তাক্বদীরঃ আল্লাহ্‌র এক গোপন রহস্য তাক্বদীর বিষয়ে বিস্তারিত আব্দুল আলীম ইবনে কাওসার
তাক্বদীরের স্তরসমূহ - চতুর্থ স্তরঃ আল্লাহ্‌র রাজ্যের সবকিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন একথার প্রতি ঈমান আনা

আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ সবকিছুই জানেন, তাঁর চিরন্তন এই জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি সবকিছুই লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন, এ সবকিছুর পেছনে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছা বিদ্যমান এবং সেই ইচ্ছা অনুযায়ীই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকেন। প্রত্যেকটি জিনিসকে তিনি যে আকৃতিতে, যে সময়ে এবং যে বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করতে চান, সেভাবেই সৃষ্টি করেন।[1] আল্লাহ প্রত্যেকটি মানুষ এবং তার কর্ম সৃষ্টি করেছেন। আসমান-যমীনে অণু-পরমাণুসহ এমন কোন কিছু নেই যে, আল্লাহ তাকে এবং তার নড়াচড়া বা স্থিরতাকে সৃষ্টি করেননি।[2] ঘরের জানালা বা অন্য কোন ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতরে সূর্য্যকিরণ প্রবেশ করলে তাতে অসংখ্য অণু-পরমাণু পরিলক্ষিত হয়, এমনকি এসব অণু-পরমাণুর একটি কণাও আল্লাহ্‌র সৃষ্টির বাইরে নয়। বরং সেগুলির প্রত্যেকটি কণা সম্পর্কে আল্লাহ্‌র চিরন্তন সূক্ষ্ম জ্ঞান রয়েছে, তিনি তাকে লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন, তাতে তাঁর ইচ্ছা রয়েছে এবং সময় মত তিনি তা সৃষ্টি করেন। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ﴾ [سورة الزمر: 62]

‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর দায়িত্বশীল’ (যুমার ৬২)।

বান্দার কর্মের স্রষ্টাও কি আল্লাহ নন?: বিভ্রান্ত অনেক ফের্কা বান্দার কর্মকে আল্লাহ্‌র সৃষ্ট নয় বলে মিথ্যা দাবী করে। কিন্তু আহলুস্‌ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা মতে, বান্দার কর্মেরও মূল স্রষ্টা মহান আল্লাহ্‌ই; কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়ন করে বান্দা। এরশাদ হচ্ছে,

 ﴿وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ﴾ [سورة الصافات: 96]

‘আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমাদের কর্মকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছফফাত ৯৬)। মুফাস্‌সিরগণ বলেন, উক্ত আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, বান্দার কর্ম আল্লাহ্‌রই সৃষ্ট।[3] মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

 ﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُم بَأْسَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ﴾ [سورة النحل: 81]

‘আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট বস্তু দ্বারা তোমাদের জন্য ছায়া বানিয়েছে। পাহাড়সমূহে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরী করেছেন এবং তোমাদের জন্যে পোশাক তৈরী করে দিয়েছেন, যা তোমাদেরকে গ্রীষ্ম এবং বিপদের সময় রক্ষা করে। এমনিভাবে তিনি তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহের পূর্ণতা দান করেন, যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ কর’ (নাহ্‌ল ৮১)।

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ এখানে স্পষ্ট ঘোষণা করলেন যে, তৈরীকৃত পোষাক তাঁরই তৈরী। কারণ পোষাকের কাঁচামালকে পোষাক বলা হয় না; বরং মানুষ কর্তৃক পোষাকের রূপ দেওয়া হলেই কেবল তাকে পোষাক বলা যায়। এতদ্‌সত্ত্বেও এটিকে  সরাসরি আল্লাহ্‌র সৃষ্টি বলা হল’।[4]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,

 «إِنَّ اللَّهَ يَصْنَعُ كُلَّ صَانِعٍ وَصَنْعَتَهُ»

‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহই প্রত্যেকটি তৈরীকারক এবং তার তৈরীকৃত বস্তুকে সৃষ্টি করেন’।[5]

ইমাম বুখারী (রহেমাহুল্লাহ) এই হাদীছটি উল্লেখ করার পর বলেন, فَأَخْبَرَ أَنَّ الصِّنَاعَاتِ وَأَهْلَهَا مَخْلُوقَةٌ ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীছটিতে ঘোষণা করলেন, তৈরীকৃত সবকিছু এবং সেগুলির তৈরীকারক আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি’।[6]

আল্লাহ্‌র সৃষ্ট কর্ম মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়নের একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন ফার্মাসিস্ট কোন ওষুধ বা বিষ বানাতে যেয়ে কয়েক প্রকার পদার্থ চয়ন করে। এরপর প্রত্যেক প্রকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পদার্থ গ্রহণ করে ওষুধ তৈরী করে। আবার দেখা যায়, ঐ একই পদার্থের পরিমাণে পরিবর্তন আনে এবং সেগুলিকে সংমিশ্রণের মাধ্যমে বিষ তৈরী করে। এখানে ঔষধি এই পদার্থগুলির স্রষ্টা যেমন আল্লাহ, তেমনি ঐ ফার্মাসিস্ট, তার ক্ষমতা এবং জ্ঞানের স্রষ্টাও তিনি। বরং এই ওষুধ কিংবা বিষের স্রষ্টাও মূলতঃ আল্লাহই। অন্যভাবে বলা যায়, মহান আল্লাহ তার বান্দাকে কর্মশক্তি, ইচ্ছাশক্তি এবং জ্ঞান দান করেছেন। ফলে সে আল্লাহ্‌র সৃষ্ট পদার্থ থেকেই ভাল বা মন্দ জিনিস আবিষ্কার করছে। সে শূন্য থেকে কোন কিছু তৈরী করছে না; বরং যা করছে, আল্লাহ্‌র সৃষ্ট বস্তু থেকেই করছে; আর আল্লাহ্‌র দেয়া ক্ষমতা দিয়েই করছে।[7]

[1]. আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্‌ওয়াল ক্বাদার/১৪।

[2]. মা‘আরেজুল ক্ববূল ৩/৯৪০।

[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭/২৬; ইবনুল জাওযী, যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর, (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, তৃতীয় প্রকাশ: ১৯৮৪ইং), ৭/৭০ এবং অন্যান্য।

[4]. শিফাউল আলীল/১১৮।

[5]. ইমাম বুখারী, খালক্বু আফআলিল ইবাদ, ‘বান্দাদের কর্মসমূহ’ অনুচ্ছে, (বৈরূত: মুআস্‌সাসাতুর্‌ রিসালাহ, তৃতীয় প্রকাশ: ১৯৯০ ইং), পৃ: ২৫।

[6]. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৫।

[7]. কাশফুল গায়ূম আনিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১৮-১৯।