সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ওযূ আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম
জাওরাব ও জুতার উপর মাসাহ প্রসঙ্গে

জাওরাব ও জুতার উপর মাসাহ প্রসঙ্গে

(ক) জাওরাবের উপর মাসাহ:

جورب(জওরাব): পশমী সুতা, শণের তৈরি এক ধরনের মোজা বিশেষ যা মানুষেরা তাদের দু‘পায়ে পরিধান করে। এ সংজ্ঞটিকে মদ্য পানীয়র সাথে তুলনা করা যেতে পারে। (শারাব বা পানীয় যেমন বিভিন্ন বস্ত্ত থেকে তৈরি করা হয়, জাওরাবও তেমনি বিভিন্ন উপাদান হতে তৈরি হতে পারে (অনুবাদক))।

জাওরাবের উপর মাসাহ এর হুকুম নিয়ে উলামাদের মাঝে তিন ধরনের বক্তব্য রয়েছে।

প্রথম: জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ নয়, তবে তার উপর চামড়ার জুতা থাকলে বৈধ: এটা আবূ হানীফা (অবশ্য তিনি পরবর্তীতে এমত থেকে প্রত্যাবর্তন করেন), মালিক ও শাফেঈর মাযহাব।[1] তাঁরা বলেন: যেহেতু জাওরার কে جورب বা মোজা নামে নামকরণ করা যায় না, সেহতু তাতে মোজার হুকুম চলবেনা। আর জাওরাবের উপর মাসাহ প্রসঙ্গে কোন হাদীসও বর্ণিত হয়নি (!!)।

দ্বিতীয়: পুরু ও ওযূতে পায়ের যে অংশ ধৌত করা ফরয় সে অংশ আচ্ছাদনকারী হলে জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ: এটা হাসান, ইবনুল মুসাইয়িব, আহমাদ, ও হানাফী, শাফেঈ, হাম্বলী প্রমুখ বিদ্বানগণের অভিমত।[2]

তৃতীয়: সাধারণভাবে সকল ধরনের জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ, এমনকি যদি তা খুব পাতলা হয় তবুও: এটাই ইবনু হাযম ও ইবনু তাইমিয়ার স্পষ্ট মাযহাব। আর এ মতকেই ইবনু উছাইমীন ও আল্লামা শানক্বীতী পছন্দ করেছেন।[3] এটাই অধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত।

এখানে জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ মর্মে বর্ণিত শেষ দু‘টি অভিমতের প্রবক্তাগণ নিম্নোক্ত দলীল গুলোকে দলীল হিসাবে দাড় করান। যথা-

عَنِ الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ،্রأَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ، وَالنَّعْلَيْنِগ্ধ

(১) মুগীরা বিন শোবা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস: ‘নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) একবার ওযূ করলেন এবং জাওরাব ও দু জুতার উপর মাসাহ করলেন।[4]

عَنِ الأزرق بن قيس قال :্র رأيت أنس بن مالك أحدث فغسل وجهه ويديه ومسح برأسه ، ومسح على جوربين من صوف فقلت : أتمسح عليهما ؟ فقال : إنهما خفان ولكنهما من صوف গ্ধ

(২) আয়রাক্ব ইবনে কায়েস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনে মালিককে লক্ষ্য করেছি, তিনি বায়ু নিঃসরণ হলে তাঁর চেহারা ও দুহাত ধৌত করতেন এবং পশমের তৈরি জাওরাবের উপর মাসাহ করতেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি জাওরাবের উপর মাসাহ করলেন? তিনি বললেন, এ দু’টি মোজা যা পশমের তৈরি।[5]

এখানে আনাস (রাঃ) খাফ বা মোজা চামড়ার তৈরি হওয়ার ব্যাপারে আম (ব্যাপক), সে কথা স্পষ্ট করেছেন। উলেস্নখ্য যে, তিনি আরবী ভাষাবিদদের অন্যতম একজন সাহাবী ছিলেন।

(৩) জাওরাবের উপর মাসাহ করার হাদীস ১১ জন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। যাদের মধ্যে উমার তাঁর ছেলে আবদুলস্নাহ বিন উমার, আলী, ইবনে মাসউদ আনাস প্রমুখ সাহাবী অন্যতম। তাদের সমসাময়িক কোন সাহাবী তাদের বিরোধিতা করেন নি। বরং, সকলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পরবর্তীতে জমহুর উলামা পাতলা জাওরাবের উপর মাসাহ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা তা দ্বারা ফরযের স্থান আচ্ছাদিত হয় না। অথচ এটা মাসাহ বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত নয় যা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে।

যেহেতু বর্তমানকালে আনুপাতিক হারে পাতলা জাওরাবের প্রচলন বেশি। সেহেতু এই শর্ত সংকীর্ণতা ও জটিলতা সৃষ্টির কারণে শরীয়ত দাতার প্রশস্ততার ইচ্ছার বিপরীত। (আল্লাহ্‌ই অধিক অবগত আছে)।

উপকারিতাঃ

জাওরাব এর অর্থের মধ্যে ঐ সকল পট্টি অন্তর্ভুক্ত হবে যা কোন বিশেষ ওজরে দু‘পায়ে পরিধান করা হয়। এ বিধানটি মুলতঃ কষ্ট দূর করার জন্য। এ জন্যে তার উপর মাসাহ বৈধ। যেমনটি শাইখুল ইসলাম পছন্দ করেছেন। আর জাওরাবের উপর মাসাহ করার হুকুম খাফ এর উপর মাসাহ করার হুকুমের মতই।

যখন একটা জাওরাবের উপর আরেকটি জাওরাব পরিধান করা হবে, তখন তার কয়েকটি অবস্থা হতে পারে:

(১) যখন ওযূ করার পর একটি জাওরবের উপর আরেকটি জাওরাব পরিধান করা হবে, এ ক্ষেত্রে ওযূ নষ্ট হয়ে গেলে উপরের জাওরাবের উপর মাসাহ করলেই চলবে। এটা আবূ হানীফার মাযহাব এবং হাম্বলী ও মালিকীদের কাছে অধিক প্রাধান্য যুক্ত মত। আর শাফেঈদের এটা পুরাতন মত, নতুন মত এর বিপরীত।[6]

(২) ওযূ করার পর দু‘টি জাওরাব পরিধান করবে অতঃপর উভয়টির উপর মাসাহ করবে। আর যদি মাসাহ করার পর উপরের জাওরাবটি খুলে ফেলে, সেক্ষেত্রে নিচের জাওরাবের উপর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাসাহ জায়েয। কেননা সে পবিত্র অবস্থায় দু পায়ে জাওরাব পরিধান করেছে।

(৩) ওযূ করার পর একটি জাওরাব পরিধান করবে এবং ওযূ ভঙ্গের পূর্বেই তার উপর আরেকটি জাওরাব পরিধান করবে। তখন দু‘টির যে কোন একটির উপর মাসাহ করার ইখতিয়ার (ঐচ্ছিকতা) রয়েছে।[7]

(৪) ওযূ করার পর একটি জাওরাব পরিধান করবে এবং তার উপর মাসাহ করার পর আরেকটি জাওরাব পরিধান করবে, সেক্ষেত্রে যদি সে পবিত্র অবস্থায় পরের জাওরাবটি পরিধান করে থাকে তাহলে উপরেরটির উপর মাসাহ বৈধ। কেননা সে পবিত্র অবস্থায় দু‘পা প্রবেশ করিয়েছে।[8] কিন্তু যদি ওযূ ভঙ্গের পর পরবর্তী জাওরাব পরিধান করে থাকে তাহলে, উপরের জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ হবে না বরং নিচেরটার উপর মাসাহ বৈধ হবে।

(খ) জুতার উপর মাসাহ:

এ মর্মে মুগীরা বিন শু’বার (রাঃ) হাদীস গত হয়ে গেছে যে,্র

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ، وَالنَّعْلَيْنِগ্ধ

‘নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) একদা ওযূ করলেন এবং জাওরাব ও দু জুতার উপর মাসাহ করলেন।[9]

সঠিক ভাবে বিবেচনা করলে এ হাদীসটি নিম্নোক্ত দু‘টি অবস্থার সম্ভাবনা রাখে। যথা-

১। জাওরাবের উপর জুতা পরিধান করবে এবং তার উপর মাসাহ করবে, তখন উভয়টির হুকুম একই হবে। যেমন একটি জাওরাব আরেকটি জাওরাবের উপর একটি খাফ আরেকটি খাফের উপর পরিধান করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।

২। হয়ত মুগীরা (রাঃ) একবার জাওরাবের উপর আরেকবার জুতার উপর রাসূল (ﷺ) কে মাসাহ করতে দেখেছিলেন। তখন এটা জুতার উপর মাসাহ বৈধ হওয়ার দলীল হিসেবে সাব্যাস্ত হবে যদিও তা জাওরাব বিহীন হয়। কিছু কারণে এ দলীল গ্রহণ করা যদিও দূরবর্তী ব্যাপার, তার পরও এর দ্বারা জায়েয হওয়ার দলীল গ্রহণ করা যায় ইতিপূর্বে উল্লেখিত আবূ যিবয়্যান এর হাদীস দ্বারা,

عن أبي ظبيان أنه رأى عليا رضي الله عنه بال قائما ، ثم دعا بماء ، فتوضأ ومسح على نعليه ، ثم دخل المسجد ، فخلع نعليه ، ثم صلى

অর্থাৎ, আবূ যিবয়্যান হতে বর্ণিত, তিনি আলী (রাঃ) কে দেখলেন যে, তিনি দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন ও পানি নিয়ে ডাকলেন, অতঃপর তিনি ওযূ করলেন ও দুই জুতার উপর মাসাহ করলেন, এর পর মাসজিদে প্রবেশ করে জুতা খুলে সালাত আদায় করলেন।[10] এ হাদীসের মধ্যে জাওরাবের কথা উল্লেখ নেই।

অনুরূপভাবে জুতার উপর মাসাহ করার সমর্থনে আরো বলা যেতে পারে যে, বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাসাহকৃত বস্ত্ত দ্বারা ফরযের স্থানটি আবৃত করা শর্ত নয়।

[1] আল-মাসবূত্ব (১/১০২), আল-মাদূনাহ (১/৪০), আল-উম্ম (১/৩৩), আল-আওসাত্ব (১/৪৬৫)।

[2] মাসায়িলু আহমাদ (১/২১) ইবনু হানী প্রণীত, আল আওসাত্ব (১/৪৬৪), ‘আল-মাজমূ’ (১/৫৪০), ফাতহুল ক্বাদীর (১/১৫৭)।

[3] আল-মুহালস্না (২/৮৬), আল-মাসায়িলুল মারদিনিয়্যাহ (৫৮ পৃ.), মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৮৪), আল-মুমতি’ (১/১৯০), আযওয়াউল বায়ান (২/১৮, ১৯), এখানে এ বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে।

[4] এ হাদীসকে আলবানী সহীহ বলেছেন, আবূ দাউদ (১৫৯), তিরমিযী (৯৯), আহমাদ (৪/২৫২), এ ব্যাপারে বিসত্মারিত ‘আল-ইরওয়া (১০১)-দ্রষ্টব্য।

[5] এ হাদীসকে আহমাদ শাকির সহীহ বলেছেন; আলকূনী (১/১৮১) দাওলাবী প্রণীত।

[6] হাশিয়াতু ইবনে আবেদীন (১/১৭৯), জাওয়াহিরুল ইকলিল (১/২৪) রওযাতুতত্বালিবীন (১/১২৭), এখানে তাদের বক্তব্য خف বা চামড়ার মোজার মত। এ ÿÿত্রে উভয়ের একই হুকুম।

[7] হাম্বলীগণ এ বিষয়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন, ‘কাশশাফুল কান্না’ (১/১১৭-১১৮)।

[8] এ বিষয়টিকে ‘কাশশাফুল কান্না’ গ্রন্থে (১/১১৭-১১৮) এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তাতে (উপরটির উপর) মাসাহ করা যাবে না। কেনানা নিচের যে মোজাটির উপর মাসাহ করা হয়েছে তা ধৌতের বিকল্প স্বরূপ। আর একটি বিকল্প আরেকটি বিকল্পের জন্য জায়েয নয়। বরং নিচেরটির উপর মাসাহ করতে হবে। কেননা সংশিস্নষ্ট বিষয়টির সাথেই শুধু ছাড় রয়েছে। আমার মতে, এ ব্যাখ্যাটির ব্যাপারে কিছু কথা থেকে যায়। কেননা মাসআলাটির ÿÿত্রে শুধু একটিই মূলনীতি ধর্তব্য, তা হল, দু‘পায়ে পবিত্র অবস্থায় মোজা পরিধান করা। আর তা তো অর্জিত হয়ে গেছে, যদিও উপরেরটি পরার পূর্বেই নিচেরটির উপর মাসাস করা হোক। আর এর দ্বারা সালাত বৈধ হবে।

[9] কিছু পূর্বে হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে।

[10] কিছু পূর্বে হাদীসটি উল্লেখ হয়েছে।