লগইন করুন
কুরআন কারীম থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহ সকল যুগে সকল জাতি ও সমাজেই নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এরশাদ করা হয়েছে:
وَإِنْ مِنْ أُمَّةٍ إِلاَّ خَلاَ فِيْهَا نَذِيْرٌ
‘‘প্রত্যেক জাতিতেই সতর্ককারী প্রেরণ করা হয়েছে।’’[1]
এ সকল নবী-রাসূলের মোট সংখ্যা কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। বরং কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে যে, এ সব নবী-রাসূলগণের কারো কথা আল্লাহ তাঁর রাসূলকে (ﷺ) জানিয়েছেন এবং কারো কথা তিনি তাঁকে জানান নি। এরশাদ করা হয়েছে:
وَرُسُلا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ
অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা ইতোপূর্বে আপনাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি যাদের কথা আপনাকে বলি নি।’’[2]
আমাদের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ কথা যে নবী-রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার বা ২ লক্ষ ২৪ হাজার। এখানে লক্ষণীয় যে, নবী-রাসূলগণের সংখ্যার বিষয়ে কোনো একটিও সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। একাধিক যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসে এ বিষয়ে কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে। ২ লক্ষ ২৪ হাজারের সুস্পষ্ট বর্ণনা সম্বলিত কোনো সনদ-সহ হাদীস আমি কোথাও দেখতে পাই নি। তবে ১ লক্ষ ২৪ হাজার ও অন্য কিছু সংখ্যা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ:
ক. ১ লক্ষ ২৪ হাজার
একাধিক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী-রাসূলগণের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার। কিন্ত সবগুলো সনদই অত্যন্ত দুর্বল। কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ অর্থের হাদীসকে জাল বলে গণ্য করেছেন।
ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস তাদের সনদে ইবরাহীম ইবনু হিশাম ইবনু ইয়াহইয়া আল-গাস্সানী (২৩৮ হি) নামক তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবীর সূত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ইবরাহীম বলেন, আমাকে আমার পিতা, আমার দাদা থেকে, তিনি আবূ ইদরীস খাওলানী থেকে, তিনি আবূ যার গিফারী থেকে বলেছেন:
قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَمِ الأَنْبِيَاءُ قَالَ مِائَةُ أَلْفٍ وَأَرْبَعَةٌ وَعِشْرُوْنَ أَلْفاً قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ كَمِ الرُّسُلُ مِنْهُمْ قَالَ ثَلاَثُ مِائَةٍ وَثَلاَثَةَ عَشَرَ جَمٌّ غَفِيْرٌ
‘‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন, এক লক্ষ চবিবশ হাজার। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এদের মধ্যে রাসূল কত জন? তিনি বলেন, তিন শত তের জন, অনেক বড় সংখ্যা।’’[3]
হাদীসটির বর্ণনাকারী ইবরাহীম ইবনু হিশামের বিষয়ে মুহাদ্দিসদের কিছুটা মতভেদ রয়েছে। তাবারানী ও ইবনু হিববান তাকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদী রাবী বলে চিহ্নিত করেছেন। আবূ যুরআ বলেন: লোকটি কায্যাব বা মহা-মিথ্যাবাদী। আবূ হাতিম রাযী তার কাছে হাদীস গ্রহণ করতে গমন করেন। তিনি তার কাছ থেকে তার পান্ডুলিপি নিয়ে তার মৌখিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে অগণিত বৈপরীত্য ও অসামঞ্জস্য দেখতে পান। ফলে তিনি বলেন: বুঝা যাচ্ছে যে, লোকটি কখনো হাদীস শিক্ষার পিছনে সময় ব্যয় করে নি। লোকটি মিথ্যাবাদী বলে মনে হয়। যাহাবী তাকে মাতরূক বা পরিত্যক্ত বলে উল্লেখ করেছেন।[4]
যেহেতু হাদীসটি ইবরাহীম ইবনু হিশাম ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করেন নি, সেহেতু ইবনুল জাওযী হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[5]
ইমাম আহমাদ এ অর্থে অন্য একটি হাদীস সংকলন করেছেন। এ হাদীসে মু‘আন ইবনু রিফা‘আহ নামক একজন রাবী বলেন, আমাকে আলী ইবনু ইয়াযিদ বলেছেন, কাসিম আবূ আব্দুর রাহমান থেকে, তিনি আবূ উমামা (রা) থেকে... নবীগণের সংখ্যা কত? তিনি বলেন ১ লক্ষ ২৪ হাজার... ।’’[6]
এ হাদীসের রাবী মু‘আন ইবনু রিফা‘আহ আস-সুলামী কিছুটা দুর্বল রাবী ছিলেন।[7] তার উস্তাদ আলী ইবনু ইয়াযিদ আরো বেশি দুর্বল ছিলেন। ইমাম বুখারী তাকে ‘মুনকার’ বা ‘আপত্তিকর’ বলেছেন। ইমাম নাসাঈ, দারাকুতনী প্রমুখ মুহাদ্দিস তাকে ‘পরিত্যক্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন।[8] তার উস্তাদ কাসিম আবূ আব্দুর রাহমানও (১১২ হি) দুর্বল ছিলেন। এমনকি ইমাম আহমাদ, ইবনু হিববান প্রমুখ মুহাদ্দিস বলেছেন যে, কাসিম সাহাবীগণের নামে এমন অনেক কথা বর্ণনা করেন যে,মনে হয় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এ ভুলগুলো বলছেন। তিনি দাবী করতেন যে, তিনি ৪০ জন বদরী সাহাবীকে দেখেছেন, অথচ তাঁর জন্মই হয়েছে প্রথম শতকের মাঝামাঝি।[9]
এ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, এ হাদীসটিও অত্যন্ত দুর্বল। আরো দু একটি অত্যন্ত দুর্বল সনদে এ সংখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে। সামগ্রিক বিচারে এ সংখ্যাটি ‘মাউযূ’ না হলেও দুর্বল বলে গণ্য। আল্লাহই ভাল জানেন।[10]
খ. ৮ হাজার পয়গম্বর
আবূ ইয়ালা মাউসিলী মূসা ইবনু আবীদাহ আর-রাবাযী থেকে, তিনি ইয়াযিদ ইবনু আবান আর-রাকাশী থেকে বর্ণনা করেছেন, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
بَعَثَ اللهُ ثَمَانِيَةَ آلاَفِ نَبِيٍّ أَرْبَعَةَ آلاَفٍ إِلَى بَنِيْ إِسْرَائِيْلَ وَأَرْبَعَةَ آلاَفٍ إِلَى سَائِرِ النَّاسِ
মহান আল্লাহ ৮ হাজার নবী প্রেরণ করেছেন। ৪ হাজার নবী বনী ইসরাঈলের মধ্যে এবং বাকী চার হাজার অবশিষ্ট মানব জাতির মধ্যে।’’[11]
এ হাদীসটিও দুর্বল। ইমাম ইবনু কাসীর বলেন, এ সনদটিও দুর্বল। আর-রাবাযী দুর্বল। তার উস্তাদ রাকাশী তার চেয়েও দুর্বল।’’ ইবনু কাসীর আলোচনা করেছেন যে, আরো একটি সনদে এ সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে। সনদটি বাহ্যত মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।[12]
গ. এক হাজার বা তারও বেশি পয়গম্বর
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
إنِّيْ خَاتِمُ أَلْفِ نَبِيٍّ أَوْ أَكْثَرَ
‘‘আমি এক হাজার বা তারো বেশি নবীর শেষ নবী।’’[13]
ইবনু কাসীর, হাইসামী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, সংখ্যার বর্ণনায় অন্যান্য হাদীসের চেয়ে এ হাদীসটি কিছুটা গ্রহণযোগ্য, যদিও এর সনদেও দুর্বলতা রয়েছে।[14]
[2] সূরা (৫) নিসা: আয়াত ১৬৪। আরো দেখুন: সূরা (৪০) গাফির/মুমিন: আয়াত ৭৮।
[3] ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১/৭৬-৭৯।
[4] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ওয়াল মাতরূকীন ১/৫৯; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/২০১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/১২২।
[5] ইবনু কাসীর, আত-তাফসীর ১/৫৮৬-৫৮৭।
[6] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৫/২৬৫। শাইখ আর্নাউত বলেন: হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল।
[7] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১২৬; ইবনু আদী, আল-কামিল ৬/৩২৮; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৬/৪৫৫; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৭/৩৯১।
[8] নাসাঈ, আদ-দু‘আফা, পৃ. ৭৭, ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ২/২০০; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪০৬।
[9] ইবনুল জাওযী, আদ-দু‘আফা ৩/১৪; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/৪৫৩; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ৪৫০।
[10] বিস্তারিত আলোচনা দেখনু, ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৭-৫৮৮; হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ১/১৯৬-১৯৮ (সম্পাদকের টীকা); মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১/৩৯৩; ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহের আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ২৮৮-২৯০।
[11] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮; তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ১/২৩৬-২৩৭।
[12] ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/৫৮৮।
[13] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৬৫৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়ায়িদ ৭/৩৪৬।
[14] ইবনু কাসীর, তাফসীর /৫৮৮; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/৩৪৬।