লগইন করুন
মূসার নবুঅতী জীবনে এটি ছিল একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা। ইবরাহীমের অগ্নি পরীক্ষার ন্যায় এটিও ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক মহা পরীক্ষা। পিছনে ফেরাঊনের হিংস্র বাহিনী, সম্মুখে অথৈ সাগর। এই কঠিন সময়ে বনু ইস্রাঈলের আতংক ও হাহাকারের মধ্যেও মূসা ছিলেন স্থির ও নিস্কম্প। দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় তিনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাসে অটল থাকেন এবং সাথীদের সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। হিজরতের রাতে একইরূপ জীবন-মরণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)।
যাই হোক ফেরাঊন খবর জানতে পেরে তার সেনাবাহিনীকে বনু ইস্রাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ বলেন,
فَأَتْبَعُوهُم مُّشْرِقِينَ- فَلَمَّا تَرَاءى الْجَمْعَانِ قَالَ أَصْحَابُ مُوسَى إِنَّا لَمُدْرَكُونَ- قَالَ كَلاَّ إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ- فَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى أَنِ اضْرِبْ بِعَصَاكَ الْبَحْرَ فَانفَلَقَ فَكَانَ كُلُّ فِرْقٍ كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ- وَأَزْلَفْنَا ثَمَّ الْآخَرِينَ- وَأَنجَيْنَا مُوسَى وَمَن مَّعَهُ أَجْمَعِينَ- ثُمَّ أَغْرَقْنَا الْآخَرِينَ- (الشعراء ৬০-৬৬)-
‘সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল’ (শো‘আরা ২৬/৬০)। ‘অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলল, إِنَّا لَمُدْرَكُونَ ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম’ (৬১)। ‘তখন মূসা বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন’(৬২)। ‘অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল’(৬৩)। ‘ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপরদলকে (অর্থাৎ ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম’(৬৪)। ‘এবং মূসা ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম’(৬৫)। ‘অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম’ (শো‘আরা ২৬/৬০-৬৬)।
এখানে ‘প্রত্যেক ভাগ’ বলতে তাফসীরকারগণ বারো গোত্রের জন্য বারোটি ভাগ বলেছেন। প্রত্যেক ভাগের লোকেরা পানির দেওয়াল ভেদ করে পরস্পরকে দেখতে পায় ও কথা বলতে পারে, যাতে তারা ভীত না হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি এগুলো কল্পনা না করলেও চলে। বরং উপরে বর্ণিত কুরআনী বক্তব্যের উপরে ঈমান আনাই যথেষ্ট। সাড়ে ছয় লক্ষ লোক এবং তাদের সওয়ারী ও গবাদি পশু ও সাংসারিক দ্রব্যাদি নিয়ে নদী পার হবার জন্য যে বিরাট এলাকা প্রয়োজন, সেই এলাকাটুকু বাদে দু’পাশে দু’ভাগে যদি সাময়িকভাবে পানি দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সেটাতে বিশ্বাস করাই শ্রেয়। ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকার সাগরে যে ‘সুনামী’ (TSUNAMI) হয়ে গেল, তাতে ৩৩ ফুট উঁচু ঢেউ দীর্ঘ সময় যাবত দাঁড়িয়ে ছিল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাই মূসার যামানায় সাগর বিদীর্ণ হয়ে তলদেশ থেকে দু’পাশে পানি দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই বিচিত্র নয়। আল্লাহর হুকুমে সবকিছুই হওয়া সম্ভব।
মূসা ও বনু ইস্রাঈলকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে দেখে ফেরাঊন সরোষে ঘোড়া দাবড়িয়ে সর্বাগ্রে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দু’দিক থেকে বিপুল পানি রাশি ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল। আল্লাহ বলেন, فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ بِجُنُودِهِ فَغَشِيَهُم مِّنَ الْيَمِّ مَا غَشِيَهُمْ- (طه ৭৮)- ‘অতঃপর ফেরাঊন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (ত্বোয়াহা ২০/৭৮)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْياً وَعَدْواً حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنتُ أَنَّهُ لآ إِلَهَ إِلاَّ الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ- (يونس ৯০)-
‘আর বনু ইস্রাঈলকে আমরা সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা বশতঃ। অতঃপর যখন সে (ফেরাঊন) ডুবতে লাগল, তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনছি এ বিষয়ে যে, সেই সত্তা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যার উপরে ঈমান এনেছে বনু ইস্রাঈলগণ এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন’ (ইউনুস ১০/৯০)। আল্লাহ বললেন,
آلآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ- فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آيَةً وَإِنَّ كَثِيراً مِّنَ النَّاسِ عَنْ آيَاتِنَا لَغَافِلُونَ- (يونس ৯১-৯২)-
آلآن ‘এখন একথা বলছ? অথচ তুমি ইতিপূর্বে না-ফরমানী করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’। ‘অতএব আজ আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে দিচ্ছি। যাতে তোমার পশ্চাদ্বর্তীদের জন্য তুমি নিদর্শন হ’তে পার। বস্ত্ততঃ বহু লোক এমন রয়েছে যারা আমাদের নিদর্শনাবলীর বিষয়ে বেখবর’ (ইউনুস ১০/৯১-৯২)।
স্মর্তব্য যে, সাগরডুবির দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার পরেও ভীত-সন্ত্রস্ত বনু ইস্রাঈলীরা ফেরাঊন মরেছে কি-না বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফলে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন। তখন আল্লাহ তার প্রাণহীন দেহ বের করে দিলেন। অতঃপর মূসার সাথীরা নিশ্চিন্ত হ’ল।[34]
উল্লেখ্য যে, ফেরাঊনের মমিকৃত দেহ অক্ষতভাবে পাওয়া যায় ১৯০৭ সালে এবং বর্তমানে তা মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।
এতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ফেরাঊনের সময় মিসরীয় সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাদের সময়ে লাশ ‘মমি’ করার মত বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়। পিরামিড, স্ফিংক্স হাযার হাযার বছর ধরে আজও সেই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি ধারণ করে আছে, যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আজকের যুগের কোন কারিগর প্রাচীন এসব কারিগরী কলা-কৌশলের ধারে-কাছেও যেতে পারবে কি-না সন্দেহ।