকে এগিয়ে দেন এবং তাকে হত্যা করা হয়’। বর্ণনাটি ইবনু ইসহাক বিনা সনদে (ইবনু হিশাম ২/২৪২-৪৩) এবং বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত-এর মধ্যে (৪/২৩) ইবনু ইসহাকের বরাতে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ (মা শা- ‘আ ১৭৪-৭৫ পৃঃ)।
ইহূদী নেতাদের মধ্যে যুবায়ের বিন বাত্বা নিহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণিত। কিন্তু উপরোক্ত বর্ণনায় তার নিহত হওয়ার যে আগ্রহ বর্ণিত হয়েছে, তা সরাসরি কুরআনের বিরোধী। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَلَتَجِدَنَّهُمْ أَحْرَصَ النَّاسِ عَلَى حَيَاةٍ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا يَوَدُّ أَحَدُهُمْ لَوْ يُعَمَّرُ أَلْفَ سَنَةٍ وَمَا هُوَ بِمُزَحْزِحِهِ مِنَ الْعَذَابِ أَنْ يُعَمَّرَ وَاللهُ بَصِيرٌ بِمَا يَعْمَلُونَ ‘তুমি তাদেরকে দীর্ঘ জীবনের ব্যাপারে অন্যদের চাইতে অধিক আকাংখী পাবে এমনকি মুশরিকদের চাইতেও। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে যেন সে হাযার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে দূরে রাখতে পারবে না। বস্ত্ততঃ তারা যা করে, সবই আল্লাহ দেখেন’ (বাক্বারাহ ২/৯৬)।
[6]. আর-রাহীক্ব ৩১৭ পৃঃ; বায়হাক্বী হা/১৭৮৮৮; আল-বিদায়াহ ৪/১২৬; ইবনু হিশাম ২/২৪৫। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক, ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৩৯৮)।