লগইন করুন
ইতিহাস, সীরাত ও মুজিযা বর্ণনার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা যায়। সকল বিষয়ের লেখকই সে বিষয়ে সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ করতে চান। তথ্য সংগ্রহের এ আগ্রহের ফলে প্রথম যুগ থেকেই অনেক আলিম এ সকল ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল হাদীস গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী যুগে এ আগ্রহের ফলে সীরাতুন্নবী গ্রন্থগুলোর মধ্যে অগণিত ভিত্তিহীন জাল হাদীস অনুপ্রবেশ করেছে।
ইতোপূর্বে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবীর আলোচনা থেকে জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচলিত সকল হাদীসই ৪র্থ-৫ম শতাব্দীর মধ্যে সংকলিত হয়ে গিয়েছিল। এর পরবর্তী যুগে অতিরিক্ত যা কিছু সংকলিত হয়েছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগে বানানো জাল ও ভিত্তিহীন কথা। এ প্রকারের গ্রন্থগুলোকে তিনি ৪র্থ ও ৫ম পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাস, সীরাত ও মুজিযা বিষয়ক গ্রন্থগুলোর অবস্থাও আমরা এথেকে বুঝতে পারব। প্রথম ছয় শত বছরে সংকলিত এ জাতীয় গ্রন্থগুলির অন্যতম: ইবনু ইসহাকের (১৫০হি) সীরাহ, ওয়াকিদীর (২০৭ হি) মাগাযী, ইবনু হিশামের (২১৮ হি) সীরাহ, ইবনু সা’দ (২৩০হি)-এর ‘তাবাকাত’, খালীফা ইবনু খাইয়াতের (২৪০ হি) তারীখ, বালাযুরির (২৭৯ হি) ফুতুহুল বুলদান, ফিরইয়াবীর (৩০১ হি) দালাইলুন নুবওয়াত, তাবারীর (৩১০ হি) তারীখ, মাসঊদীর (৩৪৫ হি) তারীখ, বাইহাকীর (৪৫৮ হি) দালাইলুন নুবওয়াত ইত্যাদি। এ সকল পুস্তকে প্রচুর ‘অত্যন্ত যয়ীফ’ হাদীস এবং কিছু জাল হাদীস গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও আমরা দেখি যে, পরবর্তী যুগের লেখকগণ আরো অনেক কথা সংগ্রহ করছেন যা এ সকল গ্রন্থে মোটেও পাওয়া যাচ্ছে না।
পরবর্তী যুগের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো সুয়ূতীর (৯১১ হি) আল-খাসাইসুল কুবরা, কাসতালানীর (৯২৩ হি) আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামীর (৯৪২ হি) সুবুলুল হুদা বা সীরাহ শামিয়াহ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ দাবি করেছেন যে, তাঁরা তাঁদের গ্রন্থে যয়ীফ হাদীস উল্লেখ করবেন, কিন্তু জাল হাদীস উল্লেখ করবেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাঁরা এমন অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন, যেগুলোকে তাঁরা নিজেরাই অন্যত্র জাল ও মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন।
এর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো আলী ইবনু বুরহান উদ্দীন হালাবীর (১০৪৪ হি) সীরাহ হালাবিয়াহ, যারকানীর (১১২২ হি) শারহুল মাওয়াহিব ইত্যাদি গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ কোনো বাছ বিচারই রাখেন নি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল যত বেশি পারা যায় তথ্যাদি সংকলন ও বিন্যাস করা। এজন্য কোনোরূপ বিচার ও যাচাই ছাড়াই সকল প্রকার সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ ও সনদবিহীন বিবরণ একত্রিত সংমিশ্রিত করে বিন্যাস করেছেন। ফলে অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা এগুলোতে স্থান পেয়েছে। আর জাল হাদীসের মধ্যে নতুনত্ব ও আজগুবিত্ব বেশি। এজন্য এ সকল পুস্তকে সহীহ হাদীসের পরিবর্তে জাল হাদীসের উপরেই বেশি নির্ভর করা হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, কুরআন কারীম ও অসংখ্য সহীহ হাদীস দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নুবুওয়াত, মুজিযা ও মর্যাদা প্রমাণ করা বোধহয় সম্ভব হচ্ছে না, অথবা এ সকল মিথ্যা ও জাল বর্ণনাগুলো ছাড়া বোধহয় তাঁর মর্যাদার বর্ণনা পূর্ণতা পাচ্ছে না!!
এ পর্যায়ের গ্রন্থগুলোর লেখকগণ অধিকাংশ বর্ণনারই সূত্র উল্লেখ করেন নি। যেখানে সূত্র উল্লেখ করেছেন সেখানেও তাদের অবহেলা অকল্পনীয়। একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। সীরাহ হালাবিয়ার লেখক বলেন:
وَرَأَيْتُ فِيْ كِتَابِ التَّشْرِيْفَاتِ فِيْ الْخَصَائِصِ وَالْمُعْجِزَاتِ لَمْ أَقِفْ عَلَى اسْمِ مُؤَلِّفِهِ عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ سَأَلَ جِبْرِيْلَ، فَقَالَ يَا جِبْرِيْلُ، كَمْ عُمِّرْتَ مِنَ السِّنِيْنَ ... رواه البخاري
‘‘আমি ‘তাশরীফাত ফিল খাসাইস ওয়াল মু’জিযাত’ নামক একটি বই পড়েছি। এ বইটির লেখকের নাম আমি জানতে পারি নি। এ বইয়ে দেখেছি, আবূ হুরাইরা (রা) থেকে হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিব্রাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? ... হাদীসটি বুখারী সংকলন করেছেন।’’[1]
এ হাদীসটি বুখারী তো দূরের কথা কোনো হাদীস গ্রন্থেই নেই। এ অজ্ঞাত নামা লেখকের বর্ণনার উপর নির্ভর করে গ্রন্থকার হাদীসটি উদ্ধৃত করলেন। একটু কষ্ট করে সহীহ বুখারী বা ইমাম বুখারীর লেখা অন্যান্য গ্রন্থ খুঁজে দেখলেন না। এভাবে তিনি পরবর্তী যুগের মুসলমানদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে একটি জঘন্য মিথ্যা কথা প্রচলনের স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমাদের দেশের আলিমগণ ‘‘সীরাহ হালাবীয়া’ জাতীয় পুস্তকের উপরেই নির্ভর করেন, ফলে অগণিত জাল কথা তাদের লিখনি বা বক্তব্যে স্থান পায়। প্রসিদ্ধ আলিম ও বুযুর্গ আব্দুল খালেক (রাহ) তাঁর ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মূলত এ ‘সীরাহ হালাবিয়া’ (সীরাত-ই হালাবী) গ্রন্থটির উপরেই নির্ভর করেছেন। স্বভাবতই তিনি গ্রন্থকারের প্রতি শ্রদ্ধাবশত কোনো তথ্যই যাচাই করেন নি। ফলে এই মূল্যবান গ্রন্থটির মধ্যে আমরা অগণিত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস দেখতে পাই।
আমরা দেখেছি যে, যয়ীফ হাদীসের উপর আমল জায়েয হওয়ার শর্ত হলো, বিষয়টি বিশ্বাস করা যাবে না, শুধু কর্মের ক্ষেত্রে সাবধানতামূলক কর্ম করা যাবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, বিশ্বাস ও কর্ম বিচ্ছিন্ন করা মুশকিল। কারণ যয়ীফ হাদীসের উপর যিনি আমল করছেন তিনি অন্তত বিশ্বাস করছেন যে, এ আমলের জন্য এ ধরনের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। বিশেষত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনী ও মুজিযা বিষয়ক বর্ণনার ক্ষেত্রে একজন মুমিন কিছু শুনলে তা বিশ্বাস করেন। শুধু তাই নয়, এ সকল ‘যয়ীফ’ বা ‘জাল’ কথাগুলো তাঁর ‘ঈমানের’ অংশে পরিণত হয়। এভাবে তাঁর ‘বিশ্বাসের’ ভিত্তি হয় যয়ীফ বা জাল হাদীসের উপর।