কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম ১৩. পাপীদের নাজাত কিভাবে? ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
১৩. পাপীদের নাজাত কিভাবে?

‘সবাইকে ভক্তি করার’ কথা মুখে বললেও, ঈসায়ী প্রচারকগণের প্রথম লক্ষ্য ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঘৃণা ও অভক্তি’ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। তাঁরা কখনো বলেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপীদের মুক্তির জন্য আগমন করেন নি, বরং মানুষদেরকে সতর্ক করতে এসেছিলেন (নাউযূ বিল্লাহ)। কখনো বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মাত হয়ে জান্নাত পেতে মুত্তাকী হতে হয়। পক্ষান্তরে যীশুর উম্মাত হলে মহাপাপী হলেও ক্ষতি নেই।

প্রথমত: আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল নবী-রাসূলই পাপীদের মুক্তির জন্য আগমন করেন। তবে প্রচলিত ইঞ্জিল থেকে প্রমাণিত হয় যে, যীশু মানুষদের জাহান্নামী করতে এসেছিলেন (নাঊযু বিল্লাহ)। নিম্নের বিষয়গুলি দেখুন:

(ক) যীশুর গ্রেফতারের পর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের ঘটনা প্রসঙ্গে লূক বলেন: ঈসাকে দেখে হেরোদ (ফিলিস্তিনের রাজা Herod Antipas) খুব খুশি হলেন। তিনি ঈসার সমন্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন, তাই তিনি অনেক দিন ধরে তাঁকে দেখতে চাইছিলেন। হেরোদ আশা করেছিলেন ঈসা তাকে কোনো কেরামতী কাজ করে দেখাবেন। তিনি ঈসাকে অনেক প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ঈসা কোন কথারই জবাব দিলেন না। প্রধান ইমামেরা এবং আলেমেরা সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ঈসাকে দোষ দিতে লাগলেন। তখন হেরোদ ঈসাকে অপমান ও ঠাট্রা করলেন, আর তাঁর সৈন্যরাও তাই করল। ,,,(লুক ২৩/৮-১১)

এখানে যীশু রাজা হেরোদের আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ সত্ত্বেও কোনো মু‘জিযা দেখালেন না। ইতোপূর্বে দেখিয়েছেন অথবা ভবিষ্যতে দেখাবেন- তাও বললেন না। তিনি যদি এরূপ কিছু করতেন তাহলে রাজা হেরোদ-সহ সকল ইয়াহূদী ও সকল মানুষ বিশ্বাস অর্জন করে নাজাত লাভ করত। এরপর তিনি প্রয়োজনে ক্রুশে উঠে মৃত্যুবরণ করতেন। কিন্তু তিনি কিছুই করলেন না; ফলে এ সকল মানুষ এবং কিয়ামত পর্যন্ত ইয়াহূদী জাতি সকলেই অবিশ্বাসের কারণে নরকবাসী হয়ে গেল।

(খ) ক্রুশারোহণ প্রসঙ্গে মথি বলেন: “যে সব লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল তারা মাথা নেড়ে ঈসাকে ঠাট্রা করে বলল, “তুমি না বায়তুল-মোকাদ্দস ভেংগে আবার তিন দিনের মধ্যে তৈরী করতে পার! তাহলে এখন নিজেকে রক্ষা কর। যদি তুমি ইবনুল্লাহ হও তবে ক্রুশ থেকে নেমে এস”। প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা এবং বৃদ্ধ নেতারাও তাঁকে ঠাট্রা করে বললেন, ‘ও অন্যদের রক্ষা করত, নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। ও তো ইসরাইলের বাদশাহ্! & এখন ক্রুশ থেকে ও নেমে আসুক। তাহলে আমরা ওর উপর ঈমান আনব। ও আল্লাহর উপর ভরসা করে, এখন আল্লাহ যদি ওর উপর খুশি থাকেন তবে ওকে তিনি উদ্ধার করুন। ও তো নিজেকে ইবনুল্লাহ বলত। যে ডাকাতের তাঁর সংগে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল তারাও সেই একই কথা বলে তাঁকে টিট্কারি দিল। (মথি ২৭/৩৯-৪৩)

এ সময়ে তো তাঁর দায়িত্ব ছিল যে, বিশ্ববাসীকে জান্নাতের প্রকৃত বিশ্বাস জানিয়ে দিতে অন্তত একবার ক্রুশ থেকে নেমে আসবেন। এরপর আবার ক্রুশে উঠে জীবনত্যাগ করবেন। তাহলে এসকল মানুষ ও সকল ইয়াহূদী মুক্তি পেত!

(গ) মথি ১২/৩৮-৪০: “কয়েকজন আলেম ও ফরীশী ঈসাকে বললেন, “হুজুর, আমরা আপনার কাছ থেকে একটা চিহ্ন দেখতে চাই।” ঈসা তাঁদের বললেন, “এই কালের দুষ্ট ও বেঈমান লোকেরা চিহ্নের খোঁজ করে, কিন্তু ইউনুস নবীর চিহ্ন ছাড়া আর কোন চিহ্নই তাদের দেখানো হবে না। ইউনুস যেমন সেই মাছের পেটে তিন দিন ও তিন রাত ছিলেন ইবনে আদম তেমনি তিন দিন ও তিন রাত মাটির নীচে থাকবেন।”

যীশু তাঁদেরকে একটি চিহ্ন দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন যা তিনি তাদেরকে দেখান নি। তিনি মাটির নিচে তিন দিন তিন রাত থাকেন নি, বরং দুই রাত ও এক দিন ছিলেন (যোহন ২০/১-১৮; মথি ২৮/১-১০; মার্ক ১৬/১-১১; লূক ২৪/১-১২)। সর্বোপরি, যীশু তাঁর প্রতিশ্রুতি মত পৃথিবীর গর্ভ থেকে পুনরুত্থানের চিহ্নটি অধ্যাপক ও ফরীশীদেরকে দেখান নি। যীশু পুনরুত্থানের পর নিজেকে এদের সামনে বা অন্য কোনো ইয়াহূদীর সামনে একটিবারের জন্যও প্রকাশ করেন নি। এজন্যই ইয়াহূদীরা যীশুর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করেন না। যদি যীশু পাপীদের মুক্তির জন্যই এসে থাকতেন তাহলে তো তিনি পুনরুত্থানের পরে অধ্যাপক ও ফরীশীদেরকে দেখা দিয়ে তাদের সকলের, সকল ইয়াহূদী এবং বিশ্বের সকল মানুষের মুক্তির ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু তিনি তো তা করলেন না।

দ্বিতীয়ত: সকল নবী-রাসূলই পাপীদের জন্য আগমন করেন। তবে আমরা দেখেছি যে, ঈসা মাসীহ শুধু ইসরায়েল বংশের পাপীদের নাজাতের পথ দেখাবেন। অন্য কোনো দেশের, বর্ণের, বংশের বা ধর্মের মানুষ তাঁর উম্মাত হয়ে বা তাঁর মত অনুসরণ করে নাজাত পাবে না। (মথি ৭/৬, ১০/৫-৮; ১৫/২২-২৮) পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা বিশ্বের সকল যুগের সকল মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। বিশ্বের যে কোনো যুগ, দেশ, জাতি, বর্ণ বা ধর্মের পাপী মানুষ তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করলে মুক্তি, নাজাত ও সফলতা লাভ করবেন। কুরআন কারীমের এ কথা বারংবার ঘোষণা করা হয়েছে। (আ‘রাফ: ১৫৮; ফুরকান: ১, আম্বিয়া: ১০৭, সাবা: ২৮)

তৃতীয়ত: আমরা দেখেছি, ঈসা মাসীহের মাধ্যমে পাপমোচন তত্ত্বটি ভিত্তিহীন মিথ্যা। যীশু পাপীদের পাপ বহন করবেন না “যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরিবে; পিতার অপরাধ পুত্র বহন করিবে না, ও পুত্রের অপরাধ পিতা বহন করিবে না; ধার্মিকের ধার্মিকতা তাহার উপর বর্তিবে ও দুষ্টের দুষ্টতা তাহার উপর বর্তিবে।” (যিহিষ্কেল ১৮/২০) “কিন্তু জ্বলন্ত আগুন ও গন্ধকের হ্রদের মধ্যে থাকাই হবে ভীতু, বেঈমান, ঘৃণার যোগ্য, খুনী, জেনাকারী, জাদুকর, মূর্তিপূজাকারী এবং সব মিথ্যাবাদীদের শেষ দশা। এটাই হল দ্বিতীয় মৃত্যু।” (প্রকাশিত বাক্য/কালাম ২১/৮)

যদি মাসীহ পাপ বহন করবেন তবে ছোট বড় সকল পাপের জন্য চিরস্থায়ী নরক কেন? তিনি আরো বলেন: “যে কেউ কোন স্ত্রীলোকের দিকে কামনার চোখে তাকায় সে তখনই মনে মনে তার সংগে জেনা করল। তোমার ডান চোখ যদি তোমাকে গুনাহের পথে টানে তবে তা উপড়ে দূরে ফেলে দাও। তোমার সমস্ত শরীর দোজখে যাওয়ার চেয়ে বরং তার একটা অংশ নষ্ট হওয়া তোমার পক্ষে ভাল। (মথি ৫/২৮-২৯)

তিনি সুস্পষ্ট বললেন যে, চক্ষু না তুললে পুরো দেহ জাহান্নামে পুড়বে। তিনি যদি পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাতের পাপও বহন করতে না পারেন তাহলে কোন্ পাপ বহন করবেন? খৃস্টান প্রচারক হয়ত বলবেন যে, তিনি মানুষদেরকে বুঝানোর জন্য এ সব কথা বলেছেন, মূলত তিনি সকল পাপ বহন করবেন। তাঁরা নিজেদের বিভ্রান্তি প্রচার করতে যীশুকে সত্য বুঝাতে অক্ষম বা মুনাফিক বলে চিত্রিত করেন। বস্তুত, তিনি কোনো পাপীর পাপই বহন করবেন না; তবে ইসরায়েল বংশের শির্কমুক্ত ঈমানদার পাপীদের পাপ ক্ষমার জন্য তিনি সুপারিশ করবেন। (সূরা মায়িদা: ৭২)

চতুর্থত: পাপমোচন থিওরির ভিত্তিতে প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার: Martin Luther (১৪৮২-১৫২৯ খৃ) বলেন: “তোমরা শুধু বিশ্বাস কর। আর সুনিশ্চিতরূপে জেনে রাখ যে, এতেই তোমাদের মুক্তি লাভ হবে। মুক্তির জন্য কোনো উপবাসের কষ্ট করতে হবে না, সৎ থাকার কষ্ট করতে হবে না, পাপের স্বীকারোক্তির কষ্ট করতে হবে না, কোনোরূপ সৎকর্ম পালনের কষ্ট করতে হবে না। খৃস্টের জন্য যেমন সুনিশ্চিত মুক্তি, তোমাদের জন্যও ঠিক তেমনি সুনিশ্চিত মুক্তি, যাতে কোনোরূপ সন্দেহ নেই। তোমরা পাপ কর। পরিপূর্ণ সাহসিকতার সাথে পাপ করতে থাক এবং শুধু বিশ্বাস কর। শুধু বিশ্বাসই তোমাদেরকে মুক্তি প্রদান করবে, যদিও তোমরা প্রতিদিন এক হাজার বার ব্যভিচার বা হত্যার মত পাপে লিপ্ত হও। তোমরা শুধু বিশ্বাস কর। আমি তোমাদেরকে বলছি, শুধু বিশ্বাসই তোমাদেরকে মুক্তি দিবে।” (ক্যাথলিক হেরাল্ড, ভলিউম ৯, পৃষ্ঠা ২৭৭) এজন্যই আমরা দেখি যে, মিথ্যা, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, মদপান, ব্যভিচার, ধর্ষণ ইত্যাদি পাপ খৃস্টান চার্চ ও পাদরিদের নিয়মিত কর্ম। এমনকি হিটলারের মত ঠান্ডা মাথায় গ্যাস চেম্বারে কয়েক লক্ষ মানুষ হত্যা করলেও কোনো সমস্যা নেই। যীশু সকলের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে বসে রয়েছেন! সাধু পলের এ বিশ্বাস পাপীকে পাপ মুক্ত করে না, বরং পাপীকে মহাপাপীতে পরিণত করে।

পক্ষান্তরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগতের প্রতিটি পাপীকে অতি সহজে পাপ মুক্ত হয়ে দুনিয়ায় আল্লাহর প্রিয়ভাজন বা ওলী হওয়ার এবং আখিরাতে জান্নাত পাওয়ার সহজ পথ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তাওবার শিক্ষা দিয়েছেন। পাপ যত মহাপাপই হোক না কেন, যে কোনো পাপী বান্দা একান্তই নিজের মনের মধ্যে অনুশোচনা ও ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে পরিপূর্ণ ক্ষমা ও নাজাত লাভ করতে পারেন।

সম্মানিত পাঠক, মনে করুন, একটি ছেলে প্রায়ই মায়ের অবাধ্য হয়। এরপর যখনই মনটা নরম হয় মায়ের কাছে যেয়ে মাকে জাড়িয়ে ধরে, ক্ষমা চায়। তখন মা আদর করেন ও দোআ করেন। প্রায়ই এমন ঘটে। মায়ের আরেক ছেলে। প্রায়ই মায়ের অবাধ্যতা করে। সে জানে তার বড়ভাই তার জন্য মায়ের কাছে সুপারিশ করবেন। কাজেই সে মায়ের সান্নিধ্যে কখনোই যায় না, অথবা যখনই মনটা নরম হয় তখন বড়ভাইকে মায়ের কাছে তার জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করে। বলুন তো কোন্ সন্তান সত্যিকার মাতৃপ্রেম ও মায়ের স্নেহ লাভ করবে?

সম্মানিত পাঠক, প্রতি মুহূর্তেই আমরা পাপ করি। যখনই মনটা একটু নরম হয় তখনই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়াই হলো পাপ মোচনের সঠিক পথ। পাপের মাধ্যমে আল্লাহর থেকে আমরা যতটুকু দূরে যাই, আল্লাহর যিকর ও তাওবার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর অনেক বেশি ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভ করি। ইসলামের শিক্ষা হলো, মহান আল্লাহ মায়ের চেয়েও অনেক প্রিয়, অনেক আপন। প্রতিটি মানুষকে তিনি সন্তানের চেয়েও অনেক বেশি ভালবাসেন। দীন শিক্ষার জন্য মানুষের উস্তাদ বা আলিমের প্রয়োজন। কিন্তু মহান আল্লাহর কাছে দো‘আ করতে বা তাওবা করতে পাপীকে কারো কাছে যেতে হবে না। কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা বা আলিম-ইমামের কাছেও তাকে যেতে হবে না। নিজের স্থানে থেকে নিজের মনের আবেগ ও অনুশোচনা দিয়ে প্রতিটি মানুষ সরাসরি মহান আল্লাহকে ডাকবে, পাপ করলে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে পাপী বান্দা আল্লাহর প্রিয়মত ওলীতে পরিণত হয়।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যীশু বা অন্য কাউকে আল্লাহ ও তার মাঝে মধ্যস্থ বলে মনে করে, অথবা কেউ তাকে ত্রাণ করবে বলে বিশ্বাস করে সে উক্ত মধ্যস্থের উপর নির্ভরতার কারণে পাপ ত্যাগ করতে পারে না, কখনো প্রার্থনার আবেগ হলে মূলত উক্ত মধ্যস্থের কথাই তার হৃদয়ে জাগে। এভাবে তার হৃদয় আল্লাহর যিকর থেকে বঞ্চিত হয়, ক্রমান্বয়ে পাপ তার হৃদয়কে অন্ধকার করে তাকে চির জাহান্নামী করে।