লগইন করুন
রামাদান বা রমযান মাসের ফযীলত, ইবাদত, লাইলাতুল কাদরের গুরুত্ব, ইবাদত ইত্যাদি কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবে এক্ষেত্রেও জালিয়াতগণ তাদের মেধা ব্যয় করেছেন। সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস তারা বানিয়েছেন। সহীহ হাদীসের মধ্যে কিছু জাল কথা ঢুকিয়েও তারা প্রচার করেছেন। যেহেতু মূল ফযীলত প্রমাণিত, সেহেতু এ সকল জাল হাদীসের বিস্তারিত আলোচনা করছি না। প্রচলিত কয়েকটি ভিত্তিহীন কথার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে রামাদান প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই।
১. আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি ও আযাব-মুক্তি
রামাদান, সিয়াম, সাহরী খাওয়া, ইফতার করা ইত্যাদির গুরুত্ব, মর্যাদা, সাওয়াব ও বরকতের বিষয়ে অগণিত সহীহ হাদীস রয়েছে। তা সত্ত্বেও এগুলোর বদলে অনেক আজগুবি বাতিল, ভিত্তিহীন ও জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত। একটি জাল হাদীসে বলা হয়েছে:
إِذَا كَانَ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ نَظَرَ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ الصُّيَّامِ، وَإِذَا نَظَرَ إِلَى عَبْدٍ لَمْ يُعَذِّبْهُ
‘‘যখন রমজান মাসের প্রথম রাত্রি উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকাতের (তাঁর সিয়াম পালনকারী সৃষ্টির) প্রতি রহমতের দৃষ্টিপাত করেন, আর আল্লাহ তা‘আলার রহমতের দৃষ্টি যাহার উপর পতিত হয়, সে কোন সময় শাস্তি ভোগ করিবে না।’’[1]
মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি জাল।[2]
২. সাহরীর ফযীলত ও সাহরী ত্যাগের পরিণাম
সাহরী খাওয়ার উৎসাহ প্রদান করে একাধিক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অন্তত এক চুমুক পানি পান করে হলেও সাহরী খেতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। সাহরীকে বরকতময় আহার বলা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ইহূদী ও খৃস্টানদের সিয়ামের সাথে আমাদের সিয়ামের পার্থক্য সাহরী।
কিন্তু এ সকল সহীহ বা হাসান হাদীসের পাশাপাশি কিছু অতিরঞ্জিত বানোয়াট হাদীসও প্রচলিত হয়েছে। যেমন: ‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ ফরমাইয়াছেন .. ছেহেরীর আহারের প্রতি লোকমার পরিবর্তে আল্লাহ তা‘আলা এক বৎসরের ইবাদতের সাওয়াব দান করিবেন।... যে সেহরী খাইয়া রোজা রাখিবে সে ইহূদীদের সংখ্যানুপাতে সাওয়াব লাভ করিবে।... তোমাদের মধ্য হইতে যে ব্যক্তি সেহরী খাওয়া হইতে বিরত থাকিবে, তাহার স্বভাব চরিত্র ইহূদীদের ন্যায় হইয়া যাইবে।...’’[3] এ সকল কথা সবই বানোয়াট কথা বলে প্রতীয়মান।
৩. লাইলাতুল কাদ্র বনাম ২৭ রমযান
কুরআন-হাদীসে ‘লাইলাতুল কাদরের’ মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘লাইলাতুল কাদ্র’কে নির্দিষ্ট করে দেন নি। রামাদান মাসের শেষ দশ রাত এবং বিশেষ করে শেষ দশ রাতের মধ্যে বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কাদ্র সন্ধান করার নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবী-তাবিয়ীগণের কেউ কেউ ২৭ রামাদান লাইলাতুল কাদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বর্ণিত হয় নি। কাজেই ‘২৭ রমযানের’ ফযীলতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট বা বিকৃত।
এরূপ কিছু বাতিল কথা: ‘‘হাদীসে আছে,- যে ব্যক্তি রমযানের ২৭ তারিখের রাত্রিতে জাগিয়া এবাদত বন্দেগী করিবে। আল্লাহ তাআলা তাহার আমল নামায় এক হাজার বৎসরের এবাদতের ছওয়াব লিখিয়া দিবেন। আর বেহেশতে তাহার জন্য অসংখ্য ঘর নির্মাণ করাইবেন। ... আবূ বকর ছিদ্দীকের প্রশ্নের উত্তরে রাছূল ﷺ বলিয়াছিলেন: রমযানের ২৭ তারিখেই শবে কদর জানিও।...রমযান মাসের ২৭ তারিখের সূর্যাস্ত যাইবার সময় নিম্নলিখিত দোওয়া ৪০ বার পাঠ করলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মার্জিত হইবে।’’[4]
অনুরূপ বানোয়াট কথা: ‘‘হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ করিয়াছেন, যেই ব্যক্তি রমজান মসের ২৭ তারিখের রজনীকে জীবিত রাখিবে, তাহার আমলনামায় আল্লাহ ২৭ হাজার বৎসরের ইবাদতের তুল্য সাওয়াব প্রদান করিবেন এবং বেহেশতের মধ্যে অসংখ্য মনোরম বালাখানা নির্মাণ করিবেন যাহার সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেহই অবগত নন।[5]
৪. লাইলাতুল কাদ্রের গোসল
শবে বরাতের ন্যায় কাদ্রের রাত্রিতেও গোসল করার বিষয়ে জাল হাদীস আমাদের সমাজে প্রচলিত। যেমন: ‘‘যাহারা শবে-ক্বদরের এবাদতের নিয়্যতে সন্ধ্যায় গোসল করিবে তাহাদের পা ধৌত করা শেষ না হইতেই পূর্বের পাপ মার্জিত হইয়া যাইবে।’’[6]
লাইলাতুল কাদ্র-এ গোসলের ফযীলতে কোনো হাদীস বর্ণিত হয় নি। তবে যয়ীফ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রামাদান মাসের শেষ ১০ রাতের প্রত্যেক রাতে মাগরিব ও ইশার সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে গোসল করতেন। এরূপ গোসলের ফযীলতে আর কোনো কিছু জানা যায় না।[7]
৫. লাইলাতুল কাদ্রের সালাতের নিয়্যাত
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ‘নাওয়াইতু আন...’ বলে যত প্রকারের নিয়্যাত আছে সবই বানোয়াট। এখানে আরো লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশে শবে বারাত, শবে কাদ্র ইত্যাদি রাতে বা কোনো মর্যাদাময় দিনে নফল সালাত আদায়ের জন্য বিভিন্ন বানোয়াট নিয়্যাত প্রচলিত আছে। কোনো নফল সালাতের জন্যই কোনো পৃথক ‘নিয়্যাত’ নেই। লাইলাতুল কাদ্র বা যে কোনো রাতের সালাতের নিয়্যাত হবে ‘সালাতুল লাইল’ বা ‘কিয়ামুল্লাইল’-এর। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মুমিন দুই দুই রাক‘আত করে নফল সালাতের নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য মনে নিয়ে যত রাক‘আত পারেন সালাত আদায় করবেন। যদি রাতটি সত্যই আল্লাহর কাছে ‘লাইলাতুল কাদ্র’ বলে গণ্য হয় তাহলে বান্দা লাইলাতুল কাদ্রের সাওয়াব লাভ করবে। মুখে ‘আমি লাইলাতুল কাদ্রের নামায পড়ছি...’ ইত্যাদি কথা বলা অর্থহীন ও ভিত্তিহীন।
৬. লাইলাতুল কাদ্রের সালাতের পরিমাণ ও পদ্ধতি
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে লাইলাতুল কাদরে ‘কিয়াম’ বা ‘কিয়ামুল্লাইল’ করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিয়ামুল্লাইল অর্থ রাত্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নফল সালাত আদায় করা। এর জন্য কোনো বিশেষ রাক‘আত সংখ্যা, সূরা, আয়াত, দোয়া বা পদ্ধতি নেই। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) নিজে সুদীর্ঘ কিরাআতে এবং সুদীর্ঘ রুকু ও সাজদার মাধ্যমে কিয়ামুল্লাইল করতেন। এজন্য সম্ভব হলে দীর্ঘ কিরাআত ও দীর্ঘ রুকু-সাজদা সহকারে সালাত আদায় করা উত্তম। না পারলে ছোট কিরাআতে রাক‘আত সংখ্যা বাড়াবেন। মুমিন তার নিজের সাধ্য অনুসারে সূরা, তাসবীহ, দোয়া ইত্যাদি পাঠ করবেন। প্রত্যেকে তার কর্ম অনুসারে সাওয়াব পাবেন।
কাজেই ‘লাইলাতুল কাদরের সালাতের রাক‘আত সংখ্যা, সূরার নাম, সালাতের পদ্ধতি, সালাতের মধ্যে বা পরে বিশেষ দোয়া ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই মনগড়া এবং বাতিল কথা।[8] অনেক প্রকারের মনগড়া কথা ‘বাজারে’ প্রচলিত। একটি মনগড়া পদ্ধতি ও তৎসংশ্লিষ্ট কিছু জাল হাদীস একটি প্রসিদ্ধ পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি।
‘‘শবে-ক্বদরের নামাজ পড়িবার নিয়ম: এই রাত্রিতে পড়িবার জন্য নির্দিষ্ট ১২ রাকাত নফল নামায আছে। ঐ রাত্রিতে দুই রাকাত নফল নামায পড়িবে প্রথমে নিয়্যত করিবে, যথাঃ- ‘‘আমি আল্লাহর ওয়াস্তে ক্বেবলারোখ দাঁড়াইয়া শবে-ক্বদরের দুই রাকাত নামায পড়িতেছি।’’ নিয়্যত ও তাকবীরে-তাহরীমা অন্তে-ছুবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিছমিল্লাহ ও ‘ছুরা ফাতেহার’ পর প্রত্যেক রাকাতে ‘ছুরা ক্বদর’ একবার, ‘ছুরা এখলাছ’ তিনবার পাঠ করিবে এবং এইরূপে নামায শেষ করিবে।
হাদীছে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে সমস্ত শবে-ক্বদরের ছওয়াব বখশিশ করিবেন এবং হযরত ইদ্রীস, হযরত শোয়াইব, হযরত আইয়ুব, হযরত ইউছুফ, হযরত দাউদ ও হযরত নূহ আলাইহিচ্ছালাম এর সমস্ত পুণ্যের ছওয়াব তাহাদের আমলনামায় লিখিয়া দিবেন ও তাহাদের দোওয়া মকবুল হইবে এবং তাহাদিগকে বেহেশতের মধ্যে এই পৃথিবীর সমতুল্য একটি শহর দান করিবেন।
অতঃপর দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নফল নামায পড়িবে। প্রথমতঃ নিয়্যত করিবে। নিয়্যত ও তাকবীরের তাহরীমা পাঠান্তে প্রত্যেক রাকাতে ‘ছুরা ফাতেহার’ পর ‘ছুরা ক্বদর’ একবার ও ‘ছুরা এখলাছ’ ২৭ বার পড়িবে। ইহাও খেয়াল রাখিবে যে, প্রথমতঃ নিয়্যত করিয়া প্রথম রাকাতে ‘ছুরা ফাতেহার’ পূর্বে ছুবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিছমিল্লাহ পড়িতে হয়। কিন্তু তৎপর যত রাকাতই হউক না কেন প্রত্যেক রাকাতে ছুরা ফাতেহার পূর্বে কেবল মাত্র বিছমিল্লাহ পড়িতে হইবে এবং উল্লিখিত নিয়মেই পড়িয়া নামায শেষ করিবে।
হাদীসে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে এইরূপ নিষ্পাপ করিয়া দিবেন, যেমন অদ্যই মাতৃগর্ভ হইতে ভুমিষ্ঠ হইয়াছে। আর বেহেশতে তাহাদের জন্য হাজার বালাখানা তৈয়ার হইবে। - (মেশকাত) তৎপর দুই দুই রাকাত করিয়া চারি রাকাত নামায পড়িবে। প্রথমতঃ নিয়্যত করিবে, নিয়্যত ও তাকবীরে-তাহরীমার পাঠান্তে ছোবহানাকা, আউজুবিল্লাহ, বিছমিল্লাহ ও ছুরা ফাতেহার পরে প্রত্যেক রাকাতে, ছুরা ক্বদর তিনবার ও ছূরা এখলাছ ৫০ বার পড়িবে এবং এইরূপে নামায শেষ করিয়া ছেজদায় গিয়া ঐ দোওয়া একবার পড়িবে- যাহা সূর্যাস্ত যাইবার কালে পড়িবার জন্য লিখা হইয়াছে। হাদীছে আছে, যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন ও তাহাদের দোওয়া খোদা তাআলার দরবারে মকবুল হইবে।’’[9]
এগুলো সবই ভিত্তিহীন বানোয়াট কথা। ‘মেশকাত’ তো দূরের কথা কোনো হাদীস-গ্রন্থেই এ সকল কথা পাওয়া যায় না।
৭. লাইলাতুল কাদ্রের কারণে কদর বৃদ্ধি
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তকে নিম্নের হাদীসটি লিখা হয়েছে:
مَنْ أَدْرَكَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ رَفَعَ اللهُ قَدْرَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কাদ্র পাবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার কদর বা মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।’’[10] কথাটি ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হয়।
৮. জুমু‘আতুল বিদা বিষয়ক জাল কথা
সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, জুমু‘আর দিন ‘সাইয়েদুল আইয়াম’ বা সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। সূর্যের নিচে এর চেয়ে উত্তম দিবস আর নেই।[11] অনুরূপভাবে ‘রামাদান’ শ্রেষ্ঠ মাস।[12] কাজেই রামাদান মাসের জুমু্‘আর দিনটির মর্যাদা সহজেই অনুমেয়। মুমিন স্বভাবতই প্রত্যেক জুমু‘আর দিনে সুন্নাত সম্মত নেক আমলগুলি বেশি বেশি পালনের চেষ্টা করেন। একইভাবে রামাদানের প্রত্যেক দিনেই মুমিন সাধ্যমত নেক কর্মের চেষ্টা করেন। আর রামাদানের জুমু‘আর দিনে উভয় প্রকারের চেষ্টা একত্রিত হয়। রামাদান মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফযীলত পূর্ণ দিন হলো শেষ দশ দিন। এ ছাড়া রামাদানের শেষে রামাদান চলে যাচ্ছে বলে মুমিনের কিছু অতিরিক্ত আগ্রহ বাড়াই স্বাভাবিক।
এ ছাড়া রামাদান মাসের শেষ জুমু‘আর বা অন্য কোনো জুমা‘আর দিনের কোনো বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস বর্নিত হয় নি। তবে জালিয়াতগণ রামাদানের শেষ জুমু‘আর দিনের বা ‘বিদায়ী জুমু‘আর’ বিশেষ কিছু ফযীলত বানিয়ে সমাজে প্রচার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে এ দিনে কাযা সালাত বা উমরী কাযা আদায়ের ফযীলত ও এ দিনের বিশেষ দোয়া বিষয়ক কিছু জাল ও বানোয়াট কথা। যেমন:
مَنْ قَضَى صَلاَةً مِنَ الْفَرَائِضِ (الْخَمْسَ الصَّلَوَاتِ الْمَفْرُوْضَةَ) فِيْ آَخِرِ جُمُعَةٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ كَانَ ذَلِكَ جَابِراً لِكُلِّ صَلاَةٍ فَاتَتْهُ فِيْ عُمُرِهِ إِلَى سَبْعِيْنَ سَنَةً
‘‘যদি কোনো ব্যক্তি রামাদান মাসের শেষ জুমু‘আর দিনে এক ওয়াক্ত (অন্য জাল বর্ণনায় ৫ ওয়াক্ত) কাযা সালাত আদায় করে তবে ৭০ বৎসর পর্যন্ত তার সকল কাযা সালাতের ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ কথাটি জাল ও মিথ্যা কথা।[13]
বাহ্যত এ জাল হাদীসটির প্রচলন ঘটেছে বেশ দেরি করে। ফলে ৬ষ্ঠ-৭ম শতাব্দীতে যারা জাল হাদীস সংকলন করেছেন তারা তা উল্লেখ করেন নি। ১০ হিজরী শতক থেকে মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস এর জালিয়াতির বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আল্লামা শাওকানী (১২৫০হি) বলেন: ‘‘এ কথাটি যে বাতিল তাতে কেনো সন্দেহ নেই। আমি কোনো মাউদূ হাদীসের গ্রন্থেও এ হাদীসটি পাই নি। কিন্তু আমাদের যুগে আমাদের সানআ (ইয়ামানের রাজধানী) শহরে অনেক ফকীহ ও ফিক্হ অধ্যয়নকারীর মধ্যে তা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এদের অনেকেই এর উপর আমল করে। জানি না কে এ জাল কথাটি বানিয়েছে। আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপমানিত করুন।’’[14]
কোনো কোনো আলিম জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে এ জাল ও ভিত্তিহীন কথাটি তাদের গ্রন্থে লিখেছেন। ৭ম-৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা হুসামুদ্দীন হুসাইন ইবনু আলী সাগনাকী (৭১০ হি) হেদায়া’-র ব্যাখ্যা ‘আন-নিহায়া’ গ্রন্থে এ কথাটিকে ‘হাদীস’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। ‘আন-নিহায়া’ হেদায়ার অন্যতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ। পরবর্তী ব্যাখ্যাকারগণ এ গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছেন। ফলে হেদায়ার পরবর্তী অনেক ব্যাখ্যাকার এ জাল কথাটি ‘হাদীস’ হিসেবে লিখেছেন। অনেক সময় বড় আলিমদের প্রতি মানুষের ভক্তি ও শ্রদ্ধা তাদের সকল কথা নির্বিচারে গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি করে। তাঁদের গ্রন্থে এ হাদীস উদ্ধৃত থাকাতে অনেক সাধারণ মানুষ এ জাল কথাটিকে সঠিক বলে মনে করতে পারেন; এজন্য মোল্লা আলী কারী বলেন:
بَاطِلٌ قَطْعاً لأَنَّهُ مُنَاقِضٌ لِلإِجْمَاعِ عَلَى أَنَّ شَيْئًا مِنَ الْعِبَادَاتِ لاَ يَقُوْمُ مَقَامَ فَائِتَةِ سَنَوَاتٍ ثُمَّ لاَ عِبْرَةَ بِنَقْلِ النِّهَايَةِ وَلاَ شُرَّاحِ الْهِدَايَةِ فَإِنَّهُمْ لَيْسُوْا مِنَ الْمُحَدِّثِيْنَ وَلاَ أَسْنَدُوْا الْحَدِيْثَ إِلَى أَحَدٍ مِنَ الْمُخَرِّجِيْنَ
‘‘এ কথাটি নিঃসন্দেহে বাতিল। কারণ এ কথাটি মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যের বিরোধী। মুসলিম উম্মাহ একমত যে, কোনো একটি ইবাদত কখনোই অনেক বছরের পরিত্যক্ত ইবাদতের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না বা ক্ষতিপূরণ করতে পারে না। এরপর ‘নেহায়া’-র রচয়িতা এবং হেদায়ার অন্যান্য ব্যাখ্যাকারের উদ্ধৃতির কোনো মূল্য নেই; কারণ তাঁরা মুহাদ্দিস ছিলেন না এবং তারা কোনো হাদীস গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েও এ হাদীসটি উল্লেখ করেন নি।’’[15]
আল্লামা কারী হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পবিত্র আঙিনাকে মিথ্যার নাপাকি থেকে পবিত্র রাখা বিষয়ে তিনি আপোষহীন। মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম ও আলিমদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা তাঁকে আপোষের পথে পরিচালিত করতে পারি নি। অনেক আপোষকামী আলিমের মত তিনি বলতে পারতেন: হয়ত কোনো হাদীসের বইয়ে হাদীসটি ছিল... এত বড় আলিম যখন বলেছেন, হয়ত এর কোনো সূত্র ছিল। এরূপ বিভিন্ন ‘‘হয়ত’’ দিয়ে তিনি কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। কারণ, আলিমদের ভুল হতে পারে এবং তা স্বীকার করার মধ্যে কোনো অবমাননা বা অভক্তি নেই। কিন্তু কোনো হাদীসের সনদ নেই জানার পরেও তার জন্য অযুহাত খোঁজা জালিয়াতির মহাপাপের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। আর এজন্যই মোল্লা আলী কারীর এ কথার টীকায় বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও হানাফী ফকীহ আল্লামা আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ বলেন:
أَحْسَنْتَ، أَحْسَنْتَ، جَزَاكَ اللهُ خَيْراً عَنْ حَدِيْثِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ
‘‘অত্যন্ত ভাল কথা বলেছেন! অত্যন্ত ভাল কথা বলেছেন!! রাসূলুল্লাহর ﷺ হাদীসে পক্ষ থেকে আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন।’’[16]
৯. প্রচলিত কিছু ভিত্তিহীন কথাবার্তার নমুনা
ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তকাদিতে অনেক সময় লেখকগণ সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে যয়ীফ ও জাল হাদীসের উপর নির্ভর করা ছাড়াও বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধকে একসাথে এমনভাবে সংমিশ্রণ করেন যে, পূরা কথাটি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। হাদীস-গ্রন্থের উদ্ধৃতিও অনেক সময় মনগড়াভাবে দেয়া হয়। একটি পুস্তকে বলা হয়েছে:
‘‘হযরত (ﷺ) বলিয়াছেন, যাহারা শবে-ক্বদরে বন্দেগী করিবে তাহারা শত বৎসরের নেকীর ছওয়াব পাইবে। হযরত (ﷺ) আরও বলিয়াছেন, যাহারা শবে-ক্বদরে এবাদত করিয়াছে দোজখের আগুন তাহাদের উপর হারাম হইবে। আর একটি হাদীসে আছে- যদি তোমরা তোমাদের গোরকে আলোকময় পাইতে চাও, তবে শবে-ক্বদরে জাগরিত থাকিয়া এবাদত কর। আরও হাদীসে আছে- যাহারা শবে-ক্বদরে জাগিয়া এবাদত করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাদের ছগীরা, কবীরা সমস্ত পাপই মার্জনা করিবেন ও কেয়ামতের দিন তাহাদিগকে কিছুতেই নিরাশ করিবেন না। আর একটি হাদীসে আছে,- যে ব্যক্তি শবে-ক্বদর পাইবে নিশ্চয়ই আমি তাহাকে বেহেশতে লইবার জন্য জামিন হইব। .....’’
‘‘হাদীসে আছে: একদিন হযরত মূছা (আঃ) আল্লাহ তায়ালাকে প্রশ্ন করিলেন, হে আল্লাহ তায়ালা তুমি উম্মতে মোহাম্মদীকে উৎকৃষ্ট কোন জিনিস দান করিয়াছ? তদুত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলিলেন, আমি হযরত মোহাম্মদ (ﷺ)-এর উম্মতকে উৎকৃষ্ট রমযান মাস দান করিয়াছি। মুছা (আঃ) বলিলেন, প্রভু, সেই মাসের কি ফযীলত ও মরতবা তাহা আমাকে শুনাও। তখন আল্লাহ তায়ালা বলিলেন, হে মূছা! রমযান মাসের ফযীলত ও মরতবার কথা কতই শুনাইব তবে সামান্য এতটুকুতেই বুঝিতে পারিবে যে, উহার মর্যাদা কি পরিমাণ! তোমাদের সাধারণের মধ্যে আমার মর্যাদা ও সম্মান যেরূপ অতুলনীয়, অন্যান্য মাস হইতে রমযান মাসের মর্যাদাও তেমনি অতুলনীয় জানিবে। (তিরমিযি)’’ ....হযরত (ﷺ) বলেছেন, যাহারা নিজের পরিবার পরিজনসহ সন্তোষের সহিত রমজান মাসের ৩০টি রোযা রাখিয়াছে, হালাল জিনিস দ্বারা ইফতার করিয়াছে, আল্লাহ তায়ালা তাহাদিগকে ঐ প্রকার ছওয়াব দিবেন, যেমন তাহারা মক্কা শরীফে ও মদীনা শরীফে রোযা রাখিয়াছে। হাদীসে আছে, যাহারা উক্ত স্থানসমূহে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাদের ৭০ হাজার হজ্জ্বের, ৭০ হাজার ওমরার ও ৭০ হাজার রমযান মাসের ছওয়াব দিবেন ও পৃথিবীতে যত ঈমানদার বান্দা আছেন, সমস্তের নেকীর ছওয়াব দিবেন আর ঐ পরিমান পাপও তাহাদের আমলনামা হইতে কাটিয়া দিবেন। আর সপ্ত-আকাশে যত ফেরেস্তা আছে, তাহাদের সমস্তের পূণ্যের ছওয়াব তাহাদের আমলনামায় লিখিয়া দিবেন। (তিরমিজী)’’[17]
এ সকল কথা এভাবে সুনান তিরমিযী তো দূরের কথা, অন্য কোনো হাদীস গ্রন্থে সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে জানতে পারি নি। শুধুমাত্র মক্কা মুকাররামায় রামাদান পালনের বিষয়ে দু একটি যয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সম্ভবত গ্রন্থকার এখানে ইবনু মাজাহ সংকলিত নিম্নের হাদীসটির ‘ইচ্ছামত’ অনুবাদ করেছেন:
ইবনু মাজাহ বলেন, আমাদেরকে মুহাম্মাদ ইবনু আবী উমার বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল-আম্মী বলেছেন, তার পিতা থেকে, সাঈদ ইবনু জুবাইর থেকে, ইবনু আববাস থেকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ بِمَكَّةَ فَصَامَ وَقَامَ مِنْهُ مَا تَيَسَّرَ لَهُ كَتَبَ اللَّهُ لَهُ مِائَةَ أَلْفِ شَهْرِ رَمَضَانَ فِيمَا سِوَاهَا وَكَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِكُلِّ يَوْمٍ عِتْقَ رَقَبَةٍ وَكُلِّ لَيْلَةٍ عِتْقَ رَقَبَةٍ وَكُلِّ يَوْمٍ حُمْلَانَ فَرَسٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَفِي كُلِّ يَوْمٍ حَسَنَةً وَفِي كُلِّ لَيْلَةٍ حَسَنَةً
‘‘যে ব্যক্তি মক্কায় রামাদান মাস পাবে, সিয়াম পালন করবে এবং যতটুকু তার জন্য সহজসাধ্য হবে ততটুকু কিয়ামুল্লাইল পালন করবে, আল্লাহ তার জন্য অন্যত্র এক লক্ষ রামাদান মাসের সাওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। এবং আল্লাহ তার জন্য প্রতি দিবসের পরিবর্তে একটি দাসমুক্তি এবং প্রতি রাতের পরিবর্তে একটি দাসমুক্তি, এবং প্রতি দিনের জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য ঘোড়াসাওয়ার পাঠানো এবং প্রতি দিনের জন্য একটি নেকি এবং প্রতি রাতের জন্য একটি নেকি লিপিবদ্ধ করবেন।’’[18]
এ হাদীসটি একমাত্র আব্দুর রাহীম ইবনু যাইদ আল-আম্মী (১৮৪ হি) নামক এ ব্যক্তি ছাড়া কেউ বর্ণনা করে নি। এ আব্দুর রাহীম একজন মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত রাবী বলে প্রসিদ্ধ। ইমাম বুখারী, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী, জালিয়াত ও পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[19]
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১০৪; যাহাবী, তারতীবুল মাউদূ‘আত, পৃ. ১৭৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০০-১০১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৬; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২১।
[3] মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দে ফযীলত, পৃ. ৩৩-৩৪।
[4] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ২৪৫-২৪৮।
[5] মুফতী ছামদানী, বার চান্দে ফযীলত, পৃ. ৩৯; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা, নেক কানুন, পৃ. ৩১৫।
[6] গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ ২৪৮; দুলাল, নেক কানুন , পৃ. ৩১৬।
[7] ইবনু রাজাব, লাতাইফ ২/৩০৯, ৩১৩-৩১৫।
[8] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১১৫।
[9] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মোমেনীন, পৃ ২৪৮।
[10] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৩।
[11] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৫৮৯; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ৩/১১৫; ১১৮; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৩/১৯১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪১২-৪১৩; মুনযিরী, তারগীব ১/২৭৭-২৮৫।
[12] বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৩১৪, ৩৫৫; হাইসামাী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৪০।
[13] মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪২; আল-মাসনূ, পৃ. ১৫৬-১৫৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ, ১/৭৯; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৩৫৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৮৫; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২২৫।
[14] শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/৭৯।
[15] মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪২; আল-মাসনূ, পৃ. ১৫৬-১৫৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৮৫।
[16] আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ, মোল্লা আলী কারীর আল-মাসনূ গ্রন্থের টীকা, ১৫৭ পৃ.।
[17] মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ২৭৪-২৪৫।
[18] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১০৪১।
[19] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১০৪১; বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ৩/২১৭; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৩/৩৪৭, ৩৮৭; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৪/৩৩৬-৩৩৭; ইবনু হাজার, তাহযীব ৬/২৭৩; তাকরীব, পৃ. ৩৫৪; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৭৭৬; যায়ীফাহ ২/২৩২।