মুখতাসার যাদুল মা‘আদ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)
স্বাস্থ্য রক্ষায় নাবী (সাঃ) এর হিদায়াত

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-


يَا بَنِي آَدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ


‘‘হে বানী আদম! তোমরা প্রত্যেক সলাতের সময় সাজসজ্জা অবলম্বন কর, খাও, পান কর এবং অপব্যয় করোনা। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না’’।[1] মানুষের শরীর থেকে যেই পরিমাণ পানি ও মলমূত্র বের হয়ে যায়, আল্লাহ্ তা‘আলা ঠিক সেই পরিমাণ খাদ্য-পানীয় শরীরে প্রবেশ করানোর আদেশ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তাদের শরীর ও স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। খাদ্যের পরিমাণ ও তা গ্রহণের পদ্ধতি তাই হওয়া উচিৎ, যা দ্বারা শরীর উপকৃত হবে। সুতরাং পরিমাণ মত পানাহার গ্রহণ বা না গ্রহণের মধ্যেই স্বাস্থ্য রক্ষা বা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি নিহিত। সেই সাথে পানাহার গ্রহণের পদ্ধতি বা ধরণটির প্রতিও বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরী। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে, তা অপচয়ে পরিণত হবে। সুতরাং অতিরিক্ত পানাহার গ্রহণ এবং পরিমাণ মত পানাহার না গ্রহণ- উভয়টিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং রেসূ-ব্যধির কারণ। খাও এবং অপচয় করোনা- এই দু’টি ঐশি কালেমার (শব্দের) মধ্যেই স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি জড়িত।


আল্লাহ্ তা‘আলা এই দু’টি পবিত্র শব্দের মধ্যে স্বাস্থ্য রক্ষার সকল বিষয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আর সুস্বাস্থ্য ও বিপদাপদ মুক্ত থাকা যেহেতু আল্লাহর নিয়ামাত সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি বিরাট নিয়ামাত এবং বান্দার উপর আল্লাহর এক বিশাল অনুদান; বরং এটিই সর্বাধিক বড় নিয়ামাত, তাই আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে এই নিয়ামাতটি দিয়েছেন, তার উচিৎ এটির পরিচর্যা করা এবং একে ক্ষতিকর বিষয় হতে হেফাজত করা। নাবী (ﷺ) বলেন-


نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ


এমন দু’টি নিয়ামত রয়েছে, যাতে অধিকাংশ লোক প্রতারিত হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে সুস্বাস্থ্য আর অপরটি হচ্ছে অবসরতা’’।[2]

তিরমিযী এবং অন্যান্য সুনান গ্রন্থে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নাবী (ﷺ) বলেন- যে ব্যক্তি সুস্থ ও স্বীয় বাসস্থানে নিরাপদ অবস্থায় সকালে ঘুম থেকে উঠল এবং তার কাছে এক দিনের পানাহারও বিদ্যমান রয়েছে, তাকে দুনিয়ার সমস্ত সম্পদই দেয়া হয়েছে।[3] তিরমিযীতে মারফু সূত্রে আরও বর্ণিত হয়েছে,


إِنَّ أَوَّلَ مَا يُسْأَلُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِى الْعَبْدَ مِنَ النَّعِيمِ أَنْ يُقَالَ لَهُ أَلَمْ نُصِحَّ لَكَ جِسْمَكَ وَنُرْوِيكَ مِنَ الْمَاءِ الْبَارِدِ


‘‘কিয়ামতের দিন বান্দাকে সর্বপ্রথম নিয়ামাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে বলবেনঃ আমি কি তোমার শরীর সুস্থ রাখিনি? আমি কি তোমাকে ঠা-া পানি দ্বারা পরিতৃপ্ত করিনি?

এ জন্যই পূর্ব যামানার কোন কোন আলেম বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ


ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ


‘‘এরপর অবশ্যই সেদিন তোমরা নিয়ামাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’’।[4] এর ব্যাখ্যায় বলেছেন- এখানে নিয়ামাত বলতে সুস্বাস্থ্য উদ্দেশ্য। মুসনাদে আহমাদে মারফু সূত্রে বর্ণিত,


سَلُوْا الله اليَقِيْنَ وَالْمُعَافَاةَ فَمَا أُوْتِيَ أَحَدٌ بَعْدَ اليَقِيْنِ خَيْراً مِنَ الْعَافِيَةِ


‘‘তোমরা আল্লাহর কাছে ঈমান ও সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা কর। সুতরাং ঈমানের পর সু-স্বাস্থ্যের চেয়ে অধিক উত্তম আর কোন নিয়ামাত নেই’’।[5] এই হাদীছে দ্বীন ও দুনিয়ার আফিয়াত তথা সুস্থতা ও নিরাপত্তার বিষয়কে এক সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবেও তাই। দুনিয়া ও আখিরাতে ঈমান ও সুস্থতা ব্যতীত কোন বান্দাই সফল হতে পারেনা। একমাত্র পরিচ্ছন্ন ঈমান ও গভীর বিশ্বাসই বান্দার উপর থেকে আখিরাতের শাস্তি দূর করতে পারে। আর দুনিয়াতে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন রেসূ থেকে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে আফিয়াত (সুস্বাস্থ্য) বজায় রাখা।

নাসাঈ শরীফে মারফু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,


سَلُوا الله العَفْوَ وَالعَافِيَةَ والْمُعَافَاةَ فَمَا أُوْتِيَ أَحَدٌ بَعْدَ الْيَقِيْنِ خَيْراً مِنَ الْمُعَافَاةِ


‘‘তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা, সুস্থতা এবং নিরাপত্তা প্রার্থনা কর। কেননা ঈমানের পর সুস্থতার চেয়ে উত্তম নেয়ামত কাউকেই প্রদান করা হয় নি’’।[6] হাদীছে বর্ণিত তিনটি শব্দের দ্বারা তিন রকমের অকল্যাণ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে। ক্ষমা চাওয়া দ্বারা অতীতে কৃতকর্মের অকল্যাণ দূর করা হয়, আফিয়াত তথা সুস্বাস্থ্য চাওয়ার মাধ্যমে বর্তমানের অকল্যাণ হতে বাঁচার আবেদন করা হয়েছে এবং মুআফাত চাওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতের অকল্যাণ হতে বাঁচানোর আবেদন করা হয়েছে।

[1]. সূরা আরাফ-৭:৩১

[2]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুর রিকাক, তাও.হা/৬৪১২, ইফা. ৫৯৭০, আপ্র. ৫৯৬৪, সহীহ আত তিরমিযী, মাপ্র. হা/২৩০৪, মিশকাত, হা/ ৫১৫৫

[3]. তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুয্ যুহ্দ। ইমাম তিরমিযী রহঃ) বলেনঃ এই হাদীসটি মারওয়ান বিন মুআবীয়ার সনদ ব্যতীত অন্য কোন সনদে বর্ণিত হয় নি। তবে হাদীসের শাহেদ থাকার কারণে অর্থাৎ অনুরূপ বিষয় অন্য সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে তা শক্তিশালী হয়েছে। ইমাম আলবানী রহঃ) এ কারণেই হাদীসটিকে হাসান (সহীহ) বলেছেন। সিলসিলাহ সহীহা, হা/২৩১৮।

[4]. সূরা তাকাছুর-১০২:৮

[5]. মুসনাদে আহমাদ এবং ইবনে মাজাহ। ইমাম আলবানী রহঃ) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[6]. ইমাম নাসাঈ হাদীসটিকে দিবারাত্রির আমল নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন শব্দে এবং একই অর্থে হাদীসটি অন্যান্য কিতাবেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আলবানী রহঃ) ও এই অর্থে বর্ণিত একাধিক হাদীছগুলোকে সহীহ বলেছেন। সিলসিলাহ সহীহা, হা/১১৩৮।