লগইন করুন
ব্যাখ্যাঃ ভাষ্যকার বলেনঃ গ্রন্থকার ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ দ্বারা কিতাবুত্ তাওহীদ লিখা শুরু করেছেন। তিনি আরো বলেনঃ কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল মাজীদে’ আমি বিস্মিল্লাহ্-এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি। বিসমিল্লাহ্-এর মাধ্যমে সকল কাজ-কর্ম শুরু করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত। সুন্নাতের অনুসরণ করেই ইমাম বুখারী এবং অন্যান্য আলেমগণ বিসমিল্লাহ্ দ্বারা তাদের কিতাব লিখা শুরু করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে চিঠি লেখার সময় বিসমিল্লাহ লিখতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি প্রসিদ্ধ হাদীছে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করার আদেশ দিয়েছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[1]
গ্রন্থকার এখানে ‘তাওহীদ’ দ্বারা ‘তাওহীদুল ইবাদাহ’ তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করাকে বুঝিয়েছেন।[2] প্রত্যেক রাসূলই এ প্রকার তাওহীদের মাধ্যমে নিজ নিজ গোত্রের লোকদের সামনে দাওয়াতের সূচনা করেছেন। সূরা আরাফের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
‘‘নিশ্চয়ই আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। তা না করলে আমি তোমাদের উপর একটি মহা দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করছি। একই সূরার ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ
‘‘আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ هَذِهِ نَاقَةُ اللَّهِ لَكُمْ آَيَةً فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِي أَرْضِ اللَّهِ وَلَا تَمَسُّوهَا بِسُوءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘আর সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে। তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো সত্য মাবুদ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি প্রমাণ এসে গেছে। এটি আল্লাহ্র উষ্ট্রী। তোমাদের জন্য এটি একটি নিদর্শন স্বরূপ। অতএব একে ছেড়ে দাও, আল্লাহ্র ভূমিতে এটি চরে বেড়াবে। একে অসৎ নিয়তে স্পর্শ করবেনা। অন্যথায় তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে। (সূরা আরাফঃ ৭৩) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘‘আমি মাদায়েনের প্রতি তাদের ভাই শুআইবকে প্রেরণ করেছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়োনা এবং ভূপৃষ্ঠের সংস্কার সাধন করার পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করোনা। এটিই হল তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’’। (সূরা আরাফঃ ৮৫) সূরা হুদের আরো কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন যে, নবীগণ সর্বপ্রথম তাওহীদ দিয়েই তাদের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’’ (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।
..................................................................
ব্যাখ্যাঃ এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তাআলা একটি মহান উদ্দেশ্যে জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর সেটি হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলা তাদের উপর যা ওয়াজিব করেছেন, তারা তা বাস্তবায়ন করবে, তাঁরই এবাদত করবে, তাঁর এবাদত ব্যতীত অন্যান্য বস্ত্তর এবাদত বর্জন করবে। সুতরাং এই আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা দু’টি কাজের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে আল্লাহর কাজ। তথা আল্লাহ্ তাআলা জিন-ইনসান সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং জিন-ইনসান সৃষ্টি করা আল্লাহর কাজ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বান্দার কাজ। তা হচ্ছে বান্দাগণ এককভাবে আল্লাহর এবাদত করবে। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ
العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة
আল্লাহ্ তাআলা বান্দার যে সমস্ত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, তার নামই এবাদত।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ এবাদত হচ্ছে এমন একটি নাম, যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ও সর্বোচ্চ ভালোবাসার অর্থ বহন করে এবং তাঁর সামনে পূর্ণ ও সর্বোচ্চ নতি স্বীকার করার কথা ঘোষণা করে। নতি স্বীকার করা ব্যতীত শুধু ভালোবাসা কিংবা ভালোবাসাহীন শুধু নতি স্বীকার কখনই এবাদত হতে পারে না। এবাদত ঐ বস্ত্তকে বলা হয়, যাতে উপরোক্ত দু’টি বিষয় পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ বান্দাগণ আল্লাহ্ তাআলাকে ভালোবাসবে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করবে, এ জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁকেই ভালোবাসবে ও ভয় করবে তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলার সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন হবে, যাকে দ্বীনি ইচ্ছা বা ইরাদায়ে শরঈয়া বলা হয়।[3] আর এটিই আল্লাহ্ তাআলা উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘‘আমি জিন এবং মানব জাতিকে একমাত্র আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো’’। (সূরা নাহলঃ ৩৬)
......................................................
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্ তাআলা এখানে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি প্রত্যেক যামানায় এবং প্রত্যেক জাতির কাছেই রাসূল পাঠিয়েছেন। যাতে করে প্রেরিত রাসূল একমাত্র আল্লাহর এবাদত করার আদেশ দেন এবং ঐ সমস্ত বস্ত্তর এবাদত করা হতে নিষেধ করেন, যা শয়তান মানুষের সামনে খুব চাকচিক্যময় করে প্রকাশ করেছে এবং আল্লাহর এবাদত বাদ দিয়ে তাদেরকে ঐ সমস্ত বাতিল মাবুদের এবাদতে লিপ্ত করেছে। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা তাদের কাউকে হেদায়াত করেছেন। তাই তারা এককভাবে আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করেছে এবং তাঁর রাসূলদের আনুগত্য করেছে। আর বনী আদমের কতক লোক পথহারা হয়ে আল্লাহর এবাদতে অন্যান্য বস্ত্তকে শরীক করেছে। রাসূলগণ যেই হেদায়াত নিয়ে আগমণ করেছেন, তারা তা গ্রহণ করেনি। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
‘‘তোমার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রদান করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই এবাদত করো’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ২৫) এই তাওহীদের জন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্যই তাদেরকে আহবান করা হয়েছে। এটিই হচ্ছে তাওহীদুল উলুহীয়াহ। একে توحيد القصد والطلب তাওহীদুল কাস্দ ওয়াত্ তালাবও বলা হয়।
আর তাওহীদে রুবুবীয়া, তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত এবং তাওহীদুল আফআল কিংবা ‘তাওহীদুল ইল্ম ওয়াল ইতিকাদ’ তথা জ্ঞান ও বিশ্বাসগত তাওহীদ বলা হয়। মানব জাতির অধিকাংশ লোকই আল্লাহ তাআলার এই তাওহীদকে স্বীকার করেছে।[4] তবে অধিকাংশ লোকই তাওহীদুল উলুহীয়াকে অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী হুদ (আঃ)এর গোত্রের লোকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তিনি যখন তাঁর জাতির লোকদেরকে বললেনঃ
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ
‘‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো সত্য উপাস্য নেই’’। (সূরা আরাফঃ ৬৫) তখন তারা বললঃ তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছ যে, আমরা এক আল্লাহ্র এবাদত করি এবং আমাদের বাপ-দাদারা যাদের পূজা করত, তাদেরকে ছেড়ে দেই? (সূরা আরাফঃ ৭০) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার মুশরিকদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন, তখন তারাও বলেছিলঃ
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ
‘‘সে কি বহু মাবুদকে এক মাবুদে পরিণত করে দিয়েছে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! (সূরা সোয়াদঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর এবাদত করো আর তাগুতকে বর্জন করো’’-এ আয়াতটি তার পূর্বের এবং পরের অন্যান্য আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা করছে। আরো ব্যাখ্যা করছে যে, যেই এবাদতের জন্য বান্দাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা হচ্ছে এমন খাঁটি ও নির্ভেজাল এবাদত, যার সাথে শির্ক এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তর এবাদতের মিশ্রন নেই। সেই অন্য বস্ত্ত যেই হোক না কেন। সুতরাং জানা গেল যে, আমল ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবেনা, যতক্ষণ না তা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বাতিল মাবুদের এবাদত হতে মুক্ত হবে।[5] আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করার জন্যই জিন-ইনসান সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের কেউ তাঁর এবাদত করছে। আবার কেউ তাঁর এবাদতে অন্যকে শরীক করছে এবং কুফুরী করছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বলেনঃ
فَمِنْهُم مَّنْ هَدَى اللّهُ وَمِنْهُم مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ
‘‘অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোককে আল্লাহ্ হেদায়াত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে গোমরাহী অবধারিত হয়ে গেছে’’। (সূরা নাহলঃ ৩৬) আল্লাহ্ তাআলা সূরা নিসার ৬৪ নং আয়াতে বলেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ
‘‘বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়’’।
উপরের আয়াতগুলোর মাধ্যমে পরিস্কার বুঝা গেল যে, জিন-ইনসান সৃষ্টির ক্ষেত্রে দয়াময় আল্লাহ্ তাআলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদেরকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যে বিষয়ের আহবান করার জন্য রাসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে, তারা তাই করবে। এ জন্যই যারা এককভাবে তাঁর এবাদত করেনি এবং তাঁর রাসূলগণের দাওয়াত গ্রহণ করেনি, তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। তিনি নবী-রাসূলগণ এবং তাদের সাথীদের জন্য তাওহীদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ করেছেন। তাদের কেউ কেউ নবী-রাসূলদের আনুগত্য করেছে। এদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আবার তাদের মধ্য হতে অন্যরা নবী-রাসূলদের তাওহীদের দাওয়াতের বিরোধিতা করেছে। তাদের সংখ্যাই ছিল অধিক।
এই তাওহীদের নামই হচ্ছে ইসলাম। এই ইসলাম ছাড়া আল্লাহ্ তাআলা অন্য কোন দ্বীন কবুল করবেন না। সূরা ইউসুফের ৪০ নং আয়াতে ইউসুফ (আঃ)এর উক্তি নকল করে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহ্কে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের এবাদত করে থাকো, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ্ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি। আল্লাহ্ ছাড়া কারও হুকুম করার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো এবাদত করোনা। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’’।
এককভাবে আল্লাহর এবাদত করাই হলো সেই সত্য দ্বীন, যা দিয়ে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সকল রাসূল প্রেরণ করেছেন, এই শিক্ষাই সকল আসমানী কিতাবে নাযিল করেছেন এবং এটি বাস্তবায়ন করার জন্যই রাসূলদেরকে আদেশ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
‘‘তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করোনা’’। (সূরা শুরাঃ ১৩) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللّهَ وَلا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآبِ
‘‘হে নবী তুমি লোকদেরকে বলোঃ আমাকে আদেশ করা হয়েছে, আমি যেন একমাত্র আল্লাহ্র এবাদত করি এবং তার সাথে অংশীদার না করি। আমি তাঁর দিকেই দাওয়াত দেই এবং তাঁর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা রা’দঃ ৩৬) এখানে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে একমাত্র তাঁরই এবাদত করার আদেশ দিয়েছেন এবং উম্মতকে এদিকেই আহবান করার নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্ত কুরআনই এ তাওহীদ এবং তাওহীদের ব্যাখ্যায় ভরপুর। এতে রয়েছে তাওহীদপন্থীদের পুরস্কার ও তাওহীদ অস্বীকারকারীদের তিরস্কার। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيراً مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ قَدْ جَاءكُم مِّنَ اللّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ، يَهْدِي بِهِ اللّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلاَمِ وَيُخْرِجُهُم مِّنِ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ
‘‘হে আহ্লে কিতাবগণ! তোমাদের কাছে আমার রাসূল আগমণ করেছেন। কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে, তিনি তার মধ্য থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করেন এবং অনেক বিষয় মার্জনা করেন। তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি এসেছে এবং এসেছে একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে এর দ্বারা তিনি তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালিত করেন’’। (সূরা মায়েদাঃ ১৫-১৬)
আবু দাউদ ও তিরমিজীতে বর্ণিত মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে এসেছে, মুআয বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কিছু আমল দেখিয়ে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ তুমি একটি বিরাট বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছ। তবে আল্লাহ্ তাআলা যার উপর সেই আমলটি সহজ করে দিয়েছেন, তার জন্য তা খুবই সহজ। আমলটি হচ্ছে, তুমি আল্লাহর এবাদত করবে, তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবেনা। নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং রামাযানের রোযা রাখবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের কথাও বলেছেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ আমি কি তোমাকে দ্বীনের মূল বিষয়, স্তম্ভ এবং এর সর্বোচ্চ চূড়া সম্পর্কে বলবোনা? মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, বলুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ দ্বীনের মূল হচ্ছে ইসলাম। এর স্তম্ভ হচ্ছে নামায এবং দ্বীনের সর্বোচ্চ চূড়া হচ্ছে জিহাদ।[6]
এই হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে ইসলাম হচ্ছে তাওহীদের অন্য একটি নাম। আর অন্যান্য হুকুম-আহকাম ও ফরয-ওয়াজিবগুলো হচ্ছে তাওহীদের হকসমূহের অন্তর্গত। সকল আলেম এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, তাওহীদ হচ্ছে নামায এবং অন্যান্য আমল সঠিক হওয়ার শর্ত। কালেমায়ে শাহাদাত لا إله إلا الله و أن محمداً رسول الله এর তাৎপর্য ও দাবী এটিই। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে, এটি একদিকে যেমন শির্ককে প্রত্যাখ্যান করে এবং শির্ক ও মুশরিকদের থেকে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করে অন্যদিকে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবাদতকে সাব্যস্ত করে, রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনয়ন আবশ্যক হওয়া এবং তাঁর আনুগত্য করা জরুরী হওয়ার প্রমাণও বহন করে।
[2] - আলেমগণ কুরআন ও হাদীছের আলোকে তাওহীদকে তিনভাবে বিভক্ত করেছেনঃ
ক) তাওহীদে রুবুবীয়াহঃ
তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ হল দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর প্রতিপালক, তিনিই সব কিছুর মালিক, সৃষ্টি কর্তা, ব্যবস্থাপক ও পরিচালক। তার রাজত্বে কোন অংশীদার নেই। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। তাঁর ফয়সালাকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না, তার আদেশ প্রত্যাখ্যান করার মত কেউ নেই, তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাঁর অনুরূপ আর কেউ নেই, নেই তাঁর কোন সমতুল্য। তাঁর প্রতিপালনাধীন কোন বিষয়ের বিরোধী কেউ নেই এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীতেও কোন শরীক নেই। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ قُلْ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لاَ يَمْلِكُونَ لأَنفُسِهِمْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ أَمْ جَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ خَلَقُوا كَخَلْقِهِ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ قُل اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
‘‘বলো! কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক? বলোঃ আল্লাহ। বলোঃ তবে কি তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছো, যারা নিজেদের লাভ ও ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়? তুমি বলোঃ অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? অথবা অন্ধকার ও আলো কি সমান? তবে কি তারা আল্লাহর এমন শরীক স্থাপন করেছে যারা তাঁর সৃষ্টির মত সৃষ্টি করেছে যে কারণে সৃষ্টি তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে? বলোঃ আল্লাহ সকল বস্ত্তর স্রষ্টা; তিনি একক ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা রা’দঃ ১৬)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ * أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ
‘‘তারা কি কোন কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করেনা’’। (সূরা তুরঃ ৩৫-৩৬)
সর্বকালের অধিকাংশ বনী আদমই এই প্রকার তাওহীদ তথা তাওহীদে রুবুবীয়ার প্রতি বিশ্বাস করেছে এবং তা মেনে নিয়েছে। জাহেলী যুগের মক্কার মুশরিকরাও তা মেনে নিয়েছিল। কুরআন মজীদে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো- কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবেঃ আল্লাহ্। (সূরা লুকমানঃ ২৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنْ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنْ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنْ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
‘‘তুমি জিজ্ঞেস করো, কে রিযিক দান করে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তা ছাড়া কে জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ্! তখন তুমি বলো, তারপরও কি ভয় করবেনা? (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
মুসলিম হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য শুধু তাওহীদে রুবুবীয়াতে বিশ্বাস যথেষ্ট নয়। তাওহীদে উলুহীয়াতে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত কাউকে মুমিন হিসাবে গণ্য করা হবেনা। কারণ মক্কাবাসীরা তাওহীদে রুবুবীয়াতে বিশ্বাস করত। কিন্তু আল্লাহর এবাদতে তারা শরীক স্থাপন করত। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
‘‘আর অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শির্কেও লিপ্ত হয়’’। (সূরা ইউসুফঃ ১০৬) এখানে ঈমান বলতে তাওহীদে রুবুবীয়া উদ্দেশ্য। শুধু তাওহীদে রুবুবীয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট গণ্য করা হয়নি। এ জন্যই মক্কাবাসীরা এতে ঈমান আনয়ন করা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে বদর, উহুদ ও খন্দকসহ বহু যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। মুসলিম হওয়ার জন্য যদি শুধু আল্লাহ্ তাআলা রুবুবীয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করাই যথেষ্ট হত, তাহলে তিনি কখনই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না এবং তাদের জান ও মালকে হালাল মনে করতেন না।
তাওহীদুল উলুহীয়াহঃ
প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল কথা ও কাজ তথা সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন বস্ত্তর এবাদতকে অস্বীকার করার নাম তাওহীদে উলূহিয়্যাহ। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ
‘‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া তোমরা অন্য কারো এবাদত করবে না’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করোনা’’। (সূরা নিসাঃ ৩৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
نَّنِي أَنَا اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمْ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي
‘‘আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই। অতএব আমার এবাদত করো এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম করো’’। (সূরা তোহাঃ ১৪) এটিই (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ)এর সরল ও সঠিক ব্যাখ্যা।
সুতরাং নামায আদায় করা, প্রার্থনা করা, যবেহ্ করা, নযর বা মানত করা, সাহায্য চাওয়া, বিপদে আশ্রয় প্রার্থনা করা, ইত্যাদি সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করা যাবেনা। এই প্রকার তাওহীদকেই কাফেরগণ অমান্য করেছিল এবং নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের উম্মতের মাঝে মূল বিরোধ ছিল এই তাওহীদকে কেন্দ্র করেই।
তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাতঃ
তাওহীদুল্ আসমা ওয়াস্ সিফাতের অর্থ হলো, আল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত নামে নামকরণ করেছেন এবং তাঁর কিতাবে নিজেকে যে সমস্ত সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যে সমস্ত অতি সুন্দর নামে এবং সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা। তার ধরণ বর্ণনা করা ব্যতীত যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই আল্লাহ তাআলার জন্য তা সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক স্থানে কোন প্রকার ধরণ বর্ণনা করা ব্যতীত স্বীয় সুউচ্চ গুণাবলী উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا
‘‘তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। কিন্তু তারা জ্ঞান দ্বারা তাঁকে আয়ত্ত করতে পারেনা’’। (সূরা তোহাঃ ১১০) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
‘‘ তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’ (সূরা শুরাঃ ১১)
তিরমিযী শরীফে উবাই বিন কাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ আমাদের সামনে আপনার রবের বংশ পরিচয় বর্ণনা করুন। তখন আল্লাহ তাআলা এই সূরাটি নাযিল করেনঃ
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
‘‘হে রাসূল তুমি বলোঃ তিনি আল্লাহ্ একক। আল্লাহ্ অমূখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকে জন্ম দেয়া হয়নি এবং তাঁর সমতুল্য অন্য কেউ নেই’’। ‘সামাদ’ হচ্ছে যিনি কাউকে জন্ম দেন নি বা যাকে কেউ জন্ম দেয়নি। কারণ জন্মগ্রহণকারী সকলেই মরণশীল। আর মরণশীল প্রতিটি বস্ত্তই উত্তরাধিকারী রেখে যায়। আর আল্লাহ তাআলা মরণশীল নন, তিনি কারো উত্তরাধিকারী নির্ধারণকারী নন। ‘আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই’ অর্থাৎ কেউ তাঁর সমকক্ষ, সম মর্যাদা সম্পন্ন এবং তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই।
আল্লাহ্ তাআলার অনেকগুলো অতি সুন্দর নাম এবং সুউচ্চ গুণাবলী রয়েছে যা তাঁর পরিপূর্ণতা এবং মহত্ত্বের প্রমাণ বহন করে, এ কথার প্রতি ঠিক সেভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যেভাবে পবিত্র কুরআন এবং হাদীছে উল্লেখ হয়েছে। কোন প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরণ-গঠন বা সাদৃশ্য আরোপ না করেই। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’ এই আয়াতে কোন বস্ত্ত তাঁর অনুরূপ না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা- এই দু’টি সিফাত তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটাই হলো সালাফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীগণের মূলনীতি। তারা সকলেই আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর শিখানো মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা নিজের জন্য যে অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী পছন্দ করেছেন বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নাম ও গুণাবলী তাঁর হাদীছে উল্লেখ করেছেন উহা ব্যতীত অন্য কোন নাম বা গুণাবলী আল্লাহ্ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট করা যাবেনা। কেননা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ অধিক অবগত নয়। আল্লাহ্র পর তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আল্লাহ্ সম্পর্কে অধিক অবগত আর কেউ নেই।
[3] - শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে বুঝাতে চেয়েছেন যে, কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর যে ইরাদাহ বা ইচ্ছার কথা উল্লেখিত হয়েছে তা দুই প্রকার। যথাঃ
(১) ইরাদাহ কাওনীয়া কাদ্রীয়া (সৃষ্টি ও নির্ধারণ করার ইচ্ছা)। এটি আল্লাহর এমন ইচ্ছা, যা তাঁর ভালোবাসা এবং পছন্দকে আবশ্যক করেনা। কুফরী, ঈমান, আনুগত্য, পাপাচার, সন্তুষ্টি, ভালবাসা, পছন্দনীয় এবং অপছন্দনীয় সবই এ প্রকার ইচ্ছার অন্তর্ভূক্ত। কোন ব্যক্তিই আল্লাহর এ প্রকার ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারে না এবং তা হতে পালানোর কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإسْلاَمِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا
‘‘অতএব আল্লাহ্ যাকে হিদায়াত করতে চান, ইসলামের জন্যে তার অন্তকরণ খুলে দেন। আর যাকে পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তার অন্তকরণ খুব সংকুচিত করে দেন’’। (সূরা আন-আমঃ ১২৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ فِتْنَتَهُ فَلَنْ تَمْلِكَ لَهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ الَّذِينَ لَمْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمْ
‘‘আল্লাহ্ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান, তার জন্য আল্লাহর কাছে কিছুই করার নেই। ওরা হল সেই লোক, যাদের অন্তরসমূহকে আল্লাহ্ পবিত্র করার ইচ্ছা পোষণ করেন নি’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৪১) এছাড়াও আরো আয়াত রয়েছে।
(২) ইরাদা শারঈয়া ও দ্বীনিয়া (শরীয়তগত ইচ্ছা)। আল্লাহর যে ইচ্ছা সন্তুষ্টি ও ভালবাসার সাথে সম্পৃক্ত, তাকে ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কোন জিনিষকে ভালবেসে যে ইচ্ছা পোষণ করেন তাকে ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। এ ইচ্ছার কারণেই আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ ও নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করার ইচ্ছা করেন, তোমাদের পক্ষে যা কঠিন, তা তিনি চান না’’। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
يُرِيدُ اللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্যে বর্ণনা করতে, তোমাদেরকে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের আদর্শসমূহ প্রদর্শন করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে ইচ্ছা করেন। আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান’’। (সূরা নিসাঃ ২৬) এ ছাড়া আরো আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তাআলার এ প্রকার ইচ্ছা তথা শরীয়ত গত ইচ্ছা শুধু তার ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হবে, যার ক্ষেত্রে সৃষ্টিগত ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছে। আনুগত্যকারী মুমিনের মধ্যে ইরাদাহ কাওনীয়া ও শরঈয়া উভয়ই একত্রিত হয়ে থাকে। আর কাফেরের ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সকল বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের আহবান জানিয়েছেন। তাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকেই আহবানে সাড়া দেয়ার পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى دَارِ السَّلاَمِ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘‘আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে শান্তির আবাসস্থল তথা জান্নাতের দিকে আহবান করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথে চলার ক্ষমতা দান করেন’’। (সূরা ইউনুসঃ ২৫) সুতরাং তিনি সকলকে আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু যাকে ইচ্ছা কেবল তাকেই হেদায়াত নসীব করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ اهْتَدَى
‘‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথের উপর রয়েছে’’। (সূরা নাজ্ম ৩০)
আল্লাহ তাআলার ইরাদাহ তথা ইচ্ছার বিষয়টি ভালভাবে বুঝার জন্য আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহর আদেশ, ফয়সালা এবং তাঁর ইচ্ছার মধ্যে এমন কিছু ইচ্ছা ও আদেশ রয়েছে, যা শরীয়তের হুকুম-আহকামের সাথে সংশ্লিষ্ট। আরেক প্রকার আদেশ, ইচ্ছা ও ফয়সালা রয়েছে, যা সৃষ্টি ও নির্ধারণের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তাআলার যেই আদেশ সৃষ্টি ও নির্ধারনের সাথে সম্পৃক্ত, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি এবং নির্ধারণ করার ইচ্ছা করেন, তার সাথে সম্পৃক্ত আদেশ হুবহু বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ
‘‘আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি করার নিয়ম এই যে, যখন তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তিনি কেবল তাকে এতটুকু বলেন যে, হয়ে যাও। অতঃপর তা হয়ে যায়’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৮২) আললাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰ أَمْرِهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পন্ন করেই থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা’’। (সূরা ইউসুফঃ ২১) অর্থাৎ আল্লাহর বিধানগত আদেশ অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ
وَقَضَيْنَا إِلَيْهِ ذَٰلِكَ الْأَمْرَ أَنَّ دَابِرَ هَٰؤُلَاءِ مَقْطُوعٌ مُّصْبِحِينَ
‘‘আর তাকে আমি এ ফায়সালা পৌঁছিয়ে দিলাম যে, সকাল হতে হতেই এদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হবে’’। (সূরা হিজরঃ ৬৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَقَضَيْنَا إِلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا
‘‘তারপর আমি নিজের কিতাবে বনী ইসরাঈলকে এ মর্মে ফয়সালা দিয়েছিলাম যে, তোমরা দুবার পৃথিবীতে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং ভীষণ বাড়াবাড়ি করবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৪) সুতরাং আল্লাহর ফয়সালা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে শরীয়তগত ফয়সালা বান্দাদের মানা না মানার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণীঃ وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ‘‘তোমার রব এ ফয়সালা দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া তোমরা আর কারো এবাদত করোনা। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩) এটি আল্লাহর শরীয়তের ফয়সালার (আদেশের) অন্তর্ভূক্ত। তাই আপনি দেখবেন যে, অনেক মানুষ আল্লাহর সাথে শির্কও করে এবং কেউ কেউ তার পিতা-মাতার অবাধ্যও হয়।
আর আল্লাহ তাআলার বাণীঃ ﴾أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴿ ‘‘আল্লাহ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁর এবাদত ব্যতীত অন্য কারোর এবাদত করবেনা৷ এটিই সরল সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানেনা’’। (সূরা ইউসুফঃ ৪০) এটি হচ্ছে শরীয়ত ও দ্বীনি আদেশ। কিছু লোক এই আদেশের বিরোধীতাও করে। তাই আপনি দেখবেন যে, এক শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর সাথে এমন কিছুকে শরীক করে, যার পক্ষে আল্লাহ কোন দলীল প্রমাণ নাযিল করেন নি।
[4]- যেসব জাতি আল্লাহ তাআলার রুবুবীয়াতকে অস্বীকার করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে ইবরাহীম (আঃ)এর সাথে বিতর্ককারী (নমরুদ) অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘তুমি কি সেই ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে জাননা, যে ইবরাহীমের সাথে তর্ক করেছিল? তর্ক করেছিল এই কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব কে? এবং তর্ক এ জন্য করেছিল যে, আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছিলেন৷ যখন ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ যার হাতে জীবন ও মৃত্যু তিনিই আমার রব৷ জবাবে সে বললোঃ আমিও তো জীবন ও মৃত্যু দিতে পারি৷ ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ তাই যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে, আল্লাহ তো পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠান। তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও তো দেখি৷ একথা শুনে সেই কাফের হতবুদ্ধি হয়ে গেলো কিন্তু আল্লাহ জালেমদের সঠিক পথ দেখান না’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৮)
আল্লাহ তাআলা যখন মূসা (আঃ)কে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন তখন তিনি নিজেকে রাববুল আলামীনের রাসূল হিসেবে পেশ করলেন। ফেরাউন তখন বলেছিলঃ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ রাববুল আলামীন আবার কে? ফেরাউন আরো বলেছিল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَىٰ আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় রব (সূরা নাযিআতঃ ২৪) সে আরো বলেছিল,
يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَل لِّي صَرْحًا لَّعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَىٰ إِلَٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ
‘‘হে সভাসদবর্গ! আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোন প্রভু আছে বলে জানি না৷ ওহে হামান! আমার জন্য ইঁট পুড়িয়ে একটি উঁচু প্রাসাদ তৈরি করো, হয়তো তাতে উঠে আমি মূসার প্রভুকে দেখতে পাবো, আমিতো তাকে মিথ্যুক মনে করি’’ (সূরা কাসাসঃ ৩৮)
এখন প্রশ্ন হলো সে কি আসমান ও যমীনের রবের উপর বিশ্বাস করতো এবং তা গোপন রেখেছিল? না কি সে মোটেই বিশ্বাস করতো না? আল্লাহর নবী মুসা (আঃ)এর কথা থেকে বুঝা যায় ফেরাউন আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো। আল্লাহ তাআলা মুসা (আঃ)এর উক্তি উদ্বৃত করে বলেনঃ
قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَثْبُورًا
‘‘তুমি খুব ভাল করেই জান এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেন নি। হে ফেরাউন! আমার মনে হয় তুমি নিশ্চয়ই একজন হতভাগ্য ব্যক্তি’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১০২) অর্থাৎ হে ফেরাউন তুমি ভাল করেই জান যে, এই নিদর্শন ও মুজিযাগুলো যিনি নাযিল করেছেন, তিনি হলেন আসমান ও যমীনের প্রভু আল্লাহ তাআলা। কিন্তু তুমি অযথা ঝগড়া করছো এবং বিতর্ক করছো। ফেরাউনের গোত্রের লোকেরা ফেরাউনকে বলেছিলঃ
وَقَالَ الْمَلَأُ مِن قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ قَالَ سَنُقَتِّلُ أَبْنَاءَهُمْ وَنَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ
‘‘ফেরাউনকে তার জাতির প্রধানরা বললঃ ‘‘তুমি কি মূসা ও তার জাতিকে এমনিই ছেড়ে দেবে যে, তারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়াবে এবং তোমার ও তোমার মাবুদের এবাদত পরিত্যাগ করবে? ’’ফেরাউন জবাব দিলঃ ‘‘আমি তাদের পুত্রদের হত্যা করবো এবং তাদের কন্যাদের জীবিত রাখবো৷ আমরা তাদের উপর প্রবল কর্তৃত্বের অধিকারী’’। (সূরা আরাফঃ ১২৭) ফেরাউনের রাজ দরবারের উচ্চ পদস্থ লোকদের এই কথা থেকে বুঝা যায় যে, ফেরাউনের একজন মাবুদ ছিল। সে গোপনে এই মাবুদের এবাদত করতো।
কেউ কেউ আবার তাদের কথার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, এখানে তাদের কথার অর্থ হলো, মুসা তোমাকে পরিত্যাগ করবে এবং তোমার জন্য তার এবাদতকেও পরিত্যাগ করবে। (আল্লাহই অধিক জানেন)
তবে কিছু কিছু কাফের আল্লাহর রুবুবীয়াতকেও অস্বীকার করে থাকে। তার প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণীঃ
وَيُرْسِلُ الصَّوَاعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَن يَشَاءُ وَهُمْ يُجَادِلُونَ فِي اللَّهِ وَهُوَ شَدِيدُ الْمِحَالِ
‘‘তিনি বজ্র প্রেরণ করেন। অতঃপর যার উপর ইচ্ছা উহা নিক্ষেপ করেন৷ তারা আল্লাহর ব্যাপারে বাদানুবাদ করছে। আসলে তাঁর কৌশল বড়ই কঠোর। (সূরা রা’দঃ ১৩)
কোন কোন আলেমের নিকট হাসান সনদে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আনাস (রাঃ) থেকে ইমাম বাযযার (রঃ) কাশফুল আসতারে (৩/৫৪) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আনাস (রাঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার জন্য একজন সাহাবীকে জাহেলী যামানার কাফেরদের জনৈক নেতার নিকট পাঠালেন। সেই কাফের বললঃ তুমি যেই রবের দিকে আমাকে ডাকছ, সে কিসের তৈরী? সেকি লোহার তৈরী? না কি পিতলের? রৌপ্যের? না কি স্বর্ণের?
সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ফেরত এসে ঘটনা জানালেন। তিনি তাঁকে দ্বিতীয়বার পাঠালেন। সেই কাফের একই কথা বলল। তাঁকে তৃতীয়বার পাঠানো হলে সে একই কথা বলল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহ তাআলা একটি বজ্র প্রেরণ করে তোমার সেই সাথীকে জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তখন উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন।
উপরোক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপ এই যে, (১) কোন কোন কাফের সৃষ্টিজগতের রবকে অস্বীকার করে এবং সৃষ্টির জন্য কোন ইলাহ (মাবুদ) থাকার কথাকেও অস্বীকার করে। (২) কোন কোন কাফের স্বীকার করে যে, আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, তিনিই একমাত্র রিযিক দাতা ও সৃষ্টিজগতের সকল বিষয়ের তদবীরকারী। তবে আল্লাহ তাআলার সাথে তারা অন্যান্য মাবুদের এবাদত করে এবং আল্লাহর সাথে এমন বস্ত্তকে শরীক করে, যার পক্ষে আল্লাহ তাআলা কোন দলীল-প্রমাণ নাযিল করেন নি। কতিপয় কাফের-মুশরেক যে আল্লাহর রুবুবীয়াতকে স্বীকার করতো, তার দলীল হচ্ছে, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ্। (সূরা লুকমানঃ ২৫)
(৩) কোন কোন কাফের আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তারা দাবী করে যে, আল্লাহর পুত্র সন্তান রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের জবাবে বলেনঃ
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ ۖ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ
‘‘ইহুদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খৃষ্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র৷এগুলো একেবারেই আজগুবী ও উদ্ভট কথাবার্তা৷ তাদের পূর্বে যারা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দেখাদেখি তারা এগুলো নিজেদের মুখে উচ্চারণ করে থাকে৷ আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তাদের উপর, তারা কোথা থেকে ধোকা খাচ্ছে! (সূরা তাওবাঃ ৩০) আল্লাহ তাআলা সূরা মায়েদার ১৮ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَىٰ نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ قُلْ فَلِمَ يُعَذِّبُكُم بِذُنُوبِكُم ۖ بَلْ أَنتُم بَشَرٌ مِّمَّنْ خَلَقَ ۚ يَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ ۚ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۖ وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ
‘‘ইহুদী ও খৃষ্টানরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান এবং তাঁর প্রিয়পাত্র৷ তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তাহলে তোমাদের গুনাহের জন্য তিনি তোমাদের শাস্তি দেন কেন? আসলে তোমরাও ঠিক তেমনি মানুষ যেমন আল্লাহ অন্যান্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন৷ তিনি যাকে চান মাফ করে দেন এবং যাকে চান শাস্তি দেন৷ পৃথিবী ও আকাশসমূহ এবং এ দুয়ের মধ্যকার যাবতীয় সৃষ্টি আল্লাহর মালিকানাধীন এবং তাঁরই দিকে সবাইকে ফিরে যেতে হবে’’।
(৪) কিছু মানুষ রয়েছে, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁকে এমন বিশেষণে বিশেষিত করে, যা তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য অশোভনীয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَقَالَتْ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ
‘‘আর ইহুদীরা বলেঃ আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে। তাদের হাতই বাঁধা হয়ে গেছে। এ কথা বলার কারণে তাদের প্রতি অভিসম্পাত; বরং তাঁর উভয় হস্ত সদা উন্মুক্ত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করেন’’। (সূরা মায়িদাঃ ৬৪) আল্লাহ তাআলা ইহুদীদের প্রতিবাদ করে বলেনঃ
لَقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا وَقَتْلَهُمْ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ
‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে, আল্লাহ হচ্ছেন অভাবগ্রস্ত আর আমরা বিত্তবান। এখন আমি তাদের কথা এবং যেসব নবীকে তারা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে, তা লিখে রাখবো, অতঃপর বলবোঃ ‘আস্বাদন করো জ্বলন্ত আগুনের আযাব’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৮১)
(৫) আল্লাহ তাআলার উপর বিশ্বাসী কিছু মানুষ আল্লাহর অনেক সিফাতকে অস্বীকার করে। মুতাযেলা ও জাহমীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এদের অন্তুর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীদের সাথে কথা বলেছেন, তিনি কথা বলেন, কিয়ামতের দিন মানুষের সাথে কথা বলবেন, আল্লাহ তাআলার হাত ও চক্ষু রয়েছে। তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য ইত্যাদি সকল বিষয়ের খবর রাখেন। কোন কোন ফির্কা আল্লাহ তাআলার এসব সিফাত (বিশেষণ) অস্বীকার করে থাকে। এমনি আরো অসংখ্য গোমরাহ দল রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবেনা। আমরা এগুলো থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি।
অপর পক্ষে তাওহীদ ও সঠিক পথের অনুসারী মুসলিমগণ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা আল্লাহ তাআলাকে এমনসব সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করে, যদ্বারা আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সত্তাকে গুণান্বিত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র সুন্নাতে আল্লাহ তাআলার যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তারা কোন প্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ছাড়া তাতেও বিশ্বাস করে। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। যথাস্থানে তা আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ।
[5] - এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, মুসলিমগণ মুশরেকদের বাতিল মাবুদ ও শির্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে এবং তারা সর্বদা এমন আমল করবে, যা তাদেরকে শির্ক থেকে দূরে রাখে। এরই অংশ হিসাবে আমরা ফজরের সুন্নত দুই রাকআত নামাযের মাধ্যমে দিবসের আমল শুরু করি এবং বিতর নামাযের মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি ঘটাই। শির্ক ও মুশরেকদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন ঘোষণা করার জন্যই উপরোক্ত নামায দু’টিতে এমন দু’টি সূরা পাঠ করি, যাতে রয়েছে শির্কের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও আপোসহীনতার জোরালো ঘোষণা। সুতরাং এই আমলটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া বাঞ্চনীয়।
[6] - হাদীছটি ইমাম তিরমিজী, নং- ২৬১৯ এবং ইবনে মাজাহ, নং-৪০৪৪-এ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ এই হাদীছটি হাসান সহীহ। দেখুনঃ ইরওয়াউল গালীল, হাদীছ নং- ৪১৩।