লগইন করুন
ব্যাখ্যাঃ নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করার ক্ষেত্রে যে ধমকি রয়েছে, এখানে তার বিবরণ এসেছে। নক্ষত্রের দিকে বৃষ্টি বর্ষনের সম্বন্ধ করাকে الاستسقاء بالأنواء বলা হয়। أنواء শব্দটি نوء শব্দের বহুবচন। অর্থ হচ্ছে চন্দ্রের কক্ষপথ।
আবুস সাআদাত (রঃ) বলেনঃ চন্দ্রের মোট কক্ষপথের সংখ্যা ২৮টি। প্রত্যেক রাতে চাঁদ এগুলোর একটি পথে অবতরণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ
‘‘চন্দ্রের জন্য আমি বিভিন্ন মনযিল বা কক্ষপথ নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খেজুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। (সূরা ইয়াসীনঃ ৩৯)
প্রত্যেক ১৩ রাত পর ফজর উদিত হওয়ার সাথে সাথে চন্দ্রের একটি মঞ্জিল অস্ত যায়। ঠিক তখনই তার বদলে অন্য একটি মঞ্জিল উদিত হয়। প্রাচীন আরবরা ধারণা করত যে, চন্দ্রের এক মঞ্জিল উধাও হয়ে অন্য মঞ্জিল উদিত হওয়ার সময় বৃষ্টি হয়। ঐ সময় যে তারকাটি লোপ পেত আরবরা তার দিকেই বৃষ্টির সম্বন্ধ করত। তারা তখন বলতঃ আমরা অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি। আরবী ভাষায় একে نوء বলার কারণ হল, যখন একটি তারকা পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হত, তখনই পূর্বাকাশে অন্য একটি তারকা উদিত হত। نوء অর্থ উদিত হওয়া।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তোমরা নক্ষত্রের মধ্যে তোমাদের রিযিক নিহিত আছে মনে করে আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করছো’’।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ ‘‘তোমরা নক্ষত্রের মধ্যে তোমাদের রিযিক নিহিত আছে মনে করে আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করছ’’। (সূরা আল ওয়াকিয়াঃ ৮২)
ব্যাখ্যাঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, তিরমিযী হাসান সূত্রে, ইবনে জারীর, আবু হাতিম এবং ইমাম যিয়াউদ্দীন মাকদেসী স্বীয় কিতাব মুখতারায় আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর বাণীঃ وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ ‘‘তোমাদের নেয়ামতের অংশকে’’ অর্থাৎ আল্লাহর শুকরিয়াকে তোমরা এই করেছ যে, তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করছো। তোমরা বলে থাক যে, অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি।
আলী, ইবনে আববাস, কাতাদাহ, যাহ্হাক, আতা আল-খোরাসানী এবং অন্যান্য আলেম থেকে উপরোক্ত ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। এটিই অধিকাংশ মুফাসসিরে কেরামের মত। এর মাধ্যমেই উক্ত আয়াত থেকে লেখকের দলীল গ্রহণের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তোমাদের জীবন যাপনের উপকরণ হিসাবে এ রিযিক পেয়ে তোমরা মিথ্যারোপ করছো, অর্থাৎ কুরআনকে মিথ্যা বলছো।
হাসান বলেনঃ কুরআন থেকে তোমাদের অংশ শুধু এতটুকুই নিয়েছো যে, তোমরা কুরআনের প্রতি মিথ্যারোপ করছ। তিনি আরো বলেনঃ ক্ষতিগ্রস্ত ঐ ব্যক্তি, যে কুরআনকে অবিশ্বাস করা ব্যতীত কুরআন থেকে আর কিছুই গ্রহণ করেনি।
আবু মালেক আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«أَرْبَعٌ فِى أُمَّتِى مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِى الأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُومِ وَالنِّيَاحَةُ وَقَالَ النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ»
‘‘জাহেলী যুগের চারটি কু-স্বভাব আমার উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, যা তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করতে পারবেনা। (এক) আভিজাত্যের অহংকার করা। (দুই) বংশের বদনাম করা। (তিন) নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা এবং (চার) মৃত ব্যাক্তির জন্য বিলাপ করা। তিনি আরও বলেনঃ ‘মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপকারিনী মৃত্যুর পূর্বে যদি তাওবা না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে যে, তার পরনে থাকবে আলকাতরার প্রলেপযুক্ত লম্বা জামা এবং খোস-পাঁচড়াযুক্ত কোর্তা।[1]
ব্যাখ্যাঃ আবু মালেকের নাম হচ্ছে হারিছ বিন হারিছ আল-শামী। তিনি ছিলেন সাহাবী। তাঁর নিকট থেকে একমাত্র আবু সালাম হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্যতীত আবু মালেক নামে আরো দু’জন সাহাবী রয়েছে।
أَرْبَعٌ فِى أُمَّتِى مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ ‘‘আমার উম্মতের মধ্যে চারটি বিষয় রয়েছে, যা তারা পরিত্যাগ করতে পারবেনা’’ঃ অর্থাৎ এই উম্মতের লোকেরা তাতে লিপ্ত হবে। সেগুলো হারাম হওয়া সম্পর্কে জেনে অথবা না জেনেই তাতে লিপ্ত হবে। অথচ সেগুলো হচ্ছে জাহেলী যামানার কাজকর্ম। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সকল মুসলিমের উচিৎ তা থেকে বিরত থাকা। জাহেলিয়াত বলতে এখানে নবুওয়াতের পূর্বের যুগ উদ্দেশ্য। যারা এগুলোতে লিপ্ত হবে, তারা অপরাধী হবে। এ কাজগুলো থেকে মানুষকে নিষেধ করা উচিত। যখনই কোনো সমাজে শির্ক পাওয়া যাবে, তখন তার সাথে এ অন্যায় কাজগুলো এবং তার সাথে অন্যান্য অপরাধও পাওয়া যাবে।
শাইখুল ইসলাম বলেনঃ উপরোক্ত হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, জাহেলী যামানার কতিপয় আমল এই উম্মতের লোকেরা ছাড়তে পারবেনা। এখানে ঐ সমস্ত লোকদের নিন্দা করা হয়েছে, যারা এগুলোতে লিপ্ত হবে। এ থেকে আরও জানা গেল যে, জাহেলী যামানার প্রত্যেক কাজই ইসলামে নিন্দিত। তাই যদি না হত, তাহলে এ পাপ কাজগুলোকে জাহেলীয়াতের কাজ বলে উল্লেখ করে তার নিন্দা করা হতনা। আর এটিও জানা কথা যে, উক্ত বিষয়গুলোকে নিন্দা করার জন্যই জাহেলিয়াতের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى
‘‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে। মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না’’। (সূরা আহজাবঃ ৩৩) এখানে জাহেলী যামানার নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বের হওয়ার নিন্দা করা হয়েছে এবং জাহেলী যুগের লোকদেরও নিন্দা করা হয়েছে। এ নিন্দার দাবী হচ্ছে জাহেলী যুগের লোকদের সাদৃশ্য করা নিষিদ্ধ।
الفخر بالأحساب বংশ ও আভিজাত্যের অহংকার করাঃ অর্থাৎ বাপ-দাদাদের নাম-ডাক ও সুনাম-সুখ্যাতির মাধ্যমে মানুষের সাথে বড়াই করা। এটি বিরাট মূর্খতা। কেননা তাকওয়া তথা আল্লাহ ভীতি ছাড়া মর্যাদার অন্য কোনো বিষয় নেই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্র কাছে সেই সর্বাধিক মর্যাদাবান, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন’’। (সূরা হুজরাতঃ ১৩)
সুনানে আবু দাউদে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফু হিসাবে বর্ণিত হয়েছে,
«إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ أَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرَهَا بِالآبَاءِ مُؤْمِنٌ تَقِىٌّ وَفَاجِرٌ شَقِىٌّ أَنْتُمْ بَنُو آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ لَيَدَعَنَّ رِجَالٌ فَخْرَهُمْ بِأَقْوَامٍ إِنَّمَا هُمْ فَحْمٌ مِنْ فَحْمِ جَهَنَّمَ أَوْ لَيَكُونُنَّ أَهْوَنَ عَلَى اللَّهِ مِنَ الْجِعْلاَنِ الَّتِى تَدْفَعُ بِأَنْفِهَا النَّتْنَ»
‘‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের থেকে জাহেলীয়াতের অহংকার এবং বাপ-দাদাদের সুনাম-সুখ্যাতি নিয়ে গর্ব করাকে বাতিল করে দিয়েছেন। এখন মানুষের মধ্যে শুধু মুমিন মুত্তাকী না হয় হতভাগ্য পাপিষ্ঠ, -এ দু’প্রকার লোকই রয়েছে। সমস্ত মানুষ আদমের সন্তান। আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি হতে। লোকদের উচিত, তাদের পূর্ব পুরুষদের সুনাম নিয়ে গর্ব না করা। কেননা তারা এখন জাহান্নামের কয়লায় পরিণত হয়েছে। অথবা তারা আল্লাহর নিকট কালো আকৃতির ঐ গোবরের পোঁকার চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট, যে তার নাক দিয়ে পঁচা-দুগর্ন্ধযুক্ত বস্ত্ত যেমন পায়খানা, গোবর ইত্যাদি উলটপালট করে।[2]
وَالطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ মানুষের বংশের বদনাম ও দোষারোপ করাঃ একদা আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন এক ব্যক্তির মায়ের নাম নিয়ে গালি দিল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তুমি তার মায়ের নাম নিয়ে গালি দিলে? নিশ্চয়ই তুমি এমন একজন ব্যক্তি, যার মধ্যে জাহেলী যুগের অভ্যাস বিদ্যমান রয়েছে।[3]
এ হাদীছ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কারো বংশের বদনাম করা জাহেলিয়াতের অন্তর্ভূক্ত। আরও জানা গেল যে, কোনো কোনো মুসলিমের মধ্যে জাহেলিয়াতের কিছু বৈশিষ্টও থাকতে পারে। ইহুদী কিংবা নাসারাদের অভ্যাসও থাকতে পারে। তাতে সে কাফের বা ফাসেক হয়ে যায়না। এটি হচ্ছে শাইখুল ইসলামের মত।
الاستسقاء بالأنواء তারকারাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করাঃ যখন কোনো মানুষ বলবে, আমরা অমুক অমুক গ্রহ-নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি, তখন তার বিশ্বাস এমন হতে পারে যে, বৃষ্টি বর্ষণে নক্ষত্রের প্রভাব রয়েছে। এমন বিশ্বাস কুফরী ও শির্কের অন্তর্ভূক্ত। কেননা সে বৃষ্টি বর্ষণকারীকে বাদ দিয়ে অন্যের দিকে বৃষ্টির সম্বন্ধ করল। অথচ আল্লাহ তাআলাই একমাত্র বৃষ্টি বর্ষণ করেন। আর যদি তার বিশ্বাস এমন হয়, তারকা বৃষ্টি বর্ষণকারী নয়; বরং আল্লাহই একমাত্র বৃষ্টি বর্ষণকারী, তথাপিও এ বাক্যটি ব্যবহার করাকে ইবনে মুফলিহ (রঃ) তার ‘কিতাবুল ফুরু’তে এবং ‘আল-ইনসাফ’ গ্রন্থকার হারাম বলেছেন। এতে কোনো মতভেদ নেই।
মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপ করাঃ বিলাপ অর্থ হচ্ছে মৃতের উপর উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করা, চেহারায় আঘাত করা, বুকের দিক থেকে জামা ছিড়ে ফেলা এবং অনুরূপ কান্ড করা। এ কাজগুলো কবীরা গুনাহর অন্তর্ভূক্ত। কেননা এতে কঠোর ধমকি ও শাস্তির কথা এসেছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে উপরের হাদীছে।
النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا ‘‘বিলাপকারিনী মৃত্যুর পূর্বে যদি তাওবা না করে’’ঃ এতে প্রমাণিত হয় যে, তাওবা করলে গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ ‘‘তাকে আলকাতরার প্রলেপযুক্ত লম্বা জামা এবং খোস-পাঁচড়াযুক্ত কোর্তা পরিয়ে কিয়ামতের দিন উঠানো হবে’’ঃ হাদীছে سربال শব্দটি একবচন। বহুবচনে سرابيل। লম্বা কোর্তা ও জামাকে সিরবাল বলা হয়। হাদীছে বর্ণিত এ সারাবীল বা কোর্তা হবে জাহান্নামীদের পোষাক। এগুলো হবে আলকাতরার প্রলেপযুক্ত। আলকাতরার প্রলেপ লাগানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাতে করে তাদের শরীরে আগুন ভয়াবহ রূপে প্রজ্জলিত হয়। তাদের শরীরের গন্ধও হবে খুব নিকৃষ্ট।
ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ অত্র হাদীছে قطران বলতে গলিত পিতল উদ্দেশ্য।
ইমাম বুখারী ও মুসলিম যায়েদ বিন খালেদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন,
«صَلَّى لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَلاَةَ الصُّبْحِ بِالْحُدَيْبِيَةِ عَلَى إِثْرِ سَمَاءٍ كَانَتْ مِنَ اللَّيْلَةِ فَلَمَّا انْصَرَفَ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ فَقَالَ « هَلْ تَدْرُونَ مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ » قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ « أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِى مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِى وَمُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ»
‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুদাইবিয়াতে আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়লেন। সে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। নামাযান্তে তিনি লোকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমরা কি জানো তোমাদের প্রভু আজ রাতে কী বলেছেন? লোকেরা বললঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ বলেছেন, আজ সকালে আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি ঈমানদার হয়েছে আবার কেউ কাফের হয়েছে। যে ব্যক্তি বলেছে, আল্লাহর ফযল ও রহমতে বৃষ্টি হয়েছে, সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে আর নক্ষত্রকে অর্থাৎ বৃষ্টি বর্ষণে নক্ষত্রের প্রভাবকে অস্বীকার করেছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমাকে অস্বীকার করেছে আর নক্ষত্রের প্রতি ঈমান এনেছে’’।[4]
ব্যাখ্যাঃ যায়েদ বিন খালেদ আল-জুহানী একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী। তিনি ৬৮ হিজরীতে মৃত্যু বরণ করেন। কোনো কোনো আলেম ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
তোমরা কি জানো তোমাদের প্রভু কী বলেছেন? এখানে প্রশ্নবোধক বাক্যের মাধ্যমে সতর্ক করা উদ্দেশ্য। সুনানে নাসাঈতে রয়েছে, তোমরা কি শুননি যে, আজ রাতে তোমাদের প্রভু কী বলেছেন? এতে প্রমাণিত হয় যে, প্রশ্নের মাধ্যমে আলেম তার ছাত্রদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন।
সাহাবীদের কথাঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সর্বাধিক জানেনঃ এতে প্রশ্নকৃত ব্যক্তির জন্য সুন্দর আদবের শিক্ষা রয়েছে। যখন কোনো আলেমের কাছে এমন বিষয় জিজ্ঞাসা করা হবে, যে বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই, তখন তার উচিৎ যে ব্যক্তির কাছে সে বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে, তার নিকট তা সোপর্দ করা। এটি ওয়াজিবও বটে।
أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِى مُؤْمِنٌ بِى ‘‘আজ সকালে আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি ঈমানদার হয়েছে’’ঃ কেননা সে বৃষ্টিকে তার বর্ষণকারীর প্রতি সম্বন্ধ করেছে। কেননা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ তা বর্ষণ করতে সক্ষম নয়।
অপর পক্ষে আমার কোনো কোনো বান্দা আজ সকালে কাফের হয়েছে। কেননা তার বিশ্বাস যে, বৃষ্টি বর্ষণে তারকার প্রভাব রয়েছে। এমন বিশ্বাস কুফুরী। কেননা এতে আল্লাহর রুবুবীয়াতে শির্ক করা হয়। মুশরিকও কাফেরের অন্তর্ভূক্ত।
فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ আর যারা বলে ‘আল্লাহর ফজল ও রহমতে আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছিঃ এতে প্রমাণিত হয় যে, ফযল ও রহমত আল্লাহ তাআলার দু’টি সিফাত।
ইমাম বুখারি ও মুসলিম আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে এ অর্থেই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তাতে এ কথা আছে যে, কেউ কেউ বলেছেন, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাব সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তখন আল্লাহ তাআলা আয়াতগুলো নাযিল করেনঃ
فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ (75) وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ إِنَّهُ لَقُرْآَنٌ كَرِيمٌ (77) فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ (78) لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (79) تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (80) أَفَبِهَذَا الْحَدِيثِ أَنْتُمْ مُدْهِنُونَ (81) وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ
‘‘অতএব, আমি তারকারাজির ভ্রমণ পথের শপথ করছি, নিশ্চয়ই এটি বড় শপথ যদি তোমরা জানতে পারো। নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন, যা সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। পবিত্রগণ ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করতে পারেনা। এটি বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করছো? এ নেয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ এই রেখেছো যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো। (সূরা ওয়াকিয়াঃ ৭৫-৮২)
ব্যাখ্যাঃ এর ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) সূরা ওয়াকেয়ার ৭৫ থেকে ৮২ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল।
২) জাহেলী যুগের চারটি স্বভাবের উল্লেখ করা হয়েছে।
৩) উল্লেখিত স্বভাবগুলোর কোনোটি কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।
৪) এমন কিছু কুফরী আছে, যা মুসলিমকে ইসলাম থেকে একেবারে বের করে দেয়না।
৫) বান্দাদের মধ্যে কেউ আজ সকালে আমার প্রতি বিশ্বাসী আবার কেউ অবিশ্বাসী হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার নেয়ামত নাযিল হওয়ার কারণেই এমনটি হল।
৬) এখানে আল্লাহর প্রতি ঈমানের যে কথা বর্ণিত হয়েছে, তা ভালভাবে বুঝা উচিৎ। অর্থাৎ এখানে ইখলাস তথা একনিষ্ঠ ঈমান উদ্দেশ্য। যাতে শির্কের কোন অংশ থাকেনা।
৭) এখানে যে কুফরীর বর্ণনা এসেছে, তাও ভালভাবে বুঝা উচিত। এটি সে কুফরী নয়, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়।
৮) কতক লোক বলেছিল لقد صدق نوء كذا وكذا অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাব সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাদের এ কথার মর্মার্থও ভাল করে বুঝতে হবে।
৯) তোমরা কি জান তোমাদের রব কী বলেছেন? এ কথা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, কোনো বিষয় শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন করতে পারেন।
১০) মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপকারিণীর জন্য কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।
[2] - ইমাম আবু দাউদ এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছ নং- ৫১১৬। ইমাম তিরমিজী তা বর্ণনা করার পর হাসান বলেছেন। তবে তিরমিযীর বর্ণনার শব্দের পার্থক্য রয়েছে। উপরোক্ত শব্দে হাদীছটি যঈফ। কারণ তার সনদে রয়েছে হিশাম বিন সাদ। মুহাদ্দিছগণ হিশামকে যঈফ বলেছেন।
[3] - বুখারী, অধ্যায়ঃ পাপকাজ জাহেলিয়াতের অন্তর্ভূক্ত।
[4] - বুখারী, অধ্যায়ঃ হুদায়বিয়ার যুদ্ধ।