মানহাজ (আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ) নিত্য নতুন মানহাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উপকারী জবাব শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
প্রশ্ন-৬০ : শাসকদের নছীহত বা কল্যাণকামিতার শারঈ পদ্ধতি কী?

উত্তর : অনেকভাবে শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনা করা যেতে পারে। তাদের মুক্তি ও হিদায়াতে অটল থাকার জন্য দু’আ করা। শাসকদের কল্যাণার্থে দু’আ করা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।[1] বিশেষত দু’আ কবুল হওয়ার বিশেষ বিশেষ সময় ও স্থানে দু’আ করা।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তা’আলা বলেন, যদি কবুল হওয়ার বিশেষ কোন দু’আ থাকতো তাহলে আমি শাসকদের জন্যই সেই দু’আ করতাম।[2] কেননা শাসকের উপকারে পুরো সমাজের উপকার এবং শাসকের ক্ষতিতে পুরো সমাজের ক্ষতি নিহিত।

শাসকের জন্য কল্যাণকামিতার আরো ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন চাকুরিজীবীদের উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসমূহ পালন করা, সমাজে সংঘটিত কোন মন্দ ও অশ্লীল কাজ সম্পর্কে শাসকগণ অনবগত থাকলে সে ব্যাপরে তাদেরকে অবগত করা। তবে অবশ্যই এই উপদেশ প্রদান উপদেশদাতা ও গ্রহীতার মাঝে গোপনে সংঘটিত হতে হবে।[3]

মঞ্চে ময়দানে বা প্রকাশ্যভাবে নছীহত প্রদান করা যাবে না। কেননা এ পদ্ধতিতে অকল্যাণ ছড়িয়ে পড়ে এবং শাসক ও জনগণের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। মঞ্চে ময়দানে বা জনসম্মুখে শাসকদের সমালোচনা করা নছীহত প্রদানের পন্থা নয়। এর দ্বারা কোন উপকার সাধিত হয় না। বরং অকল্যাণই বৃদ্ধি পায়।[4]

শাসকদেরকে উপদেশ প্রদানের পদ্ধতি হলো আপনি ব্যক্তিগতভাবে, লিখনির মাধ্যমে অথবা শাসকদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে গোপনে তাদেরকে নছীহত প্রদান করবেন।

বর্তমানে শাসকদের জন্য নছীহত লিখে তা জনগণের হাতে হাতে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় তা নছীহার অন্তর্ভুক্ত নয়। যদিও আমরা এটাকে নছীহত (উপদেশ) বলছি মূলতঃ এটা ফাদ্বীহাত বা দুর্নাম। এর দ্বারা বিবিধ অকল্যাণ হয়ে থাকে। শত্রুরা আনন্দ পায় এবং প্রবৃত্তিবাদীরা এর দ্বারা অনধিকার চর্চার অবকাশ পায়।


[1]. ইমাম মুহাম্মাদ আল-হাসান ইবনে আলী আল বারবাহারী ‘শারহুস সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থে বলেন, তুমি যদি কোন ব্যক্তিকে শাসকের বিরুদ্ধে বদ দু’আ করতে দেখ তাহলে নিশ্চিত জেনে নাও যে সে প্রবৃত্তিবাদী। আর যদি কোন ব্যক্তিকে শাসকদের কল্যাণে দু’আ করতে দেখ তাহলে নিশ্চিত জেনে নাও যে, সে সুন্নাহর অনুসারী। ইনশাআল্লাহ। পৃ.১১৬ তাহকীক আবু ইয়াসির খালিদ আর-রদাদী।

সালাফে সালেহীন শাসকদের পক্ষে দু’আ করেছেন এ ব্যাপারে অনেক আছার রয়েছে। ফুযাইল ইবনে আয়ায (রহ.) এর প্রতি লক্ষ্য করুন, তিনি বলেন, যদি আমার একটিই মাত্র কবুল যোগ্য দু’আ থাকতো তাহলে আমি তা শাসকের কল্যাণেই ব্যয় করতাম। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তা কীভাবে হে, আবু আলী ? তিনি প্রতুত্তরে বললেন,  যদি আমি নিজের জন্য দু’আ করি তাহলে তা শুধু আমার নিজেরই উপকার করবে। আমার ছাড়া অন্য কারো উপকারে আসবে না। পক্ষান্তরে আমি যদি শাসকের জন্য দু’আ করি তাহলে এর দ্বারা শাসকের দেশের এবং সকল জনগণের উপকার হবে। (হিলইয়াতুল আওলিয়া খ.৮ পৃ. ৯১) ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ.) তার পুত্র আব্দুল্লাহ (রহ.) কে চিঠির মাধ্যমে লিখে পাঠিয়ে ছিলেন যে আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমীরুল মু’মিনীনের স্থায়িত্ব কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাকে অটল রাখেন, তাকে সাহায্যে-সহযোগিতা করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সকল কাজে সক্ষম। (আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ (রহ.), কিতাবুস-সুন্নাহ খ. ০১ পৃ. ১৪০; যাহাবী, আস-সিয়ার ১১/৩৮৭)।

[2]. মাজমু‘উল ফাতওয়া খ. ২৮, পৃ.৩৯১; কাশশাফুল কিনা’ খ. ০১ পৃ.১৪০

[3]. এটাই হলো শাসকদেরকে উপদেশ প্রদান করার আদর্শপন্থা। রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে আমাদেরকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে বলেন,

من كانت عنده نصيحة لذي سلطان فلا يكلمه بها علانية، وليأخذه بيده وليخل به؛ فإن قبلها قبلها، وإلا كان قد أدى الذي عليه والذي له

যদি কারো নিকট শাসককে প্রদান করার জন্য কোন উপদেশ থাকে তাহলে সে যেন তা প্রকাশ্যে জনসম্মুখে না বলে। বরং সে যেন শাসকের হাত ধরে সংগোপনে বলে। যদি শাসক তার উপদেশ গ্রহণ করে তো ভালো। না করলে ও সে তার নিজের দায়িত্ব পালন করলো। (হাসান, হাকিম)।

[4]. প্রকাশ্যে উপদেশ প্রদান করাতে সমূহ ক্ষতি বিদ্যমান।

(ক) লৌকিকতার বহিঃপ্রকাশ: প্রকাশ্যে উপদেশ প্রদান করলে লৌকিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আর এটা সর্বজন জ্ঞাত বিষয়, যে লৌকিকতার পরিণাম স্বরূপ পুরো আমলটাই বরবাদ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে গোপন আমল কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

খ) উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক প্রকাশ্য নছীহাই গ্রহণের সম্ভাবনা খুবই কম থাকে কেননা সে দেখতে পায় যে এটা তার জন্য নছীহত বা উপদেশ নয় বরং ফাদ্বীহাত বা নিন্দাবাদ।

গ) মঞ্চে ময়দানে প্রকাশ্যে শাসকের সমালোচনাকারী তাদের বাস্তব দোষত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করলেও এর দ্বারা জনগণকে শাসকের উপর উস্কে দেয়া হয়। কখনো কখনো এর দ্বারা সৎকাজেও জনগণকে শাসকদের নির্দেশ শ্রবণ ও আনুগত্য করা থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এটা মূলতঃ খারিজীদের মানহাজ। উছমান (রা.) কে হত্যার সেই ফিতনা এভাবেই ঘটেছিল। সুন্নাহ সম্পর্কে কিছু লোক সাধারণ জনগণকে উছমান (রা.) এর ব্যাপারে ধোঁকা দিল। এর পর সেই মর্মামিত্মক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটল। সুতরাং যুবক বা জনসাধারণকে এই নষ্ট মানহাজে দীক্ষা দেয়া জায়েয নয়। এই নষ্ট শয়তানী মানহাজ মানুষকে ধ্বংসের প্রতি ঠেলে দেয়। বরং কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মানহাজ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার দ্বারা ঐ মানহাজের মুকাবিলা করতে হবে। আল্লাহই ভালো জানেন।