লগইন করুন
(১০) রুকূ থেকে উঠার পর পুনরায় হাত বাঁধা :
রুকূ হতে উঠার পর অনেকে হাত কিছুক্ষণ খাড়াভাবে ধরে রাখে। উক্ত আমলের পক্ষে কোন দলীল নেই। কেউ আবার পুনরায় বুকে হাত বাঁধে। শায়খ বিন বায এবং মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) উক্ত মর্মে ফৎওয়া প্রদান করেছেন। তবে তারা শাব্দিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।[1] কারণ উক্ত আমলের পক্ষে শাব্দিক ব্যাখ্যা ছাড়া স্পষ্ট কোন দলীল নেই। উক্ত দাবীর মূল দলীলগুলো নিম্নরূপ :
(أ) عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ كَانَ النَّاسُ يُؤْمَرُوْنَ أَنْ يَضَعَ الرَّجُلُ الْيَدَ الْيُمْنَى عَلَى ذِرَاعِهِ الْيُسْرَى فِي الصَّلَاةِ قَالَ أَبُوْ حَازِمٍ لَا أَعْلَمُهُ إِلَّا يَنْمِىْ ذَلِكَ إِلَى النَّبِيِّ .
(ক) সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, লোকদেরকে নির্দেশ দেওয়া হত, মুছল্লী যেন ‘ছালাতের মধ্যে তার ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর রাখে’। আবু হাযেম বলেন, এটা রাসূল (ছাঃ)-এর দিকেই ইঙ্গিত করা হত বলে আমি জানি।[2] ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন,بَابُ وَضْعِ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى ‘ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ’।[3]
(ب) عَنْ عَلْقَمَةَ بْنِ وَائِلٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ إِذَا كَانَ قَائِمًا فِى الصَّلاَةِ قَبَضَ بِيَمِيْنِهِ عَلَى شِمَالِهِ.
(খ) আলক্বামা ইবনু ওয়ায়েল থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছি, যখন তিনি ছালাতের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকতেন, তখন ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরে রাখতেন’।[4] ইমাম নাসাঈ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, بَابُ وَضْعِ الْيَمِيْنِ عَلَى الشِّمَالِ فِى الصَّلاَةِ ‘ছালাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা অনুচ্ছেদ’।
(ج) عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِىَّ حِيْنَ كَبَّرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ حِذَاءَ أُذُنَيْهِ ثُمَّ حِيْنَ رَكَعَ ثُمَّ حِيْنَ قَالَ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ رَفَعَ يَدَيْهِ وَرَأَيْتُهُ مُمْسِكاً يَمِيْنَهُ عَلَى شِمَالِهِ فِى الصَّلاَةِ فَلَمَّا جَلَسَ حَلَّقَ بِالْوُسْطَى وَالإِبْهَامِ وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَوَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُمْنَى وَوَضَعَ يَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُسْرَى.
(গ) ওয়ায়েল ইবনু হুজর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দেখেছি, যখন তিনি তাকবীর দিতেন তখন কান বরাবর দুই হাত উত্তোলন করতেন। যখন রুকূ করতেন এবং ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলতেন, তখন দুই হাত উত্তোলন করতেন। আর আমি তাঁকে ছালাতের মধ্যে ডান দিয়ে বাম হাত ধরা অবস্থায় দেখেছি। আর যখন তিনি বসতেন তখন মধ্যমা ও বৃদ্ধা আঙ্গুল দ্বারা মোট পাকাতেন এবং শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করতেন। তিনি ডান হাত ডান উরুর উপর এবং বাম হাত বাম উরুর উপর রাখতেন।[5]
পর্যালোচনা :
মৌলিক দলীল হিসাবে উক্ত তিনটি হাদীছ পেশ করা হয়। বিশেষ করে মুসনাদে আহমাদের হাদীছটি। যদিও এ ধরনের হাদীছ আরো আছে। ‘ছালাতের মধ্যে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা’ অংশটুকু দ্বারা রুকূর আগে এবং পরে দাঁড়ানো অবস্থায় হাত বাঁধার জন্য ব্যাপক ভিত্তিক অর্থ নেয়া হয়। অথচ এর উদ্দেশ্য যে তাকবীরে তাহরীমা বলার পর হাত বাঁধা তা স্পষ্ট।
(ক) ইমাম বুখারী (রহঃ) সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ ছালাতের ধারাবাহিক বর্ণনায় এভাবেই উল্লেখ করেছেন। এই হাদীছগুলো দ্বারা রুকূর পরের অবস্থা বুঝানোর জন্য কেউ পেশ করেননি। তাছাড়া রুকূর আগে এবং পরে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা এটাও কেউ বলেননি। বরং ছালাতের শুরুতে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে বুকের উপর বাঁধার কথা উল্লেখ করেছেন।
(খ) মুসনাদে আহমাদের হাদীছটি জোরালভাবে পেশ করার মধ্যে কোন উপকারিতা নেই। কারণ বর্ণনার ধারাটা কেবল আগে পরে হয়েছে। সরাসরি ধারাবাহিক অর্থ নিলে দেখা যাবে, তিনি রুকূর আগে হাত বাঁধেননি, রুকূর পরে বেঁধেছেন। অনুরূপ আগে আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করেছেন, পরে উরুর উপর হাত রেখেছেন। এ ধরনের অর্থ নিলে সবই উল্টা হয়ে যাবে। সুতরাং উক্ত হাদীছ দিয়ে দলীল পেশ করার কোন সুযোগ নেই।
(গ) দাঁড়ানো অবস্থায় যদি ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা শর্ত হয় তবে রুকূর পর কুনূতে নাযেলার সময় কী করণীয়? কারণ তখন তো দুই হাত মুখ বরাবর তুলে দু‘আ করতে হয়।[6] অনুরূপ রুকূর আগেও কুনূতে বিতর পড়ার সময় হাত তুলার প্রমাণ আছে।[7] তাই হাত বেঁধেই রাখতে হবে এমনটি নয়। নির্দিষ্ট হাদীছ আসলে সেভাবেই আমল করতে হবে। মূলতঃ উক্ত হাদীছগুলো রুকূর আগে বুকে হাত বাঁধার হাদীছ। রুকূর পর হাত ছেড়ে দিতে হবে। কারণ ছালাতের প্রত্যেক আহকামের ব্যাপারে একাধিক দলীল মওজুদ থাকলেও রুকূর পর পুনরায় হাত বাঁধার ব্যাপারে স্পষ্ট কোন দলীল নেই। যদিও রুকূর পর রাসূল (ছাঃ) কান বা কাঁধ বরাবর হাত উঠাতেন মর্মে শত শত স্পষ্ট হাদীছ রয়েছে। কিন্তু পুনরায় হাত বাঁধার বিষয়টি কোন হাদীছে বর্ণিত হয়নি। বরং হাত ছেড়ে দেওয়ার পক্ষেই হাদীছের দলীল শক্তিশালী। আবু হুমায়েদ সায়েদী (রাঃ) ১০ জন ছাহাবীর সামনে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাতের বাস্তব নমুনা যে হাদীছে প্রদর্শন করেছিলেন এবং সত্যায়ন প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সে হাদীছে বলা হয়েছে-
فَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ اسْتَوَى حَتَّى يَعُوْدَ كُلُّ فَقَارٍ مَكَانَهُ.
‘তিনি রুকূ থেকে মাথা উঠিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন এমনভাবে যে, মেরুদন্ডের জোড় সমূহ স্ব স্ব স্থানে ফিরে আসে’।[8] অনুরূপভাবে ছালাতে ভুলকারী ব্যক্তিকে রাসূল (ছাঃ) যা শিক্ষা দিয়েছিলে সেখানে এসেছে, حَتَّى تَرْجِعَ الْعِظَامُ إِلَى مَفَاصِلِهَا ‘যতক্ষণ না হাড় সমূহ স্ব স্ব জোড়ে ফিরে আসে’।[9]
উক্ত হাদীছ দু’টিতে নির্দিষ্ট করে রুকূর পরের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। শরীরের হাড়ের জোড় সমূহ স্ব স্ব স্থানে ফিরে গেলে রুকূর পর দাঁড়ানো অবস্থায় হাতকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে। অন্যথা হাতের অস্থির জোড় স্ব স্ব স্থানে ফিরে যাবে না। আর পুনরায় হাত বাঁধাটা হাতের স্বাভাবিক অবস্থা নয়।
(ঘ) উক্ত আম হাদীছ দ্বারা পূর্বের কেউ রুকূ থেকে উঠার পর হাত বাঁধার দলীল পেশ করেননি। যদিও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর ছেলে ছালেহ তার পিতার পক্ষ থেকে বলেছেন, ‘মুছল্লী চাইলে রুকূ থেকে উঠার পরে তার দুই হাত ছেড়েও দিতে পারে বাঁধতেও পারে’।[10] যদিও এটা তার ব্যক্তিগত মত। এরপরও তাতে কোন দলীল নেই। কারণ রুকূর আগেও এমনটি করা প্রমাণিত হবে, যা সুন্নাত বিরোধী। মূলকথা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের কাছে এটি পরিচিত নয়। এ জন্য শায়খ আলবানী ‘ভ্রষ্ট বিদ‘আত’ বলেছেন।[11] অতএব কেবল শাব্দিক ব্যাখ্যা নয়, স্পষ্ট দলীলের দিকে ফিরে যাওয়া উচিৎ।
[2]. ছহীহ বুখারী হা/৭৪০, ১/১০২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭০৪, ২য় খন্ড, পৃঃ ১০২)।
[3]. ছহীহ বুখারী ১/১০২ পৃঃ।
[4]. নাসাঈ হা/৮৮৭, ১/১০২ পৃঃ, ‘ছালাতের শুরু’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।
[5]. আহমাদ হা/১৮৮৯১।
[6]. আহমাদ হা/১২৪২৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/৩২৭৪; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল ২/১৮১ পৃঃ।
[7]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ২/৭১ পৃঃ, ২/১৮১ পৃঃ, সনদ ছহীহ।
[8]. বুখারী হা/৮০০; মিশকাত হা/৭৯২, পৃঃ ৭৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭৩৬, ২/২৫২ পৃঃ।
[9]. আহমাদ হা/১৯০১৭; ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৭৮৭; মিশকাত হা/৮০৪, পৃঃ ৭৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭৪৮, ২/২৫৯ পৃঃ, ‘ছালাতের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ; ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ১৩৮।
[10]. মাসায়েলে ইমাম আহমাদ, পৃঃ ৯০; ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ১৩৯।
[11]. ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ১৩৯- ولست أشك فى أن وضع اليدين على الصدر فى هذا القيام بدعة ضلالة لأنه لم يرد مطلقا فى شيء من أحاديث الصلاة وما أكثرها ولو كان له أصل لنقل إلينا ولو عن طريق واحد ويؤيده أن أحدا من السلف لم يفعله ولاذكره أحد من أئمة الحديث فيما أعلم. মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, ডিসেম্বর’ ৯৮, ২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা, পৃঃ ৫০-৫১।