লগইন করুন
১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন শব্দসমূহ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন যাতে আল্লাহ তা‘আলার ও তার সৃষ্টির মধ্যে সমান করে দেয়ার ধারণা হয়। যেমন কেউ বলে থাকেন, ماشَاء الله وشِئْتَ আল্লাহ এবং আপনি যা চেয়েছেন। অথবা কেউ বললো, لولا الله وأنت যদি আল্লাহ না থাকতেন এবং আপনি না থাকতেন। এর বদলে যেন বলে, ماشاء الله ثم شئت আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর আপনি যা চেয়েছেন। কেননা واو দ্বারা সম্পর্ক করা হলে মাতুফ এবং মাতুফ আলাইহিকে সমান করে দেয়া হয়।[1] এভাবে শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সমান করে দেয়া ছোট শিরক। আর এটি বড় শিরকের দিকে নিয়ে যায়।
ماشاء الله ثم شئت ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর আপনি যা চেয়েছেন’ এ কথা বললে শিরক না হওয়ার কারণ হলো, ثُمَّ দ্বারা তারতীব ও তাখীর অর্থ প্রদান করে। অর্থাৎ ثُمَّ-এর পূর্বে উল্লেখিত শব্দের মধ্যে যে অর্থ থাকে, সেটা ثُمَّ-এর পরে উল্লেখিত শব্দের অর্থের পূর্বে বাস্তবায়ন হওয়ার দাবি রাখে।
২) কবর পাকা করা, সেটাতে বাতি জ্বালানো, চুনকাম করা এবং তাতে কিছু লেখার মাধ্যমে কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
৩) সালাত আদায়ের জন্য কবরকে মসজিদে রূপান্তরিত করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এটি মানুষকে কবরের ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়।
৪) সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় এবং সূর্য ডুবার সময় সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এতে ঐসব লোকের সাথে সাদৃশ্যের সম্ভাবনা রয়েছে, যারা এই সময়গুলোতে সূর্যকে সিজদাহ করে।
৫) তিন মসজিদ ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের আশায় অন্য কোনো স্থানের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যে মসজিদ তিনটিতে ছাওয়াবের আশায় ভ্রমণ করা যায়, তা হলো মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদুল আকসা।
৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন,
্রلاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
‘‘তোমরা আমার অতিরিক্ত প্রশংসা করো না। যেমন প্রশংসা করেছিল খ্রিষ্টানরা মারইয়াম তনয় ঈসা (আ.) এর। আমি কেবল আল্লাহ তা‘আলার একজন বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তারই রসূল বলবে’’।[2] প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করাকে الإطراء বলা হয়।
৭) যেসব স্থানে মূর্তিপূজা করা হয় অথবা যেখানে জাহেলী যুগের কোনো উৎসব পালন করা হয়, সেখানে মানত পূরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাওহীদের সংরক্ষণ, তাকে হেফাযত এবং শিরকের রাস্তা বন্ধ করার জন্যই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত কথা বলেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে শিরকের সুস্পষ্ট বর্ণনা করা এবং উম্মতকে শিরক থেকে দূরে রাখার জন্য কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করার পরও কবরপূজারীরা তার সুন্নাতের বিরোধীতা করেছে এবং তার আদেশের বিরুদ্বাচরণ করে ঐসব কাজেই লিপ্ত রয়েছে, যা থেকে তিনি নিষেধ করেছেন। তারা কবরের উপর মজবুত গম্বুজ নির্মাণ করেছে। তার উপর মসজিদ নির্মাণ করেছে, বিভিন্ন অলঙ্কার দিয়ে সেটাকে অলংকৃত করেছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা এগুলোর জন্য বিভিন্ন প্রকার ইবাদতও পেশ করছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, কবরের ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত, তার আদেশ, তার নিষেধ, তার সাহাবীদের আমল এবং বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মানুষের আমলকে যে ব্যক্তি একত্র করবে, সে উভয়ের মাঝে এমন অসংগতি দেখতে পাবে, যা একসাথে একত্রিত হতেই পারে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের দিকে ফিরে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন, আর এরা কবরের নিকট এবং কবরের দিকে ফিরে সালাত পড়ছে। তিনি কবরকে মসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন, আর এরা কবরের উপর মসজিদ বানাচ্ছে এবং আল্লাহর ঘরের মতো বানিয়ে এগুলোকে সমাধি ও পবিত্র স্থান হিসাবে নামকরণ করেছে। তিনি কবরের উপর বাতি জ্বালাতে নিষেধ করেছেন, আর এরা সেটার উপর মোমবাতি ও বাতি জ্বালানোর জন্য সম্পদ ওয়াক্ফ করছে। তিনি কবরকে উৎসবের স্থানে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন, আর এরা একে বিভিন্ন ঈদ ও উৎসবের স্থানে পরিণত করেছে। তাতে ঈদের দিন মুসলিমদের একত্রিত হওয়ার মতো কিংবা তারচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক একত্রিত হয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরকে মাটির সমান করার আদেশ দিয়েছেন। যেমন আবুল হাইয়্যাজ আল্ আসাদী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আলী ইবনে আবু তালেব একদা আমাকে বলেন,
أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ
হে আবু হাইয়্যাজ! আমি কি তোমাকে ঐ কাজ দিয়ে প্রেরণ করবো না যা দিয়ে আমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরণ করেছিলেন? আর তা ছিল এই যে, তুমি কোনো মূর্তি পেলে তা ভেঙে চুরমার করে দিবে, কোনো উচু কবর পেলে তা মাটির বরাবর না করে ছাড়বে না।[3]
কবরপূজারীরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ আদেশের মারাত্মক বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে। তারা কবরকে যমীন থেকে উচু করতে করতে ঘরের মত উঁচু করছে এবং সেটার উপর গম্বুজও নির্মাণ করছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর চুনকাম করতে এবং সেটার উপর বসতে নিষেধ করেছেন। যেমন সহীহ মুসলিমে জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ
‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর চুনকাম করতে, সেটার উপর বসতে এবং তার উপর নির্মাণকাজ করতে নিষেধ করেছেন’’।[4]
কবরের উপর কিছু লিখতেও তিনি নিষেধ করেছেন। যেমন সুনানে তিরমিযীতে জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,
أن رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى أنْ تجصص الْقُبُورُ وَأَنْ يُكْتَبَ عَلَيْهَا
‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর চনুকাম করতে এবং সেটার উপর লিখতে নিষেধ করেছেন’’।[5] ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি হাসান-সহীহ।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তারা কবরের উপর বোর্ড লাগিয়ে তাতে কুরআনের আয়াত এবং অন্যান্য জিনিস লিখে রাখছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর মাটি ছাড়া অন্য কিছু রাখতে নিষেধ করেছেন। যেমন ইমাম আবু দাউদ রহিমাহুল্লাহ জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর চুনকাম করতে অথবা সেটার উপর লিখতে কিংবা তাতে মাটি ছাড়া অন্য কিছু রাখতে নিষেধ করেছেন’’।[6]
অথচ এরা কবরের উপর ইট, টালি, চুনা, পাথর ইত্যাদি ব্যবহার করছে। ইমাম ইবরাহীম নাখঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সালাফগণ কবরের উপর ইট, টালি ইত্যাদি রাখাকে অপছন্দ করতেন।
মোটকথা কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী, কবরকে উৎসবের স্থান হিসাবে গ্রহণকারী, কবরের উপর বাতি প্রজ্বলিতকারী, কবরের উপর গৃহ ও গম্বুজ নির্মাণকারী এসব লোক রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশের বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে।
এর চেয়ে আরো ভয়াবহ হলো কবরসমূহকে মসজিদে রূপান্তরিত করা এবং তার উপর বাতি জ্বালানো। এটি কবীরাহ গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। কবর পূজারীদের বিদআতের ব্যাপারে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
তার যুগের পরে বিষয়টি তাদের অপকর্ম আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আরো ভয়াবহ নিকৃষ্ট আকার ধারণ করেছে। পরবর্তীতে বিষয়টি এমন হয়েছে যে, যারা কবর পূজারীদের বিরোধীতা করে, তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, কট্টরপন্থী এবং অলীদের হক নষ্টকারী হিসাবে গণ্য করা হয়।
আফসোসের ব্যাপার হলো, অলীদের হক নষ্ট করা হলে রাগান্বিত হয়। তাদের ইবাদত বর্জন করাকে তাদের হক নষ্ট হয় বলে মনে করা হয়। কিন্তু বড় বড় শিরকের মাধ্যমে আল্লাহর হক নষ্ট করা হলে তারা মোটেই রাগ করে না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের বিরোধীতার মাধ্যমে তার হক নষ্ট করা হলেও তারা রাগ করে না। আসলে মহান আল্লাহ তা‘আলার শক্তি না হলে অন্যায় কাজ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই এবং তার সাহায্য না হলে সৎ আমল করারও সম্ভব নয়।
৮) যেসব কথা ও কাজ মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়, তার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি অন্যতম। তাই তিনি তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তার প্রশংসায় যেখানে বাড়াবাড়ি করা নিষেধ, সেখানে অন্যদের প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করা আরো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কেননা এটি ক্ষুদ্র সৃষ্টিকে মহান স্রষ্টার হকের মধ্যে শরীক করে দেয়া হয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। যেমন,
لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْد فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
‘‘তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। যেমন প্রশংসা করেছিল খ্রিষ্টানরা মারইয়াম তনয় ঈসা (আ.) এর। আমি কেবল আল্লাহ তা‘আলার একজন বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তার রসূল বলবে’’।[7]
কারো প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করাকে الإطراء বলা হয়। অর্থাৎ তোমরা আমার এমন প্রশংসা করবে না, যাতে সীমালংঘন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামের প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করেছিল। এমনকি তারা তার মধ্যে উলুহীয়াতের দাবিও করেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি একজন বান্দা মাত্র। সুতরাং তোমরা আমাকে কেবল আল্লাহর বান্দা ও তার রসূল বলবে। অর্থাৎ আমাকে উপরোক্ত বিশেষণে বিশেষিত করো। এর সাথে অন্য কিছু যুক্ত করবে না। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তার রসূল বলো।
আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এ গুণেই বিশেষিত করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
﴿الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنزَلَ عَلَىٰ عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجًا﴾
‘‘প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তার বান্দার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন এবং এর মধ্যে কোনো বক্রতা রাখেননি’’। (সূরা কাহাফ: ১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَىٰ عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا﴾
‘‘বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি, যিনি তার বান্দার উপর নাযিল করেছেন ফুরকান। যাতে সে সমগ্র সৃষ্টির জন্য সতর্ককারী হন’’। (সূরা আল ফুরকান: ১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَأَنَّهُ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللَّهِ يَدْعُوهُ كَادُوا يَكُونُونَ عَلَيْهِ لِبَدًا﴾
‘‘আর আল্লাহর বান্দা যখন তাকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন তারা সবাই তার নিকট ভিড় জমালো’’। (সূরা আল জিন: ১৯)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ﴾
‘‘হে রসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার কাছে যা নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছাও’’ (সূরা আল মায়িদা: ৬৭)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ﴾
‘‘হে নবী! তোমরা স্ত্রীদের তালাক দিলে তাদেরকে তাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও’’। (সূরা তালাক: ১)
কিন্তু মুসলিম নামধারী মুশরিকরা তার আদেশের বিরোধীতা করাকেই বেছে নিয়েছে এবং তার নিষেধাজ্ঞার বিরোধীতা করাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। তার প্রতি যে তা’যীম-সম্মান প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন এবং যা থেকে তাদেরকে সতর্ক করেছেন, তারা তাই করছে। তারা তার আদেশের মারাত্মক বিরোধীতা করেছে এবং তারা বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনের ক্ষেত্রে নাসারাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করেছে। কবিতা ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় এমন বাড়াবাড়ি করেছে, যা সুস্পষ্ট শিরক। যেমন কাসীদা বুরদায় বুসেরী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় বলেছেন,
يا أكرم الخلق ما لي من ألوذ به + سواك عند حلول الحادث العمم
‘‘হে সৃষ্টির সেরা সম্মানিত! আমার জন্য কে আছে আপনি ব্যতীত, যার কাছে কঠিন বালা-মুছীবতে আশ্রয় প্রার্থনা করবো?’’ (নাউযুবিল্লাহে)
এর পরের লাইনগুলোর বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, তাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দু‘আ করা, তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা ও আল্লাহ তা‘আলাকে ভুলে গিয়ে সঙ্কটময় সময়ে এবং ভয়াবহ মুছীবতের সময় তার নিকট বিপদাপদ থেকে উদ্ধার কামনা করা হয়েছে।
আসল কথা হলো, এ কবি ও তার মতো অন্যান্য লোকের জন্য শয়তান শিরকী কাজগুলোকে সুসজ্জিত করে দেখিয়েছে। অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় বাড়াবাড়ির পথ দেখিয়েছে। অথচ এগুলোকে ভালোবাসা ও সম্মানের লেবাস পরিয়ে দেখালেও এগুলো বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত এবং তার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে সুন্নাতের পাবন্দী হওয়াকে শয়তান তাদের জন্য তার প্রতি ঘৃণা ও মানহানির পোষাকে প্রকাশ করেছে।
আসল কথা হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ। সুতরাং এতে বাড়াবাড়ি করা, কথায় ও আমলে তার অনুসরণ বর্জন করা এবং তার হুকুমের প্রতি সন্তুষ্ট না থাকাই তার মর্যাদা খাটো করার নামান্তর। সুতরাং তার অনুসরণ করা, তার দীন ও সুন্নাতের সাহায্য করা ব্যতীত তার প্রতি তা’যীম প্রদর্শন হয় না এবং তার ভালোবাসার দাবিও বাস্তবায়ন হয় না।
আব্দুল্লাহ ইবনে শিক্ষীর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি বনী আমেরের প্রতিনিধি দলের সাথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গিয়ে বললাম,
أَنْتَ سَيِّدُنَا فَقَالَ السَّيِّدُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى قُلْنَا وَأَفْضَلُنَا فَضْلاً وَأَعْظَمُنَا طَوْلاً فَقَالَ قُولُوا بِقَوْلِكُمْ أَوْ بَعْضِ قَوْلِكُمْ وَلاَ يَسْتَجْرِيَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ
‘‘আপনি আমাদের সায়্যেদ! মনিব বা প্রভু। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন একমাত্র সায়্যেদ! মনিব, প্রভু। আমরা বললাম: আমাদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমাদের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল। এরপর তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের এ সব কথা অথবা এগুলো থেকে কতিপয় কথা বলে যাও। তবে শয়তান যেন তোমাদেরকে তার বশীভূত করতে না পারে। ইমাম আবু দাউদ এই হাদীছকে ভাল সনদে বর্ণনা করেছেন’’।[8]
উপরোক্ত হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এ কথা বলতে নিষেধ করেছেন যে, ‘আপনি আমাদের সাইয়্যেদ’। তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলাই প্রকৃত সাইয়্যেদ (মনিব)। তিনি তাদেরকে এ কথা বলতে নিষেধ করেছেন যে, আমাদের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমাদের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল। তাদের পক্ষ হতে বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি এটি বলতে নিষেধ করেছেন। তারা তার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রশংসা করাকে অপছন্দ করেছেন। কারণ এটি তাদেরকে বাড়াবাড়ির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেছেন, وَلاَ يَسْتَجْرِيَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ অর্থাৎ শয়তান যেন তোমাদেরকে তার পিছনে টেনে না নেয়। তোমরা যেনে শয়তানের প্রতিনিধি না হয়ে যাও। الجري শব্দের অর্থ দূত ও প্রতিনিধি।
সুতরাং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত হাদীছে বর্ণনা করেছেন যে, প্রশংসিত ব্যক্তির সামনে প্রশংসাকারীর প্রশংসা শয়তানের কাজের অন্তর্ভুক্ত। যদিও প্রশংসার গুণাবলী তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। এতে করে প্রশংসিত ব্যক্তি নিজেকে বড় মনে করতে পারে। আর এটি পূর্ণাঙ্গ তাওহীদেরও পরিপন্থী। এমনি প্রশংসাকারী প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করে ফেলতে পারে। এতে করে সে প্রশংসিত ব্যক্তিকে এমন মর্যাদার আসনে নিয়ে যাবে, যার যোগ্য সে নয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাপারে إطراء করতে নিষেধ করেছেন। প্রশংসায় এমন বাড়াবাড়ি করাকে إطراء বলা হয়, যা মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি প্রশংসিত ব্যক্তি রুবুবীয়ার গুণাবলীতেও গুণান্বিত করে ফেলতে পারে। কতক সীমালংঘনকারী রসূল সাল্লাল্লাহু আআইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় এমন কবিতা রচনা করেছে, যাতে অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। যেমন কাসীদা বুরদাহ এর লেখক বুসেরী এবং অন্যরা এমন কবিতা লিখেছেন, যা তাদেরকে বড় শিরক পর্যন্ত নিয়ে গেছে। বুসেরী বুরদাহয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় বলেন,
يا أكرم الخلق ما لي من ألوذ به + سواك عند حلول الحادث العمم
‘‘হে সৃষ্টির সেরা সম্মানিত! আমার জন্য কে আছে আপনি ব্যতীত, যার কাছে আমি কঠিন বালা মুছীবতে আশ্রয় প্রার্থনা করবো?’’ (নাউযুবিল্লাহ) বুরদাহর আরেক লাইনে সে বলেছে,
فإنَّ من جودك الدنيا وضرَّتها + ومن علومك علم اللوح والقلمِ
হে নবী! আপনার দয়া থেকেই দুনিয়া ও আখেরাত সৃষ্টি হয়েছে। আর আপনার জ্ঞান থেকেই লাওহে মাহফুয ও কলমের জ্ঞান উদ্ভাসিত হয়েছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য আল্লাহ তা‘আলা উবুদীয়াতের মর্যাদাপূর্ণ করার পরও তিনি তার প্রশংসা করাকে অপছন্দ করতেন। উবুদীয়াতের মর্যাদাকে সংরক্ষণ করা এবং আকীদাকে হেফাযত করার জন্যই তিনি তার প্রশংসা করাকে অপছন্দ করেছেন। উম্মতকে তার অতিরিক্ত প্রশংসা বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন। উম্মতের কল্যাণ কামনা করা, তাওহীদের মর্যাদা রক্ষা করা এবং শিরক ও শিরকের মাধ্যমগুলো যেন তাওহীদকে নষ্ট করে ফেলে অথবা সেটাকে যেন দুর্বল না করে ফেলে, তাই তিনি বনী আমের গোত্রের প্রতিনিধি দলকে أنت سيدنا আপনি আমাদের মনিব বলতে নিষেধ করেছেন। السيد শব্দটি السؤدد থেকে নেয়া হয়েছে।
ইবনুল আছীর النهاية গ্রন্থে বলেন, প্রভু, মালিক, ভদ্র, মর্যাদাবান, দয়ালু-দাতা, সহনশীল, স্বজনদের কষ্ট বরদাশতকারী, স্বামী, সভাপতি, অগ্রগামী ইত্যাদি অর্থে السيد শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের কথা السيد الله এর অর্থ হলো প্রকৃত প্রভুত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই। আর সমস্ত সৃষ্টিই তার গোলাম। আল্লাহ তা‘আলার জন্য السيد শব্দটি প্রয়োগ হলে এর অর্থ হবে মালিক, অভিভাবক এবং প্রভু। ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়ালস্নরাহু আনহু الله الصمد এর ব্যাখ্যায় বলেন, তিনি এমন প্রভু, যিনি প্রভুত্বের সকল গুণাবলীতে পূর্ণতায় পৌঁছেছেন।
ইমাম ইবনুল আছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, কোরাইশদের এক লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, আপনি কোরাইশদের সাইয়্যেদ বা প্রভু। তিনি তখন বললেন, আল্লাহই সায়্যেদ বা প্রভু ও মনিব। অর্থাৎ তিনিই যথাযোগ্য প্রভু হওয়ার অধিকারী। আসলে তিনি তার সামনে প্রশংসা করাকে অপছন্দ করেছেন এবং বিনয়ী হওয়াকে পছন্দ করেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ وَلاَ فَخْرَ
‘‘আমি আদম সন্তানের নেতা। তবে এটি কোনো অহংকারের বিষয় নয়’’।[9]
আল্লাহ তা‘আলা তাকে যে সম্মান, ফযীলত নেতৃত্বের গুণাবলী প্রদান করেছেন, সে বিষয়ে সংবাদ দিতে গিয়ে এবং তাকে আল্লাহ তা‘আলা যে নিয়ামত দিয়েছেন, তা উম্মতকে জানাতে গিয়ে এ কথা বলেছেন। যাতে করে তারা সেটার দাবি অনুপাতেই তার প্রতি ঈমান আনয়ন করে। এ জন্যই তিনি স্বীয় ফযীলত বর্ণনা করার পরপরই বলেছেন,وَلاَ فَخْرَ ‘‘তবে এটি কোনো অহংকারের বিষয় নয়’’। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হতে সম্মান স্বরূপ আমি ফযীলতটি অর্জন করেছি। আমি ইহা নিজে অর্জন করিনি এবং স্বীয় শক্তির বলেও উপার্জন করিনি। সুতরাং এতে আমার অহংকার করার কিছু নেই। ইমাম ইবনে আছীরের কথা এখানেই শেষ।
তিনি বনী আদমের নেতা। যেমনটি খবর দিয়েছেন। কিন্তু তারা যখন এ শব্দের মাধ্যমে তার প্রশংসা করলো, তখন তাদেরকে এমন বাড়াবাড়ির আশঙ্কায় তা বলতে নিষেধ করেছেন, যা শিরকের দিকে নিয়ে যাতে পারে।
আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীছ উপরোক্ত কথাটি সুস্পষ্ট করেছে। তিনি বলেন, কতিপয় লোক রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে বললো, হে আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি! হে আমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তির পুত্র! হে আমাদের সাইয়্যেদ (নেতা বা প্রভু)! হে আমাদের নেতার পুত্র! তখন তিনি বললেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا بِقَوْلِكُمْ ولاَ يَسْتَهْوِيَنَّكُمُ الشَّيْطَانُ أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ وَرَسُولُه وَاللَّهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُونِى فَوْقَ فَوْقَ مَنْزِلَتِي الَّتِي أَنْزَلَنِي اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ
‘‘হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের কথা বলে যাও। এমন যেন না হয় যে, শয়তান তোমাদেরকে প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত করে ফেলবে এবং পরিণামে তোমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি শুরু করে দিবে। আমি আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ, আল্লাহর বান্দা এবং তার রসূল। আল্লাহর শপথ! আমি পছন্দ করি না যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন, তোমরা আমাকে তার উপরে উঠাবে। ইমাম নাসায়ী ভাল সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এ হাদীছ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা গেলো যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে লোকদের বাড়াবাড়ির আশঙ্কায় তাদেরকে يا سيدنا ‘‘হে আমাদের নেতা বলতে নিষেধ করেছেন’’।
সুতরাং শুরু থেকেই তিনি এ পথ বন্ধ করেছেন। সুতরাং আমাদের সাইয়্যেদ বলার পরিবর্তে তিনি তাদেরকে এমন দু’টি বিশেষণে বিশেষিত করার আদেশ করেছেন, যা উবুদীয়াতের সর্বোচ্চ স্তর। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের একাধিক স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ গুণ দু’টিতে বিশেষিত করেছেন। এ গুণ দু’টির একটি হলো আব্দুল্লাহ, অন্যটি হলো রসূলুল্লাহ। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তাওহীদ সংরক্ষণ করার জন্য তিনি এটি চাননি যে, লোকেরা তাকে তার চেয়ে উপরে উঠাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অনেক সহীহ সুন্নাতে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন,
لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْد فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ
‘‘তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। যেমন বাড়াবাড়ি করেছিল খ্রিষ্টানরা মারইয়াম তনয় ঈসা (আ.) এর। আমি কেবল আল্লাহ তা‘আলার একজন বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং তার রসূল বলবে’’।[10]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إنه لا يستغات بي وإنما يستغاث بالله
আমার কাছে ফরিয়াদ করা যাবে না। একমাত্র আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করতে হবে।[11]
তিনি কারো প্রশংসা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তার সামনে এক লোক অন্য লোকের প্রশংসা করলে তিনি বলেন,
ويلك! قَطَعْتَ عُنُقَ صَاحِبِكَ
ধ্বংস তোমার জন্য! তুমি তোমার সাথীর গর্দান কেটে ফেলেছো।[12] অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন,
إِذَا لَقِيتُمْ الْمَدَّاحِينَ فَاحْثُوا فِي وُجُوهِهِمْ التُّرَابَ
‘‘যখন তুমি লোকদেরকে দেখবে যে, তারা মানুষের খুব প্রশংসা করছে, তখন তাদের মুখ-মণ্ডলে মাটি নিক্ষেপ করো’’।[13]
প্রশংসাকারীর পক্ষ হতে বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি এ কথা বলেছেন। ঐদিকে যার প্রশংসা করা হবে, তার গর্ব-অহংকারও বেড়ে যেতে পারে। উভয়টিই আকীদহার জন্য ক্ষতিকর।
তবে কোনো মানুষকে سيد বলা যাবে কি না, এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মানুষকে সাইয়্যেদ বলার ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। একদল আলেম তা বলতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ থেকে এ কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের দলীল হলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন বলা হলো,يا سَيِّدُنَا ‘‘আপনি আমাদের নেতা! মনিব বা প্রভু। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,السَّيِّدُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى ‘‘আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন একমাত্র সায়্যেদ! মনিব বা, প্রভু’’।[14]
আরেকদল আলেমের মতে, মানুষকে সাইয়্যেদ বলা বৈধ। তারা আনসারদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদীছকে দলীল হিসাবে পেশ করেছেন। আনসারদের নেতা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে আগমন করলেন, তখন তিনি তাদেরকে বললেন, قُومُوا إِلَى سَيِّدِكُمْ ‘‘তোমরা তোমাদের নেতার জন্য দাঁড়াও’’।[15] এ হাদীছটি প্রথম হাদীছের চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তি এখানেই শেষ।
ব্যাখ্যাকার বলেন, আনসারদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা, ‘‘তোমরা তোমাদের নেতার জন্য দাঁড়াও’’ দ্বারা দলীল পেশ করার ব্যাপারে কথা হলো, তিনি সা'দের উপস্থিতিতে এবং তাকে লক্ষ্য করে এ কথা বলেননি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। ভাষ্যকারের কথা এখানেই শেষ।
তাদের দলীলটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ, এ কথার অর্থ হলো, মানুষের সামনে প্রশংসা স্বরূপ এ কথা বলা যাবেনা যে, يا سيد হে আমাদের নেতা বা প্রভু বা মনিব! তবে অনুপস্থিত ব্যক্তির প্রশংসায় এটি বলা যাবে। তবে সে যদি প্রকৃত পক্ষেই এ বিশেষণের অধিকারী হয়ে থাকে, তাহলেই কেবল এটি বলা যাবে; অন্যথায় নয়। এভাবে ব্যাখ্যা করলে উভয় দলীলের মধ্যে সামঞ্জস্য হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
চলমান পাতা....
[2]. বুখারী ও মুসলিম। অধ্যায়: আল্লাহর বাণী: আপনি কিতাবে মারইয়ামের কথা স্মরণ করুন।
[3] . সহীহ মুসলিম, হা/১৬০৯।
[4]. সহীহ মুসলিম হা/১৬১০।
[5]. তিরমিযী, হা/ ৯৭২।
[6]. আবু দাউদ হা/২৮০৭।
[7]. বুখারী ও মুসলিম। অধ্যায়: আল্লাহর বাণী: আপনি কিতাবে মারইয়ামের কথা স্মরণ করুন।
[8]. সহীহ: মিশকাতুল মাসাবীহ, হা/৪৯০০।
[9]. তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুত তাফসীর, হাদীছ নং- ৩১৪৮। ইবনে মাজাহ, অধ্যায়: কিতাবুশ শাফা‘আহ, হাদীছ নং- ৪৩৬৩। ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীছটি সহীহ।
[10]. সহীহ বুখারী ৩৪৪৫ ও মুসলিম। অধ্যায়: আল্লাহর বাণী: আপনি কিতাবে মারইয়ামের কথা স্মরণ করুন।
[11]. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহি.) স্বীয় মুসনাদে এবং ইমাম তাবারানী (রহি.) আলমুজামুল কবীরে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছের সনদে ইবনে লাহীয়া থাকার কারণে মুহাদ্দিছগণ হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন।
[12]. সহীহ বুখারী ২৬৬২, মুসলিম ৩০০০।
[13]. সহীহ: আবু দাউদ ৪৮০৪।
[14]. সহীহ: আবূ দাউদ ৪৮০৬।
[15]. সহীহ বুখারী ৩০৮৩, সহীহ মুসলিম ১৭৬৮, আবু দাউদ ৫২১৫।