যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান ব্যভিচার আবদুল হামীদ ফাইযী
ব্যভিচার

বিবাহ-বন্ধনের পূর্বে মনের বন্ধন যথেষ্ট মনে করে নারী-পুরুষের অবৈধ সংসর্গ বা যৌনমিলন সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক বড় ব্যাধি। বিয়ে না করেই এ ধরনের যৌনক্রিয়া চরিত্রগত একটি জঘন্য অপরাধ। এ পথ ও আচরণ হল দুশ্চরিত্র, ভ্রষ্ট ও লম্পটদের। উভয়ের বিয়ে তো হবেই’ মনে করে কোন প্রকার স্পর্শ বা দেহ-মিলন বৈধ হতে পারে না। যতক্ষণ না আল্লাহর বিধান দ্বারা উভয়ের মাঝে বন্ধন প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎও হারাম।

ব্যভিচার একটি কদর্য ও নোংরা আচরণ। ব্যভিচারে রয়েছে একাধিক বিঘ্ন ও বিপত্তি। ব্যভিচারে বংশ-পরিচয় হারিয়ে যায়, সম্ভ্রম নষ্ট হয়। ব্যভিচার-ঘটিত কারণে মানুষে-মানুষে শত্রুতা ছড়িয়ে পড়ে। এটি এমন অপরাধ, যে অন্যান্য আরো অপরাধ টেনে নিয়ে আসে। ব্যভিচার হল পশুর আচরণ। ব্যভিচারের ফলে নানান ব্যাধি ও মহামারী দেখা দেয় সমাজে। যার জন্য সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ মানুষকে সাবধান করে বলেন, “আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।” (সূরা ইসরা ৩২ আয়াত)

অপরাধ হিসাবে ব্যভিচার তুলনামূলকভাবে অধিকতর জঘন্য। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, হত্যার পর ব্যভিচারের চেয়ে বড় গোনাহর কাজ আর অন্য কিছুকে জানি না। বলা বাহুল্য এ কদাচার কোন মু'মিন নারী-পুরুষের হতে পারে না। মহান আল্লাহ নিজ বান্দার কিছু গুণ বর্ণনা করে বলেন, “এবং তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহ্বান (শির্ক) করে না, আল্লাহ যে প্রাণ-হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতীত তা হত্যা করে।

এবং ব্যভিচার করে না। যারা এ গুলো করে তারা শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন ওদের শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে ওরা হীন অবস্থায় স্থায়ী হবে।” (সূরা ফুরকান ৬৮-৬৯

মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, সবচেয়ে বড় পাপ কি? উত্তরে তিনি বললেন, “তোমার আল্লাহর সহিত কাউকে অংশী স্থাপন করা, অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোন্ পাপ? তিনি বললেন, “তোমার সঙ্গে খাবে এই ভয়ে নিজ সন্তান হত্যা করা।” পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোন পাপ?' তিনি বললেন, “তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা।” (বুখারী ৪৭৬১, মুসলিম ৮৬ নং)

উক্ত আয়াত ও হাদীসে লক্ষণীয় যে, ব্যভিচারের পাপকে মানুষ খুন করার মত মহাপাপ। এবং শির্কের মত অতি মহাপাপের পাশাপাশি বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এই জঘন্য কাজটি মুশরিকের জন্য শোভনীয়, কোন মুসলিমের জন্য নয়। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ একটি বাস্তব পরিস্থিতি উল্লেখ করে বলেন, “ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক নারীকেই বিবাহ করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিবাহ করে। আর তা মু’মিনদের জন্য হারাম করা হয়েছে।” (সূরা নর ৩ আয়াত)।

মহান আল্লাহ তার মুমিন বান্দার গুণ বর্ণনা করে অন্যত্র বলেন, “মুমিন বান্দারা অবশ্যই সফলকাম। ---যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। --- (অর্থাৎ, ব্যভিচার করে। ।) (সূরা মু'মিনুন ৫, সূরা মাআরিজ ২৯ আয়াত) মহানবী (সা.) বলেন, “মু’মিন থাকা অবস্থায় কোন ব্যভিচারী ব্যভিচার করে না।” (বুখারী, মুসলিম প্রমুখ) অর্থাৎ, এ অবস্থায় তার ঈমান তার হৃদয়ে অবস্থান করে না!

পক্ষান্তরে ব্যভিচার সে-ই করতে পারে, যার লজ্জা-শরম নেই। নির্লজ্জ নারী-পুরুষই এমন অবৈধ যৌন-মিলন ঘটাতে পারে। অথচ “লজ্জা হল ঈমানের একটি শাখা।” (মুসলিম, তিরমিযী প্রমুখ, সহীহুল জামে ৩১৯৭ নং) সুতরাং লজ্জা না থাকলে তথা নির্লজ্জ হয়ে ব্যভিচারের মত মহাপাপ করলে সে অবস্থায় মু’মিন থাকা যায় কি করে? ব্যভিচারী আল্লাহর কাছে দুআ করলেও তার দুআ কবুল হয় না। (সহীহুল জামে ২৯৭ ১নং)

ব্যভিচারী ইসলামী রাষ্ট্রে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত। বিবাহিত নারী-পুরুষ ব্যভিচার করে থাকলে তাদেরকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। অবশ্য ব্যভিচারী নারী-পুরুষ অবিবাহিত হলে তাদের শাস্তি হাল্কা। মহান আল্লাহ বলেন, “ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী -ওদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত কর; আল্লাহর বিধান কার্যকরী করতে ওদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে অভিভূত না করে যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও। আর মু'মিনদের একটি দল যেন ওদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” (সূরা নুর ২ আয়াত)

এ ছাড়া মহানবী (সা.) এর জবানী মতে উভয়কে বেত্রাঘাত সহ এক বছরের জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করার কথাও বলা হয়েছে।

সুতরাং উক্ত জঘন্যতম কাজ যে কেউ প্রেম ও ভালোবাসার মাধ্যমে করুক অথবা এমনিই করুক, ভদ্র করুক অথবা অভদ্র করুক, ধনী করুক অথবা গরীব করুক, প্রত্যেকের জন্য একই শাস্তি প্রযোজ্য এবং কারো ব্যাপারেই এ শাস্তি প্রয়োগে কোন প্রকার দয়া প্রকাশ করার অবকাশ নেই। কারণ, ব্যভিচারী হল সমাজের কলঙ্ক, কুলের কুলাঙ্গার, পবিত্র পরিবেশের ঘৃণ্য জীব। বিশেষ করে সেই নারী ও পুরুষ, যার স্বামী ও স্ত্রী থাকতেও অথবা যৌনক্ষুধা কিছু প্রশমিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যভিচার করে, বেশ্যালয়ে যায় অথবা ফ্রেন্ড’ ব্যবহার করে, তারা এমন অপরাধী; যাদেরকে সমাজে বাঁচিয়ে রাখাই হল কলঙ্ক প্রতিপালিত করা, আর তা পবিত্র সমাজ ও পরিবেশের জন্য বড় অহিতকর।

পরন্তু কেউ যদি গোপনে এমন মহাপাপ করেও দুনিয়ার শাস্তি থেকে বেঁচে যায়, তাহলে সে যে রক্ষা পেল তা নয়। দুনিয়াতে তার শাস্তি প্রয়োগ না হলেও আখেরাতে মহাবিচারকের বিচারে সে মহাশাস্তি ভোগ করবে।

পাপ করে যাবে কোথায়? তোমার পাপের কথা তোমার অতন্দ্র-প্রহরী সঙ্গী ফিরিস্তা তোমার রোজনামচা আমলনামায় লিখে রাখছেন। একদিন এমন আসছে, যেদিন আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে। মাটি সেদিন তার সকল খবর বলে দেবে। অণু পরিমাণ পাপ অথবা পুণ্য স্বচক্ষে দেখা যাবে।

মনে কর এক কক্ষে তুমি তোমার প্রিয়তমার সহিত অবৈধ দেহ-মিলনে বিভোল আছ। এমন সময় কক্ষের দরজা ঠেলে তোমার আব্বা, আম্মা, ভাই, বিশ্বস্ত বন্ধু অথবা কোন শত্রু তোমাকে ঐ অবস্থাতেই দেখে ফেলল। তখন তোমার অনুভূতি কি হবে? আর যদি তুমি এমনই চালাক হও যে, তোমার সে কাজ কেউই ধরতে ও বুঝতে পারে না, তাহলে “তুমি কখনো মনে করো না যে, অত্যাচারীরা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে উদাসীন। অবশ্য তিনি ওদেরকে সেদিন পর্যন্ত ঢিল দেন, যেদিন চক্ষু স্থির হবে।” (সূরা ইবরাহীম ৪২ আয়াত)

সৃষ্টির নজর থেকে গোপনীয়তা অবলম্বন করলেও স্রষ্টার নজর থেকে তা কোন সময়ই পারবে না। ঘরের সকল দরজা বন্ধ করে পাপে লিপ্ত হলেও আল্লাহ ও তোমার মাঝে কোন দরজা বা পর্দার আড়াল আনতে পার না। রাতের গোপন গহীন অন্ধকারে সকলে ঘুমে ঢলে। পড়েছে, তুমি সে সময়কে প্রিয়ার সহিত মিলনের সুবর্ণ সুযোগ মনে করলেও, এ কথা ভুলে যেও না যে, একজন সদা জাগ্রত আছেন। যিনি সকল পর্দা ও অন্ধকারের আবরণ ভেদ করে তোমার প্রতি সুতীক্ষ দৃষ্টি রেখেছেন। সুতরাং পরকালের মহাশাস্তির জন্য প্রস্তুত থেকো।

মহানবী (সা.) বলেন, “অধিকাংশ যে অঙ্গ মানুষকে দোযখে নিয়ে যাবে, তা হল মুখ ও গুপ্তাঙ্গ।” (আহমাদ ২/২৯১, তিরমিযী ২০০৪, ইবনে মাজাহ ৪২৪৬, সিলসিলাহ সহীহাহ ৯৭৭ নং) তিনি স্বপ্নযোগে এক শ্রেণীর ব্যভিচারী নারী-পুরুষের আযাব দর্শন করেন; যারা উলঙ্গ অবস্থায় আগুনের চুল্লীতে আগুনের ক্ষিপ্ত প্রবাহে ওঠা-নামা করছে। (মুসলিম)

তিনি আরো দেখেন যে, এক সম্প্রদায় ফুলে-ফেঁপে ঢোল হয়ে আছে, তাদের নিকট হতে বিকট দুর্গন্ধ ছুটছে। মনে হচ্ছিল তাদের সে গন্ধ যেন পায়খানার ট্র্যাংকের মত। তারা ছিল ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীর দল। (ইবনে খুযাইমাহ ১৯৮৬, ইবনে হিব্বান ৭৪৯ ১ নং, হাকেম ১/৪৩০)