মুখতাসার যাদুল মা‘আদ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)
মুসলিমদের মধ্যে ধন-সম্পদ বণ্টন করার ব্যাপারে নাবী (সাঃ) এর আদর্শ

নাবী (ﷺ) এর কাছে তিন প্রকারের মাল ছিল।

  • ১. সাদকাহ ও যাকাতের মাল।
  • ২. গণীমতের মাল।
  • ৩. ফাঈ (বিনা যুদ্ধে দুশমনদের থেকে প্রাপ্ত সম্পদ)।

গণীমত ও যাকাতের মাল বন্টনের তরীকা (পদ্ধতি) পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। আমরা সেখানে বর্ণনা করেছি যে, আট প্রকার লোকদেরকেই যে যাকাত দিতে হবে, নাবী (ﷺ) তা বলেন নি। কখনও কখনও এ রকম হত যে, তিনি এক প্রকার লোককেই যাকাত দিয়ে দিতেন।

আর হুনাইন যুদ্ধের দিন তিনি মালে ফাঈকে মুআল্লাফাতুল কুলুব অর্থাৎ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য এক শ্রেণীর লোককেই দান করেছেন। আনসারদেরকে তা থেকে কিছুই দেন নি। এতে আনসারদের মধ্যে অসন্তুষ্টির ভাব পরিলক্ষিত হলে তিনি বললেন- তোমরা কি এটি পছন্দ করনা যে, লোকেরা উট ও ছাগল (সম্পদ) নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা আল্লাহর রসূলকে সাথে নিয়ে তাঁবুতে যাবে? আল্লাহর শপথ! তোমরা যা নিয়ে ফিরছ, তা ঐ সমস্ত বস্ত্ত হতে অনেক ভাল।


একদা আলী (রাঃ) ইয়ামান থেকে কিছু স্বর্ণ পাঠালে রসূল (ﷺ) তা চার জন লোকের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। সুনানের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে, নাবী (ﷺ)-এর আত্মীয়দের জন্য নির্ধারিত অংশ তিনি বনী হাশেম ও বনী মুত্তালেবকে দিয়েছেন। নাওফাল ও আবদে শামস্ গোত্রকে কিছুই দেন নি। তিনি বলেন- আমরা এবং বনী মুত্তালেব আইয়্যামে জাহেলিয়াত ও ইসলামের কোন যুগেই পৃথক হয়নি। আমরা এবং তারা একই। এই বলে তিনি এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের ফাঁকায় প্রবেশ করিয়ে জালের মত বানালেন। তিনি তাদের ধনী ও গরীবদের মাঝে সমান করে ভাগ করেন নি। মিরাছী সম্পদ বন্টনের ন্যায় কোন পুরুষকে মহিলার দ্বিগুণও দেন নি। বরং প্রয়োজন ও অবস্থার প্রতি খেয়াল রেখে তিনি কাউকে কম আবার কাউকে বেশী দান করতেন। এই সম্পদ দ্বারা তিনি কোন অবিবাহিত যুবককে বিয়ে করিয়ে দিতেন, কারও ঋণ পরিশোধ করতেন আবার কখনও শুধু তাদের মধ্যে থেকে অভাবীদেরকেই দিতেন।

নাবী (ﷺ) এর পবিত্র জীবনী ও হিদায়াত গভীরভাবে পাঠ করলে দেখা যায়, তিনি খুমুস তথা গণীমতের মাল থেকে তাঁর জন্য নির্ধারিত অংশ তিনি যাকাত বন্টনের খাতেই ব্যয় করতেন। যাকাত বন্টনের খাতসমূহের (আট শ্রেণীর) বাইরে তিনি কখনও অন্য কাউকে খুমুস থেকে দান করতেন না। মিরাছী সম্পদের মত করেও তা বণ্টন করতেন না। যে ব্যক্তি রসূল (ﷺ)-এর পবিত্র জীবনী পাঠ করবে, সে এতে কোন প্রকার সন্দেহ করতে পারেনা।

ফাঈ (বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত সম্পদ) কি নাবী (ﷺ) এর মালিকানাধীন ছিল যে তিনি যেভাবে ও যেখানে ইচছা ব্যয় করবেন? না কি এরূপ ছিলনা? এ ব্যাপারে আলেমদের থেকে দু’টি মত পাওয়া যায়। তবে তাঁর পবিত্র হাদীস পাঠ করলে জানা যায় যে, তা তাঁর ইচ্ছা ও মালিকানার অধীন ছিলনা। বরং তিনি কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছায় তা বণ্টন করতেন। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে আল্লাহর বান্দা ও রসূল কিংবা আল্লাহর রসূল ও বাদশাহ হওয়ার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রসূল হওয়ার পাশাপাশি বান্দা হওয়াকেই পছন্দ করেছেন। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ইবাদতকারী রসূল সব সময় তার মালিক ও প্রেরকের হুকুমেই চলেন। আর বাদশাহী ওয়ালা রসূলের স্বাধীনতা থাকে। তিনি স্বীয় ইচ্ছায় কাউকে দেন আবার কাউকে বঞ্চিত করেন। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা সুলায়মান (আঃ) কে রাজত্ব ও রিসালাত উভয়ই দিয়েছিলেন। আ ল্লাহ তা‘আলা বলেন-
هَذَا عَطَاؤُنَا فَامْنُنْ أَوْ أَمْسِكْ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَإِنَّ لَهُ عِنْدَنَا لَزُلْفَى وَحُسْنَ مَآبٍ


‘‘এটা আমার দান। তোমাকে ইখতিয়ার দেয়া হচ্ছে। যাকে চাও তাকে দাও অথবা যাকে চাও তাকে দেয়া থেকে বিরত থাকো। এর কোন হিসেব দিতে হবেনা’’।[1]

অর্থাৎ আপনি যাকে ইচ্ছা দান করুন আর যাকে ইচ্ছা বঞ্চিত করুন। আমি আপনার কোন হিসাব নিবনা। আমাদের নাবী (ﷺ)-এর কাছেও এই মর্যাদা পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এর প্রতি আগ্রহ দেখান নি। রসূল (ﷺ) বলেন- আল্লাহর শপথ! আমি কাউকেই দেইনা কিংবা মাহরুম করিনা। আমি কেবল বণ্টনকারী। আমাকে যেখানে বা যাকে যা দেয়ার আদেশ করা হয় আমি তাকেই তা দেই। তাই তিনি ফাঈ (বিনা যুদ্ধে প্রাপ্ত মাল) থেকে নিজের ও পরিবার-পরিজনের ভরণ পোষণের জন্য এক বছরের খরচ বের করে নিতেন। আর বাকী সম্পদ দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য হাতিয়ার ও প্রয়োজনীয় বস্ত্ত সংগ্রহ করায় ব্যয় করতেন। এই প্রকার সম্পদ তথা খুমুসের বিষয়ে মতভেদ শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত চলছে।

যাকাত, গণীমত এবং মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টন করার মাসআলা খুবই সহজ। কারণ এতে হকদারগণ এবং তাদের অংশ নির্দিষ্ট রয়েছে। হকদারগণ ব্যতীত অন্য কারও জন্য কোন প্রকার অংশ নেই। তাই রসূল (ﷺ) এর পর ফাঈ-এর সম্পদ ব্যয় করতে গিয়ে মুসলিম শাসকগণ যে সমস্যায় পড়েছেন যাকাত, গণীমত ও মিরাছী সম্পদ বণ্টন করতে গিয়ে ততটা সমস্যায় পড়েন নি। ফাঈ-এর সম্পদ বন্টনের বিষয়টি কষ্টকর এবং মতভেদপূর্ণ না হলে ফাতেমা (রাঃ) রসূল (ﷺ)-এর পরিত্যক্ত সম্পদ হতে অংশ দাবী করতেন না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-


مَا أَفَاءَ اللهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْ أَهْلِ الْقُرَى فَلِلهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنْكُمْ وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ


‘‘আল্লাহ্ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রসূলের, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্যে, যাতে ধন-সম্পদ কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জিভূত না হয়। রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহ্কে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কঠোর শাস্তি দাতা’’।[2]

আল্লাহ্ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর রসূলকে ফাঈ হিসাবে যেই সম্পদ দিয়েছেন, তার পুরোটাই উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত ব্যক্তিদের জন্যই। রসূল (ﷺ)-এর জন্য নির্ধারিত খুমুস (এক পঞ্চমাংশ) উল্লেখিত লোকদের জন্য খাস নয়; বরং এখানে সকল প্রকার লোকদের বিবরণ এসেছে। তাই এখানে নির্দিষ্ট খাত তথা খুমুসের হকদার এবং সাধারণ খাত তথা আনসার, মুহাজির এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগমণকারী সকল মুসলমানের জন্য খরচ করা হবে।

রসূল (ﷺ) এবং তাঁর পরে খোলাফায়ে রাশেদ্বীন এই আয়াত মুতাবেক আমল করেছেন। তাদের আমলই এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা। এ জন্যই উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন- এই সম্পদে একজনের চেয়ে অন্যজন অধিক হকদার নয়। এমন কি আমিও অন্যজনের চেয়ে অধিক হকদার নই। আল্লাহর শপথ! প্রত্যেক মুসলিমেরই এতে হক রয়েছে। তবে ক্রীতদাসদের এতে কোন অধিকার নেই। আল্লাহর কিতাবে আমাদের অংশ নির্ধারিত রয়েছে। আর রসূল (ﷺ) স্বীয় আমল দ্বারা তা বণ্টন করেছেন। সুতরাং ইসলামে কোন ব্যক্তির ত্যাগ, বিপদাপদ ও কষ্ট বরদাশত, বীরত্ব প্রদর্শন, কারও ধনাঢ্যতা, কারও অভাব এ জাতীয় প্রতিটি বিষয়েরই আলাদা আলাদা মূল্যায়ন হবে। প্রতেক্যেই নিজ নিজ হক বুঝে পাবে। আল্লাহর শপথ! আমি বেঁচে থাকলে ইয়ামানের সানআর পাহাড়ে যে রাখাল ছাগল চরাচ্ছে, তারও যদি এই সম্পদে কোন অংশ থাকে, তাহলে তাও তার কাছে পৌঁছে যাবে। সে নিজ স্থানে অবস্থান কালেই তার হক বুঝে পাবে। তাকে আমার কাছে এসে তার হক বুঝে নিতে হবেনা। সুতরাং ফাঈ-এর আয়াতে যে সমস্ত মুসলিমগণের উল্লেখ করা হয়েছে, খুমুসের আয়াতেও তারাই উদ্দেশ্য। খুমুসের আয়াতে আনসার ও মুহাজিরগণের উল্লেখ করা হয়নি। কেননা তাদেরকে ফাঈ-এর হকদার বানানো হয়েছে। খুমুসের হকদারগণের জন্য দু’টি হক রয়েছে। একটি হচ্ছে খুমুস থেকে তাদের জন্য একটি খাস (নির্দিষ্ট) হক, আর অন্যটি হচ্ছে ফাঈ থেকে তাদের আম তথা সাধারণ হক। সুতরাং উভয় প্রকার সম্পদেই তাদের হক রয়েছে।


নাবী (ﷺ) যে সমস্ত লোকের মধ্যে ফাঈ-এর সম্পদ ভাগ করেছেন, তাদের প্রয়োজন ও অভাব-অনটনের দিকে খেয়াল রেখেই ভাগ করেছেন। এতে অন্যান্য সম্পদ যেমন মীরাছ, ওসীয়ত ইত্যাদির সম্পদ বন্টনের নিয়ম অনুসরণ করেন নি। এমনি খুমুসের সম্পদও তার হকদারদের মধ্যেই বণ্টন করতে হবে। কেননা আল্লাহর কিতাবে উভয় শ্রেণীর সম্পদ ব্যয়ের খাত একটিই। সুতরাং খুমুসের সম্পদ কেবল তার হকদারকেই দেয়া হবে। খুমুসের হকদারগণ ফাঈ-এর মধ্যেও প্রবেশ করবে। আর খুমুসের সম্পদ শুধু খুমুসের হকদারদেরকেই দেয়া হবে। যেমন সূরা হাশরের আয়াতে বর্ণিত লোকদের মধ্যেই ফাঈ-এর সম্পদ ভাগ করতে হবে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ এ থেকে কোন অংশ পাবেনা। ইমাম মালেক এবং আহমাদ (রহঃ) এর মতে রাফেজীদের (শিয়াদের একটি গ্রুপ) জন্য ফাঈ-এর সম্পদে কোন অংশ নেই।

আল্লাহ্ তা‘আলা এক শ্রেণীর লোককেই ফাঈ এবং খুমুসের হকদার বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাদেরকে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। গণীমতের সম্পদ শুধু এর হকদারদের (মুজাহিদদের) জন্য। অন্যদের এতে কোন অংশ নেই। খুমুসের সম্পদ শুধু এর হকদারদের জন্যই। আর ফাঈ-এর সম্পদ যেহেতু বিশেষ করে কারও জন্য নির্দিষ্ট নয়, তাই এর হকদারদের সাথে মুহাজির, আনসার এবং তাদের অনুগামীদেরকেও এর হকদার সাব্যস্ত করা হবে। একইভাবে তারা ফাঈ এবং খুমুসের খাত হিসাবে গণ্য হবে।

রসূল (ﷺ) তাঁর নিজের অংশ ইসলামের স্বার্থে খরচ করতেন। আর খুমুসের পাঁচ অংশ হতে চার অংশ প্রয়োজন অনুসারে তার হকদারদের মধ্যে ভাগ করতেন।

[1]. সূরা সোয়াদ-৩৮:৩৯

[2]. সূরা হাশর-৫৯: ৭