ইমেইলে পাঠাতে নিচের ফর্মটি পূরণ করুন
security code
আল-ফিকহুল আকবর আল-ফিকহুল আকবার ও ইসলামী আকীদা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
২. ইলমুল আকীদার গুরুত্ব

জাগতিক সাফল্য ও আখিরাতের মুক্তির মূল ভিত্তি বিশুদ্ধ বিশ্বাস। মানুষের মন ও বিশ্বাস-ই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে এবং মানবতার পূর্ণতায় উপনীত হতে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অপরিহার্যতা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা থেকে সুস্পষ্ট যে, বিশ্বাসের বিশুদ্ধতার উপরেই মানুষের মুক্তির মূল ভিত্তি। আর এজন্যই ইমাম আবূ হানীফা ইলমুল আকীদার নামকরণ করেছেন: ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বা শ্রেষ্ঠতম ফিকহ। বিশ্বাস-জ্ঞানকে ‘‘শ্রেষ্ঠতম ফিকহ’’ নামকরণের মাধ্যমে ইমাম আযম বুঝিয়েছেন যে, ফিকহ বা ধর্মীয় জ্ঞানের যত শাখা রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা ও দীনী ইলমের শ্রেষ্ঠতম বিষয় ঈমান বিষয়ক জ্ঞান। তিনি নিজেই এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ পুস্তিকাটির শুরুতে আবূ মুতী বালখী (১৯৯ হি) বলেন:


سَأَلْتُ أَبَا حَنِيْفَةَ النُّعْمَانَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْفِقْهِ الأَكْبَرِ، فَقَالَ: أَنْ لاَ تُكَفِّرَ أَحَداً مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ، وَلاَ تَنْفِيْ أَحَداً مِنَ الإِيْمَانِ، وَأَنْ تَأْمُرَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ، وَتَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ، وَأَنَّ مَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيْبَكَ، وَلاَ تَتَبَرَّأَ مِنْ أَحَدٍ مِنْ أَصْحَابِ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، وَلاَ تُوَالِيْ أَحَداً دُوْنَ أَحَدٍ، وَأَنْ تَرُدَّ أَمْرَ عُثْمَانَ وَعَلِيٍّ إِلَى اللهِ تَعَالَى.


‘‘আমি আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিতকে ‘‘আল-ফিকহুল আকবার’’ (শ্রেষ্ঠতম ফিকহ) সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন: তা এই যে, তুমি কোনো আহল কিবলাকে পাপের কারণে কাফির বলবে না, কোনো ঈমানের দাবিদারের ঈমানের দাবি অস্বীকার করবে না, তুমি ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায়ের নিষেধ করবে, তুমি জানবে যে, তোমার উপর যা নিপতিত হয়েছে তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো পথ ছিল না এবং তুমি যা পাও নি তা পাওয়ার ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো সাহাবীর প্রতি অবজ্ঞা-অভক্তি প্রকাশ করবে না, তাঁদের কাউকে বাদ দিয়ে কাউকে ভালবাসবে না, এবং উসমান (রা) ও আলী (রা)-এর বিষয় আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করবে।’’[1]

‘ফিক্হ’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। কুরআন হাদীসের আলোকে ইসলামী বিধিবিধানের গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে ‘ফিকহ’ বলা হয়। ইমাম আবূ হানীফা উল্লেখ করেছেন যে, শরীয়তের আহকাম বা বিধিবিধান বিষয়ক ফিকহ শিক্ষা করার চেয়ে দীনের বিশ্বাস বিষয়ক ফিকহ অর্জন করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন:


الْفِقْهُ فِيْ الدِّيْنِ أَفْضَلُ مِنَ الْفِقْهِ فِيْ الأَحْكَامِ ... قُلْتُ: فَأَخْبِرْنِيْ عَنْ أَفْضَلِ الْفِقْهِ. قَالَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ: أَنْ يَتَعَلَّمَ الرَّجُلُ الإِيْمَانَ بِاللهِ تَعَالَى وَالشَّرَائِعَ وَالسُّنَنَ وَالْحُدُوْدَ وَاخْتِلاَفَ الأُمَّةِ وَاتِّفَاقَهَا...


‘‘দীন বিষয়ে জ্ঞানার্জন আহকাম বিষয়ে জ্ঞানার্জনের চেয়ে উত্তম। .... আমি বললাম: তাহলে আপনি আমাকে ফিকহের উত্তম বিষয় সম্পর্কে বলুন। আবূ হানীফা বলেন: শ্রেষ্ঠ ফিকহ এই যে, মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান শিক্ষা করবে, শরীয়তের বিধিবিধান, সুন্নাত, সীমারেখা এবং উম্মাতের মতভেদ ও ঐকমত্য শিক্ষা করবে।’’[2]

এখানে ইমাম আযম দীন ও আহকামের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। দীন হলো বিশ্বাস ও তাওহীদের নাম, পক্ষান্তরে আহকাম ও শরীয়াহ কর্ম বিষয়ক বিধানাবলির নাম। বিভিন্ন নবী ও রাসূলকে আল্লাহ বিভিন্ন শরীয়াহ দিয়েছেন, তবে সকলের দীন এক ও অভিন্ন। এ প্রসঙ্গে ‘আল-আলিম ওয়াল-মুতাআল্লিম’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা বলেন:


أَلَسْتَ تَعْلَمُ أَنَّ رُسُلَ اللهِ صَلَوَاتُ اللهِ وَسَلاَمُهُ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِيْنَ لَمْ يَكُوْنُوْا عَلَى أَدْيَانٍ مُخْتَلِفَةٍ، لَمْ يَكُنْ كُلُّ رَسُوْلٍ مِنْهُمْ يَأْمُرُ قَوْمَهُ بِتَرْكِ دِيْنِ الرَّسُوْلِ الَّذِيْ كَانَ قَبْلَهُ؛ لأَنَّ دِيْنَهُمْ كَانَ وَاحِداً، وَكَانَ كُلُّ رَسُوْلٍ يَدْعُوْ إِلَى شَرِيْعَةِ نَفْسِهِ، وَيَنْهَى عَنْ شَرِيْعَةِ الرَّسُوْلِ الَّذِيْ قَبْلَهُ؛ لأَنَّ شَرَائِعَهُمْ كَثِيْرَةٌ مُخْتَلِفَةٌ، وَلِذَلِكَ قَالَ اللهُ تَعَالَى: (لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً)، وَأَوْصَاهُمْ جَمِيْعاً بِإِقَامَةِ الدِّيْنِ وَهُوَ التَّوْحِيْدُ، وَأَنْ لاَ يَتَفَرَّقُوا؛ لأَنَّهُ جَعَلَ دِيْنَهُمْ وَاحِداً فَقَالَ: (شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ) وَقَالَ سُبْحَانَهُ: (وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنَا فَاعْبُدُونِ). وَقَالَ جَلَّ وَعَلاَ: (لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ)، أَيْ: لاَ تَبْدِيْلَ لِدِيْنِهِ، فَالدِّيْنُ لَمْ يُبَدَّلْ وَلَمْ يُحَوَّلْ وَلَمْ يُغَيَّرْ، وَالشَّرَائِعُ قَدْ غُيِّرَتْ وَبُدِّلَتْ..


‘‘তুমি কি জান না যে, আল্লাহর রাসূলগণ (আঃ) ভিন্ন ভিন্ন দীনের অনুসারী ছিলেন না, প্রত্যেক রাসূল তাঁর জাতিকে পূর্ববর্তী রাসূলের দীন বর্জন করতে নির্দেশ দিতেন না; কারণ তাঁদের দীন ছিল এক। প্রত্যেক রাসূল তাঁর নিজ শরীয়ত পালনের দাওয়াত দিতেন এবং পূর্ববর্তী রাসূলের শরীয়ত পালন করতে নিষেধ করতেন; কারণ তাঁদের শরীয়ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এজন্য আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমাদের প্রত্যেককে শরীয়ত ও স্পষ্ট পথ প্রদান করেছি, ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন’’[3]। আর তিনি তাঁদের সবাইকে দীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন, আর দীন হচ্ছে ‘‘তাওহীদ’’। আর তিনি নির্দেশ দিয়েছেন দীন, অর্থাৎ তাওহীদের বিষয়ে পরস্পর দলাদলি না করতে; কারণ তিনি তো তাদের একই দীন প্রদান করেছেন। এজন্য তিনি বলেছেন: ‘‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে- এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।’’[4] আল্লাহ আরো বলেছেন: ‘‘আমি তোমার পূর্বে কোনো রাসূলই প্রেরণ করি নি এ ওহী ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’’[5] মহান আল্লাহ আরো বলেন: ‘‘আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই; এটিই প্রতিষ্ঠিত দীন’’[6]; অর্থাৎ তাঁর দীনের কোনো পরিবর্তন নেই। অতএব দীন কোনোভাবে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত বা স্থানান্তরিত হয় নি; তবে শরীয়ত বা বিধি-বিধানসমূহ পরিবর্তিত হয়েছে।’’[7]

[1] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪১।

[2] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪১।

[3] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৮ আয়াত।

[4] সূরা (৪২) শুরা: ১৩ আয়াত।

[5] সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৫ আয়াত।

[6] সূরা (৩০) রূম: ৩০ আয়াত।

[7] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ১৪-১৫।