লগইন করুন
আমরা দেখেছি যে, তাবিয়ীগণের যুগ থেকেই জাল হাদীসের পক্ষে জালিয়াতগণ বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করত। এ সকল যুক্তি তারা লিখিতভাবে উল্লেখ করত না, তবে মুখে বলে তাদের অনুসারীদের বুঝাতো। তাদের অবস্থা ছিল অনেকটা আমাদের সমাজের সূফী নামধারী ‘‘মারফতী’’ ফকীরদের মত, যারা যিকর-এর নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হন। তারা তাদের এ কর্মের পক্ষে অনেক যুক্তি পেশ করেন; তবে কেউই লিখিতভাবে তাদের অপকর্মের স্বীকৃতি দেন না এর পক্ষের যুক্তিগুলি লিখেন না। জালিয়াতদের অবস্থাও ছিল একইরূপ।
জাল হাদীস বিষয়ক অবহেলা ও অসতর্কতা এত ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিগত কয়েক শতকে কোনো কোনো আলিম জাল হাদীস প্রচারের পক্ষে ওকালিত করছেন। এরূপ একজন প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আবুল ফিদা ইসমাঈল হাক্কী ইবনু মুসতাফা ইসলামবূলী (মৃত্যু ১১২৭ হি/১৭১৫ খৃ)। তিনি দ্বাদশ হিজরী শতকের (খৃস্টীয় অষ্টাদশ শতক) একজন প্রসিদ্ধ তুর্কী আলিম ও সূফী ছিলেন। তিনি তুর্কী ও আরবী ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত ‘‘রূহুল বায়ান ফী তাফসীরিল কুরআন’’ গ্রন্থটি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীর এ বিশাল তাফসীর গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। অনেক সহীহ, হাসান ও যয়ীফ হাদীসের পাশাপাশি তিনি অনেক জাল হাদীসও উল্লেখ করেছেন। তাঁর এ গ্রন্থের জাল হাদীসগুলির বিষয়ে দুটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে: (১) জাল হাদীসের আধিক্য এবং (২) জাল হাদীসের পক্ষে যুক্তি উত্থাপন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
واعلم أن الأحاديث التي ذكرها صاحب الكشاف في أواخر السورة وتبعه القاضي البيضاوي والمولى أبو السعود رحمهم الله من أجلة المفسرين قد أكثر العلماء القول فيها فمن مثبت ومن ناف بناء على زعم وضعها كالإمام الصغاني وغيره واللائح لهذا العبد الفقير سامحه الله القدير أن تلك الأحاديث لا تخلو إما أن تكون صحيحة قوية أو سقيمة ضعيفة أو مكذوبة موضوعة فإن كانت صحيحة قوية فلا كلام فيها وإن كانت ضعيفة الأسانيد فقد اتفق المحدثون على أن الحديث الضعيف يجوز العمل به في الترغيب والترهيب فقط... وإن كانت موضوعة فقد ذكر الحاكم وغيره أن رجلاً من الزهاد انتدب في وضع الأحاديث في فضل القرآن وسوره فقيل له فلم فعلت هذا فقال رأيت الناس زهدوا في القرآن فأحببت أن أرغبهم فيه فقيل له إن النبي ﷺ قال: من كذب عليّ متعمداً فليتبوأ مقعده من النار"... فقال أنا ما كذبت عليه إنما كذبت له ... أراد أن الكذب عليه يؤدي إلى هدم قواعد الإسلام وإفساد الشريعة والأحكام وليس كذلك الكذب له فإنه للحث على اتباع شريعته واقتفاء أثره في طريقته.... قال الشيخ عز الدين بن عبد السلام : الكلام وسيلة إلى المقاصد فكل مقصود محمود يمكن التوصل إليه بالصدق والكذب جميعاً فالكذب حرام فإن أمكن التوصل إليه بالكذب دون الصدق فالكذب فيه مباح إن كان تحصيل ذلك المقصود مباحاً وواجب إن كان ذلك المقصود واجباً...وبالجملة المرء مخير في هذا الباب فإن شاء عمل بتلك الأحاديث بناء على حسن الظن بالأكابر حيث أثبتوها في كتبهم، ... وظاهر أنهم لا يضعون حرفاً إلا بعد التصفح الكثير، وإن شاء ترك العمل بها وحرم من منافع جمة ولا محاجة معه
‘‘জেনে রাখ, কাশ্শাফের লেখক সূরাগুলির শেষে যে সকল হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং প্রসিদ্ধ মুফাস্সিরদের মধ্যে কাযী বাইযাবী ও মৌলবী আবূস সাঊদ (রাহ) তাঁর অনুসরণ করেছেন এগুলির বিষয়ে আলিমদের অনেক কথা রয়েছে। কেউ এগুলি প্রমাণ করেছেন এবং কেউ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা মনে করেছেন যে, এগুলি জাল, যেমন ইমাম সাগানী এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস। এ ফকীর বান্দার- আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন- নিকট এটিই প্রকাশিত যে, এ হাদীসগুলি হয় সহীহ শক্তিশালী, অথবা তা দুর্বল-রুগ্ন, অথবা তা জাল ও মিথ্যা। যদি সহীহ শক্তিশালী হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আর যদি যয়ীফ-রুগ্ন হয় তাহলে আলিমগণ একমত পোষণ করেছেন যে, শুধু উৎসাহ প্রদান ও ভয়প্রদর্শনের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা বৈধ।.... আর যদি জাল হয়, তবে হাকিম উল্লেখ করেছেন যে, একজন দরবেশ কুরআন ও তার সূরাগুলির ফযীলতে জাল হাদীস তৈরিতে লিপ্ত হয়। তাকে বলা হয়, আপনি কেন এ কাজ করলেন? তিনি বলেন, আমি দেখলাম যে, মানুষেরা কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আমি তাদেরকে কুরআনের বিষয়ে আগ্রহী করার জন্য এ কাজটিকে ভাল মনে করলাম। তাকে বলা হলো, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘‘আমার উপর যে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে থাকতে হবে।’’ তিনি বলেন, আমি তো তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলি নি, বরং আমি তাঁর পক্ষে মিথ্যা বলেছি।’’ ... এ দরবেশের উদ্দেশ্য হলো, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা বললে ইসলামের ভিত্তি ধ্বংস হয় এবং শরীয়ত ও দীনের আহকাম বিনষ্ট হয়; তাঁর পক্ষে মিথ্যা বললে তো আর তা হয় না; এরূপ মিথ্যা তো তাঁর শরীয়ত পালনের উৎসাহ দেওয়া ও তাঁর সুন্নাত অনুসরণের জন্য বলা হয়।....
শাইখ ইয্যুদ্দীন ইবনু আব্দুস সালাম বলেন: কথা উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম। যে সকল ভাল উদ্দেশ্য সত্যকথা বা মিথ্যাকথা উভয়ের মাধ্যমেই সাধন করা যায় সে উদ্দেশ্যের জন্য মিথ্যা হারাম। আর যদি সে উদ্দেশ্য মিথ্যা ছাড়া সত্য দিয়ে সাধন করা সম্ভব না হয় তাহলে মিথ্যা বৈধ, যদি উদ্দেশ্য সাধন বৈধ হয়। আর যদি উদ্দেশ্য সাধন জরুরী হয় তাহলে তার জন্য মিথ্যাও জরুরী। ... মোট কথা, এ সকল হাদীসের বিষয়ে মুসলিমের স্বাধীনতা আছে। ইচ্ছা করলে এগুলির উপর আমল করতে পারে, ‘আকাবিরদের’ উপর সুধারণার ভিত্তিতে; কারণ তারা তাদের গ্রন্থে এগুলি উল্লেখ করেছেন। ... বাহ্যত তারা অনেক গবেষণা ও যাচাই বাছাই করেই সেগুলি লিখেছেন। আবার ইচ্ছা করলে এগুলির উপর আমল পরিত্যাগ করতে পারে, এভাবে সে অনেক মহান কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, এবং তার সাথে বিতর্ক নেই।[1]
আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীর উপরের বক্তব্যে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষণীয়:
(১) তিনি এ সকল হাদীসের বিষয়ে উল্লেখ করেছেন যে, আলিমগণ এগুলির বিষয়ে মতভেদ করেছেন। বস্ত্তত এ সকল হাদীসের অধিকাংশের বিষয়ে আলিমগণের কোনো মতভেদ নেই। সকল মুহাদ্দিস একমত যে এগুলি জাল। পক্ষান্তরে যারা এগুলি সনদ-সহ বা সনদ-ছাড়া উল্লেখ করেছেন তাদের একজনও বলেন নি যে, এগুলি সহীহ বা যয়ীফ।
(২) তিনি বলেছেন, এ হাদীসগুলি সহীহ হতে পারে, যয়ীফ হতে পরে বা জালও হতে পারে। কোনো হাদীসকে সকল মুহাদ্দিস জাল বলার পর, হাদীসের সনদে জালিয়াতের বিদ্যমানতা নিশ্চিত হওয়ার পর বা হাদীসটির কোনো সনদ না থাকা নিশ্চিত হওয়ার পর কোনো হাদীসের ক্ষেত্রে এরূপ সম্ভাবনা কখনোই থাকে না। বস্ত্তত হাদীসের সহীহ, যয়ীফ বা জাল হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক নীতিমালা ও মানদন্ডের উপর নির্ভরশীল। আল্লামা হাক্কীর এ কথা মূলত হাদীসের সনদ বিচারে সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মাহর কর্মধারা ও নীতিমালার বিষয়ে সন্দেহ ছড়ায়। উপরন্তু তা হাদীস গ্রহণে সতর্কতার বিষয়ে কুরআন-হাদীস ও সাহাবীগণের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক।
(৩) আল্লামা হাক্কী জালিয়াত দরবেশের যে ঘটনা উল্লেখ করেছেন অনুরূপ ঘটনা অনেক আলিম উল্লেখ করেছেন। পার্থক্য হলো, সকলেই এ সকল ঘটনা উল্লেখ করার পর এদের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লামা হাক্কী জালিয়াতের ‘যুক্তি’র যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম নাবাবী (৬৭৬ হি) জালিয়াতদের এ ‘যুক্তি’ উল্লেখ করে বলেন:
وزعم بعضهم أن هذا كذب له ﷺ لا كذب عليه وهذا الذى انتحلوه وفعلوه واستدلوا به غاية الجهالة ونهاية الغفلة وأدل الدلائل على بعدهم من معرفة شيء من قواعد الشرع وقد جمعوا فيه جملا من الاغاليط اللائقة بعقولهم السخيفة وأذهانهم البعيدة الفاسدة فخالفوا قول الله عز وجل ... وخالفوا صريح هذه الأحاديث المتواترة والاحاديث الصريحة المشهورة فى إعظام شهادة الزور وخالفوا إجماع أهل الحل والعقد وغير ذلك من الدلائل القطعيات فى تحريم الكذب على آحاد الناس فكيف بمن قوله شرع وكلامه وحى ... ومن أعجب الاشياء قولهم هذا كذب له وهذا جهل منهم بلسان العرب وخطاب الشرع فإن كل ذلك عندهم كذب عليه
‘‘কেউ কেউ ধারণা করেছে যে, এরূপ মিথ্যা তাঁর পক্ষে মিথ্যা, তার বিরুদ্ধে নয়। তাদের এ মত ও দলীল চূড়ান্ত মূর্খতা ও সীমাহীন অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। আর এটিই হলো সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে, তারা শরীয়তের মূলনীতির কোনো কিছুই জানে না। তাদের এ কথায় তারা এমন সব মূর্খতা ও বিভ্রান্তি জমায়েত করেছে যা একমাত্র তাদের মত মূঢ়তা ও নীচতায় ভরা বুদ্ধি ও বিনষ্ট মন-মগজধারীদের পক্ষেই সম্ভব। তারা আল্লাহ নির্দেশের বিরোধিতা করেছে....। আর তারা এ সকল সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন মুতাওয়াতির হাদীসেরও বিরোধিতা করেছে। উপরন্তু তারা অন্যান্য মাশহূর হাদীসের বিরোধিতা করেছে, যে সকল হাদীসে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। এছাড়া তারা মুসলিম উম্মাহর সকল আলিমের ইজমার বিরোধিতা করেছে। এভাবে তারা দীনের সকল কাতয়ী বা সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীত দলীলের বিরোধিতা করেছে, যে সকল দলীলে সাধারণ মানুষদের নামে বা তাদের সম্পর্কে মিথ্যা বলা হারাম করা হয়েছে, তাহলে যার কথাই শরীয়ত এবং যাঁর কথাই ওহী তাঁর নামে মিথ্যা বলার বিধান কী হতে পারে? ... তাদের কথার সবচেয়ে উদ্ভট বিষয় হলো মিথ্যাকে পক্ষে ও বিপক্ষে বলে দাবি করা। এ হলো আরবী ভাষা ও শরীয়তের সম্ভাষণ সম্পর্কে তাদের প্রগাঢ় মূর্খতা। আরবীতে যে কোনো মিথ্যাকেই (الكذب عليه): ‘‘তার নামে মিথ্যা বা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা’’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।[2]
এভাবে উম্মাতের সকল আলিমই জালিয়াতদের বক্তব্য উল্লেখ করে তাদের বিভ্রান্তি ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে শাইখ ইসমাইল হাক্কী জালিয়াতদের বক্তব্যের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে যে কোনো মিথ্যা কথাই ওহীর বিশুদ্ধতা বিনষ্ট করে, মানুষের বানানো কথাকে দীনের ভিত্তি বানিয়ে দেয় এবং ইসলামী শরীয়ত ধ্বংস করে। সর্বোপরি দীন পালন বা সুন্নাতের পথে আহবান করতে সহীহ হাদীস ও সত্য কথা যথেষ্ট নয় বরং মিথ্যার প্রয়োজন আছে এ কথা কি কল্পনা করা যায়?
(৪) শাইখ হাক্কী জালিয়াতির স্বপক্ষে শাইখ ইয্যুদ্দীন ইবনু আব্দুস সালামের বক্তব্যের যে দলীল (!!) পেশ করেছেন তা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। ইয্যুদ্দীন সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে কথাটি বলেছেন। এ হলো জীবন বাঁচানো বা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে অসত্য বলা বা ঘুরিয়ে কথা বলার বৈধতার ব্যাখ্যা। কিন্তু শাইখ হাক্কী এ কথাটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যা থেকে বুঝা যায় যে, ইসলামের প্রয়োজনে (!!) হাদীস জালিয়াতি করা বা হাদীসের নামে মিথ্যা বলা বৈধ বা জরুরী হতে পারে!!!
সত্য দ্বারা বা সহীহ হাদীস দ্বারা ইসলামের সকল উদ্দেশ্য পূরণ সম্ভব নয় এরূপ চিন্তুা কি কোনো মুসলিম করতে পারেন? আল্লাহর দীন পালন ও প্রচারের জন্য মিথ্যার প্রয়োজন আছে এরূপ চিন্তা কি সম্ভব? আল্লাহ তাঁর দীনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন নি, কাজেই আমাকে মিথ্যা বলে তা সংরক্ষণ করতে হবে- এরূপ চিন্তা কি কোনো মুমিন করতে পারেন? এ মিথ্যাটি যে ইসলামের জন্য প্রয়োজন, এটি ছাড়া ইসলামের মাকসূদ পূরণ হতে পারে না- এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমাকে কে দিয়েছে? আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের পক্ষে মিথ্যা বলার প্রয়োজন আছে এরূপ চিন্তার চেয়ে ভয়ানক বিভ্রান্তি আর কী হতে পারে?
মিথ্যা বলে দীনের গৌরব বাড়ানোর মূল চেতনা প্রচলিত খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পলের। আমরা দেখেছি তিনি প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে লিখেছেন যে, মিথ্যা বলে যদি আল্লাহর মর্যাদা বাড়ানো যায় তাহলে আর পাপ হবে কেন? সাধু পলের এ যুক্তি আর উপর্যুক্ত জালিয়াতের যুক্তির মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নেই। একবার এ যুক্তি দিয়ে জালিয়াতির দরজা খোলার পর শয়তান নানান রকম মিথ্যাকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের পক্ষে বলে যুক্তি দিয়ে ধর্মের নামে প্রচার করায় এবং এভাবেই ঈসা (আঃ)-এর দীনকে নষ্ট করা হয়েছে। আর এজন্যই ইসলামে এ দরজা চিরতরে বন্ধ করা হয়েছে।
(৫) আল্লামা হাক্কী লিখেছেন, আকাবিরদের উপর নেক ধারণার ভিত্তিতে এ সকল হাদীস গ্রহণ করা যায়। আমরা দেখেছি যে, মুসলিম উম্মাহর কোনো প্রাজ্ঞ বুজুর্গ, ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকীহ বা সূফী এরূপ ‘‘নেক ধারণা’’-কে প্রশ্রয় দেন নি। আমরা আগেই বলেছি, যে সকল মুফাস্সির এ সকল হাদীস উল্লেখ করেছেন তাঁরা কখনোই বলেন নি যে, এগুলি সহীহ বা যয়ীফ। এমনকি তারা কখনোই বলেন নি যে, তাঁরা তাদের গ্রন্থে যাচাই না করে হাদীস লিখবেন না। উপরন্তু তাদের গ্রন্থের মধ্যে এরূপ অনেক ‘‘হাদীস’’ তারা উল্লেখ করেছেন যার কোনোরূপ অস্তিত্ব বা সনদ নেই। এগুলি প্রমাণ করে যে, তারা এবিষয়ে কোনো যাচাই বাছাই করেন নি। যে হাদীসের বিষয়ে সকল মুহাদ্দিস একমত যে তা জাল সে হাদীসের বিষয়ে শুধু ‘‘অমুক আলিম তা তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সম্ভবত তিনি যাচাই না করে তা করেন নি, কজেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে’ এরূপ চিন্তা কোনো মুসলিম করতে পারেন না। তাহলে যাচাই করে হাদীস গ্রহণের বিষয়ে, মিথ্যার সন্দেহ হলে সে হাদীস গ্রহণ না করার বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা কোথায় থাকবে?
বস্ত্তত বিগত দু-তিন শতাব্দী যাবত মুসলিম উম্মাহর আলিম, তালিব ইলম ও সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে যে অসতর্কতা ও অবহেলা প্রসার লাভ করেছে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ আল্লামা হাক্কীর এ বক্তব্য। আল্লাহ আমাদেরকে ও তাঁকে ক্ষমা করুন, রহমত করুন এবং তাঁর নেক আমলের বরকতে তাঁর ভুলত্রুটি দূরীভূত করে দিন।
[2] নাবাবী, শারহু সাহীহ মুসলিম ১/৭০-৭১।