লগইন করুন
মুছ‘আব ছিলেন মক্কার এক ধনাঢ্য পরিবারের আদরের দুলাল। তিনি যখন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বের হতেন, তখন আগে-পিছে গোলামের দল থাকত। দু’শো দিরহামের কম মূল্যের কোন পোষাক তিনি পরতেন না। তিনি ইসলাম গ্রহণ করায় তার গোত্রের লোকেরা তাকে বেঁধে ঘরে আটকে রাখে। পরে তিনি কৌশলে বেরিয়ে হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে মক্কায় আসেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণধী এবং অত্যন্ত বিশ্বস্ত যুবক। বিষয়বস্ত্ত উপস্থাপন ও অন্যকে আকৃষ্ট করার অনন্য সাধারণ গুণাবলী তার মধ্যে ছিল।
১ম আক্বাবাহর বায়‘আত সম্পাদিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছ‘আবকে তাদের সাথে ইয়াছরিবে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে গিয়ে তরুণ দলনেতা আবু উমামাহ আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর বাড়ীতে অবস্থান করেন এবং উভয়ে মিলে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। তাঁকে মুক্বরি (الْمُقْرِئُ) অর্থাৎ পাঠদানকারী বা শিক্ষক বলে সবাই ডাকত। তাঁর দাওয়াতের ফল এই হয়েছিল যে, পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার আগেই ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল এবং আনছারদের এমন কোন গৃহ ছিল না যার পুরুষ ও মহিলাদের কিছু সংখ্যক মুসলমান হননি। তাঁর প্রচারকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-
একদিন আস‘আদ বিন যুরারাহ তাঁকে সাথে নিয়ে বনু আব্দিল আশহাল ও বনু যাফরের(بنو ظَفَر) মহল্লায় গমন করেন ও সেখানে একটি কূয়ার পাশে কয়েকজন মুসলমানকে নিয়ে বসেন। তখনো পর্যন্ত বনু আব্দিল আশহাল গোত্রের দুই নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও উসায়েদ বিন হুযায়ের ইসলাম কবুল করেননি। মুবাল্লিগদের আগমনের খবর জানতে পেরে সা‘দ উসায়েদকে বললেন, আপনি যেয়ে ওদের নিষেধ করুন যেন আমাদের সরল-সিধা মানুষগুলিকে বোকা না বানায়। আস‘আদ আমার খালাতো ভাই না হ’লে আমি নিজেই যেতাম’।
উসায়েদ বর্শা উঁচিয়ে সদর্পে সেখানে গিয়ে বললেন, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে এখুনি পালাও। তোমরা আমাদের বোকা লোকগুলিকে মুসলমান বানাচ্ছো’। মুছ‘আব শান্তভাবে বললেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন ও কথা শুনুন। যদি পসন্দ না হয়, তখন দেখা যাবে’। উসায়েদ তখন মাটিতে বর্শা গেড়ে বসে পড়লেন। অতঃপর মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। ইতিমধ্যে উসায়েদ চমকিত হয়ে বলে উঠলেন, مَا أَحْسَنَ هَذَا الْكَلاَمَ وَأَجْمَلَهُ ‘কতই না সুন্দর কথা এগুলি ও কতই না মনোহর’। এরপর তিনি সেখানেই ইসলাম কবুল করলেন।
অতঃপর তিনি সা‘দ বিন মু‘আয-এর নিকটে এসে বললেন, فَواللهِ مَا رَأَيْتُ بِهِمَا بَأْسًا ‘আল্লাহর কসম! আমি তাদের মধ্যে দোষের কিছু দেখিনি’। তবে আমি তাদের নিষেধ করে দিয়েছি এবং তারাও বলেছে, আপনারা যা চান তাই করা হবে’। এ সময় উসায়েদ চাচ্ছিলেন যে, সা‘দ সেখানে যান। তাই তাকে রাগানোর জন্যে বললেন, আমি জানতে পারলাম যে, বনু হারেছাহ্র লোকজন আস‘আদ বিন যুরারাহকে হত্যা করার জন্য বের হয়েছে এজন্য যে, সে আপনার খালাতো ভাই। সা‘দ ক্রুদ্ধ হয়ে তখনই বর্শা হাতে ছুটে গেলেন। যেয়ে দেখেন যে, আস‘আদ ও মুছ‘আব নিশ্চিন্তে বসে আছে। বনু হারেছাহ্র হামলাকারীদের কোন খবর নেই। তখন তিনি বুঝলেন যে, উসায়েদ তার সঙ্গে চালাকি করেছে তাকে এদের কাছে পাঠানোর জন্য। তখন সা‘দ ক্রুদ্ধস্বরে উভয়কে ধমকাতে থাকলেন এবং আস‘আদকে বললেন, তুমি আমার আত্মীয় না হ’লে তোমাদের কোনই ক্ষমতা ছিল না আমার মহল্লায় এসে লোকদের বাজে কথা শুনাবার’। আস‘আদ পূর্বেই সা‘দ ও উসায়েদ-এর বিষয়ে মুছ‘আবকে অবহিত করেছিলেন যে, এরা দু’জন মুসলমান হ’লে এদের গোত্রের সবাই মুসলমান হয়ে যাবে। আস‘আদের ইঙ্গিতে মুছ‘আব অত্যন্ত ধীর ও নম্র ভাষায় সা‘দকে বললেন, আপনি বসুন এবং আমাদের কথা শুনুন! অতঃপর পসন্দ হলে কবুল করবেন, নইলে প্রত্যাখ্যান করবেন’।
অতঃপর তিনি বসলেন এবং মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে শুনালেন ও তাওহীদের মর্ম বুঝালেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’লেন। অতঃপর সেখানেই দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে নিজ গোত্রে এলেন ও সবাইকে ডেকে বললেন, হে বনু আব্দিল আশহাল! كَيْفَ تَعْلَمُونَ أَمْرِي فِيكُمْ؟ তোমরা আমাকে তোমাদের মধ্যে কেমন মনে কর? তারা বলল, اَنْتَ سَيِّدُنَا وَأَفْضَلُنَا رَأْيًا وَأَيْمَنُنَا نَقِيبَةً ‘আপনি আমাদের নেতা, সর্বোত্তম সিদ্ধান্তের অধিকারী ও আমাদের নিশ্চিন্ততম কান্ডারী’। তখন তিনি বললেন, فَإِنَّ كَلاَمَ رِجَالِكُمْ وَنِسَائِكُمْ عَلَيَّ حَرَامٌ حَتّى تُؤْمِنُوا بِاللهِ وَبِرَسُولِهِ ‘তোমাদের নারী ও পুরুষ সকলের সঙ্গে আমার কথা বলা হারাম, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনবে’। এ কথার প্রতিক্রিয়া এমন হ’ল যে, সন্ধ্যার মধ্যেই সকলে ইসলাম কবুল করল’ (ইবনু হিশাম ১/৪৩৫-৩৭) মাত্র একজন তরুণ ব্যতীত। যার নাম ছিল আমর বিন ছাবিত আল-উছাইরিম (الأُصَيْرِمُ)। ইনি পরে ওহোদ যুদ্ধের দিন ইসলাম কবুল করেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও শাহাদত বরণ করেন (ইবনু হিশাম ২/৯০)।