লগইন করুন
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী, সুয়ূতী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, ইলমুল বাতিন বা বাতিনী ইলমকে যাহেরী ইলম থেকে পৃথক বা গোপন কোন বিষয় হিসাবে বর্ণনা করে যে সকল হাদীস প্রচলিত সেগুলো সবই বানোয়াট ও মিথ্যা।[1]
আমাদের সমাজে এ বিষয়ে সত্য ও মিথ্যা অনেক সময় মিশ্রিত হয়েছে এবং অনেক সহীহ বা হাসান হাদীসকে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা জানি যে, মানুষের জ্ঞানের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হলো কোনো কিছু ‘জানা’। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, এ ‘জানা’ মনের গভীরে বা অবচেতনে বিশ্বাসে পরিণত হওয়া। যেমন, একজন মানুষ জানেন যে, ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’, অথবা ‘ধূমপানে বিষপান’। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ধূমপান করেন। কিন্তু তিনি কখনই বিষপান করেন না। কারণ তার এ জ্ঞান সুগভীর বিশ্বাসে পরিণত হয় নি। যখন তা বিশ্বাসে পরিণত হবে তখন তিনি আর ধূমপান করতে পারবেন না, যেমন তিনি বিষপান করতে পারেন না।
ধর্মীয় বিধিবিধানের বিষয়েও জ্ঞানের এরূপ দু’টি পর্যায় রয়েছে। একজন মানুষ জানেন যে প্রজ্জ্বলিত আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিলে তিনি পুড়ে যাবেন। একারণে তিনি কখনোই আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিবেন না। তাকে ধাক্কা দিয়ে আগুনে ফেলতে গেলেও তিনি প্রাণপণে বাধা দিবেন। আবার এ মানুষটিই ‘জানেন’ ও ‘বিশ্বাস করেন’ যে, ‘নামায কাযা করলে জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত আগুনে পুড়তে হবে’, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ‘নামায কাযা’ করেন। কারণ তার এ ‘জ্ঞান’ ও ‘বিশ্বাস’ প্রকৃত পক্ষে মনের গভীরে বা অবচেতন মনের গভীর বিশ্বাসের জ্ঞানে পরিণত হয় নি। যখন এ জ্ঞানটি তার গভীর বিশ্বাসের জ্ঞানে পরিণত হবে তখন তিনি কোনো অবস্থাতেই নামায কাযা করতে পারবেন না, যেমনভাবে তিনি কোনো অবস্থাতেই আগুনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন না। তিনি জাহান্নামের আগুন হৃদয় দিয়ে অবলোকন ও অনুভব করতে পারবেন।
এজন্য আমরা জানি যে, একজন সাধারণ ধামির্ক মুসলিম, যিনি সাধারণভাবে ফজরের নামায জামাআতে আদায় করেন, তিনি যদি রাতে দেরি করে ঘুমাতে যান তাহলে হয়ত ফজরের জামাতের জন্য তার ঘুম ভাঙ্গবে না। কিন্তু এ ব্যক্তিরই যদি ভোর ৪টায় ট্রেন বা গাড়ি থাকে তাহলে কয়েকবার রাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। কারণ গাড়ি ফেল করলে কিছু অসুবিধা হবে বা ক্ষতি হবে এই জ্ঞানটি তার অবচেতন মনের বা ‘কালবের’ জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নামাযের জামাআত ফেল করলে কিছু ক্ষতি হবে এ জ্ঞানটি সে প্রকারের গভীর জ্ঞানে পরিণত হয় নি। যখন তা এরূপ গভীর জ্ঞানে বা ‘কালবেরর জ্ঞানে’ পরিণত হবে তখন ফজরের জামাআতের জন্যও তার বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
প্রথম পর্যায়ের জ্ঞানের পালন ও আচরণই জ্ঞানকে দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। সকল ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। ‘ধূমপানে বিষপান’ এ জ্ঞানটিকে যদি কারো মনে বারংবার উপস্থিত করা হয়, সে তা পালন করে, ধূমপানের অপকারিতার দিকগুলো বিস্তারিত পাঠ করে, এ বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা ইত্যাদিতে উপস্থিত হয়, তবে এক পর্যায়ে এ জ্ঞান তার গভীর জ্ঞানে পরিণত হবে এবং তিনি ধূমপান পরিত্যাগ করবেন। অনুরূপভাবে ‘গীবত জাহান্নামের পথ’ এ জ্ঞানটি যদি কেউ বারংবার আলোচনা করেন, এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলো বারংবার পাঠ করেন, আখিরাতের গভীর বিশ্বাসে তিনি এর শাস্তি মন দিয়ে অনুভব করেন... তবে এক পর্যায়ে তিনি ‘গীবত’ পরিত্যাগ করবেন। তার মনই তাকে ‘গীবত’ করতে বাধা দিবে।
আমরা জানি, দু পর্যায়ের জ্ঞানই জ্ঞান। প্রথম পর্যায়ের জ্ঞানের আলোকে আল্লাহ বান্দাদের হিসাব নিবেন। যে ব্যক্তি জেনেছে যে, নামায কাযা করা হারাম, কিন্তু তার পরও সে তা কাযা করেছে, তার জন্য তার কর্মের শাস্তি পাওনা হবে। আর জ্ঞান যখন দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয় তখন তা মানুষের জন্য আল্লাহর পথে চলা অতি সহজ ও আনন্দদায়ক করে তোলে। হাদীসে জ্ঞানকে এ দিক থেকে দু পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এ অর্থে ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন,
إِنَّ قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ ، وَلَكِنْ إِذَا وَقَعَ فِى الْقَلْبِ فَرَسَخَ فِيهِ نَفَعَ
‘‘অনেক মানুষ কুরআন পাঠ করে; কিন্তু তা তাদের গলার নিচে নামে না (হৃদয়ে গভীর জ্ঞানে পরিণত হয় না)। কিন্তু যখন তা অন্তরে পৌঁছে যায় এবং গভীর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন তা তার কল্যাণ করে।’’[2]
প্রখ্যাত তাবিয়ী হাসান বসরী (১১০ হি) বলেছেন:
الْعِلْمُ عِلْمَانِ: عِلْمٌ عَلَى اللِّسَانِ فَتِلْكَ (فَذَلِكَ) حُجَّةُ اللهِ عَلَى عِبَادِهِ (ابْنِ آَدَمَ)، وَعِلْمٌ فِي الْقَلْبِ فَذَاكَ الْعِلْمُ النَّافِعُ.
‘‘ইলম বা জ্ঞান দুই প্রকারের: (১) জিহবার জ্ঞান, যা আদম সন্তানের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রমাণ ও (২) অন্তরের জ্ঞান। এ জ্ঞানই উপকারী জ্ঞান।’’[3]
হাসান বসরীর এ উক্তিটির সনদ নির্ভরযোগ্য। তবে অন্য সনদে এ ‘উক্তিটি’ হাসান বসরীর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বর্ণিত হয়েছে। এক সনদে পরবর্তী এক রাবী দাবি করেছেন, হাসান বসরী বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উপরের বাক্যটি বলেছেন। অন্য সনদে পরবর্তী রাবী দাবি করেছেন, হাসান বসরী বলেছেন, জাবির (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উপরের বাক্যটি বলেছেন। এ দুটি সনদকে কোনো কোনো আলিম দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আল্লামা মুনযিরী হাদীসটির সনদ হাসান বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
এখানে উল্লেখ্য যে, এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেছেন:
حَفِظْتُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وِعَاءَيْنِ فَأَمَّا أَحَدُهُمَا فَبَثَثْتُهُ وَأَمَّا الآخَرُ فَلَوْ بَثَثْتُهُ قُطِعَ هَذَا الْبُلْعُومُ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে ইলম-এর দুটি পাত্র সংরক্ষণ করেছি। একটি পাত্র প্রচার করেছি। অন্য পাত্রটি যদি প্রচার করি তবে আমার গলা কাটা যাবে।’’[5]
এ হাদীসটিকে কেউ কেউ ইলমুল বাতিন-এর প্রতি ইঙ্গিত বলে বুঝাতে চেয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে এখানে আবূ হুরাইরা (রা) উমাইয়া যুগের যালিম শাসকদের বিষয়ে ইঙ্গিত করছেন। খিলাফতে রাশিদার পরে যালিম শাসকদের আগমন, দ্বীনি বিষয়ে অবহেলা ইত্যাদি বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন এবং ইয়াযীদ ও অন্যান্য যালিম শাসকের নামও বলেছিলেন। আবূ হুরাইরা এবং অন্যান্য অনেক সাহাবী উমাইয়া যুগে এ বিষয়ক হাদীসগুলো বলার ক্ষেত্রে এ ধরনের কথা বলতেন।[6]
এভাবে মুহাদ্দিসগণ একমত করেছেন যে, ‘ইলমুল বাতিন’ শব্দ কোনো সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি। এছাড়া ইলম যাহির ও ইলম বাতিনের বিভাজনও কোনো হাদীসে করা হয় নি। ‘‘ইলম যাহির’’ ও ‘‘ইলম বাতিন’’ পরিভাষায় দুটির উদ্ভাবন ও বিভাজন বিষয়ক সকল কথাই শিয়াদের জালিয়াতি ও অপপ্রচার। তবে পরবর্তী যুগের অনেক সুন্নী আলিম ও বুজুর্গ ‘‘ইলম যাহির’’ ও ‘‘ইলম বাতিন’’ পরিভাষাদ্বয় ব্যবহার করেছেন। তারা উপরের হাদীসে উল্লিখিত দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞান ‘ইলমুল ক্বাল্ব’ বা অন্তরের জ্ঞানকে অনেক সময় ‘ইলমুল বাতিন’ বলে অভিহিত করেছেন। এ জ্ঞান কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান বা শরীয়তের জ্ঞান থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বরং এ জ্ঞান হলো কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের প্রকৃত ও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়। কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী শরীয়তের জ্ঞান অবিরত চর্চা, পালন ও অনুশীলনের মাধ্যমে যখন অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে এবং অবচেতন মন থেকে মানুষের র্কম নিয়ন্ত্রণ করে তখন তাকে ‘ইলুমুল ক্বালব’ বা ‘ইলমুল বাতিন’ বলা হয়।
উভয় ক্ষেত্রেই ‘‘ইলম’’ বা জ্ঞান একই, তা হলো, কুরআন ও সুন্নাহের জ্ঞান। এ জ্ঞান যদি ‘‘যাহির’’ অর্থাৎ মানুষের প্রকাশ্য অঙ্গ জিহবায়, মুখে বা কথায় অবস্থান করে তবে তাকে ‘‘ইলমুলয যাহির’’ বা প্রকাশ্য অঙ্গের ইলম’’ বলা হয়। আর যদি তা আভ্যন্তরীণ অঙ্গ বা ‘‘কালব’’-এ অবস্থান করে তবে তাকে ‘‘ইলমুল বাতিন’’ বা লুক্কায়িত অঙ্গের ইলম বলা হয়। আরবী ব্যাকরণ অনুসারে ‘‘যাহির’’ ও ‘‘বাতিন’’ শব্দদ্বয় ইলমের বিশেষণ নয়, বরং ইলমের ইযাফত বা অবস্থান বুঝায়। কিন্তু শিয়াদের প্রচারণা ও সাধারণ আলিম ও বুজুর্গগণের অসতর্কতায় যাহির ও বাতিন শব্দদ্বয়কে ইলমের বিশেষণ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছে যে, ইলমই দু প্রকারের এক প্রকারের ইলম যাহির বা প্রকাশ্য যা কুরআন, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদি পাঠে জানা যায়। আরেক প্রকারের ইলম বাতিন বা লুক্কায়িত, এ ইলম বই পত্র পড়ে জানা যায় না, বরং অন্য কোনোভাবে জানতে হয়। আর এ ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন এবং সকল বিভ্রান্তির দরজা উন্মোচন করে।
এভাবে ইলম যাহির ও ইলম বাতিন নামে অনেক প্রকারের ইসলাম বিরোধী কুসংস্কার মুসলিম সমাজে ছড়ানো হয়েছে। ইলম বাতিনকে গোপন কিছু বিষয় বা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানের বাইরে অর্জনীয় কোনো বিষয় বলে দাবি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু হাদীসও জালিয়াতগণ তৈরি করেছে। ‘ইলম বাতিন ইলম যাহির থেকে পৃথক বা গোপন কোনো ইলম’ এ অর্থে প্রচলিত সকল কথাই জাল। এ জাতীয় কয়েকটি জাল হাদীস উল্লেখ করছি:
[2] ইবনু রাজাব, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ ৩৪৩।
[3] দারিমী, আস-সুনান ১/১১৪।
[4] দারিমী, আস-সুনান ১/১১৪; ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ ১/৪০৭; রাবীয় ইবনু হাবীব, আল-মুসনাদ, পৃ. ৩৬৫; ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৭/৮২; খতীব বাগদাদী, তারীখু বাগদাদ ৪/৩৪৬; ইবনুল জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়া ১/৮২-৮৩; আল-মুনযিরী, আত-তারগীব ১/৫৮।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫৬।
[6] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/২১৬-২১৭।