লগইন করুন
৭. ৪. ৩. ১. সনদের বিভিন্নতা
অনেক সময় একজন মুহাদ্দিস এক বা একাধিক সনদের ভিত্তিতে একটি হাদীসকে জাল বলে চিহ্নিত করেন। তিনি জানতে পারেন নি যে, হাদীসটি অন্য কোনো সনদে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে অন্য একজন মুহাদ্দিস অন্য এক বা একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেন।
৭. ৪. ৩. ২. রাবীর মান নির্ধারণে মতভেদ
‘রাবী’-র বর্ণিত হাদীসগুলোর তুলনামূলক নিরীক্ষা হাদীসের বিশুদ্ধতা বিচারের মূল মাপকাঠি। আর এ কারণেই রাবীর বর্ণনা বিচারে কিছু মতভেদ হয়। এদিক থেকে আমরা রাবীগণকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি। (১) পূর্ণ গ্রহণযোগ্য রাবীগণ, যাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে সকল নিরীক্ষক মুহাদ্দিস একমত, (২) পূর্ণ অনির্ভরযোগ্য রাবীগণ, যাদের দুর্বলতা বা জালিয়াতির বিষয়ে নিরীক্ষক মুহাদ্দিসগণ একমত এবং (৩) মতভেদীয় রাবীগণ, যাদের গ্রহণযোগ্যতার মান নির্ধারণে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন।
যে সকল রাবী কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ দেখেছেন যে, তাঁদের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বেশকিছু উল্টাপাল্টা ও ভুল বর্ণনা রয়েছে আবার কিছু বিশুদ্ধ বর্ণনাও রয়েছে এদের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো মতভেদ করেছেন। তাদের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে শুদ্ধ ও ভুল বর্ণনার হার, কারণ ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বা অনিচ্ছাকৃত ভুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ মাঝে মাঝে মতভেদ করেছেন।
কখনো বা কোনো মুহাদ্দিস আংশিক তথ্যের উপর নির্ভর করে রায় দিয়েছেন, যা অন্য মুহাদ্দিস সামগ্রিক তথ্যের উপর নির্ভর করে বাতিল করেছেন। যেমন একজন রাবীর কিছু হাদীস বিশুদ্ধ বা ভুল দেখে একজন মুহাদ্দিস তাকে গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। অন্য মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণিত সকল হাদীস নিরীক্ষার মাধ্যমে অন্য বিধান প্রদান করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, এ সকল মতভেদের ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ পর্যালোচনা করেছেন এবং মতামত প্রদানকারীগণের বিভিন্ন মতামতের ভারসাম্য, বিচক্ষণতা, গভীরতা ইত্যাদির ভিত্তিতে মতবিরোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিমালা নির্ণয় করেছেন।[1]
৭. ৪. ৩. ৩. মুহাদ্দিসের নীতিগত বা পদ্ধতিগত মতভেদ
কখনো কখনো রাবী এবং হাদীসের বিধান প্রদানে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে পদ্ধতিগত কিছু পার্থক্য দেখা যায়। কেউ একটু বেশি ঢিলেমি ও কেউ বেশি কড়াকড়ি করেছেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ এ সকল বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে তাদের মতভেদ নিরসন করেছেন। যেমন,
চতুর্থ শতকের মুহাদ্দিস ইবনু হিববান আবু হাতিম মুহাম্মাদ আল-বুসতী (৩৫৪ হি), ৬ষ্ঠ শতকের মুহাদ্দিস ইবনুল জাওযী আবুল ফারাজ আব্দুর রাহমান ইবনু আলী (৫৯৭ হি) ভিত্তিহীন কঠোরতার জন্য অভিযুক্ত। পক্ষান্তরে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযী মুহাম্মাদ ইব্নু ঈসা (২৭৯ হি), ৪র্থ-৫ম শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ হাকিম নাইসাপূরী (৪০৫ হি), ১০ম শতকের মুহাদ্দিস জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি) প্রমুখ ঢিলেমির জন্য পরিচিতি লাভ করেছেন। এখানে কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
(১) ইবনু হিববান ও ইবনুল জাওযীর কড়াকড়ি-জাত ভুলের উদাহরণ। দ্বিতীয় হিজরী শতকের রাবী আফলাহ ইবনু সাঈদ আনসারী (১৫৬ হি) বলেন, আমাদেরকে উম্মু সালামার গোলাম আব্দুল্লাহ ইবনু রাফি বলেছেন, আমি আবূ হুরাইরাকে (রা) বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
يُوشِكُ إِنْ طَالَتْ بِكَ مُدَّةٌ أَنْ تَرَى قَوْمًا فِي أَيْدِيهِمْ مِثْلُ أَذْنَابِ الْبَقَرِ يَغْدُونَ فِي غَضَبِ اللَّهِ وَيَرُوحُونَ فِي سَخَطِ اللَّهِ
‘‘তোমার জীবন যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে খুব সম্ভব তুমি এমন কিছু মানুষ দেখতে পাবে যাদের হাতে গরুর লেজের মত (বেত বা ছড়ি) থাকবে। (নিরীহ মানুষদের সন্ত্রস্ত করবে বা আঘাত করবে।) তারা সকালেও আল্লাহর ক্রোধের মধ্যে থাকবে এবং বিকালেও আল্লাহর ক্রোধের মধ্যেই থাকবে।’’
এ হাদীসটিকে ইবনু হিববান ও ইবনুল জাওযী জাল বলে গণ্য করেছেন। তাদের দাবি, এ হাদীসের বর্ণনাকারী আফলাহ ইবনু সাঈদ জাল হাদীস বর্ণনা করতেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের মতের আলোকে দেখেছেন যে, তাদের এ মত সম্পূর্ণ ভুল। কোনো মুহাদ্দিসই বলেন নি যে, আফলাহ জাল হাদীস বর্ণনা করেন। এমনকি কেউ বলেন নি যে, আফলাহ অনির্ভরযোগ্য। মুহাম্মাদ ইবনু সা’দ (২৩০ হি), ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (২৩৩ হি), আবূ হাতিম রাযী (২৭৭ হি), নাসাঈ (৩০৪ হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ইবনু হিববান বা ইবনুল জাওযী কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেন নি যে, আফলাহ অন্য রাবীদের বিপরীত উল্টোপাল্টা কোনো হাদীস বর্ণনা করেছেন। সর্বোপরি এ হাদীসটি আফলাহ ছাড়াও অন্য নির্ভরযোগ্য রাবী আবূ হুরাইরার (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। কাজেই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ এবং ইবনু হিববান ও ইবনুল জাওযীর সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রমাণিত।[2]
(২) ইমাম তিরমিযীর ঢিলেমি-জাত ভুলের উদাহরণ। তিনি বলেন: ‘‘আমাদেরকে মুসলিম ইবনু আমর আবু আমর আল-হাযযা মাদানী বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনু নাফি’ আস-সাইগ বলেন, তিনি কাসীর ইবনু আব্দুল্লাহ থেকে তার পিতা থেকে তার দাদা (আমর ইবনু আউফ) থেকে বলেন,
إِنَّ النَّبِيَّ ﷺ كَبَّرَ فِي الْعِيدَيْنِ فِي الأُولَى سَبْعًا قَبْلَ الْقِرَاءَةِ وَفِي الآخِرَةِ خَمْسًا قَبْلَ الْقِرَاءَةِ
‘‘নবী আকরাম ﷺ দুই ঈদে প্রথম রাক‘আতে কুরআন পাঠের পূর্বে ৭ এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে কুরআন পাঠের পূর্বে ৫ তাকবীর বলেছেন।’’[3]
হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম তিরমিযী বলেন :
حَدِيثُ جَدِّ كَثِيرٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ وَهُوَ أَحْسَنُ شَيْءٍ رُوِيَ فِي هَذَا الْبَابِ عَنْ النَّبِيِّ ﷺ.
‘‘কাসীরের দাদার হাদীসটি হাসান (গ্রহণযোগ্য)। এ বিষয়ে যত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে এ হাদীসটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।[4]
এভাবে তিনি এ হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, তার মতে এ বিষয়ে এটিই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হাদীস।
মুহাদ্দিসগণ ইমাম তিরমিযীর এ মতের প্রবল বিরোধিতা করেছেন। কারণ, মুহাদ্দিসগণ এ হাদীসের বর্ণনাকারী কাসীর ইবনু আব্দুল্লাহকে অত্যন্ত দুর্বল ‘‘রাবী’’ বলে গণ্য করেছেন। উপরন্তু অনেকেই তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী বলে চিহ্নিত করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল বলেন: সে অত্যন্ত দুর্বল ও একেবারেই অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বলেন: সে দুর্বল। ইমাম আবু দাউদ বলেন: লোকটি জঘন্য মিথ্যাবাদী ছিল। ইমাম শাফিয়ী বলেন: সে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদীদের একজন। ইমাম নাসাঈ ও দারাকুতনী বলেন: সে পরিত্যক্ত, অর্থাৎ মিথ্যা হাদীস বলার অভিযোগে অভিযুক্ত। ইবনু হিববান বলেন: সে তার পিতা থেকে দাদা থেকে একটি মিথ্যা হাদীসের পুস্তিকা বর্ণনা করেছে। শুধুমাত্র সমালোচনার প্রয়োজন ছাড়া কোনো গ্রন্থে সে সকল হাদীস উল্লেখ করাও জায়েয নয়। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন: এ ব্যক্তি যে দুর্বল সে বিষয়ে ইজমা বা ঐকমত্য হয়েছে।[5] এজন্য আবুল খাত্তাব উমার ইবনু হাসান ইবনু দাহিয়া (৬৩৩ হি) বলেন:
"وَكَمْ حَسَّنَ التِّرْمِذِيُّ فِيْ كِتَابِهِ مِنْ أَحَادِيْثَ مَوْضُوْعَةٍ وَأَسَانِيْدَ وَاهِيَةٍ مِنْهَا هَذَا الْحَدِيْثُ"
‘‘তিরমিযী তাঁর গ্রন্থে কত যে মাউযূ বা বানোয়াট ও অত্যন্ত দুর্বল সনদকে হাসান বা গ্রহণযোগ্য বলেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এ হাদীসটিও সেগুলোর একটি।’’[6]
(৩) ইমাম হাকিম-এর মুসতাদরাক থেকে উদাহরণ। হাদীসকে সহীহ বলার ক্ষেত্রে হাকিমের দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। তিনি তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে অনেক জাল হাদীসকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। একটি উদাহরণ দেখুন:
হাকিম বলেন, আমাদেরকে আবুল হাসান আলী ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু উকবা শাইবানী কুফায় অবস্থানকালে বলেছেন, আমাদেরকে কাযী ইবরাহীম ইবনু আবিল আনবাস বলেছেন, আমাদেরকে সাঈদ ইবনু উসমান আল-খার্রায বলেছেন, আমাদেরকে আব্দুর রাহমান ইবনু সাঈদ আল-মুয়ায্যিন বলেছেন, আমাদেরকে কাতার ইবনু খালীফাহ বলেছেন, আবুত তুফাইল থেকে, তিনি আলী ও আম্মার (রা) থেকে: তাঁরা উভয়ে বলেন:
إِنَّ النَّبِيَّ ﷺ كَانَ يَجْهَرُ فِيْ الْمَكْتُوْبَاتِ بِـ(بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ) وَكَانَ يَقْنُتُ فِيْ صَلاَةِ الْفَجْرِ
‘‘নবী (ﷺ) ফরয সালাতসমূহে জোরে জোরে (সশব্দে) ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করতেন এবং তিনি সালাতুল ফজরে কুনুত পাঠ করতেন...।’’
ইমাম হাকিম হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন:
هَذَا حَدِيْثٌ صَحِيْحُ الإِسْنَادِ وَلاَ أَعْلَمُ فِيْ رُوَاتِهِ مَنْسُوْباً إِلَى الْجَرْحِ
‘‘এ হাদীসটির সনদ সহীহ। এর রাবীদের মধ্যে কেউ দুর্বল বলে গণ্য হয়েছেন বলে জানি না।’’[7]
ইমাম যাহাবী, যাইলায়ী, ইবনু হাজার প্রমুখ মুহাদ্দিস হাকিমের এ সিদ্ধান্ত ভুল বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম যাহাবী বলেন, এ হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বরং মাউযূ বা জাল বলেই প্রতীয়মান হয়। সনদের দুজন রাবী অত্যন্ত দুর্বল: (১) সাঈদ ইবনু উসমান আল-খার্রায এবং (২) তার উস্তাদ আব্দুর রাহমান ইবনু সাঈদ আল-মুয়ায্যিন।[8]
আরো অনেক নমুনা আমরা দ্বিতীয় পর্বে দেখতে পাব ইনশাআল্লাহ।
(৪) ১০ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী। ইলম হাদীসের বিভিন্ন ময়দানে তাঁর খেদমত রয়েছে। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ বিভিন্নভাবে তাঁর গ্রন্থাবলির উপর নির্ভর করেন। তিনি তাঁর প্রণীত ও সংকলিত ‘আল-জামি’ আস-সগীর’, ‘আল-জামি’ আল-কাবীর’ ‘আল-খাসাইসুল কুবরা’ বিভিন্ন গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি এ সকল গ্রন্থে সহীহ ও যয়ীফ হাদীস সংকলন করবেন, তবে কোনো জাল হাদীস তিনি এ সকল গ্রন্থে উল্লেখ করবেন না। কিন্তু পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তাঁর এ সকল গ্রন্থের মধ্যে কিছু জাল হাদীসও দেখতে পেয়েছেন। বিশেষত, ইমাম সুয়ূতী নিজেই জাল হাদীসের বিষয়ে অনেকগুলি বই লিখেছেন। বেশ কিছু হাদীস ইমাম সুয়ূতী ‘জাল’ বলে চিহ্নিত করে ‘জাল হাদীস’ বিষয়ক গ্রন্থে সংকলিত করেছেন। আবার তিনি নিজেই সেগুলোকে ‘আল-জামি’ আস-সাগীর’, আল-জামি’ আল-কাবীর’ বা ‘আল-খাসাইসুল কুবরা’ গ্রন্থাদিতে সংকলন করেছেন।
একটি উদাহরণ দেখুন। পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী (৪২৭ হি) ও আহমাদ ইবনু আলী খতীব বাগদাদী (৪৬৩ হি) একটি হাদীস সংকলন করেছেন। তাঁরা তাঁদের সনদে তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী ইসহাক ইবনুস সাল্ত থেকে হাদীসটি সংকলন করেছেন। এ ইসহাক ইবনুস সালত বলেন, আমাদেরকে ইমাম মালিক ইবনু আনাস বলেছেন, আমাদেরকে আবুয যুবাইর মাক্কী বলেছেন, আমাদেরকে জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেছেন,
رَأَيْتُ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ ثَلاَثَةَ أَشْيَاءَ لَوْ لَمْ يَأْتِ بِالْقُرْآنِ لآمَنْتُ بِهِ، أَصْحَرْنَا فِيْ بَرِيَّةٍ تَنْقَطِعُ الطُّرُقُ دُوْنَهَا فَأَخَذَ النَّبِيُّ ﷺ الْوَضُوْءَ وَرَأَى نَخْلَتَيْنِ مُتَفَرِّقَتَيْنِ فَقَالَ النَّبِيُّ ﷺ: يَا جَابِرُ اذْهَبْ إِلَيْهِمَا فَقُلْ لَهُمَا: اجْتَمِعَا. فَاجْتَمَعَتَا حَتَّى كَأَنَّهُمَا أَصْلٌ وَاحِدٌ فَتَوَضَّأَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَبَادَرْتُهُ بِالْمَاءِ وَقُلْتُ لَعَلَّ اللهُ أَنْ يُطْلِعَنِيْ عَلَى مَا خَرَجَ مِنْ جَوْفِهِ فَآكُلَهُ فَرَأَيْتُ الأَرْضَ بَيْضَاءَ، فَقُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَمَا كُنْتَ تَوَضَّأْتَ؟ قَالَ: بَلَى، وَلَكِنَّنَا مَعْشَرَ النَّبِيِّيْنَ أُمِرَتِ الأَرْضُ أَنْ تُوَارِيَ مَا يَخْرُجُ مِنَّا مِنَ الْغَائِطِ وَالْبَوْلِ
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এমন তিনটি (অলৌকিক) বিষয় দেখেছি যে, তিনি কুরআন আনয়ন না করলেও আমি তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করতাম। (একবার) আমরা এক দূরবর্তী মরুভূমিতে গমন করি। তখন নবী (ﷺ) ইসতিনজার পানি হাতে নিলেন। তিনি দুটি পৃথক খেজুরগাছ দেখে আমাকে বললেন, হে জাবির, তুমি গাছদুটির কাছে যেয়ে তাদেরকে বল: তোমরা একত্রিত হও। এতে গাছ দুটি এমনভাবে একত্রিত হয়ে গেল যেন তারা একই মূল থেকে উৎপন্ন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইসতিনজা সম্পন্ন করেন। আমি তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে তাকে দিলাম। আর আমি বললাম, তাঁর পেট থেকে যা বের হয়েছে তা হয়ত আল্লাহ আমাকে দেখাবেন এবং আমি তা ভক্ষণ করব। কিন্তু আমি দেখলাম যে, মাটি পরিস্কার সাদা। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি ইসতিনজা করেন নি? তিনি বলেন, হ্যাঁ, তবে আমাদের নবীগণের বিষয়ে যমীনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আমাদের থেকে মল-মূত্র যা নির্গত হবে তা আবৃত করে ফেলতে।......’’
ইমাম মালিক ছিলেন দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস। অগণিত মুহাদ্দিস তাঁর কাছ থেকে হাদীস শিক্ষা করেছেন। মূলত, সে সময়ের সকল মুহাদ্দিসই তাঁর কাছ থেকে হাদীস শিখেছেন। অনেকেই বছরের পর বছর তাঁর সান্নিধ্যে থেকে হাদীস শিখেছেন। এ সকল অগণিত ছাত্রের কেউই এ হাদীসটি বর্ণনা করেন নি। অনুরূপভাবে তাবিয়ী আবুয যুবাইর বা সাহাবী জাবির (রা) থেকেও অন্য কোনো সূত্রে তা বর্ণিত হয় নি। একমাত্র ইসহাক ইবনুস সাল্ত নামক এই ব্যক্তি দাবি করেছেন যে, ইমাম মালিক তাকে হাদীসটি বলেছেন। এ ব্যক্তি অত্যন্ত দুর্বল ও বাতিল হাদীস বর্ণনাকারী বলে চিহ্নিত হয়েছেন। আরো লক্ষণীয় হলো, এ ইসহাকের বর্ণনাও তৃতীয় বা চতুর্থ শতকে কোনোরূপ প্রসিদ্ধি বা পরিচিতি লাভ করে নি। ৫ম শতকে কেউ কেউ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। জুরজানী ও খতীব থেকে ইসহাক পর্যন্ত সনদও অন্ধকারাচ্ছন্ন। এজন্য খতীব বাগদাদী, হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী, যাহাবী, ইবনু হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিসের মতামতের আলোকে ইমাম সুয়ূতী নিজেই হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন এবং জাল হাদীস বিষয়ক ‘যাইলুল লাআলী’ নামক গ্রন্থে তিনি তা উল্লেখ করেছেন।
আবার তিনি নিজেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর মুজিযা, অলৌকিকত্ব ও বৈশিষ্ট্যাবলি বিষয়ক ‘আল-খাসাইসুল কুবরা’ নামক গ্রন্থে এই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনি দাবি করেছেন যে, এ গ্রন্থে তিনি কোনো মাউযূ বা জাল হাদীস উল্লেখ করবেন না। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তাঁর এ স্ববিরোধিতা ও হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে তাঁর ঢিলেমির কথা উল্লেখ করেছেন।[9]
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৮০, ৪/২১৯৩; ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ১/১৭৬-১৭৭; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/২৯২; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৪৪০-৪৪১; ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ১১৪।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ২/৪১৬, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪০৭।
[4] তিরমিযী, আস-সুনান ২/৪১৬, আবু তালিব কাযী, ইলালুত তিরমিযী, পৃ: ৯৩-৯৪।
[5] ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৮/৩৭৭, তাকরীবুত তাহযীব ৪৬০।
[6] যাইলায়ী, আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ (৭৬২ হি), নাসবুর রাইয়াহ ২/২১৭-২১৮।
[7] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪৩৯।
[8] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪৩৯; যাইলায়ী, নাসবুর রাইয়াহ ২/২২৩।
[9] হামযা ইবনু ইউসূফ জুরজানী, তারীখ জুরজান, পৃ. ৫২৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৩৪৪; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/৩৬৫; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৫০; ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/৩৩৮।