লগইন করুন
মক্কার বাসিন্দারা মূলতঃ হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কা‘বাগৃহকে যথার্থভাবেই আল্লাহর গৃহ বা বায়তুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে ত্বাওয়াফ, সাঈ তথা হজ্জ ও ওমরাহ করত এবং বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কোন নবী না আসায় শয়তানী প্ররোচনায় তাদের সমাজনেতা ও ধনিক শ্রেণীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং এক সময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তিপূজার শিরকের প্রচলন হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর কওমের মধ্যে হয়েছিল।
(১) কুরায়েশ বংশের বনু খোযা‘আহ গোত্রের সরদার ‘আমর বিন লুহাই (عَمرو بن لُحَى بن عامر الْخُزاعى) অত্যন্ত ধার্মিক, দানশীল ও দরবেশ স্বভাবের লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত এবং তার প্রতি অন্ধভক্তি পোষণ করত। তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ আলেম ও অলি-আউলিয়াদের মধ্যে গণ্য করা হ’ত। অতএব শয়তান তাকেই বেছে নিল তার কার্যসিদ্ধির জন্য। একবার তিনি শামের ‘বালক্বা’ (الْبَلْقَاء) অঞ্চলের ‘মাআব’ (مَآب) নগরীতে গিয়ে দেখেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ‘হুবাল’ (هُبَل) মূর্তির পূজা করে। তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, আমরা এই মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হয় এবং সাহায্য প্রার্থনা করলে সাহায্য পাই’। এরা ছিল আমালেক্বা গোত্রের লোক এবং ইমলীক্ব বিন লাবেয বিন সাম বিন নূহ-এর বংশধর।[1] আমর ভাবলেন অসংখ্য নবী-রাসূলের জন্মভূমি ও কর্মভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরা যখন ‘হোবল’ মূর্তির অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তখন আমরাও এটা করলে উপকৃত হব। ফলে বহু মূল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরীদ করে নিয়ে গেলেন এবং মক্কার নেতাদের রাযী করিয়ে কা‘বাগৃহে স্থাপন করলেন। কথিত আছে যে, একটা জিন আমরের অনুগত ছিল। সেই-ই তাকে খবর দেয় যে, নূহ (আঃ)-এর সময়কার বিখ্যাত অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাসর (নূহ ৭১/২৩) প্রতিমাগুলি জেদ্দার অমুক স্থানে মাটির নীচে প্রোথিত আছে। আমর সেখানে গিয়ে সেগুলো উঠিয়ে এনে তেহামায় রেখে দিলেন। অতঃপর হজ্জ-এর মওসুমে সেগুলিকে বিভিন্ন গোত্রের হাতে সমর্পণ করলেন। এভাবে আমর ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইসমাঈল (আঃ)-এর দ্বীনে পরিবর্তন আনেন এবং তাওহীদের বদলে শিরকের প্রবর্তন করেন (আর-রাহীক্ব ৩৫ পৃঃ)।
অতঃপর বনু ইসমাঈলের মধ্যে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রসার ঘটে। নূহ (আঃ
)-এর কওমের রেখে যাওয়া অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাস্র (নূহ ৭১/২৩) প্রভৃতি মূর্তিগুলি এখন ইবরাহীমের বংশধরগণের দ্বারা পূজিত হ’তে থাকে। যেমন- বনু হুযায়েল কর্তৃক সুওয়া‘ (سُوَاع), ইয়ামনের বনু জুরাশ কর্তৃক ইয়াগূছ (يَغُوث), বনু খায়ওয়ান কর্তৃক ইয়া‘ঊক্ব (يَعُوق), যুল-কুলা‘ কর্তৃক নাসর (نَسْر), কুরায়েশ ও বনু কেনানাহ কর্তৃক হুবাল (هُبَل) ও উযযা (العُزَّى), ত্বায়েফের বনু ছাক্বীফ কর্তৃক লাত (اللاَّت), মদীনার আউস ও খাযরাজ কর্তৃক মানাত (مَنَاة), বনু ত্বাঈ কর্তৃক ফিল্স (فِلْسُ), ইয়ামনের হিমইয়ার গোত্র কর্তৃক রিয়াম (رِيَام), দাউস ও খাছ‘আম গোত্র কর্তৃক যুল-কাফফায়েন(ذُو الْكَفَّيْن) ও যুল-খালাছাহ(ذُو الْخَلَصَة) প্রভৃতি মূর্তি সমূহ পূজিত হ’তে থাকে (ইবনু হিশাম ১/৭৭-৮৭)।
এভাবে ক্রমে আরবের ঘরে ঘরে মূর্তিপূজার প্রসার ঘটে। ফলে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বাগৃহের ভিতরে ও চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি দেখতে পান। তিনি সবগুলোকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন ও কা‘বাগৃহ পানি দিয়ে ধুয়ে ছাফ করে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমার সম্মুখে (স্বপ্নে) জাহান্নামকে পেশ করা হ’ল, ... অতঃপর আমাকে দেখানো হ’ল ‘আমর বিন ‘আমের আল-খুযাঈকে। জাহান্নামে সে তার নাড়ী-ভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে। এ ব্যক্তিই প্রথম তাদের উপাস্যদের নামে উট ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল (যা লোকেরা রোগ আরোগ্যের পর কিংবা সফর থেকে আসার পর তাদের মূর্তির নামে ছেড়ে দিত)। ঐসব উট সর্বত্র চরে বেড়াত। কারু ফসল নষ্ট করলেও কিছু বলা যেত না বা তাদের মারা যেত না’।[2]
(২) তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাতো। তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (যুমার ৩৯/৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করবে (ইউনুস ১০/১৮)।
(৩) তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, ত্বাওয়াফ করত, তার সামনে নত হ’ত ও সিজদা করত। ত্বাওয়াফের সময় তারা শিরকী তালবিয়াহ পাঠ করত।لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ ‘হে আল্লাহ! আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, কেবল ঐ শরীক যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং সে যা কিছুর মালিক)। মুশরিকরা ‘লাববাইকা লা শারীকা লাকা’ বলার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে ক্বাদ ক্বাদ (থামো থামো) বলতেন।[3] এজন্যেই আল্লাহ বলেছেন,وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُونَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে। অথচ সেই সাথে শিরক করে’ (ইউসুফ ১২/১০৬)। (৪) তারা মূর্তির জন্য নযর-নেয়ায নিয়ে আসত এবং মূর্তির নামে কুরবানী করত (মায়েদাহ ৫/৩)। (৫) তারা মূর্তিকে খুশী করার জন্য গবাদিপশু ও চারণক্ষেত্র মানত করত। যাদেরকে কেউ ব্যবহার করতে পারত না (আন‘আম ৬/১৩৮-১৪০)। (৬) তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভাল-মন্দ ফলাফল ও শুভাশুভ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকারের তীর ব্যবহার করত (মায়েদাহ ৫/৯০-৯১)। যাতে হ্যাঁ, না, ভাল, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোবল দেবতার খাদেম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে তাতে ঝাঁকুনি দিয়ে তীরগুলি ঘুলিয়ে ফেলত। অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত। (৭) এতদ্ব্যতীত তারা জ্যোতিষীদের কথা বিশ্বাস করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গলামঙ্গলের কারণ মনে করত।[4] (৮) তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে বা রেখা টেনে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত এবং পাখি ডাইনে গেলে শুভ ও বামে গেলে অশুভ ধারণা করত।[5] তারা ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলত এবং জিনদের সাথে আল্লাহর আত্মীয়তা সাব্যস্ত করত (ছাফফাত ৩৭/১৫০-৫২, ১৫৮-৫৯)। তারা নিজেদের জন্য পুত্রসন্তান ও আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান নির্ধারণ করত (নাজম ৫৩/২১-২২)।
[2]. বুখারী হা/৩৫২১; মুসলিম হা/৯০৪, ২৮৫৬; মিরক্বাত শরহ মিশকাত হা/৫৩৪১; সীরাহ ছহীহাহ ১/৮৩। ইনিই ছিলেন ‘আমর বিন লুহাই বিন ‘আমের, যিনি সর্বপ্রথম কা‘বাগৃহে ‘হোবল’ মূর্তির পূজা শুরু করেন (ইবনু হিশাম ১/৭৬)।
[3]. মুসলিম হা/১১৮৫, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে; মিশকাত হা/২৫৫৪ ‘ইহরাম ও তালবিয়াহ’ অনুচ্ছেদ। পক্ষান্তরে ইসলামী তালবিয়াহ হ’ল, لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ ‘আমি হাযির হে আল্লাহ আমি হাযির। আমি হাযির। তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, অনুগ্রহ ও সাম্রাজ্য সবই তোমার; তোমার কোন শরীক নেই’ (বুখারী হা/৫৯১৫; মুসলিম হা/২৮৬৮)। দ্রঃ ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ বই ৫৪ পৃঃ। বর্তমান যুগে বহু মুসলমান কবরে সিজদা করে ও কবরবাসীর নিকটে পানাহ চায়। অতঃপর মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করে। একই সঙ্গে কবরপূজা ও আল্লাহ্র ইবাদত। যা স্পষ্ট শিরক এবং যা জাহেলী আরবের মুশরিকদের অনুকরণ মাত্র।
[4]. বুখারী হা/৮৪৬; মুসলিম হা/৭৩; মিশকাত হা/৪৫৯৬-৯৭।
[5]. মুসলিম হা/৫৩৭; মিশকাত হা/৪৫৯২।