লগইন করুন
পত্নী পুরুষের সহধর্মিনী, অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানদাত্রী, জীবন-সঙ্গিনী, গৃহের গৃহিণী, সন্তানের জননী, হৃদয়ের শান্তিদায়িনী, রহস্য রক্ষাকারিণী, তার সুখী সংসারের প্রধান সদস্যা। সুতরাং এমন সাথী নির্বাচনে পুরুষকে সত্যই ভাবতে হয়, বুঝতে হয়। শুধুমাত্র প্রেম, উচ্ছৃঙ্খলতা ও আবেগে নয়; বরং বিবেক ও দিমাগে সে বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হয়।
সাধারণতঃ মানুষ তার ভাবী-সঙ্গিনীর প্রভাব-প্রতিপত্তি, মান-যশ-খ্যাতি, ধন-সম্পদ, কুলীন বংশ, মনোলোভা রূপ-সৌন্দর্য প্রভৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে তার জীবন-সঙ্গ লাভ করতে চায়; অথচ তার আধ্যাত্মিক ও গুণের দিকটা গৌণ মনে করে। যার ফলে দাম্পত্যের চাকা অনেক সময় অচল হয়ে রয়ে যায় অথবা সংসার হয়ে উঠে তিক্তময়। কিন্তু জ্ঞানী পুরুষ অবশ্যই খেয়াল রাখে যে,
‘‘দেখিতে পলাশ ফুল অতি মনোহর,
গন্ধ বিনে তারে সবে করে অনাদর।
যে ফুলের সৌরভ নাই, কিসের সে ফুল?
কদাচ তাহার প্রেমে মজেনা বুলবুল।
গুণীর গুণ চিরকাল বিরাজিত রয়,
তুচ্ছ রূপ দুই দিনে ধূলিসাৎ হয়।’’
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,
تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاكَ.
‘‘রমণীকে তার অর্থ, আভিজাত্য, রূপ-সৌন্দর্য ও দ্বীন-ধর্ম দেখে বিবাহ করা হয়। কিন্তু তুমি দ্বীনদারকে পেয়ে কৃতকার্য হও। তোমার হস্ত ধূলিধূসরিত হোক।’’[1]
তিনি আরো বলেন,
ليَتَّخذَ أحَدُكُمْ قَلْباً شَاكِراً وَلِسَاناً ذَاكراً وَزَوْجَةً صَالِحَةً تُعينُهُ عَلَى أَمرِ الآخِرَة.
‘‘তোমাদের প্রত্যেকের শুক্রকারী অন্তর ও যিক্রকারী জিহ্বা হওয়া উচিৎ। আর এমন মুমিন স্ত্রী গ্রহণ করা উচিৎ; যে তার আখেরাতের কাজে সহায়তা করবে।’’[2]
সুতরাং এমন পাত্রী পছন্দ করা উচিৎ, যে হবে পুণ্যময়ী, সুশীলা, সচ্চরিত্রা, দ্বীনদার, পর্দানশীন; যাকে দেখলে মন খুশীতে ভরে ওঠে, যাকে আদেশ করলে সত্বর পালন করে, স্বামী বাইরে গেলে নিজের দেহ, সৌন্দর্য ও ইজ্জতের এবং স্বামীর ধন-সম্পদের যথার্থ রক্ষণা-বেক্ষণা করে।[3]
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ﴾
‘‘সুতরাং সাধবী নারী তো তারা, যারা (তাদের স্বামীদের অনুপস্থিতিতে ও লোক চক্ষুর অন্তরালে) অনুগতা এবং নিজেদের ইজ্জত রক্ষাকারিণী; আল্লাহর হিফাযতে (তওফীকে) তারা তা হিফাযত করে।’’[4]
এরপর দেখা উচিৎ, ভাবী-সঙ্গিনীর পরিবেশ। শান্ত প্রকৃতির মেজাজ, মানসিক সুস্থতা ইত্যাদি; যাতে সংসার হয় প্রশান্তিময়। জবালাময়তা থেকে দূর হয় বাক্যালাপ, লেন-দেন ও সকল ব্যবহার।
বিবাহের একটি মহান উদ্দেশ্য হল সন্তান গ্রহণ । এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে স্ত্রী নির্বাচন বাঞ্ছনীয়। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,
تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمْ الْأُمَمَ.
‘‘অধিক প্রেমময়ী, অধিক সন্তানদাত্রী রমণী বিবাহ কর। কারণ, আমি তোমাদেরকে নিয়ে কিয়ামতে অন্যান্য উম্মতের সামনে (সংখ্যাধিক্যের ফলে) গর্ব করব।’’[5]
অতঃপর সাথীর রূপ-সৌন্দর্য তো মানুষের প্রকৃতিগত বাঞ্ছিত বাসনা। যেহেতু স্ত্রী সুন্দরী হলে মনের প্রশান্তি ও আনন্দ অধিক হয়। অন্যান্য রমণীর প্রতি কখনই মন ছুটে না। পরন্তু ‘‘আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।’’[6]
অনেক যুবক আছে যারা ভুল করে মহিলার চেহারাকে বিবাহ করে, কিন্তু সংসার করে তার সবকিছু নিয়ে! ফলে অশান্তি দেখা দেয় সংসারে।
অতঃপর দেখার বিষয় সঙ্গিনীর কৌমার্য। কুমারীর নিকট যে সুখ আছে অকুমারীর নিকট তা নেই। এটা তো মানুষের প্রকৃতিগত পছন্দ। যেহেতু ভালোবাসার প্রথম উপহার তার নিকট পেলে দাম্পত্যে পূর্ণ পরিতৃপ্তি আসে। নচেৎ যদি তার মনে ভালোবাসার নিক্তি পূর্ব ও বর্তমান স্বামীর প্রেম ওজন করতে শুরু করে, তবে সেই তুলনায় তার হৃদয় কখনো পূর্ব স্বামীর দিকে ঝুঁকে বর্তমান স্বামীকে তুচ্ছজ্ঞান করে। আবার কখনো নিজের ভাগ্যের এই পরিবর্তনকে বড় দুর্ভাগ্য মনে ক’রে ভালোবাসার ডালি খালি ক’রে রসহীন সংসার করে বর্তমান স্বামীর দেহপাশে। কিন্তু মন থাকে সেই মৃত অথবা সেই তালাকদাতা স্বামীর নিকট। ফলে দাম্পত্য জীবন মধুর হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। অবশ্য বর্তমান স্বামী পূর্ব স্বামী হতে সর্ববিষয়ে উত্তম হলে সে কথা ভিন্ন। পরন্তু প্রকৃত দাম্পত্য-সুখ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে প্রিয় নবী (ﷺ) এক সাহাবীকে কুমারী নারী বিবাহ করতে উদ্বুদ্ধ করে বলেছিলেন,
أَفَلاَ تَزَوَّجْتَ بِكْرًا تُلاَعِبُكَ وَتُلاَعِبُهَا.
‘‘কেন কুমারী বিবাহ করলে না? সে তোমাকে নিয়ে এবং তুমি তাকে নিয়ে প্রেমকেলি করতে।’’[7]
অন্যত্র তিনি বলেন,
عَلَيْكُمْ بِالأَبْكَارِ فَإِنَّهُنَّ أَعْذَبُ أَفْوَاهًا وَأَنْتَقُ أَرْحَامًا (وأسخًنُ أقبالاً، وأقَلُّ خباً) وَأَرْضَى بِالْيَسِيرِ.
‘‘তোমরা কুমারী বিবাহ কর। কারণ কুমারীদের মুখ অধিক মিষ্টি, তাদের গর্ভাশয় অধিক সন্তানধারী, তাদের যোনীপথ অধিক উষ্ণ, তারা ছলনায় কম হয় এবং সবল্পে অধিক সন্তুষ্ট থাকে।’’[8]
উর্বর জমিতে যে ফসলের বীজ সর্বপ্রথম রোপিত হয় সেই ফসলই ফলনে অধিক ও উত্তম হয়। ফসল তুলে সেই জমিতেই অন্য ফসল রোপন করলে আর সেই সোনার ফসল ফলে না। অনুরূপ ভালোবাসার বীজও।
অবশ্য যার সংসারে পাক্কা গৃহিণীর প্রয়োজন, যে তার ছোট ছোট ভাই-বোন ইত্যাদির সঠিক প্রতিপালন চায়, তাকে অকুমারী বিধবা বিবাহ করাই উচিৎ।[9]
পরন্তু যদি কেউ কোন বিধবা বা পরিত্যক্তার প্রতি এবং তার সন্তান-সন্ততির প্রতি সদয় হয়ে তাকে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ ক’রে তার দুর্দিন দূর ক’রে সুদিন আনে, তবে নিশ্চয় সে ব্যক্তি অধিক সওয়াবের অধিকারী।[10]
সর্বদিক দিয়ে নিজের মান যেমন, ঠিক সেই সমপর্যায় মান ও পরিবেশের পাত্রী পছন্দ করা উচিৎ। এতে কেউ কারোর উপর গর্ব প্রকাশ না করতে পেরে কথার আঘাতে প্রেমের গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে না। পজিশন, শিক্ষা, সভ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, বংশ প্রভৃতি উভয়ের সমান হলে সেটাই উত্তম। যেমন উভয়ের বয়সের মধ্যে বেশী তারতম্য থাকা উচিৎ নয়। নচেৎ ভবিষ্যতে বিভিন্ন জোয়ার-ভাটা দেখা দিতে পারে।
উপর্যুক্ত সর্বপ্রকার গুণ ও পজিশনের পাত্রী পেলেই সোনায় সোহাগা। এমন দাম্পত্য হবে চিরসুখের এবং এমন স্বামী হবে বড় সৌভাগ্যবান। পক্ষান্তরে কিছু না পেলেও যদি দ্বীন পায়, তবে তাও তার সৌভাগ্যের কারণ অবশ্যই।
সুতরাং বউ ও জামাই পছন্দের কষ্টিপাথর একমাত্র দ্বীন ও চরিত্র। বংশের উচ্চ-নীচতা কিছু নেই। যেহেতু মানুষ সকলেই সমান। সকল মুসলিম ভাই-ভাই। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوباً وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ﴾
‘‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে; যাতে তোমরা এক অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে ব্যক্তি অধিক সংযমী (মুত্তাকী ও পরহেযগার)।’’[11]
তাছাড়া ‘ভালো-মন্দ কোন গোষ্ঠী-বর্ণের মধ্যে নির্দিষ্ট নয়। প্রত্যেক বস্ত্তর উত্তম, মধ্যম ও অধম আছে।’ আর ‘কাকের ডিম সাদা হয়, পন্ডিতের ছেলে গাধাও হয়।’ সুতরাং বিবেচ্য হল, যে মানুষকে নিয়ে আমার দরকার কেবল তারই চরিত্র ও ব্যবহার। অবশ্য পারিপাশির্বক অবস্থা দেখাও দরকার নিশ্চয়ই। কারণ, তাতেও কুপ্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে।
অতএব বর-কনে নির্বাচনের সময়ঃ
১। পাত্র বা পাত্রী কোন্ স্কুলে পড়েছে জানার আগে কোন্ পরিবেশে মানুষ হয়েছে--তা জানার চেষ্টা করুন। কারণ, অনেক সময় বংশ খারাপ হলেও পরিবেশ-গুণে মানুষ সুন্দর ও চরিত্রবান হয়ে গড়ে উঠে।
২। পাত্র বা পাত্রীর চরিত্র দেখার আগে তার বাপ-মায়ের চরিত্রও বিচার্য। কারণ, সাধারণতঃ ‘আটা গুণে রুটি আর মা গুণে বেটি’ এবং ‘দুধ গুণে ঘি ও মা গুণে ঝি’ হয়ে থাকে। আর ‘বাপকা বেটা সিপাহি কা ঘোড়া, কুছ না হো তো থোড়া থোড়া।’
৩। বিবাহ একটি সহাবস্থান কোম্পানী প্রতিষ্ঠাকরণের নাম। সুতরাং এমন সঙ্গী নির্বাচন করা উচিৎ যাতে উভয়ের পানাহার প্রকৃতি ও চরিত্রে মিল খায়। নচেৎ অচলাবস্থার আশঙ্কাই বেশী।[12]
অবশ্য কারো বাহ্যিক দ্বীনদারী দেখেও ধোঁকা খাওয়া উচিৎ নয়। কারণ, সকাল ৭ টায় কাউকে নামায পড়তে দেখলেই যে সে চাশ্তের নামায পড়ে--সে ধারণা ভুলও হতে পারে। কেননা, হতে পারে সে চাশ্তের নয়, বরং ফজরের কাযা আদায় করছিল।
অনুরূপ কারো বাপের দ্বীনদারীর মতো কথা শুনে অথবা কেবল কারো ভাইয়ের বা বুনায়ের দ্বীনদারীর কথা শুনে তার দ্বীনদারী হওয়াতে নিশ্চিত হয়ে ধোঁকা খাওয়াও অনুচিত। খোদ পাত্র বা পাত্রী কেমন তা সর্বপ্রথম ও শেষ বিচার্য।
অনুরূপ মাল-ধন আছে কি না, কিছু পাব কি না পাব---তাও বিচার্য নয়। কারণ, তা তো আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। আবার আজ না থাকলে কাল এসে যেতেও পারে। আমি যেমন ঠিক তেমনি ঘরে বিবাহ করা বা দেওয়াই উচিৎ। বিশেষ করে ঘুষ (মোটা টাকা পণ) দিয়ে বড় ঘরে ঢুকতে যাওয়া ঠিক নয়।
জ্ঞানীরা বলেন, ‘তোমার চেয়ে যে নীচে তার সঙ্গ গ্রহণ করো না। কারণ, হয়তো তুমি তার মূর্খতায় কষ্ট পাবে এবং তোমার চেয়ে যে উচেচ তারও সাথী হয়ো না। কারণ, সম্ভবতঃ সে তোমার উপর গর্ব ও অহংকার প্রকাশ করবে। তুমি যেমন ঠিক তেমন সমমানের বন্ধু, সঙ্গী ও জীবন-সঙ্গিনী গ্রহণ করো, তাতে তোমার মন কোন প্রকার ব্যথিত হবে না।’
হাতি-ওয়ালার সাথে বন্ধুত্ব করলে হাতি রাখার মত ঘর নিজেকে বানাতে হবে। নতুবা ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণে চাঁদ।’
এ কথা ভাবা যায় যে, বড় বাড়িতে মেয়ে পড়লে তার খেতে-পরতে কোন কষ্ট হবে না; সুখে থাকবে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কোথায়? ‘বড় গাছের তলায় বাস, ডাল ভাঙ্গলেই সর্বনাশ।’
মেয়ের অভিভাবকের উচিৎ, মেয়ের রুচি ও পছন্দের খেয়াল রাখা। অবশ্য তার হাতে ডোর ছেড়ে দেওয়া উচিৎ নয়। পরন্তু দ্বীনের ডোর কোন সময়ই ছাড়ার নয়। কারণ, সাধারণতঃ মেয়েদের কল্পনায় থাকে,
‘রসের নাগর, রূপের সাগর, যদি ধন পাই,
আদর ক’রে করি তারে বাপের জামাই।’
বাস্! এই হল ভোগবাদিনী ও পরলোক সম্বন্ধে অন্ধ নারীদের আশা। এরা কেবল বাহ্যিক দৃষ্টির সৌন্দর্য পছন্দ ও কামনা করে; কিন্তু অন্তর্দৃষ্টির সৌন্দর্য অপ্রয়োজনীয় ভাবে! তারা জানে না যে, কুৎসিত মনের থেকে কুৎসিত মুখ অনেক ভালো।
অতএব এ কাজে অভিভাবককে তার মেয়ের সহায়ক হওয়া একান্ত ফরয। তাই তো মেয়ের বিবাহে অভিভাবক থাকার শর্তারোপ করা হয়েছে।
আবু অদাআহ বলেন, আমি সাঈদ বিন মুসাইয়েবের দর্সে বসতাম। কিছু দিন তিনি আমাকে দেখতে না পেয়ে যখন আমি তাঁর নিকট এলাম, তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি ছিলে কোথায়?’ আমি বললাম, ‘আমার স্ত্রী মারা গেল; সেই নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত ছিলাম।’ তিনি বললেন, ‘আমাদেরকে খবর দাওনি কেন? তার জানাযা পড়তাম।’ তারপর উঠে চলে আসার ইচ্ছা করলে তিনি আমাকে বললেন, ‘দ্বিতীয় বিবাহ করলে না কেন?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ আপনাকে রহম করুন! কে আমাকে মেয়ে দেবে? আমি তো দুই কি তিন দিরহামের মালিক মাত্র।’ তিনি বললেন, ‘যদি আমি দিই, তবে তুমি করবে কি?’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ।’
সঙ্গে সঙ্গে খোৎবা পাঠ করে ২ কি ৩ দিরহাম মোহরের বিনিময়ে তাঁর মেয়ের সাথে আমার বিবাহ পড়িয়ে দিলেন। তারপর আমি উঠে এলাম। তখন খুশীতে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ঘরে এসে লাগলাম চিন্তা করতে; ঋণ করতে হবে, কার নিকট করি? মাগরিবের নামায পড়লাম। রোযায় ছিলাম সেদিন। ইফতার ক’রে রাতের খানা খেলাম। খানা ছিল রুটি ও তেল। ইত্যবসরে কে দরজায় আঘাত করল। আমি বললাম, ‘কে?’ আগন্তুক বলল, ‘আমি সাঈদ।’ ভাবলাম, তিনি কি সাঈদ বিন মুসাইয়েব? তাঁকে তো চল্লিশ বছর যাবৎ ঘর থেকে মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও যেতে দেখা যায়নি। উঠে দরজা খুলতেই দেখি উনিই। ধারণা করলাম, হয়তো বা মত পরিবর্তন হয়েছে। আমি বললাম, ‘আবু মুহাম্মাদ! আপনি নিজে এলেন! আমাকে ডেকে পাঠাতে পারতেন? আমি আপনার নিকট আসতাম।’ তিনি বললেন, ‘না। এর হকদার তুমি।’ আমি বললাম, ‘আদেশ করুন।’ তিনি বললেন, ‘ভাবলাম, বিপত্নীক পুরুষ তুমি; অথচ তোমার বিবাহ হল। তাই তুমি একাকী রাত কাটাও এটা অপছন্দ করলাম। এই নাও তোমার স্ত্রী!’
দেখলাম, সে তাঁর সোজাসুজি পশ্চাতে সলজ্জ দন্ডায়মানা। অতঃপর তিনি তাকে দরজা পার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে প্রস্থান করলেন। লজ্জায় সে যেন দরজার সাথে মিশে গেল। আমি বাড়ির ছাদে চড়ে প্রতিবেশীর সকলকে হাঁক দিলাম। সকলেই বলল, ‘কি ব্যাপার?’ আমি বললাম, ‘সাঈদ তাঁর মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহ দিয়েছেন। হঠাৎ করে তিনি তাঁর মেয়েকে আমার ঘরে দিয়ে গেলেন। ঐ ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
সকল মহিলা তাকে দেখতে এল।
আমার মায়ের কাছে খবর গেলে তিনি এসে বললেন, ‘তিন দিন না সাজানো পর্যন্ত যদি তুমি ওকে স্পর্শ করো, তবে আমার চেহারা দেখা তোমার জন্য হারাম।’ অতএব তিন দিন অপেক্ষার পর তার সাথে বাসর-শয্যায় মিলিত হলাম। দেখলাম সে অন্যতমা সুন্দরী, কুরআনের হাফেয, আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সুন্নাহ বিষয়ে সুবিজ্ঞা এবং স্বামীর অধিকার বিষয়ে সবজান্তা।
এরপর একমাস ওস্তাদ সাঈদের নিকট আমার যাওয়া-আসা ছিল না। অতঃপর একদিন তাঁর মসজিদে গিয়ে সালাম দিলে তিনি উত্তর দিলেন। কিন্তু কোন কথা বললেন না। তৎপর সমস্ত লোক যখন মসজিদ থেকে বের হয়ে গেল, তখন একা পেয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। ‘ঐ লোকটার খবর কি?’ আমি বললাম, ‘তার খবর এমন; যা বন্ধুতে পছন্দ আর শত্রুতে অপছন্দ করবে।’ তিনি বললেন, ‘যদি তার কোন বিষয় তোমাকে সন্দিহান করে, তবে লাঠি ব্যবহার করো।’ অতঃপর বাড়ি ফিরে এলাম।
সাঈদের মেয়ে; যাকে খলীফা আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান তাঁর ছেলে অলীদের জন্য পয়গাম দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজপরিবারে মেয়ের বিবাহ দিতে অস্বীকার করেছিলেন। অবশেষে পছন্দ করলেন এক দ্বীনদার গরীবকে![13]
মুবারক আবু আব্দুল্লাহর ব্যাপারে কথিত আছে যে, তিনি তাঁর প্রভু (মনীব) এর বাগানে কাজ করতেন। তাঁর প্রভু বাগান-মালিক হামাযানের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। একদিন বাগানে এসে দাসকে বললেন, ‘মুবারক! একটি মিষ্টি বেদানা চাই।’
মুবারক গাছ হতে খুঁজে খুঁজে একটি বেদানা প্রভুর হাতে দিলেন। প্রভু তো ভেঙ্গে খেতেই চটে উঠলেন। বললেন, ‘তোমাকে মিষ্টি দেখে আনতে বললাম, অথচ টক বেছেই নিয়ে এলে? মিষ্টি দেখে নিয়ে এস।’
মুবারক অন্য একটি গাছ থেকে আর একটি বেদানা এনে দিলে তিনি খেয়ে দেখলেন সেটাও টক। রেগে তৃতীয়বার পাঠালে একই অবস্থা। প্রভু বললেন, ‘আরে তুমি টক আর মিষ্টি বেদানা কাকে বলে চেন না?’ বললেন, ‘জী না। আপনার অনুমতি না পেয়ে কি করে খেতাম?’
দাসের এই আমানতদারী ও সততা দেখে প্রভু অবাক হলেন। তাঁর চোখে তাঁর কদর ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেল।
প্রভুর ছিল এক সুন্দরী কন্যা। বহু বড় বড় পরিবার থেকেই তার বিয়ের সম্বন্ধ আসছিল। একদা প্রভু মুবারককে ডেকে বললেন, ‘আমার মেয়ের সাথে কেমন লোকের বিয়ে হওয়া উচিৎ বল তো?’ মুবারক বললেন, ‘জাহেলিয়াত যুগের লোকেরা বংশ ও কুলমান দেখে বিয়ে দিত, ইয়াহুদীরা দেয় ধন দেখে, খ্রীষ্টানরা দেয় রূপ-সৌন্দর্য দেখে। কিন্তু এই উম্মত কেবল দ্বীন দেখেই বিয়ে দিয়ে থাকে।’
এ ধরনের জ্ঞানগর্ভ কথা প্রভুর বড় পছন্দ হল। মুবারকের কথা প্রভু তাঁর স্ত্রীর নিকট উল্লেখ করে বললেন, ‘আমি তো মেয়ের জন্য মুবারকের চেয়ে অধিক উপযুক্ত পাত্র আর কাউকে মনে করি না।’
হয়েও গেল বিবাহ। পিতা উভয়কে প্রচুর অর্থ দিয়ে তাঁদের দাম্পত্যে সাহায্য করলেন। এই সেই দম্পতি যাঁদের ঔরসে জন্ম নিয়েছিলেন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, যাহেদ, বীর মুজাহিদ আব্দুল্লাহ বিন মুবারক।[14]
এই ছিল মেয়ের বাবাদের তাদের মেয়েদের আখেরাত বানানোর প্রতি খেয়াল রেখে পাত্র পছন্দ করার পদ্ধতি। দুনিয়াদারীর প্রতি খেয়াল রেখে নয়।
এক ব্যক্তি হাসান বাসরী (রঃ) কে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার একটি মেয়ে আছে। বহু জায়গা হতে তার বিয়ের কথা আসছে। কাকে দেব বলতে পারেন?’
হাসান বললেন, ‘সেই পুরুষ দেখে মেয়ে দাও; যে আল্লাহকে ভয় করে (যে পরহেযগার)। এতে যদি সে তাকে ভালোবাসে, তাহলে তার যথার্থ কদর করবে। আর ভালো না বাসলে সে তার উপর অত্যাচার করবে না।’[15]
শুধু অভিভাবকই নয় বরং খোদ মেয়েদেরকেও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিৎ।
আবূ তালহা তখন ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি উম্মে সুলাইমকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে উম্মে সুলাইম বললেন, ‘আপনার মত যুবক স্বামী হওয়ার যোগ্য; রদ্যোগ্য নন। কিন্তু আপনি তো কাফের। আর আমি হলাম একজন মুসলিম নারী। তাই আমাদের মধ্যে বিবাহ শুদ্ধ নয়।’ আবূ তালহা ধন-দৌলতের লোভ দেখিয়ে বললেন, ‘তুমি কি সোনা-চাঁদি ও অর্থ পেয়ে খুশী হতে পারবে না?’
উম্মে সুলাইম বললেন, ‘আমি সোনা চাঁদি কিছুই চাই না। কিন্তু আপনি এমন মানুষ; যে শুনতে পায় না, দেখতে পায় না এবং কোন উপকার করতে পারে না এমন কোন হাবশী দাসের গড়া কাঠের (মূর্তি) পূজা করেন। এতে কি আপনার বিবেকে বাধে না? শুনুন, যদি আপনি মুসলমান হন, তাহলে আমি আপনাকে বিয়ে করব। আর ইসলাম হবে আমার মোহর! এ ছাড়া অন্য কিছু আমি মোহররূপে চাই না!’ [16]
উল্লেখ্য যে, আমার এক ছাত্রী মুখ খুলে কয়েকটি বিবাহ প্রস্তাব রদ্ করলে তাকে রাজী করাবার জন্য তার অভিভাবক আমাকে দায়িত্ব দেন। রদের কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে আদবের সাথে জানাল। ‘জী, ওরা মাযার পূজা করে।’ অন্য এক প্রস্তাবের জবাবে বলল, ‘আমি শুনেছি ওদের বাড়িতে টি-ভি আছে। আমার ভয় হয় যে, আমি খারাপ হয়ে যাব?!’
এরূপ দ্বীনদারী জবাব শুনে আমি অবাক না হয়ে এবং তাকে শত ধন্যবাদ ও দুআ না দিয়ে পারিনি।
সঊদী আরবের আল-মাজমাআহ শহরে এককালে আমি বিবাহ রেজিষ্ট্রীর মুহরী (লেখক) ছিলাম। এক বিবাহ মজলিসে পাত্রীর শর্ত লিখার সময় ১ম শর্ত ছিল, সে কলেজের অধ্যয়ন শেষ করবে। ২য় শর্ত ছিল, পাত্র সিগারেট খায়, তাকে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে!
উক্ত শর্ত পালনে বর সম্মত কি না, তা জানতে তাকে প্রশ্ন করা হলে সে বলল, ‘ছাড়ার চেষ্টা করব।’ কনের কাছে তা বলা হলে সে বলল, ‘চেষ্টা নয়; শর্তে লিখুন, আজ থেকেই ছাড়বে এবং যেদিন সে পুনরায় সিগারেট খাবে সেদিন আমার এক তালাক বলে গণ্য হবে!’
মজলিসে যে বাহবা ও দুআর শোর উঠেছিল তা বলাই বাহুল্য। পরিশেষে এই শর্তে বর স্বাক্ষর করেছিল। আমি নিজ হাতে সেই শর্ত লিখেছিলাম। আজ সমাজে দরকার আছে এমন গুণবতী কন্যার।
কিন্তু হায়! নারীর মূল্যমান কমে যাওয়ার ফলে এবং পণের চাপের মুখে বহু গুণবতী কনে অমত সত্ত্বেও অযোগ্য পাত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। করলে হয়তো অভিভাবকদের কথার জবালা সহ্য করাই দায় হয়ে উঠবে। পক্ষান্তরে পাত্রের দাড়ি আছে বলে অথবা মেলা-খেলায় নিয়ে যাবে না বলে পাত্র রদ্ করলে তখন অভিভাবকের কোন অসুবিধা হয় না। বরং ‘এখন ছোট মেয়ে, শক-আহ্লাদ থাকতে হবে বৈ কি’---বলে দ্বীনদার পাত্র ফিরিয়ে দিতে এতটুকু লজ্জাবোধ হয় না। অথচ দাবী করে, ‘তারা নাকি মুসলমান!’
সুতরাং দ্বীনদারী ও চরিত্র ব্যতীত আভিজাত্য, নাম করা বংশ, যশ, সম্পদ, পদ প্রভৃতি বিবেচনা করে বিবাহ দিলে বা করলে দাম্পত্য-সুখের সুনিশ্চিত আশা করা যায় না। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,
إِذَا أَتَاكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ، إِلا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الأَرْضِ وَفَسَادٌ عَرِيضٌ.
‘‘তোমাদের নিকট যখন এমন ব্যক্তি (বিবাহের পয়গাম নিয়ে) আসে; যার দ্বীন ও চরিত্রে তোমরা মুগ্ধ তখন তার সাথে (মেয়ের) বিবাহ দাও। যদি তা না কর তাহলে পৃথিবীতে ফিৎনা ও মহাফাসাদ সৃষ্টি হয়ে যাবে।’’[17]
তিনি আরো বলেন,
مَنْ أَعْطَى لِلَّهِ تَعَالَى وَمَنَعَ لِلَّهِ تَعَالَى وَأَحَبَّ لِلَّهِ تَعَالَى وَأَبْغَضَ لِلَّهِ تَعَالَى وَأَنْكَحَ لِلَّهِ تَعَالَى فَقَدْ اسْتَكْمَلَ إِيمَانَهُ.
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে কিছু দান করে, কিছু দেওয়া হতে বিরত থাকে, কাউকে ভালোবাসে অথবা ঘৃণাবাসে এবং তাঁরই সন্তুষ্টিলাভের কথা খেয়াল করে বিবাহ দেয়, তার ঈমান পূর্ণাঙ্গ ঈমান।’’[18]
অতএব দ্বীন ও চরিত্রেই পাত্র-পাত্রীর সমতা জরুরী। কারণ, সকল প্রকার বর্ণ-বৈষম্য, বন্ধন ও উচ্চতা-নিচুতার প্রাচীর চুরমার করে দেয় দ্বীন ও তাকওয়া।
কোন দ্বীনদার পর্দা-প্রেমী পাত্র-পাত্রীর জন্য ফাসেক বেপর্দা-প্রেমী পাত্র-পাত্রী হতে পারে না। কোন তেŠহীদবাদী পাত্র-পাত্রীর জন্য কোন বিদআতী বা মাযারী পাত্র-পাত্রী হতে পারে না। মিঠাপানির মাছের সাথে অনুরূপ মাছের বিবাহ শোভনীয় এবং নোনাপানির মাছের সাথে অনুরূপ মাছের বিবাহই মানানসই। নতুবা মিঠা পানির মাছের নোনা পানিতে এসে এবং নোনা পানির মাছের মিঠা পানিতে এসে বাস করা কঠিনই হবে। আর মানানসই তখনই হয়; যখন ‘য্যায়সন কা ত্যায়সন শুকটি কা ব্যায়গন’-এর ঘর পড়ে। এতে স্বামী-স্ত্রীর মান-অপমানের ব্যাপারটা সমান পর্যায়ে থাকে। নচেৎ এই অসমতার কারণেই কারো স্ত্রী প্রভু হয় অথবা দাসী। পক্ষান্তরে সমতার স্ত্রী হয় বন্ধু। গেঁয়ো পাত্র-পাত্রীর পক্ষে শহুরে, শিক্ষিতের পক্ষে অশিক্ষিত, দরিদ্রের পক্ষে ধনী পাত্র-পাত্রী খুব কমই সুখ আনতে পারে।
তদনুরূপ বেপর্দা পরিবেশের পাত্রী পর্দা পরিবেশে এলে তার দম বন্ধ হয়ে যায়! কারণ, জঙ্গলের পাখীকে সোনার খাঁচা দিলেও তার মন পড়ে থাকে জঙ্গলে। কেননা, সে পর্দার পরিবেশকে খাঁচাই মনে করে! তাই সে নিজেও এমন পরিবেশে শান্তি পায় না এবং ঈর্ষাবান স্বামীও তাকে নিয়ে অশান্তি ভোগ করে। বন থেকে বাঘ তুলে এনে তার যতই তরবিয়ত দেওয়া হোক এবং পোষ মানানো যাক না কেন, তবুও তার মন থেকে কিন্তু বন তুলে ফেলা যায় না। তাই সে সদা ফাঁক খোঁজে, ফাঁকি দিতে চেষ্টা করে; এমনকি ধোঁকাও দিয়ে বসে অনেক সময়।
অবশ্য এসব কিছু হয় দ্বীনদারী তরবিয়ত ঢিলে হওয়ার ফলেই। দ্বীন ও তাকওয়া থাকলে স্বামী-স্ত্রী কারোই অসুবিধা হয় না।
একটা বিষয় খেয়াল রাখার যে, কোন পাত্র বা পাত্রী সম্পর্কে জানতে তার দ্বীন বিষয়ে প্রথমে প্রশ্ন করা উচিৎ নয়। নচেৎ এরপর সৌন্দর্যাদি পছন্দ না হয়ে তাকে রদ্ করলে দ্বীনদার রদ্ করা হয় এবং তাতে মহানবী (ﷺ) এর বিরোধিতা হয়। অতএব কর্তৃপক্ষের উচিৎ যে, অন্যান্য বিষয়ে প্রথমে পছন্দ হয়ে শেষে দ্বীন বিষয়ে প্রশ্ন (অবশ্যই) করে দ্বীন থাকলে গ্রহণ করবে, নতুবা রদ্ করে দেবে; যখন শরীয়তের বিপরীত চলা হতে বেঁচে যাবে। কথায় বলে, ‘আগে দর্শন ধারি, শেষে গুণ বিচারি।’
প্রকাশ যে, পাত্রী পছন্দের জন্য জোড়া-ভ্রূ, কুপগাল ইত্যাদি শুভ-অশুভের কিছু লক্ষণ নয়।
পাত্র বা পাত্রপক্ষ পারিপাশির্বক অবস্থা, পরিবেশ ইত্যাদি দেখে ও জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন পাত্রী পছন্দ হলে তার অভিভাবককে বিবাহের প্রস্তাব দেবে। তবে তার পূর্বে দেখা উচিৎ যে, সেই পাত্রী এই পাত্রের জন্য গম্যা কি না। অগম্যা বা অবৈধ হলে তাকে বিবাহ প্রস্তাব দেওয়া হারাম।
অনুরূপ যদি তার পূর্বে অন্য পাণিপ্রার্থী ঐ পাত্রীর জন্য প্রস্তাব দিয়ে থাকে, তাহলে সে জবাব না দেওয়া পর্যন্ত তার প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব বা (দর কষাকষি করে) প্রলোভন বৈধ নয়। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা এবং এতে বিদ্বেষ গড়ে তোলা মুসলিমের কাজ নয়।
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,
الْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ فَلاَ يَحِلُّ لِلْمُؤْمِنِ أَنْ يَبْتَاعَ عَلَى بَيْعِ أَخِيهِ وَلاَ يَخْطُبَ عَلَى خِطْبَةِ أَخِيهِ حَتَّى يَذَرَ.
‘‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সুতরাং তার জন্য তার ভায়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় এবং বিবাহ-প্রস্তাবের উপর বিবাহ প্রস্তাব -তার ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত - হালাল নয়।[19]
পাত্রী যদি কারো তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী হয়, তবে তার ইদ্দতে তাকে বিবাহ-পয়গাম দেওয়া হারাম। স্বামী-মৃত্যুর ইদ্দতে থাকলে স্পষ্টভাবে প্রস্তাব দেওয়া নিষিদ্ধ। ইঙ্গিতে দেওয়া চলে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا عَرَّضْتُمْ بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ أَوْ أَكْنَنْتُمْ فِي أَنْفُسِكُمْ عَلِمَ اللهُ أَنَّكُمْ سَتَذْكُرُونَهُنَّ وَلَكِنْ لاَ تُوَاعِدُوهُنَّ سِرّاً إِلَّا أَنْ تَقُولُوا قَوْلاً مَعْرُوفاً وَلاَ تَعْزِمُوا عُقْدَةَ النِّكَاحِ حَتَّى يَبْلُغَ الْكِتَابُ أَجَلَهُ وَاعْلَمُوا أَنَّ الله يَعْلَمُ مَا فِي أَنْفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ﴾
‘‘আর যদি তোমরা আভাসে-ইঙ্গিতে উক্ত রমণীদেরকে বিবাহ-প্রস্তাব দাও অথবা অন্তরে তা গোপন রাখ, তবে তাতে তোমাদের দোষ হবে না। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা তাদের সম্বন্ধে আলোচনা করবে। কিন্তু বিধিমত কথাবার্তা ছাড়া গোপনে তাদের নিকট কোন অঙ্গীকার করো না। নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বিবাহকার্য সম্পন্ন করার সংকল্প করো না এবং জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের মনোভাব জানেন। অতএব তাঁকে ভয় কর।’’[20]
অনুরূপ হজ্জ বা উমরা করতে গিয়ে ইহরাম অবস্থায় কোন নারীকে বিবাহ প্রস্তাব দেওয়া অবৈধ।[21]
বিবাহের পূর্বে পাত্র-পাত্রীর রক্ত, বীর্য প্রভৃতি পরীক্ষা করে তারা রোগমুক্ত কি না তা দেখে নেওয়ার সমর্থন রয়েছে ইসলামে। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, ‘‘তোমরা কুষ্ঠরোগ হতে দূরে থেকো; যেমন বাঘ হতে দূরে পলায়ন কর।’’[22]
‘‘চর্মরোগাক্রান্ত উটের মালিক যেন সুস্থ উট দলে তার উট না নিয়ে যায়।’’[23]
‘‘কারো জন্য অপরের কোন প্রকার ক্ষতি করা বৈধ নয়। কোন দু’জনের জন্য প্রতিশোধমূলক পরস্পরকে ক্ষতিগ্রস্ত করাও বৈধ নয়।’’[24]
[2] (ইবনে মাজাহ ১৮৫৬নং, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২১৭৬নং)
[3] (নাসাঈ ৩২৩১নং, হাকেম ২/১৬১, মুসনাদে আহমদ ২/২৫১)
[4] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৩৪)
[5] (আবু দাঊদ, নাসাঈ, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৯১নং)
[6] (সিলসিলা সহীহাহ ১৬২৬নং)
[7] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩০৮৮নং)
[8] (ইবনে মাজাহ, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬২৩নং, সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ৪০৫৩নং)
[9] (বুখারী ২৯৬৭নং)
[10] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৮/১১৯)
[11] (সূরা আল-হুজুরাত (৪৯) : ১৩)
[12] (তুহফাতুল আরূস, ৪৯পৃঃ)
[13] (অফিয়াতুল আ’ইয়ান ২/৩৭৭)
[14] (অফায়াতুল আ’ইয়ান, ইবনে খাল্লেকান ২/২৩৮)
[15] (উয়ূনুল আখবার, ইবনে কুতাইবাহ ৪/১৭)
[16] (তুহফাতুল আরূস, ৫২-৫৩পৃঃ)
[17] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ১০২২নং)
[18] (মুসনাদে আহমদ, হাকেম , বাইহাকী, সহীহ তিরমিযী, আল্লামা আলবানী ২০৪৬ নং)
[19] (বুখারী, মুসলিম ১৪১৪নং)
[20] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৫)
[21] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ৭৮০৯নং)
[22] (বুখারী ৫৭৯৭নং)
[23] (বুখারী ৫৭৭১নং)
[24] (মুসনাদে আহমদ, মাঃ, ইবনে মাজাহ ২৩৪০, ২৩৪১ নং)