লগইন করুন
যদি প্রমাণিত হয় যে, বর্ণনাকারী ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও সত্যপরায়ণ, তবে তিনি তাঁর বর্ণনায় কিছু ভুল করতেন, তবে সেক্ষেত্রে তার দুর্বলতার মাত্রা অনুসারে বর্ণিত হাদীসটিকে হাসান বা যয়ীফ বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া কোনো বর্ণনাকারীর পরিচয় জানা না গেলেও হাদীসটি সাধারণভাবে দুর্বল বলে গণ্য করা হয়। সর্বোপরি যদি দেখা যায় যে বর্ণনাকারী সৎ ও সত্যপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও উদ্ভট অর্থের ‘হাদীস’ বর্ণনা করছেন, যা অন্য কেউ বর্ণনা করছেন না সেক্ষেত্রেও তাঁর বর্ণিত হাদীস দুর্বল বলে গণ্য। এই পর্যায়ের অনেক হাদীসকে মুহাদ্দিসগণ শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার মাধ্যমে ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন। জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থাবলিতে এরূপ অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলির সনদে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত না থাকলেও সেগুলোকে জাল বলা হয়েছে। আবার এ জাতীয় কিছু হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন। বাহ্যিক সনদের কারণে কেউ কেউ তা দুর্বল বা ‘হাসান’ বললেও, অর্থের কারণে অন্যেরা তা জাল বলে গণ্য করেছেন। এখানে দুটি উদাহরণ উল্লেখ করছি:
(১) আনাস (রা)-এর সূত্রে ‘আরশ’-এর বর্ণনায় একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আনাস বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বলেন আমি জিবরাঈলকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন, আমি মিকাঈলকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন আমি ইসরাফীলকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন, আমি রাফী-কে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন আমি লাওহে মাহফূযকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন, আমি ‘কলম’-কে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন: আরশের ৩ লক্ষ ৬০ হাজার খুটি আছে..... ইত্যাদি...।
হাদীসটির সনদে ‘মুহাম্মাদ ইবনু নাসর’ নামক একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন, যাকে স্পষ্টত ‘মিথ্যাবাদী’ বলা হয় নি। তবে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল। ইবনু হাজার বলেন: ‘‘এ হাদীসটির মিথ্যাচার সুস্পষ্ট। হাদীস সাহিত্যে যার কিছুটা দখল আছে তিনি কখনোই এ বিষয়ে দ্বিমত করবেন না।’’[1]
(২) তাবি-তাবিয়ী ফুদাইল ইবনু মারযূক (১৬০হি) বলেছেন, ইবরাহীম ইবনু হাসান থেকে, ফাতিমা বিনতুল হুসাইন ইবনু আলী (১০০ হি) থেকে, আসমা বিনতু উমাইস (রা) থেকে, তিনি বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। এসময়ে তাঁর মস্তক ছিল আলীর (রা) কোলে। এজন্য আলী আসরের সালাত আদায় করতে পারেন নি। এমতাবস্থায় সূর্য ডুবে যায়। তিনি আলীকে বলেন: তুমি কি সালাত আদায় করেছ? তিনি বলেন না। তখন তিনি বলেন: হে আল্লাহ, আলী যদি আপনার ও আপনার রাসূলের আনুগত্যে থেকে থাকেন তবে তাঁর জন্য আপনি সূর্য ফিরিয়ে দিন। আসমা বলেন: আমি দেখলাম, সূর্য ডুবে গেল। এরপর ডুবে যাওয়ার পরে আবার তা উদিত হলো।’’
এ সনদে আসমা বিনতু উমাইস প্রসিদ্ধ মহিলা সাহাবী। ফাতিমা বিনতুল হুসাইন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। ফুদাইল ইবনু মারযূক সত্যপরায়ণ রাবী, তবে তিনি ভুল করতেন। ইবরাহীম ইবনু হাসান কিছুটা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে যেহেতু কেউ তাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে সুস্পষ্টত কিছু বলেন নি, এজন্য ইবনু হিববান তাঁকে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে গণ্য করেছেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, সনদ বিচারে হাদীসটি ‘হাসান’ বলে গণ্য হতে পারে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বাহ্যিক সনদের দিকে তাকিয়ে এরূপ মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইবনু তাইমিয়া, ইবনু কাসীর, যাহাবী ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস হাদীসটির ‘মতন’ বা ‘মূলবক্তব্য’ ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন।
তাঁদের বিস্তারিত আলোচনার সার-সংক্ষেপ হলো, সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরে আবার উদিত হওয়া একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা। আর মানবীয় প্রকৃতি ‘অস্বাভাবিক’ ও ‘অলৌকিক’ ঘটনা বর্ণনায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহবোধ করে। এজন্য স্বভাবতই আশা করা যায় যে, অন্তত বেশ কয়েকজন সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হবে। কিন্তু একমাত্র আসমা বিনতু উমাইস (রা) ছাড়া অন্য কোনো সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হয় নি। এরূপ ঘটনা সূর্যগ্রহণের চেয়েও অধিক আশ্চর্যজনক বিষয়। আমরা দেখি যে, সূর্যগ্রহণের ঘটনা অনেক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত, অথচ এ ঘটনাটি এ একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত।
এরপর আসমা (রা)-এর ২০ জনেরও অধিক প্রসিদ্ধ ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন। এরূপ একটি অত্যাশ্চার্য ঘটনা তাঁর অধিকাংশ ছাত্রই বর্ণনা করবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু বস্ত্তত তা ঘটে নি। শুধুমাত্র ফাতেমার সনদে তা বর্ণিত হচ্ছে। ফাতেমার ছাত্র বলে উল্লিখিত ‘ইবরাহীম ইবনু হাসান’ অনেকটা অজ্ঞাত পরিচয়। তিনি ফাতেমার কাছ থেকে আদৌ কিছু শুনেছেন কিনা তা জানা যায় না। অনুরূপ আরেকটি সনদেও ঘটনাটি আসমা বিনতু উমাইস থেকে বর্ণিত। সে সনদেও দুজন অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী ও একজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। এতবড় একটি ঘটনা এভাবে দুই-একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ বলবেন না তা ধারণা করা কষ্টকর।
অন্যদিকে এ ঘটনাটি কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য বর্ণনার সাথে বাহ্যত সাংঘর্ষিক। খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে ও আলী (রা) সহ অন্যান্য সকল সাহাবী আসরের সালাত আদায় করতে ব্যর্থ হন। সুর্যাস্তের পরে তাঁরা ‘কাযা’ সালাত আদায় করেন। অন্যদিন ঘুমের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সহ সাহাবীগণের ফজরের সালাত এভাবে কাযা হয়। এ দুই দিনে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আলী (রা)-সহ সাহাবীগণের জন্য সূর্যকে ফেরত আনা বা নেয়া হলো না, অথচ এ ঘটনায় শুধু আলীর জন্য তা করা হবে কেন? আর ওযরের কারণে সালাতের সময় নষ্ট হলে তো কোনো অসুবিধা হয় না। এছাড়া আলী (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে জামাতে সালাত আদায় করবেন না, আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এক/দেড় ঘন্টা যাবত ওহী নাযিল হবে ইত্যাদি বিষয় স্বাভাবিক মনে হয় না।
এ জাতীয় আরো অন্যান্য বিষয়ের ভিত্তিতে তাঁরা বলেন যে, এ ‘মতন’টি ভুল বা বানোয়াট। এ সকল অজ্ঞাত পরিচয় রাবীগণের মধ্যে কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল করেছেন।[2]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ভাষা, অর্থ ও বুদ্ধিবৃত্তিক নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের পদ্ধতি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সুক্ষ্ম। যে কোনো বিচারালয়ে বিচারক বুদ্ধিবৃত্তিক ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণকে ডকুমেন্টারী প্রমাণের পরে বিবেচনা করেন। কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে অপরাধের মোটিভ ও যৌক্তিকতা স্পষ্টভাবে দেখতে পারলেও পাশাপাশি প্রমাণাদি না থাকলে তিনি শুধুমাত্র মোটিভ বিচার করে শাস্তি দেন না। অনুরূপভাবে কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে যদি তিনি অনুভব করেন যে, তার জন্য অপরাধ করার কোনো যৌক্তিক বা বিবেক সংগত কারণ নেই, কিন্তু সকল ডকুমেন্ট ও সাক্ষ্য সুস্পষ্টরূপে তাকে অপরাধী বলে নির্দেশ করছে, তখন তিনি তাকে অপরাধী বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। মুহাদ্দিসগণও এভাবে সর্বপ্রথম ‘ডকুমেন্টারী’ প্রমাণগুলোর নিরীক্ষা করেছেন এবং এরপর ভাষা, অর্থ, ও তথ্য বিবেচনা করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার কিছু মূলনীতি আমরা দেখতে পাব, ইনশা আল্লাহ।
[2] ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/৩৭৮-৩৮২; আলবানী, যায়ীফাহ ২/৩৯৫-৪০১।