লগইন করুন
আমরা দেখেছি যে, অনিচ্ছাকৃত ভুলও মিথ্যা বলে গণ্য। সাহাবীগণ নিজে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ‘মিথ্যা’ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নির্ভুলভাবে ও আক্ষরিকভাবে হাদীস বলার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁদের সতর্কতার অগণিত ঘটনা হাদীস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
তাবিয়ী আম্র ইবনু মাইমূন আল-আযদী (৭৪ হি) বলেন,
مَا أَخْطَأَنِي ابْنُ مَسْعُودٍ عَشِيَّةَ خَمِيسٍ إِلا أَتَيْتُهُ فِيهِ، قَالَ فَمَا سَمِعْتُهُ يَقُولُ بِشَيْءٍ قَطُّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ. فَلَمَّا كَانَ ذَاتَ عَشِيَّةٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، فَنَكَسَ، قَالَ: فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ فَهُوَ قَائِمٌ مُحَلَّلَةً أَزْرَارُ قَمِيصِهِ قَدِ اغْرَوْرَقَتْ عَيْنَاهُ وَانْتَفَخَتْ أَوْدَاجُهُ، قَالَ: أَوْ دُونَ ذَلِكَ أَوْ فَوْقَ ذَلِكَ أَوْ قَرِيبًا مِنْ ذَلِكَ أَوْ شَبِيهًا بِذَلِكَ.
‘‘আমি প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) এর কাছে আগমন করতাম। তিনি তাঁর কথাবার্তার মধ্যে ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন’ একথা কখনো বলতেন না। এক বিকালে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন’, এরপর তিনি মাথা নিচু করে ফেলেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর জামার বোতামগুলো খোলা। তাঁর চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে এবং গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। তিনি বললেন: অথবা এর কম, অথবা এর বেশি, অথবা এর মত, অথবা এর কাছাকাছি কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন।’’[1]
তাবিয়ী মাসরূক ইবনুল আজদা’ আবু আইশা (৬১ হি) বলেন,
إن عبد الله حَدَّثَ يَوْماً عَنْ رَسُولِ اللهِ فَارْتَعَدَ وَارْتَعَدَتْ ثِيَابُهُ، ثُمَّ قَالَ: أَوْ نَحْوَ هَذَا.
‘‘একদিন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তখন তিনি কেঁপে উঠেন এমনকি তাঁর পোশাকেও কম্পন পরিলক্ষিত হয়। এরপর তিনি বলেন: অথবা অনুরূপ কথা তিনি বলেছেন।’’[2]
তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (১১০ হি) বলেন:
كَانَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ إِذَا حَدَّثَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ حَدِيثًا فَفَرَغَ مِنْهُ قَالَ أَوْ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ.
আনাস ইবনু মালিক (রা) যখন হাদীস বলতেন তখন হাদীস বর্ণনা শেষ করে বলতেন: অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন (আমার বর্ণনায় ভুল হতে পারে)।’’[3]
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবীগণ জ্ঞাতসারে একটি শব্দেরও পরিবর্তন করতেন না। আক্ষরিকভাবে হুবহু বর্ণনা করতেন তাঁরা। তাবিয়ী সা’দ ইবনু উবাইদাহ সুলামী (১০৩ হি) বলেন: সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (৭৩ হি) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسَةٍ: عَلَى أَنْ يُوَحَّدَ اللَّهُ وَإِقَامِ الصَّلاَةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَصِيَامِ رَمَضَانَ وَالْحَجِّ. فَقَالَ رَجُلٌ: الْحَجِّ وَصِيَامِ رَمَضَانَ. قَالَ: لاَ،্রصِيَامِ رَمَضَانَ وَالْحَجِّগ্ধ، هَكَذَا سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ.
‘‘পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বা তাওহীদ, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, রামাদানের সিয়াম পালন এবং হজ্জ।’’ তখন একব্যক্তি বলে: ‘‘হজ্জ ও রামাদানের সিয়াম’’। তিনি বলেন: না, ‘‘রামাদানের সিয়াম ও হজ্জ।’’ এভাবেই আমি রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি।’’[4]
ইয়াফুর ইবনু রূযী নামক তাবিয়ী বলেন, আমি শুনলাম, উবাইদ ইবনু উমাইর (৭২ হি) নামক প্রখ্যাত তাবিয়ী ও মক্কার সুপ্রসিদ্ধ ওয়ায়িয একদিন ওয়াযের মধ্যে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَثُلُ الْمُنَافِقِ كَمَثَلِ الشَّاةِ الرَّابِضَةِ بَيْنَ الْغَنَمَيْنِ.
‘‘মুনাফিকের উদাহরণ দু’টি ছাগলের পালের মধ্যে অবস্থানরত ছাগীর ন্যায়।’’
একথা শুনে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (৭৩ হি) বলেন:
وَيْلَكُمْ لاَ تَكْذِبُوا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ، إِنَّمَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: ্রمَثَلُ الْمُنَافِقِ كَمَثَلِ الشَّاةِ الْعَائِرَةِ بَيْنَ الْغَنَمَيْنِগ্ধ
‘‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা বলবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ তো বলেছেন: ‘‘মুনাফিকের উদাহরণ হলো দু’টি ছাগলের পালের মধ্যে যাতায়াতরত (wandering, roaming) ছাগীর ন্যায়।’’[5]
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা ও পরিপূর্ণ নির্ভুলতা নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ সাহাবী রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন। শুধুমাত্র যে কথাগুলো বা ঘটনাগুলো তাঁরা পরিপূর্ণ নির্ভুলভাবে মুখস্থ রেখেছেন বলে নিশ্চিত থাকতেন সেগুলোই বলতেন। অনেকে কখনোই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে কিছু বলতেন না। সাহাবীগণের সংখ্যা ও হাদীস-বর্ণনাকারী সাহাবীগণের সংখ্যার মধ্যে তুলনা করলেই আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কমবেশি সাহচর্য লাভ করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা লক্ষাধিক। নাম পরিচয় সহ প্রসিদ্ধ সাহাবীর সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। অথচ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা মাত্র দেড় হাজার।
সাহাবীদের নামের ভিত্তিতে সংকলিত প্রসিদ্ধ সর্ববৃহৎ হাদীস গ্রন্থ মুসনাদ আহমাদ। ইমাম আহমাদ এতে মোটামুটি গ্রহণ করার মত সকল সহীহ ও যয়ীফ হাদীস সংকলিত করেছেন। এতে ৯০৪ জন সাহাবীর হাদীস সংকলিত হয়েছে। পরিচিত, অপরিচিত, নির্ভরযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য সকল হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা একত্রিত করলে ১৫৬৫ হয়।
আরো লক্ষণীয় যে, হাদীস বর্ণনাকারী সহস্রাধিক সাহাবীর মধ্যে অধিকাংশ সাহাবী মাত্র ১ থেকে ২০/৩০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ১০০ টির অধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা মাত্র ৩৮ জন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৭ জন সাহাবী থেকে এক হাজারের অধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বাকী ৩১ জন সাহাবী থেকে একশত থেকে কয়েকশত হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[6]
অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকার অনেক ঘটনা সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত। সাইব ইবনু ইয়াযিদ (৯১ হি) সাহাবী ছিলেন। ছোট বয়সে তিনি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্য লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি সাহাবীগণের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বলেন,
صَحِبْتُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ، وَطَلحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ، وَسَعْدَ بْنَ أَبِيْ وَقَّاصٍ، وَالْمِقْدَادَ بْنَ الأَسْوَدِ، فَلَمْ أَسْمَعْ أَحَداً مِنْهُمْ يَتَحَدَّثُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، إلاَّ أَنِّيْ سَمِعْتُ طَلْحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ يَتَحَدَّثُ عَنْ يَوْمِ أُحُدٍ.
‘‘আমি আব্দুর রাহমান ইবনু আউফ (রা), তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা), সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা), মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রা) প্রমূখ সাহাবীর সাহচর্যে সময় কাটিয়েছি। তাঁদের কাউকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীস বলতে শুনিনি। তবে শুধুমাত্র তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহকে আমি উহদ যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে শুনেছি।’’[7]
তিনি আরো বলেন:
صَحِبْتُ سَعْدَ بْنَ مَالِكٍ مِنَ الْمَدِينَةِ إِلَى مَكَّةَ فَمَا سَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ بِحَدِيثٍ وَاحِدٍ
‘‘আমি সা’দ ইবনু মালিক (রা) এর সাথে মদীনা থেকে মক্কা পর্যন্ত গিয়েছি, অথচ তাঁকে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে একটি হাদীসও বলতে শুনিনি।’’[8]
হিজরী প্রথম শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী শা’বী (২০৪ হি) বলেন:
جَالَسْتُ ابْنَ عُمَرَ سَنَةً فَمَا سَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ شَيْئًا.
‘‘আমি আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের (রা) সাথে একটি বছর থেকেছি, অথচ তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কিছুই বলতে শুনিনি।’’[9]
অন্যত্র তিনি বলেন:
قَاعَدْتُ ابْنَ عُمَرَ قَرِيبًا مِنْ سَنَتَيْنِ أَوْ سَنَةٍ وَنِصْفٍ فَلَمْ أَسْمَعْهُ يُحَدِّثُ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ غَيْرَ هَذَا (حديثاً واحداً).
‘‘আমি দুই বছর বা দেড় বছর আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের (রা) কাছে বসেছি। এ দীর্ঘ সময়ে তাঁকে মাত্র একটি হাদীস বলতে শুনেছি...।’’[10]
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা) বলেন, আমি আমার পিতা যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা)-কে বললাম, কোনো কোনো সাহাবী যেমন হাদীস বর্ণনা করেন আপনাকে তদ্রূপ হাদীস বলতে শুনিনা কেন? তিনি বলেন:
أَمَا إِنِّي لَمْ أُفَارِقْهُ وَلَكِنْ سَمِعْتُهُ يَقُولُ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ (مُتَعَمِّداً) فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
‘‘(ইসলাম গ্রহণের পর থেকে) আমি কখনই তাঁর সাহচর্য থেকে দূরে যাই নি। কিন্তু আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, আমার নামে (ইচ্ছাকৃতভাবে) যে ব্যক্তি মিথ্যা বলবে তাকে অবশ্যই জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।’’[11]
তাহলে যুবাইর ইবনুল আওয়াম (৩৬ হি)-এর হাদীস না বলার কারণ অজ্ঞতা নয়। তিনি নবুয়তের প্রথম পর্যায়ে কিশোর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এরপর দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পরে তিনি প্রায় ২৫ বছর বেঁচে ছিলেন। অথচ তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৪০ টিরও কম। মুসনাদ আহমদে তাঁর থেকে ৩৬ টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ইবনু হাযাম উল্লেখ করেছেন যে, নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য সনদে তাঁর নামে বর্ণিত সকল হাদীসের সংখ্যা মাত্র ৩৮ টি।[12]
আমরা দেখছি যে, অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে তিনি হাদীস বলা থেকে বিরত থাকতেন। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলার শাস্তি জাহান্নাম। আর অনিচ্ছাকৃত ভুল বা শব্দগত পরিবর্তন ও তাঁর নামে মিথ্যা বলা হতে পারে। এজন্য তিনি হাদীস বর্ণনা থেকে অধিকাংশ সময় বিরত থাকতেন।
অন্যান্য সাহাবীও এভাবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। তাবিয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু আবী লাইলা (৮৩ হি) বলেন,
قُلْنَا لِزَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ: حَدِّثْنَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ قَالَ كَبِرْنَا وَنَسِينَا وَالْحَدِيثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ شَدِيدٌ.
‘‘আমরা সাহাবী যাইদ ইবনু আরকাম (৬৮ হি) কে বললাম, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস বর্ণনা করুন। তিনি বলেন: আমরা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি এবং বিস্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে হাদীস বলা খুবই কঠিন দায়িত্ব।’’[13]
সাহাবী সুহাইব ইবনু সিনান (রা) বলতেন:
هَلُمُّوْا أُحَدِّثْكُمْ مِنْ مَغَازِيْنَا، فَأَمَّا أَنْ أَقُوْلَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ، فَلاَ
‘‘তোমরা এস, আমি তোমাদেরকে আমাদের যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী বর্ণনা করব। তবে কোনো অবস্থাতেই আমি ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন’ একথা বলব না।’’[14]
তাবিয়ী হাশিম হুরমুযী বলেন, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলতেন:
لَوْلا أَنْ أَخْشَى أَنْ أُخْطِئَ لَحَدَّثْتُكُمْ بِأَشْيَاءَ سَمِعْتُهَا مِنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ، لَكِنَّهُ قَالَ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
‘‘আমার ভয় হয় যে, আমি অনিচ্ছাকৃত ভুল করে ফেলব। এ ভয় না থাকলে আমি অনেক কিছু তোমাদেরকে বলতাম যা আমি তাঁকে বলতে শুনেছি। কিন্তু তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতেই হবে।’’[15]
তাবিয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু কা’ব ইবনু মালিক (৯৮ হি) বলেন: আমি আবু কাতাদাহ (রা) কে বললাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখ থেকে যা শুনেছেন সেসব হাদীস থেকে কিছু আমাকে বলুন। তিনি বলেন:
إني أَخْشَى أَنْ يَزِلَّ لِسَانِي بِشَيْءٍ لَمْ يَقُلْهُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ، إِنِّيْ سَمِعْتُهُ يَقُوْلُ: إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَدِيْثِ عَنِّي، مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
‘‘আমার ভয় হয় যে, আমার জিহবা পিছলে এমন কিছু বলবে যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন নি। আর আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, সাবধান, তোমরা আমার নামে বেশি হাদীস বলা পরিহার করবে। যে ব্যক্তি আমার নামে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলবে তাকে অবশ্যই জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।’’[16]
এভাবে সাহাবীগণ অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। এখানে লক্ষণীয় যে, আনাস ইবনু মালিক ও আবু কাতাদাহ দুজনেই বলছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর নামে মিথ্যা বলার শাস্তি বর্ণনা করেছেন।’ কিন্তু তাঁরা অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা পরিহার করছেন। কারণ ভুল হতে পারে জেনেও সাবধান না হওয়ার অর্থ ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের সুযোগ দেয়া।’ অনিচ্ছাকৃত ভুল থেকে সর্বাত্মক সতর্ক না হওয়ার অর্থ ইচ্ছাকৃত বিকৃতিকে প্রশ্রয় দেয়া। কাজেই যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃত ভুল থেকে সতর্ক না হওয়ার কারণে ভুল করল, সে ইচ্ছাকৃতভাবেই রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে মিথ্যা বলল। কোনো মুমিন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসের বিষয়ে অসতর্ক হতে পারেন না।
[2] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/১৯৩।
[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৫।
[5] আহমাদ, আল-মুসনাদ ২/৮৮; মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬১ হি) কিতাবুত তাময়ীয, পৃ: ১৭৩-১৭৪; আস-সহীহ ৪/২১৪৬।
[6] ইবনু হাযম, আলী ইবনু আহমাদ (৪৫৬ হি), আসমাউস সাহাবাহ আর-রুওয়াত
[7] ইবনু আদী, আল-কামিল ফী দুআফাইর রিজাল ১/৯৩।
[8] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১২; আলবানী, সহীহ সুনানি ইবনি মাজাহ ১/২৮।
[9] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১, আলবানী, সহীহ সুনানি ইবনি মাজাহ ১/২৬।
[10] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৫২; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/২৪৩।
[11] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৪; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/২০০।
[12] ইবনু হাযাম, আসমাউস সাহাবাহ আর-রুওয়াত, পৃ: ৯৫।
[13] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১।
[14] বালাযুরী আহমাদ ইবনু ইয়াহইয়া (২৭৯ হি), আনসাবুল আশরাফ ১/১৮৩।
[15] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/১৭২।
[16] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/১৯৫।