লগইন করুন
আখেরাত দিবসকে শেষ দিবস হিসাবে নামকরণ করার কারণ হলো, এটি দুনিয়ার দিনসমূহ শেষ হওয়ার পর সংঘটিত হবে। সমস্ত আসমানী কিতাবসমূহ যেমন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছে এবং সমস্ত নবী-রসূল যেমন এর প্রতি ঈমান আনয়নের আহবান জানিয়েছেন ঠিক তেমনি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাবও এটি সংঘটিত হওয়ার কথা প্রমাণ করে।
আল্লাহ তা‘আলা তার সম্মানিত কিতাব কুরআনুল কারীমে এ বিষয়ে খবর দিয়েছেন, তার পক্ষে দলীল কায়েম করেছেন এবং যারা শেষ দিবসকে অস্বীকার করে কুরআনের অধিকাংশ সূরায় তাদের প্রতিবাদ করেছেন। সমস্ত বনী আদম রবের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। এটি একটি সৃষ্টিগত বিষয়। প্রত্যেকেই রবের অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রদান করে এবং তার প্রতি ঈমান আনয়ন করে। কিন্তু ফেরাউনের মতো অল্প সংখ্যক লোকই কেবল অহংকার বশত রবের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারে। তবে আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়নের কথাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক মানুষ এটিকে অস্বীকার করে।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু শেষ নবী এবং তাকে যেহেতু কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে পাঠানো হয়েছে, তাই তিনি আখেরাত ও কিয়ামতের বিষয়গুলো এমন খোলাসা করে বর্ণনা করেছেন, যা অন্যান্য আসমানী কিতাবে পাওয়া যাবে না। কুরআনুল কারীমে পুনরুত্থান দিবসের বিভিন্ন দলীল রয়েছে।
কখনো কখনো কুরআন বলছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মৃত্যু দান করেন। অতঃপর তিনিই পুনরায় জীবিত করেন। যেমন তিনি মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের সম্পর্কে বলেছেন যে, তারা যখন বললো, আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে চাই, তখন বজ্রপাত তাদেরকে আক্রমণ করলো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ (55) ثُمَّ بَعَثْنَاكُمْ مِنْ بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُون﴾
‘‘তখন তোমরা বজ্রাহত হয়েছিলে এবং নিজেরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে। অতঃপর মৃত্যুর পর আমি তোমাদেরকে পূনর্বার জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও’’। (সূরা আল-বাকারা: ৫৫-৫৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَهُمْ أُلُوفٌ حَذَرَ الْمَوْتِ فَقَالَ لَهُمُ اللَّهُ مُوتُوا ثُمَّ أَحْيَاهُمْ﴾
‘‘হে নবী! তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যারা মৃত্যুর ভয়ে হাজারে হাজারে আপন ঘর-বাড়ি পরিত্যাগ করেছিল? অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা মৃত্যু বরণ করো। পরে তাদেরকে জীবিত করলেন’’। (সূরা আল-বাকারা: ২৪৩)
আল্লাহ তা‘আলা মৃতকে জীবিত করার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন,
﴿وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِ الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَى كُلِّ جَبَلٍ مِنْهُنَّ جُزْءًا ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِينَكَ سَعْيًا وَاعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾
‘‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহীম বললো, হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত করো আমাকে দেখাও। তিনি বললেন, তুমি কি বিশ্বাস করোনা? সে বললো, অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু আমার মনকে শান্তনা প্রদানের জন্য দেখতে চাই। তিনি বললেন, তবে চারটি পাখি ধরো এবং ঐগুলোকে তোমার বশীভূত করো (তা যবেহ করার পর টুকরা টুকরা করে সম্মিলিত করো)। তারপর তাদের একেক অংশ একেক পাহাড়ে নিক্ষেপ করো। অতঃপর ঐগুলোকে ডাক দাও। দেখবে ঐগুলো দ্রুত গতিতে তোমার নিকট এসে উপস্থিত হবে। জেনে রাখো যে, আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আল-বাকারা: ২৬০)
আল্লাহ তা‘আলা ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি আল্লাহর অনুমতিক্রমে মৃতদেরকে জীবিত করতেন। আসহাফে কাহাফ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, তাদেরকে তিনশত নয় বছর পর ঘুম থেকে জাগ্রত করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা কখনো কখনো প্রথমবার সৃষ্টি করার মাধ্যমে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করার দলীল পেশ করেছেন। কেননা দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা প্রথমবার সৃষ্টি করার চেয়ে সহজ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُضْغَةٍ مُخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى﴾
‘‘হে লোক সকল! তোমরা যদি পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ কর, তবে আমি তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছি। এর পর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে তারপর পূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট মাংস পিন্ড হতে, তোমাদের নিকট (আমার কুদরত) বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই’’। (সূরা হজ্জ: ৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ﴾‘‘তাকে বলো, এদেরকে তিনি জীবিত করবেন যিনি প্রথমে সৃষ্টি করেছিলেন’’। (সূরা ইয়াসীন: ৭৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿فَسَيَقُولُونَ مَن يُعِيدُنَا ۖ قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ﴾ ‘‘তারা নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করবে, কে আমাদের আবার জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনবে? জবাবে বলো, তিনিই, যিনি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৫১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَهُوَ الَّذِي يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَىٰ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
‘‘তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তিনিই আবার তাকে পুনরুত্থিত করবেন এবং এটি তার জন্য সহজতর। আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ গুণাবলী ও উদাহরণ তারই। তিনি পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী’’। (সূরা রোম: ২৭)
কখনো কখনো তিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করার মাধ্যমে পুনরুত্থানের দলীল প্রদান করেন। কেননা আসমান-যমীন সৃষ্টি করা মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় সৃষ্টি করার চেয়ে সহজ। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يُحْيِيَ الْمَوْتَى بَلَى إِنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
‘‘তারা কি দেখেনা যে, আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের সৃষ্টিতে কোনো ক্লান্তিবোধ করেননি। তিনি মৃতকে জীবন দান করতে সক্ষম। তিনি প্রত্যেক জিনিষের উপর ক্ষমতাবান’’। (সূরা আহকাফ: ৩৩)
কখনো কখনো পুনরুত্থানের উপর দলীল গ্রহণ করতে গিয়ে বলা হয় যে, তিনি অনর্থক কিছু সৃষ্টি করা থেকে পবিত্র। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ﴾
‘‘তোমরা কি মনে করেছো আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে কখনো আমার দিকে ফিরে আসতে হবে না?’’ (সূরা মুমিনুন: ১১৫) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَيَحْسَبُ الْإِنسَانُ أَن يُتْرَكَ سُدًى أَلَمْ يَكُ نُطْفَةً مِّن مَّنِيٍّ يُمْنَىٰ ثُمَّ كَانَ عَلَقَةً فَخَلَقَ فَسَوَّىٰ فَجَعَلَ مِنْهُ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنثَىٰ أَلَيْسَ ذَٰلِكَ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يُحْيِيَ الْمَوْتَىٰ﴾
‘‘মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি বীর্যরূপ এক বিন্দু নগণ্য পানি ছিল না যা (মায়ের জরায়ুতে) নিক্ষিপ্ত হয়? অতঃপর তা মাংসপি-- পরিণত হয়। তারপর আল্লাহ তার সুন্দর দেহ বানালেন এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সুসামঞ্জস্য করলেন। তারপর তা থেকে নারী ও পুরুষ দু’রকম মানুষ বানালেন। সেই স্রষ্টা কি মৃতদের পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম নন?’’ (সূরা কিয়ামাহ: ৩৬-৪০)
পার্থিব জীবনে কোনো কোনো মানুষ সৎকর্মশীল হয় আবার কোনো কোনো মানুষ মন্দ কর্মপরায়ন হয়। তাদের কেউ কেউ নিজ কর্মের ফলাফল ভোগ করার পূর্বেই মারা যায়। এ জন্য আরেকটি জগৎ থাকা উচিত যেখানে মানুষের মাঝে আদল-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ আমলের বিনিময় পাবে।
আখিরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের অন্যতম রুকন। কুরআনের অনেক আয়াতে এ মর্মে দলীল রয়েছে। কখনো কখনো ঈমানের ছয় রুকনের সাথে আখিরাতের প্রতি ঈমান আনয়নের বিষয়টিও জড়িয়ে উল্লেখ করা হয়। ঈমানের রুকনগুলো হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান, আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, রসূলদের প্রতি ঈমান, আখিরাতের প্রতি ঈমান এবং তাক্বদীরের প্রতি ঈমান। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে জিবরীল আলাইহিস সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব প্রশ্ন করেছিলেন, তাতে ঈমানের উপরোক্ত রুকনগুলোর বিবরণ এসেছে।
কখনো কখনো আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে আখিরাতের প্রতি ঈমান আনয়নের বিষয়টি মিলিয়ে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ﴾
‘‘যারা আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন করে না, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো’’। (সূরা আত্ তাওবা: ২৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلَا يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! দানের কথা প্রচার করে এবং কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে নষ্ট করে দিও না। ঐ লোকের মতো যে নিজের ধন লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না’’। (সূরা আল-বাকারা: ২৬৪)
আল্লাহ তা‘আলা আখেরাত দিবসের বিশেষ মর্যাদা বর্ণনা করার জন্য এবং তার বান্দাদেরকে সতর্ক করার জন্য একে অনেকগুলো নামে নামকরণ করেছেন। যাতে তারা এ দিবসের অকল্যাণকে ভয় করে। তাই আল্লাহ তা‘আলা এর নাম রেখেছেন শেষ দিবস। কেননা এটি আসবে দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার পর। আখেরাত দিবসের পরে আর কোনো দিবস নেই। এর আরেকটি নাম হলো কিয়ামত দিবস। কেননা এতে লোকেরা তাদের রবের সামনে উপস্থিত হবে। এর আরো যেসব নাম রয়েছে, তার মধ্যে আল-ওয়াকেয়া, আল-হাক্কাহ, আল-কারিআহ, আল-রাজিফাহ, আল-সাখ্খাহ, আল-আযিফাহ্, আলফাযাউল আকবার, ইয়াওমুল হিসাব, ইয়াওমুদ্দীন এবং আল-ওয়াদুল হাক্ক অন্যতম। এসব নাম কিয়ামতের ভয়াবহতা, কঠিন বিপদ এবং তাতে মানুষ যেসব ভয়াবহ ও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে তার প্রমাণ বহন করে। এটি এমন দিন, যাতে দৃষ্টিসমূহ অবনত হবে, হৃদয়সমূহ স্বীয় স্থান থেকে সড়ে এসে কণ্ঠণালীর কাছে চলে আসবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِذَا جَاءَتْ الصَّاخَّةُ يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ﴾
‘‘অতঃপর যখন কর্ণ বিদারক আওয়াজ আসবে। সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী এবং তার সন্তানদের কাছ থেকেও। সেদিন প্রত্যেকেই নিজের চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে’’। (সূরা আবাসা: ৩৩-৩৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَوْمَ تَكُونُ السَّمَاءُ كَالْمُهْلِ (8) وَتَكُونُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ (9) وَلَا يَسْأَلُ حَمِيمٌ حَمِيمًا (10) يُبَصَّرُونَهُمْ يَوَدُّ الْمُجْرِمُ لَوْ يَفْتَدِي مِنْ عَذَابِ يَوْمِئِذٍ بِبَنِيهِ (11) وَصَاحِبَتِهِ وَأَخِيهِ (12) وَفَصِيلَتِهِ الَّتِي تُؤْوِيهِ (13) وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ يُنْجِيهِ﴾
‘‘সেদিন আকাশ হবে গলিত ধাতুর মতো এবং পর্বতসমূহ হবে রঙিন পশমের মতো। আর কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু অন্তরঙ্গ বন্ধুর খবর নিবে না। যদিও তাদেরকে একে অপরের দৃষ্টির সামনে রাখা হবে। অপরাধী সেদিনের শাস্তির বদলে দিতে চাইবে নিজ সন্তান-সন্ততিকে, স্ত্রী ও ভাইকে এবং তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠিকে, যে তাকে আশ্রয় দিতো এবং পৃথিবীর সকলকে, যাতে এ মুক্তিপন তাকে মুক্তি দেয়’’। (সূরা আল-মাআরিজ: ৮-১৪)
আখেরাত দিবসের প্রতি আমলই মানুষকে সৎকাজে এবং প্রস্ততি গ্রহণের জন্য উৎসাহ প্রদান করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا﴾
‘‘অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎ আমল করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে’’। (সূরা আল-কাহাফঃ ১১০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ (45) الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَأَنَّهُمْ إِلَيْهِ رَاجِعُونَ﴾
‘‘তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তা কঠিন বিষয়। তবে বিনয়ীগণের পক্ষে সেটা মোটেই কঠিন নয়। যারা বিশ্বাস করে যে, নিশ্চয় তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সম্মিলিত হবে এবং তারা তারই দিকে ফিরে যাবে’’। (সূরা বাকারা: ৪৫-৪৬) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يُوفُونَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُونَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيرًا وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا (8) إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا (9) إِنَّا نَخَافُ مِنْ رَبِّنَا يَوْمًا عَبُوسًا قَمْطَرِيرًا (10) فَوَقَاهُمُ اللَّهُ شَرَّ ذَلِكَ الْيَوْمِ وَلَقَّاهُمْ نَضْرَةً وَسُرُورًا﴾
‘‘তারা মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে, যেদিনের অনিষ্ট হবে সুদূর প্রসারী এবং খাবারের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্থ, ইয়াতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমরা তোমাদেরকে খাদ্য দান করি, আমরা তোমাদের নিকট হতে কোনো প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়। আমরা আশঙ্কা করি আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে এক ভীতিপ্রদ ভয়ঙ্কর দিনের। পরিণামে আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করবেন সে দিবসের অনিষ্ট হতে এবং তাদেরকে উৎফুলস্নতা ও আনন্দ দান করবেন’’। (সূরা দাহার: ৭-১১)
আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান শত্রুর মোকাবেলায় দৃঢ়পদ থাকতে এবং কঠিন আপদ-বিপদের সময় সবর করতে উৎসাহিত করে। বাদশাহ তালুত এবং তার সেনাবাহিনী পরীক্ষার নদী পার হয়ে যখন তাদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক শত্রুর সাথে সাক্ষাৎ করলেন, তখন কেবল তাদের মধ্যকার কতিপয় লোক সফলকাম হতে পেরেছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ ঘটনা সম্পর্কে বলেন,
﴿فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ قَالُوا لَا طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو اللَّهِ كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾
‘‘অতঃপর তালুত ও তার সাথীরা যখন নদী পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো তখন তারা তালুতকে বললো, আজ জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যারা একথা মনে করেছিল যে, তাদের একদিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হবে, তারা বললো, অনেকবারই দেখা গেছে, স্বল্প সংখ্যক লোকের একটি দল আল্লাহর হুকুমে একটি বিরাট দলের উপর বিজয় লাভ করেছে। আল্লাহ সবরকারীদের সাথে রয়েছেন’’। (সূরা বাকারা: ৪৯)
আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান না রাখাই মানুষকে কুফুরী, পাপাচার, যুলুম, শত্রুতা, সীমালংঘন ও ফিতনা-ফাসাদের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَنَا وَرَضُوا بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاطْمَأَنُّوا بِهَا وَالَّذِينَ هُمْ عَنْ آيَاتِنَا غَافِلُونَ (7) أُولَئِكَ مَأْوَاهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ﴾
‘‘নিশ্চয় যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না, পার্থিব জীবন পেয়ে পরিতৃপ্ত থাকে, যারা এতেই নিশ্চিন্ত থাকে এবং যারা আমার নিদর্শনাবলী সম্বন্ধে গাফেল, এরূপ লোকদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম তাদের কার্যকলাপের কারণে’’। (সূরা ইউনুস: ৭-৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ﴾
‘‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ ত্যাগ করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কারণ তারা হিসাবের দিবসকে ভুলে রয়েছে’’। (সূরা সোয়াদ: ২৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ (1) فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ (2) وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ﴾
‘‘তুমি কি দেখেছো তাকে যে পরকালকে অস্বীকার করে? সে তো ঐ ব্যক্তি যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্থকে খাদ্য দানে উৎসাহ প্রদান করে না’’। (সূরা আল-মাউন: ১-৩)
যেসব সৎকর্ম আখেরাত দিবসের ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচাবে আল্লাহ তা‘আলা সেটা সম্পাদন করার মাধ্যমে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاتَّقُوا يَوْمًا تُرْجَعُونَ فِيهِ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ تُوَفَّىٰ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ﴾
‘‘যেদিন তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে সেদিনকে ভয় করো। সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার উপার্জিত সৎকর্মের ও অপকর্মের পুরোপুরি প্রতিদান দেয়া হবে এবং কারো উপর যুলুম করা হবে না’’। (সূরা বাকারা: ২৮১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلاَ تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ﴾
‘‘আর তোমরা সেদিনের ভয় করো, যেদিন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবেনা এবং কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কোনো সুপারিশও কবুল হবে না; এবং তারা কোনো রকম সাহায্যও পাবে না’’। (সূরা আল বাকারা: ১২৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ﴾
‘‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো এবং সেই দিনকে ভয় করো যেদিন পিতা সন্তানের কোনো উপকারে আসবে না এবং সন্তানও কোনো উপকারে আসবে না তার পিতার। নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রতিশ্রম্নতি সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে’’। (সূরা লুকমান: ৩৩)
আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থ হলো মরণের পর যা হবে, যেমন কবরের আযাব, নিয়ামত, পুনরুত্থান, হিসাব, দাঁড়িপাল্লা স্থাপন, সৎকাজের ছাওযাব, পাপকাজের শাস্তি, জান্নাত, জাহান্নাম এবং কিয়ামত দিবসের আরো যেসব বিশেষণ আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন তাতে বিশ্বাস করা।