লগইন করুন
(ক) সহীহ হাদীসের আলোকে যুলহাজ্জ মাস
যুলহাজ্জ বা যিলহাজ্জ মাস ৪টি হারাম মাসের অন্যতম। এ মাসেই হজ্জ আদায় করা হয় এবং এ মাসেই ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়। এ মাসের প্রথম ১০ দিনে বেশি বেশি নেক কর্ম করতে সহীহ হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করেন: ‘‘যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করা আল্লাহর কাছে যত বেশি প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর কাছে তত প্রিয় নয়।’’[1] যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, এ দশ দিনের প্রতি দিনের সিয়াম এক বছরের সিয়ামের তুল্য এবং প্রত্যেক রাত লাইলাতুল কাদ্রের তুল্য।[2] অন্য একটি দুর্বল হাদীসে বলা হয়েছে, এ দশ দিনের নেক আমলের ৭০০ গুণ সাওয়াব প্রদান করা হয়।[3] অন্য একটি যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেছেন, কথিত আছে যে, যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন এক হাজার দিনের সমান এবং বিশেষত আরাফার দিন ১০ হাজার দিনের সমান।[4]
৯ যুলহাজ্জ হাজীগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন। যারা হজ্জ করছেন না তাদের জন্য এ দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। আরাফাত দিবস বা ৯ যুলহাজ্জের সিয়ামের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘‘তা বিগত বছর ও পরবর্তী বছরের পাপ মার্জনা করে।’’[5]
(খ) যুলহাজ্জ মাস বিষয়ক কিছু বানোয়াট কথা
এ সকল সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের পাশাপাশি এই মাসের ফযীলতে অনেক জাল হাদীস সমাজে প্রচালিত রয়েছে। এ সকল জাল হাদীসে এ মাসের জন্য বিশেষ বিশেষ সালাত ও সিয়ামের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া এ মাসের ১ম দশ দিনের ফযীলতের বিষয়েও অনেক জাল কথা তারা বানিয়েছে।
১. যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দিন
যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিনের অংশ হিসেবে এ দিনটির ফযীলত রয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ অন্য ফযীলত প্রচার করেছে:
وُلِدَ إِبْرَاهِيْمُ فِيْ أَوَّلِ يَوْمٍ مِنْ ذِيْ الْحِجَّةِ فَصَوْمُ ذَلِكَ الْيَوْمِ كَصَوْمِ سَبْعِيْنَ سَنَةً (فَمَنْ صَامَ ذَلِكَ الْيَوْمَ كَانَ كَفَّارَةَ ثَمَانِيْنَ سَنَةً)
‘‘যুলহাজ্জ মাসের প্রথম তারিখে ইবরাহীম (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। কাজেই যে ব্যক্তি এ দিনে সিয়াম পালন করবে সে ৭০ বছর সিয়াম পালনের সাওয়াব পাবে... তার ৮০ বছরের পাপের মার্জনা হবে...।’’[6]
২. যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ, ইয়াওমুত তারবিয়া
যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখকে ‘ইয়াওমুত তারবিয়া’ বলা হয়। এ দিনে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয়। হাজীগণ এ দিনে হজ্জের জন্য মক্কা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। হাজী ছাড়া অন্যদের জন্য এ দিনের বিশেষ কোনো আমল নেই। যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের অংশ হিসেবে এর মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ এ তারিখের দিনের ও রাতের জন্য বিশেষ সালাত ও সিয়ামের কাহিনী রচনা করেছে। ইতোপূর্বে শবে বরাত বিষয়ক জাল হাদীস আলোচনার সময় ‘তারবিয়ার’ রাত বা যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখের রাত ইবাদতে জাগ্রত থাকার বিষয়ে কয়েকটি জাল বা অত্যন্ত দুর্বল হাদীস আমরা দেখতে পেয়েছি। আরেকটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ صَامَ يَوْمَ التَّرْوِيَةِ أَعْطَاهُ اللهُ مِثْلَ ثَوَابِ أَيُّوْبَ عَلَى بَلاَئِهِ
‘‘যে ব্যক্তি তারবিয়ার দিনে (যিলহাজ্জের ৮ তারিখে) সিয়াম পালন করবে আল্লাহ তাকে সে পরিমাণ সাওয়াব প্রদান করবেন, যে পরিমাণ সাওয়াব আইয়ূব (আঃ) তার বালা-মুসিবতের কারণে লাভ করেছিলেন।’’[7]
৩. যুলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখ: আরাফার দিন
আরাফার দিনে সিয়াম পালনের ফযীলত আমরা জানতে পেরেছি। হাজীগণ ব্যতীত অন্য মুসলিমের জন্য এ তারিখের দিনে বা রাতে আর কোনো বিশেষ সালাত, দোয়া, যিকির বা অন্য কোনো নেক আমলের নির্ধারিত বিধান বা পদ্ধতি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। জালিয়াতগণ এ দিনের সালাত, যিক্র, দোয়া ইত্যাদির বিষয়েও অনেক জাল কথা প্রচার করেছে।
৪. যুলহাজ্জ মাসের বানোয়াট সালাত
আমরা দেখেছি যে, যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন ও রাত অত্যন্ত গুরুত্ব পুর্ণ। এ সময়ে নফল সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, দান ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদত বন্দেগি যথাসাধ্য বেশি বেশি করে পালন করা দরকার। যে যতটুকু করতে পারবেন ততটুকুর সাওয়াব পাবেন। এসকল দিনে বা যুলহাজ্জ মাসের কোনো দিন বা রাতের জন্য কোনোরূপ বিশেষ সালাত বা সালাতের বিশেষ পদ্ধতি কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট। যেমন:
- যুলহাজ্জ মাসের প্রথম রাত্রির সালাত: ২ রাক‘আত বা বেশি রাক‘আত ... সালাত, অমুক অমুক সূরা দ্বারা ... ইত্যাদি।
- যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ ‘ইয়াওমুত তারবিয়ার’ রাতের সালাত: ২/৪ ... ইত্যাদি রাক‘আত সালাত, অমুক অমুক সূরা দিয়ে...।
- যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখ ‘ইয়াওমুত তারবিয়ার’ দিনের সালাত: ৬/৮ ...ইত্যাদি রাক‘আত সালাত, অমুক অমুক সূরা দিয়ে...।
- আরাফার রাতের সালাত, ১০০ রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা... অত বার ... ইত্যাদি।
- আরাফার দিনের সালাত, ২/৪... ইত্যাদি রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা... অত বার ... ইত্যাদি।
- ঈদুল আযহার বা কুরবানীর দিনের রাতের সালাত, ১২/... ইত্যাদি রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা অত বার....।
- কুরবানীর দিন বা ঈদুল আযহার দিনের সালাত, ঈদুল আযহার পরে ২ রাক‘আত সালাত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা অত বার...।
- যুলহাজ্জ মাসের শেষ দিনের সালাত, দুই রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে অমুক সূরা ও অমুক আয়াত অত বার ...।
এ সকল বানোয়াট সালাতের মধ্যে বা শেষে কিছু দোয়া বা যিক্র-এর কথাও উল্লেখ করেছে জালিয়াতগণ। তারা এ সকল সালাতের জন্য আকর্ষণীয় ও আজগুবি অনেক সাওয়াব ও ফলাফলের কথা উল্লেখ করেছে।[8]
৫. যুলহাজ্জ মাসের বানোয়াট সিয়াম
যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ৯ দিন এবং বিশেষত আরাফার দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ সাওয়াব ও মর্যাদার কথা সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু জালিয়াতগণ ভাবে যে, এ সকল সাওয়াবে মুসলমানদের তৃপ্তি হবে না, এজন্য উদ্ভট সব ফযীলতের বর্ণনা দিয়ে এ সকল দিনে ও অন্যান্য দিনে সিয়াম পালনের বিষয়ে অনেক জাল হাদীস বানিয়েছে।
৬. যুলহাজ্জের শেষ দিন ও মুহার্রামের প্রথম দিনের সিয়াম
একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ صَامَ آَخِرَ يَوْمٍ مِنْ ذِيْ الْحِجَّةِ وَأَوَّلَ يَوْمٍ مِنَ الْمُحَرَّمِ فَقَدْ خَتَمَ السَّنَةَ الْمَاضِيَةَ بِصَوْمٍ وَافْتَتَحَ السَّنَةَ الْمُسْتَقْبَلَةَ بِصَوْمٍ فَقَدْ جَعَلَ اللهُ لَهُ كَفَّارَةَ خَمْسِيْنَ سَنَةً
‘‘যে ব্যক্তি যুলহাজ্জ মাসের শেষ দিন এবং মুহার্রাম মাসের প্রথম দিন সিয়াম পালন করল, সে ব্যক্তি তার বিগত বছরকে সিয়াম দ্বারা সমাপ্ত করলো এবং আগত বছরকে সিয়াম দ্বারা স্বাগত জানালো। কাজেই আল্লাহ তার ৫০ বছরের কাফফারা বা পাপ মার্জনা করবেন।’’[9]
এরূপ আরো অনেক আজগুবি সনদহীন বানোয়াট ও মিথ্যা কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়।[10]
উপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, জালিয়াতদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি দেখানোর একটি বড় ক্ষেত্র হলো সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক বিভিন্ন প্রকারের নেক আমলের ফযীলতের বিষয়ে জাল হাদীস তৈরি করা। এর বড় কারণ হলো, এ ধরনের জাল কথা সহজেই সরলপ্রাণ মুসলমানদের মন আকৃষ্ট করে এবং এগুলো দিয়ে সহজেই সরলপ্রাণ বুযুর্গ ও লেখকগণকে ধোকা দেওয়া যায়। তাঁরা আমল ভালবাসেন এবং আমলের ফযীলত বিষয়ক হাদীসগুলো সরল মনে গ্রহণ করেন।
এ জাতীয় জাল কথা প্রচলিত হওয়ার কারণও এটাই। অন্যান্য জাল কথার চেয়ে আমলের ফযীলত বিষয়ক জাল কথা প্রসিদ্ধি লাভের কারণ হলো, অনেক বুযুর্গ ওয়ায়িয, দরবেশ বা লেখক এগুলোর মধ্যে ফযীলতের আধিক্য দেখে সরল মনে এগুলোকে গ্রহণ করেছেন এবং সাধারণ মানুষদের আকৃষ্ট করার জন্য এগুলি মুখে বলেছেন বা বইয়ে লিখেছেন। আর, একবার একজন লিখলে সাধারণত পরবর্তী লেখকগণ সেগুলো থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করতে থাকেন। অনেকেই যাচাই বাছাই করার সময় পান না। অনেকে ভাবেন, যাই হোক, এর দ্বারা তো কিছু মানুষ আমল করছে। ভালই তো!!
আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, অনেক বুযুর্গ এগুলোর উপর আমল করেছেন, অনেকে ফল ও প্রভাব লাভ করেছেন। অনেকে এগুলো তাদের ওয়াযে বলেছেন বা বইয়ে লিখেছেন- তাঁরা কি সবাই গোনাহগার হবেন?
এখানে আমাদের বুঝতে হবে যে, এ সকল জাল হাদীসে সাধারণত, সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া, দান ইত্যাদি শরীয়ত সম্মত নেক আমলের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। মুমিনের দায়িত্ব হলো, নফল সালাত, সিয়াম, যিক্র, দোয়া ইত্যাদি সকল প্রকার দৈনন্দিন, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক নেক আমল নিয়মিত পালন করা। এ হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসারী সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি তাবিয়ী ও বুযুর্গগণের রীতি ও তরী‘কা। এরপর সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত মর্যাদাময় দিন ও রাতগুলিতে অতিরিক্ত ইবাদতের চেষ্টা করা। এ সকল মিথ্যা ও জাল হাদীস সাধারণত মুমিনকে সহীহ সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত ইবাদত থেকে দূরে নিয়ে যায়, অকারণ পরিশ্রম ও কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে এবং সুন্নাত বিরোধী বিভিন্ন রীতি পদ্ধতির মধ্যে নিমজ্জিত করে। এ ছাড়া যে কোনো কথা শুনে বা পড়েই তাকে হাদীস বলে মেনে নেয়া, হাদীসের কোন্ গ্রন্থে সংকলিত আছে তা অন্তত যাচাই করার চেষ্টা না করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নির্দেশনার বিরোধী ও দীনের বিষয়ে অবহেলার শামিল। এরপরও যারা অসাবধানতা, সরলতা বা অজ্ঞতা বশত এগুলোকে সঠিক মনে করে এগুলোর উপর আমল করেছেন, তারা এ সকল জাল হাদীসে বর্ণিত জাল ও বানোয়াট সাওয়াব পাবেন না, তবে মূল নেক আমালের সাধারণ সাওয়াব লাভ করবেন বলে আশা করা যায়।
কিন্তু যদি কেউ এগুলোকে জাল বলে জানার বা শোনার পরেও এগুলো বলেন, লিখেন বা পালন করেন, এ বিষয়ে কোনো তাহকীক বা যাচাই করতে আগ্রহী না হন, তবে অবশ্যই তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী হবেন।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৩১৩।
[3] বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৬; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/১২৮।
[4] বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৮; মুনযিরী, আত-তারগীব ২/১২৮।
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১৯।
[6] সুয়ূতী, যাইল, পৃ. ১১৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৫; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৯।
[7] সুয়ূতী, যাইল, পৃ. ১২১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৫; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১২১।
[8] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৮৭-৮৯, ১১৫-১১৭।
[9] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১১২; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১৯৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৮; তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ১১৮; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৯।
[10] মুফতী ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত ৪৬-৫০। অধ্যাপিকা দুলাল, নেক কানুন ৩২২-৩২৭।