লগইন করুন
উপর্যুক্ত বাতিল ও ভিত্তিহীন কথার পরিবর্তে আমাদের সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের উপর নির্ভর করা উচিত। সহীহ হাদীসে ইরবাদ ইবনু সারিয়া (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি:
إِنِّي عِنْدَ اللَّهِ مَكْتُوبٌ خَاتِمُ النَّبِيِّينَ، وَإِنَّ آدَمَ لَمُنْجَدِلٌ فِي طِينَتِهِ، وَسَأُخْبِرُكُمْ بِأَوَّلِ أَمْرِي: دَعْوَةُ إِبْرَاهِيمَ وَبِشَارَةُ عِيسَى وَرُؤْيَا أُمِّي الَّتِي رَأَتْ حِينَ وَضَعَتْنِي أَنَّهُ خَرَجَ لَهَا نُورٌ أَضَاءَتْ لَهَا مِنْهُ قُصُورُ الشَّامِ
‘‘যখন আদম তাঁর কাদার মধ্যে লুটিয়ে রয়েছেন সে অবস্থাতেই আমি আল্লাহর কাছে খাতামুন নাবিয়্যীন বা শেষ নবী রূপে লিখিত। আমি তোমাদেরকে এর শুরু সম্পর্কে জানাব। তা হলো আমার পিতা ইবরাহীমের (আঃ) দোয়া, ঈসার (আঃ) সুসংবাদ এবং আমার আম্মার দর্শন। তিনি যখন আমাকে জন্মদান করেন তখন দেখেন যে, তাঁর মধ্য থেকে একটি নূর নির্গত হলো যার আলোয় তাঁর জন্য সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে গেল।’’[1]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন,
قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَتَى وَجَبَتْ لَكَ النُّبُوَّةُ قَالَ وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدِ
‘‘তাঁরা (সাহাবীগণ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, কখন আপনার জন্য নবুয়ত স্থিরকৃত হয়? তিনি বলেন: যখন আদম দেহ ও রূহের মধ্যে ছিলেন।’’
ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান, সহীহ, গরীব বলেছেন।[2] অন্য হাদীসে মাইসারা আল-ফাজর (রা) বলেন,
قُلْتُ لِرَسُولِ الله ﷺ مَتَى كُنْتَ (كُتِبْتَ/ جُعِلْتَ) نَبِيًّا؟ قَالَ: وَآدَمُ بَيْنَ الرُّوحِ وَالْجَسَدِ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বললাম, আপনি কখন নবী ছিলেন (অন্য বর্ণনায়: কখন আপনি নবী হিসেবে লিখিত হয়েছিলেন?, অন্য বর্ণনায়: কখন আপনাকে নবী বানানো হয়?) তিনি বলেন, যখন আদম দেহ ও রূহের মধ্যে ছিলেন।’’ হাদীসটি হাকিম সংকলন করেছেন ও সহীহ বলেছেন। যাহাবীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।[3]
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন,
قِيْلَ لِلنَّبِيِّ ﷺ مَتَى وَجَبَتْ لَكَ النُّبُوَّةُ قَالَ بَيْنَ خَلْقِ آَدَمَ وَنَفْخِ الرُّوْحِ فِيْهِ
‘‘নবী (ﷺ)-কে বলা হলো, কখন আপনার জন্য নবুয়ত স্থিরকৃত হয়? তিনি বলেন, আদমের সৃষ্টি ও তার মধ্যে রূহ ফুঁক দেয়ার মাঝে।’’[4]
এ অর্থে একটি যায়ীফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নু‘আইম ইসপাহানী (৪৩০হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী সাঈদ ইবনু বাশীর (১৬৯হি) থেকে হাদীসটি গ্রহণ করেছেন। এ সাঈদ ইবনু বাশীর বলেন, আমাকে কাতাদা বলেছেন, তিনি হাসান থেকে, তিনি আবূ হুরাইরা থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন :
كُنْتُ أَوَّلَ النَّبِيِّيْنَ فِيْ الْخَلْقِ وَآَخِرُهم في البَعْثِ
‘‘আমি ছিলাম সৃষ্টিতে নবীগণের প্রথম এবং প্রেরণে নবীগণের শেষ।’’[5]
এ সনদে দুটি দুর্বলতা রয়েছে। প্রথম, হাসান বসরী মুদাল্লিস রাবী ছিলেন। তিনি এখানে (عن: আন) বা ‘থেকে’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয়, এ হাদীসের বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনু বাশীর হাদীস বর্ণনায় দুর্বল ছিলেন। কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে চলনসই হিসাবে গণ্য করেছেন। অনেকে তাকে অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করেছেন। যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলোর নিরীক্ষা করে এবং সকল মুহাদ্দিসের মতামত পর্যালোচনা করে তাকে ‘যয়ীফ’ বা দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।[6]
এ হাদীসকে কেউ কেউ তাবিয়ী কাতাদার নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইবন কাসীর বলেন, ‘‘সাঈদ ইবনু বাশীরের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। সাঈদ ইবনু আবূ আরূবাও হাদীসটি কাতাদার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি কাতাদার পরে হাসান বসরী ও আবূ হুরাইরার নাম বলেন নি, তিনি কাতাদা থেকে বিচ্ছিন্ন সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর কেউ কেউ হাদীসটিকে কাতাদার নিজের বক্তব্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।’’[7]
এ সর্বশেষ হাদীসটি ছাড়া উপরের ৪টি হাদীসই সহীহ বা হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে। এ সকল হাদীস সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি প্রক্রিয়া পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর শ্রেষ্ঠতম সন্তান, আল্লাহর প্রিয়তম হাবীব, খালীল ও রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নুবুওয়াত, খতমে নবুয়ত ও মর্যাদা সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ভিত্তিহীন, সনদবিহীন কথাগুলোকে আন্দাযে, গায়ের জোরে বা বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলার প্রবণতা ত্যাগ করে এ সকল সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা আমাদের উচিত।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৮৫।
[3] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৬৫; মাকদিসী, আল-আহাদীস আল-মুখতারা ৯/১৪২, ১৪৩।
[4] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৬৫।
[5] ইবনু আদী, আল-কামিল ৩/৩৭৩; ইবনু কাসীর, তাফসীর ৩/৪৭০; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/১৯১; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩৩১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৭৯; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৪১১-৪১২; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৬৯; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১৭০; আলবানী, যায়ীফাহ ২/১১৫।
[6] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ৫২; ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ১/৩১৪; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/১৯০-১৯২; ইবনু হাজার, তাহযীব ৪/৮-৯; তাকরীব, পৃ. ২৩৪; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১৭০; আলবানী, যায়ীফাহ ২/১১৫।
[7] ইবনু কাসীর, তাফসীর ৩/৪৭০।