মুখতাসার যাদুল মা‘আদ অনুচ্ছেদ সমুহের সূচী ও বিবরন ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)
সলাতে নাবী (সাঃ) এর কিরাআত

ফজরের কিরাআত

ফজরের সলাতে তিনি ষাট থেকে একশ আয়াত পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। তিনি উভয় রাকআতেই সূরা ক্ব-ফ, সূরা রোম, সূরা তাকভীর, সূরা যিলযাল পড়েছেন। তিনি সূরা ফালাক ও সূরা নাস দিয়েও ফজরের সলাত পড়েছেন।

তিনি একদা কোন এক সফরে ছিলেন। তখন তিনি ফজরের সলাতে সূরা মুমিনূন পড়তে শুরু করলেন। প্রথম রাকআতে যখন মুসা এবং হারুনের বর্ণনা আসল অর্থাৎ ৪৪ নং আয়াত পর্যন্ত পড়লেন তখন তাঁর কাশি এসে গেল। তখন তিনি কিরাআত পাঠ বন্ধ করে রুকুতে চলে গেলেন।

জুমআর দিন ফজরের সলাতের প্রথম রাকআতে তিনি আলীফ-লাম-মীম সাজদা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইনসান (সূরা দাহর) তথা هل أتى على الإنسان পাঠ করতেন। কেননা এই সূরা দু’টিতে সৃষ্টির সূচনা, শেষ, আদম সৃষ্টি, মুমিনদের জান্নাতে প্রবেশ ও পাপীদের জাহান্নামে প্রবেশের আলোচনা এবং জুমআর দিনে যা সংঘটিত হয়েছে ও আগামীতে এতে যা কিছু হবে তার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সুতরাং জুমআর দিনের বড় বড় ঘটনাগুলো উম্মাতকে ম্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এই দিনের ফজরের সলাতে সূরা দু’টি পাঠ করতেন। এমনিভাবে তিনি দুই ঈদ এবং জুমআর ন্যায় বড় ধরণের সম্মেলনে সূরা কাফ, সূরা কামার, সূরা আ‘লা এবং গাশিয়া পাঠ করতেন।

যোহরের কিরাআত

যোহরের সলাতে কখনও তিনি লম্বা কিরাআত পাঠ করতেন। আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন- যোহরের সলাতে কিরাআত এত দীর্ঘ করতেন যে, ইকামত শুনে কেউ ইচ্ছা করলে বাকী নামক স্থানে গিয়ে প্রয়োজন সমাধা করে বাড়িতে ফিরে এসে ওযূ করে মসজিদে গিয়ে নাবী (ﷺ) কে প্রথম রাকআতেই পেয়ে যেত।[1] তিনি তাতে কখনও সূরা আলিফ-লাম-মীম সাজদাহ তিলাওয়াত করতেন। কখনও সূরা আলা, কখনও সূরা লাইল এবং কখনও সূরা বুরুজ তিলাওয়াত করতেন।

আসরের কিরাআত

আসরের সলাতের কিরাআত যোহরের সলাতের কিরআতের অর্ধেক পরিমাণ লম্বা করতেন। আসরের লম্বা কিরাআত যোহরের সংক্ষিপ্ত কিরাআতের সমান ছিল।

মাগরিবের কিরাআত

মাগরিবের সলাতের কিরাআতে রসূল (ﷺ) এর সুন্নাত আজ কালের কিরাআতের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। তিনি একবার উভয় রাক‘আতে সূরা আরাফকে দুইভাগ করে পাঠ করেছেন। একবার তিনি এতে সূরা তুর এবং অন্যবার সূরা মুরসালাত পড়েছেন।

মাগরিবের সলাতে সব সময় ছোট সূরা পাঠ করার রীতি উমাইয়া খলীফা মারওয়ান বিন হাকামের যুগ থেকে শুরু হয়েছে। তাই যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ) তার এই কাজের প্রতিবাদ করেছেন। ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) মাগরিবের সলাতে সূরা আলিফ-লাম-মীম সোয়াদ, সাফ্ফাত, দুখান, আলা, তীন, নাস, ফালাক এবং সূরা মুরসালাত পাঠ করেছেন। কখনও তিনি তাতে ছোট ছোট সূরা পড়েছেন। এ সমস্ত বর্ণনার সবগুলোই সহীহ এবং প্রসিদ্ধ।

ইশার কিরাআত

নাবী (ﷺ) ইশার সলাতে সূরা তীন পড়েছেন এবং মুআয (রাঃ) এর জন্য তাতে সূরা শামস্, সূরা আলা, সূরা লাইল এবং অনুরূপ সূরা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সূরা বাকারা দিয়ে মুআয (রাঃ) এর ইশার সলাত পড়ানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে নাবী (ﷺ) বলেছেন- হে মুআয! তুমি কি মানুষকে ফিতনায় ফেলতে চাচ্ছ? যারা সলাতে তাড়াহুড়া করতে পছন্দ করে, তারা রসূল (ﷺ) এর এই বাক্যটি দ্বারা দলীল গ্রহণ করার চেষ্টা করে থাকে। অথচ তারা ঘটনার পূর্বের ও পরের সাথে সংশি­ষ্ট প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি।[2]

জুমআর সলাতের কিরাআত

জুমআর সলাতের প্রথম রাকআতে তিনি কখনও সূরা জুমআ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকুন পড়তেন। আবার কখনও প্রথম রাকআতে সূরা আলা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরাতুল গাশিয়া পাঠ করতেন। কিন্তু নাবী সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম সূরা জুমআ ও মুনাফিকুনের শুধু শেষ আয়াতগুলো দিয়ে কখনও জুমআর সলাত পড়েননি।

দুই ঈদের সলাতের কিরাআত

ঈদের সলাতে কখনও তিনি সূরা কাফ ও কামারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করতেন। কখনও তিনি সূরা আলা ও সূরাতুল গাশিয়া পাঠ করতেন।

এই ছিল সলাতে কিরাআত পাঠের ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত রসূল (ﷺ) এর সুন্নাত। তিনি একেক সময় একেক সূরা দিয়ে সলাত পড়েছেন এবং তাতে কখনও ছোট সূরা আবার কখনও বড় সূরা পাঠ করেছেন। তাঁর পরে খোলাফায়ে রাশেদ্বীনও এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। আবু বকর (রাঃ) একবার ফজরের সলাতে সূরা বাকারা পাঠ করেছেন। এতে তিনি সূর্যোদয়ের একটু পূর্বে সালাম ফিরিয়েছেন। আবু বকরের পরে উমার (রাঃ) ফজরের সলাতে সূরা ইউসুফ, সূরা নাহল, সূরা হুদ, সূরা বানী ইসরাঈল এবং অনুরূপ সূরা পড়েছেন।

রসূল (ﷺ) এর বাণী- ‘‘তোমাদের কেউ যখন সলাতে মানুষের ইমামতি করবে তখন সে যেন সংক্ষিপ্ত সলাত পড়ে’’। এ ব্যাপারে জেনে রাখা দরকার যে, রসূল (ﷺ) কর্তৃক সলাত সংক্ষিপ্ত করার বিষয়টি ছিল আপেক্ষিক। অর্থাৎ তিনি সংক্ষিপ্ত করে যে সমস্ত সলাত পড়েছেন বলে বর্ণিত হয়েছে, সে ব্যাপারে কথা হচ্ছে, তাঁর সংক্ষিপ্ত সলাতসমূহ তাঁর দীর্ঘ সলাতগুলোর তুলনায় অধিক সংক্ষিপ্ত ছিল।

এমনটি নয় যে তিনি সব সময় সংক্ষিপ্ত করে সলাত পড়েছেন। দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত করার সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে রসূল (ﷺ) এর আমলের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, মুক্তাদীগণের দাবী অনুযায়ী কিরাআত ও সলাত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত করা যাবেনা। রসূল (ﷺ) তাঁর যে সুন্নাত ও তরীকা সব সময় অবলম্বন করেছেন, মতভেদপূর্ণ প্রত্যেক বিষয়ে তাই হবে ফয়সালাকারী। জুমআ ও দুই ঈদের সলাত ব্যতীত অন্যান্য সকল সলাতে তিনি এভাবে সূরা নির্দিষ্ট করে দেন নি যে, তা ছাড়া অন্যটি পড়া যাবে না।

[1]. মুসলিম, অধ্যায়- যোহর ও আসরের সলাতের কিরাআত।


[2]. প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, মুআয (রাঃ) নাবী সাঃ) এর সাথে ইশার সলাত পড়তেন। তারপর তিনি তাঁর মহল্লায় গিয়ে উক্ত সলাতের ইমামতি করতেন। একবার তিনি রসূল সাঃ) এর সাথে ইশার সলাত পড়েও কিছুক্ষণ দেরী করলেন। ঐ দিকে তাঁর মহল্লার লোকেরা তাঁর পিছনে ইশার সলাত পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। তিনি বিলম্বে ফিরে এসে সেদিন সূরা বাকারা শুরু করে দিলেন। একজন মুসল্লি দীর্ঘ কিরাআতে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পিছনে গিয়ে একা সলাত পড়ে চলে গেল। এতে মুআয (রাঃ) বললেন- অমুক মুনাফেক হয়ে গেছে। লোকেরা বিষয়টি নাবী সাঃ) এর কাছে পেশ করলে তিনি মুআযকে বললেনঃ হে মুআয! তুমি কি মানুষকে ফিতনায় ফেলতে চাচ্ছ? (বুখারী)

মুআয (রাঃ)এর মহল্লার লোকেরা যেহেতু তাঁর পিছনে ইশার সলাত পড়ার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতেন, তাই তার জন্য বেশী দীর্ঘ কিরাআত শুরু করা উচিত হয় নি। এ কারণেই নাবী সাঃ) মুআযের কাজকে অপছন্দ করেছেন।