লগইন করুন
৪. ২. ৯. মালাকগণ বিষয়ক বিভ্রান্তি
আগেই উল্লেখ করেছি যে, ফিরিশতাগণ অদৃশ্য জগতের অংশ। তাঁদের উপর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমরা কুরআন ও হাদীসের আক্ষরিক অনুসরণ ও বিশ্বাসই মুমিনের নাজাতের একমাত্র পথ। গাইবী বিষয়ে ওহীর সাথে কল্পনা, ধারণা, যুক্তি ইত্যাদি মিশ্রিত করে ওহীর অতিরিক্ত কিছু বলা বিভ্রান্তির পথ উন্মুক্ত করে। মালাকগণের বিষয়ে এ ধরনের কিছু বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে পূর্ববর্তী কোনো কোনো জাতি।
৪. ২. ৯. ১. দায়িত্ব বনাম ক্ষমতা
উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন, ক্ষমতা দেননি। এই দায়িত্বকে অতীত কালের অনেক বিভ্রান্ত সম্প্রদায় ‘ক্ষমতা’ বলে বিশ্বাস করেছে। এরপর তারা এ সকল ‘মালাক’ বা ফিরিশতাকে ভক্তির নামে ইবাদত করেছে এবং এদের কাছে প্রার্থনা করেছে। এখানে আরো লক্ষণীয় যে, মহান আল্লাহ মালাকদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কোনো জীবিত বা মৃত মানুষকে কোনোরূপ দায়িত্ব দিয়েছেন বলে জানান নি। কিন্তু অনেক বিভ্রান্ত জাতি তাদের মধ্যকার অনেক নবী, ওলী, ‘বীর’ ‘সাধু’ বা ‘সৎ’ মানুষকে মৃত্যুর পরে ‘মালাকগণের’ মত ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ বলে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে দাবি করেছে। এরপর তারা দায়িত্বকে ক্ষমতা বলে কল্পনা করেছে। এরপর তারা তাদের ইবাদত করেছে বা তাদের কাছে গাইবী বা অলৌকিক সাহায্য চেয়েছে।
মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে তার ইচ্ছা ও নির্দেশকে বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন কোনো কোনো ফিরিশতাকে, কিন্তু তাই বলে বিভিন্ন অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের মত সেই ফিরিশতাকে বৃষ্টির দেবতা মনে করে তার কাছে বৃষ্টি চেয়ে প্রার্থনা করেন না। অনুরূপভাবে মুসলিমরা বিশবাস করেন যে, আল্লাহ প্রাণ সংহারের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন কোনো কোনো ফিরিশতাকে, কিন্তু তাই বলে তারা সেই ফিরিশতাকে প্রাণ সংহারের ক্ষমতাশালী মনে করে দীর্ঘায়ূ চেয়ে তার কাছে প্রার্থনা করেন না।
এভাবে আমরা মালাকগণ সম্পর্কে মুসলিম ও অমুসলিম বিশ্বাসের পার্থক্য বুঝতে পারছি। একজন মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, সকল ক্ষমতা ও শক্তি একমাত্র আল্লাহর। তাঁর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। তিনি যেমন আলো ও তাপ দানের জন্য সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন, জীবনের উৎস হিসেবে পানিকে সৃষ্টি করেছেন, বাতাস প্রবাহ, বৃষ্টিপাত, আলোছায়ার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম সৃষ্টি করেছেন, তেমনি তিনি মালাকগণকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছা করলেই সূর্য ছাড়াই আলো ও তাপ দিতে পারেন বা পানি ছাড়াই ফসল দিতে পারেন। তবে তিনি এই মহাবিশ্বকে একটি সুন্দর ও সুনিয়ন্ত্রিত নিয়মের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বের আর সব সৃষ্টির মত ফিরিশতারাও আল্লাহর আনুগত্য করেন এবং তাঁরই ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেন। তাই আমরা ফিরিশতাকে সম্মান করি, তাঁদেরকে ভালবাসি, আল্লাহর কাছে তাঁদের কল্যাণ ও শান্তি চেয়ে দু‘আ করি এবং বলি (আলাইহিমু সালাম: তাঁদের উপর শান্তি হোক), কিন্তু কখনই তাঁদের কাছে প্রার্থনা করি না, তাঁদেরকে উপাসনা করি না, তাঁদেরকে ডাকি না।
৪. ২. ৯. ২. সম্পর্ক ও সুপারিশ
কুরআনুল করীমের বিভিন্ন আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষেরা মালাক বা ফিরিশতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। তাদের এই বিশ্বাস ছিল বিভিন্ন অমূলক ধারণা এবং কুসংস্কার মিশ্রিত। তারা বিশ্বাস করত যে, মালাকগণ আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। তারা মানুষের থেকে উন্নত ও সম্মানিত। আল্লাহর সাথে তাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের রয়েছে বিভিন্ন ক্ষমতা বা ঐশ্বরিক শক্তি।
কুরআনের বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই যে, মুশরিকগণ মালাকগণকে আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত।[1] এতেই তারা ক্ষান্ত হতো না, বরং তাঁদের শাফায়াত ও সুপারিশ লাভের আশায় তারা তাদের ইবাদত উপাসনা করত বা তাদেরকে ডাকত। এছাড়া অন্য অনেক মানব গোষ্ঠী বিভিন্ন সৎ মানুষ বা নবী-রাসূলকে আল্লাহর সন্তান বলে বিশ্বাস করে তাদের শাফায়াত-সুপারিশ লাভের জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করত। কারণ, যেহেতু এরা বিশেষ সৃষ্টি ও বিশেষ সম্পর্কের অধিকারী, সেহেতু আল্লাহ এদের সুপারিশ ফেলবেন না। কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে অবিশ্বাসীদের বিভ্রান্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত আমরা উপরে দেখেছি। এক স্থানে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ لا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلا يَشْفَعُونَ إِلا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ. وَمَنْ يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَهٌ مِنْ دُونِهِ فَذَلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ
‘‘তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি পবিত্র, মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে যে বলবে ‘আমি ইলাহ আল্লাহ ব্যতীত’, তাকে আমি প্রতিফল দিব জাহান্নাম; এভাবেই আমি জালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।’’[2]
মহান আল্লাহ মালাকগণের বা আল্লাহর অন্যান্য সম্মানিত সৃষ্টির ‘শাফা‘আতের’ সুযোগ অস্বীকার করেন নি। তবে এক্ষেত্রে কাফিরদের ‘বিকৃতি’র প্রতিবাদ করেছেন। কাফিরগণ আল্লাহর সাথে মালাকগণ বা আল্লাহর প্রিয় সম্মানিত বান্দাগণের সম্পর্ককে পৃথিবীর রাজাবাদশার সাথে আমলা-চামচাদের সম্পর্কের মত মনে করেছে। পৃথিবীর শাসক বা রাজার অজ্ঞাতে অন্যায়কারী তার কোনো প্রিয়পাত্রকে তোয়াজ করে সুপারিশ আদায় করে নিতে পারে। আর এরূপ সুপারিশে শাসক বা রাজা প্রভাবিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন। আর এক্ষেত্রে সুপারিশ প্রার্থী উক্ত ‘আমলা’-কে যেকোনো প্রকারে ভক্তি বা তোয়াজ করে সুপারিশ আদায়ের চেষ্টা করেন। উক্ত রাজাকে যেমন ভক্তি তোয়াজ করেন, আমলাকেও তদ্রূপ বা তার চেয়ে বেশি করলেও অসুবিধা নেই।
আল্লাহ তাদের এ সকল বিভ্রান্তির স্বরূপ তুলে ধরেছেন। প্রথমত ফিরিশতাগণ বা আল্লাহর অন্যান্য প্রিয় বান্দগণ ‘আল্লাহর বান্দা’, আল্লাহর সন্তান নন, বা আল্লাহর সাথে তাদের সৃষ্টিগত কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই বা তাঁদের কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই। তাঁদের কেউ তাঁর অবাধ্য হলে বা কোনো প্রকারের ইশ্বরত্ব বা উপাস্য হবার দাবী করলে তাদেরকে ও অন্য সকল অত্যাচারী পাপীর মত শাস্তি পেতে হবে।
মালাকগণ বা আল্লাহর অন্যান্য প্রিয় বান্দগণের সুপারিশ কখনোই জাগতিক রাজা-বাদশাহগণের কাছে আমলাদের সুপারিশের মত নয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। ফিরিশতাগণ বা নেক বান্দাগণ সদা সর্বদা তাঁরই ভয়ে ভীত। তাঁরা শুধু আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্যই আল্লাহর কাছে শাফাআত করেন। যাদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের জন্য তাঁরা আল্লাহর কাছে শাফাআত করেন না। কাজেই পাপ, শিরক ও অবিশ্বাসে লিপ্ত থেকে ফিরিশতাদের শাফাআতের আশা করা কাফিরদের অবাস্তব কল্পনা। আর কোনো কাফির যদি ভক্তির নামে বা শাফা‘আতের আশায় তাদের কাউকে ‘ইবাদত’ করে আর তিনি তাতে সন্তুষ্ট হয় তবে আল্লাহ তার জন্যও ভয়ঙ্কর শাস্তির সংবাদ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى
‘‘আকাশে কত ফিরিশতা রয়েছে তাদের কোনো সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না যতক্ষণ না আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অনুমতি না দেন।’’[3]
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلا يَعْقِلُونَ قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
‘‘তবে কি তারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সুপারিশকারী ধরেছে? বলুন: তাদের কোনো ক্ষমতা না থাকওে এবং তারা না বুঝলেও?’ বলুন: ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই ইখতিয়ারে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই; অতপর তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যানীত হবে।’’[4]
এভাবে কুরআন মালাকগণের শাফা‘আত অস্বীকার করছে না। তবে তাদের শাফা‘আতের মালিকানা বা ক্ষমতার ধারণার ভিত্তিহীনতা বর্ণনা করছে। শাফা‘আতের মালিকানা ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা যখন অনুমতি প্রদান করবেন সে তখন কেবলমাত্র যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন তাদেরই সুপারিশ করবেন।
[2] সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৬-২৯ আয়াত।
[3] সূরা (৫৩) নাজম: ২৬ আয়াত।
[4] সূরা (৩৯) যুমার: ৪৩-৪৪।