লগইন করুন
মাওলানা রুহুল আমিন (রাহ) জাল হাদীস বিষয়ক অনেক মূলনীতি তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। জাল হাদীসের পরিচয়, হাদীস, তফসীর, ফিকহ, তাসাউফ বিভিন্ন বিষয়ের প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান জাল হাদীস, হাদীস যাচাইয়ের মূলনীতি, ইত্যাদি বিষয়ে তিনি অনেক মৌলিক বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। কোনো হাদীস যাচাই ছাড়া গ্রহণ যেমন তিনি আপত্তি করেছেন, তেমনি কোনো গ্রন্থে জাল হাদীস বিদ্যমান থাকার কারণে গ্রন্থটির বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান বা বইটি পাঠ নিষিদ্ধ করার মত হঠকারিতার প্রতিবাদ করেছেন।
সহীহ বুখারী, তিরমিযী, ইবন মাজাহ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বিদ্যমান জাল হাদীস প্রসঙ্গে তিনি বলেন: ‘‘জাল হাদিছ কাহাকে বলে? যে হাদিছটা মিথ্যাবাদী লোক কর্ত্তৃক কথিত হইয়াছে। উহাকে জাল হাদিছ বলা হয়। এমাম এবনো-হাজার আস্কালানি ফতহোল বারির মোকদ্দমার লিখিয়াছেন যে, ছহিহ বোখারির কতকগুলি এরূপ রাবি আছে যাহাদিগকে বিদ্ধানগণ মিথ্যাবাদী স্থির করিয়াছেন। এমাম বোখারি, নাইম বেনে হাম্মাদ (نُعَيْم بن حَمَّاد) হইতে ছহিহ বোখারিতে এই হাদিছটা উ&&ল্লখ করিয়াছেন: আমর বেনে ময়মুন বলিয়াছেন, আমি জাহেলিয়তের সময় একটি বানরকে দেখিয়াছিলাম যে, সেই বানরটা ব্যভিচার (জেনা) করিয়াছিল এবং সমস্ত বানর সমবেতভাবে উক্ত বানরকে প্রস্তরাঘাত করিয়াছিল। ইহাতে আমিও তাহাদের সহিত উহাকে প্রস্তরাঘাত করিয়াছিলাম। আহমদী প্রেসে মুদ্রিত ছহিহ বোখারি, ১-৫৪৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। এমাম বোখারি এই হাদিছটি উল্লেখ করতঃ বন্য পশুর জেনা ও উহাদের উপর হদ জারি করার মত সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু ইহা নইম বেনে হাম্মাদের জাল কথা। মিজানোল-এতেদাল, ৩-২৪১ পৃষ্ঠা: (এমাম) আজদি বলিয়াছেন যে, নইম বেনে হাম্মাদ হাদিছ প্রস্ত্তত করিত এবং (এমাম আবু হানিফা) নোমানের অপবাদের উদ্দেশ্যে মিথ্যা গল্প প্রস্ত্তত করিত। এই নইম বর্ণনা করিয়াছে যে, খোদাতায়ালা একটি যুবকের ন্যায় আকৃতি-ধারী, তাঁহার পদদ্বয় সবুজ রঙ্গের ফলকে আছে এবং উহাতে সুবর্ণের দুখানা পাদু্কা (জুতা) আছে। ... (আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী রচিত) আজবোয়া ফাজেলা ৪৫-৪৬ পৃষ্ঠা: এবনো মাজার মধ্যে কতকগুলি জাল হাদিছ আছে। এইরূপ ছেহাহ-ছেত্ত্বার অন্যান্য কেতাবগুলির অবস্থা অনুমান করুন। ছোনানে দারুকুৎনি ও ছোনানে বয়হকি ইত্যাদিতে অনেক জাল হাদিছ আছে।’’
হাদীসের সনদ যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের মতামত গ্রহণের মূলনীতি, সুনান তিরমিযীর মধ্যে বিদ্যমান দুর্বল ও জাল হাদীস এবং এ বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের মতামত ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেন: ‘‘বর্ত্তমানে কদমবুছির ফতোয়া নামে একখানা পুস্তক বঙ্গ-ভাষায় মুদ্রিত হইয়াছে, ... উক্ত ফৎওয়াতে কতকগুলি জাল হাদিছ হজরতের ছহিহ হাদিছ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে ... লেখক সাহেব উক্ত পুস্তকের ৪ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন .... ‘যথা তেরমেজি শরিফের (হাদিছে) আসিয়াছে: ..... অতঃপর তাহারা (য়িহুদিরা) রছুলুল্লাহ (ﷺ) এর পদদ্বয় চুম্বন করিয়াছিল।’ আমাদের উত্তর:- হাঁ, তেরমেজি শরীফের ২য় খন্ডে (৯৮ পৃষ্ঠায়) উক্ত হাদিছটি উল্লিখিত হইয়াছে।[1] এমাম তেরমেজি উক্ত হাদিছ সহিহ বলিলেও তদপেক্ষা যোগ্যতম মোহাদ্দেছ এমাম নাছায়ি এবং এমাম মোঞ্জারি কি বলিয়াছেন, তাহা মুফতি সাহেব দেখিয়াছেন কি? হেদায়ার টীকা, আয়নি, ৪র্থ খন্ড, ২৫৪ পৃষ্ঠা: ‘‘(এমাম) নাছায়ী বলিয়াছেন, উক্ত হাদিছটী মোনকার (জইফ)। (এমাম) মোঞ্জরি বলিয়াছেন, (উক্ত হাদিসের রাবি) আবদুল্লাহ বেনে ছালেমার জন্য হাদিসটী মোনকার (জইফ) হইয়াছে, কেননা, সে ব্যক্তি দোষান্বিত। নাছবোর রাইয়াহ ১/৩২/৩৩ পৃষ্ঠা। (এমাম) তেরমেজি কছির বেনে আবদুল্লাহ হইতে ঈদের বার তকবীর সংক্রান্ত একটী হাদিস রেওয়াএত করিয়া উহা ‘‘আছ’হ’ (সমধিক সহিহ) বা হাছান বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন; কিন্তু এমাম আহমদ, এবনোমইন, নাছায়ী, দারকুৎনি, আবু জোরয়া শাফেয়ি উক্ত কছির বেনে আবদুল্লাহকে পরিত্যক্ত, জাল হাদিছ প্রস্ত্ততকারী ইত্যাদি বলিয়া হাদিসটি রদ করিয়াছেন। আরও উক্ত পৃষ্ঠা- সারমর্ম: ‘‘(এমাম) এবনো দাহইয়া বলিয়াছেন, তেরমেজির নিজ কেতাবে অনেক হাদিস হাছান (মধ্যম শ্রেণীর বা উৎকৃষ্ট) বলিয়া কথিত হইয়াছে, অথচ তৎসমস্ত জাল হাদিছ এবং তৎসমস্তের ছনদ বাতীল।’’[2]
ইমাম হাকিম নিসাপূরী সংকলিত ‘আল-মুসতাদরাক’ গ্রন্থে বিদ্যমান জাল হাদীস বিষয়ে তিনি বলেন: ‘‘উক্ত পুস্তক (কদমবুছির ফতোয়া) ৭/৮ পৃষ্ঠা: আল্লামা শামি কদমবুছি জায়েজ হওয়া সমর্থন করিতে গিয়া নিমোক্ত হাদিসটি হাকেমের ছনদে বর্ণনা করিয়াছেন। একদা এক ব্যক্তি নবি করিম (ﷺ)-এর নিকট আসিয়া বলিয়াছিল, হে রছুলুল্লাহ, আমাকে এমন কিছু দেখান যাহাতে আমার দুঢ় বিশ্বাস হয় ... (হজরত তাহাই করিলেন)। অবশেষে সে ব্যক্তি নবি করিম (ﷺ)-এর অনুমতি লইয়া তাঁহার মস্তকে এবং পায়ে চুম্বন করিল। আমাদের উত্তর: হেদায়ার টীকা আয়নি ৪/২৫৫ পৃষ্ঠা: এমাম জাহাবী বলিয়াছেন, এই হাদিসের একজন রাবি আছেম বেনে হাববান পরিত্যক্ত (জাল হাদিস প্রস্ত্ততকারী)। ইহাতে বুঝা গেল যে, হাকেমের হাদিসটি বাতীল। মুফতি সাহেবের এইরূপ বাতীল হাদিস দ্বারা প্রমাণ পেশ করা ঠিক হয় নাই এবং উহা কদমবুছি জায়েজ হওয়ার প্রমাণ হইতে পারে না।’’[3]
[2] মোহাম্মদ রুহুল আমিন, এজহারোল-হক বা কদমবুছির ফতোয়ার সমালোচনা, পৃ ৪-৫। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গ্রন্থকার রচিত ‘সালাতুল ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর’ বইটি পড়ুন।
[3] মোহাম্মদ রুহুল আমিন, এজহারোল-হক, পৃ ১০-১১।